পুরাকালে
মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবতারা শ্রীবিষ্ণু ও মহাদেবের
কাছে সাহায্যের জন্য উপস্থিত হন। প্রবল পরাক্রমশালী মহিষাসুরকে বধ করার জন্য সকল
দেবতার তেজ থেকে এক অপূর্ব নারীর সৃষ্টি হয়। সকল দেবতারা তাকে নিজেদের অস্ত্র ও
অলংকার দিয়ে সজ্জিত করেন। এই নারী মহিষাসুরকে যুদ্ধে আবাহন করেন,এবং
প্রচন্ড যুদ্ধের পর ত্রিশূল দিয়ে গেঁথে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই নারী চরিত্রই দেবী
দুর্গার রূপে পূজিত হন। দেবীর দশ হাতে ত্রিশূল,খড়গ,সুদর্শনচক্র, ধনুর্বান,শক্তি খেটক, পূর্ণচাপ, নাগতালা, অঙ্কুশ ও পরশু এ ধরনের অস্ত্র দেখা
যায় বলে তিনি দশপ্রহরণ ধারিনী।
এই দেবী
দুর্গার আরাধনা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা নিয়ে
নানা মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তিদের মতে দেবী দুর্গা শক্তির বিকাশ
আনুমানিক চতুর্থ থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে রচিত মার্কেণ্ডেয় পুরাণ এবং শ্রী শ্রী
চন্ডীতে। তবে সূত্রপাত হয় মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ,দেবী পুরাণ ও ভাগবত পুরাণ। মহাভারতের
বিরাট পর্বে ও ভীষ্মপর্বেও দুর্গা স্তব আছে। ভীষ্মপর্বে ত্রয়োবিংশ অধ্যায়ে অর্জুন
দেবী দুর্গার স্তব পাঠ করেন। বিষ্ণুপুরাণ এর পঞ্চম অংশে দেবকীর গর্ভে দুর্গার
জন্মানোর বৃত্তান্ত আছে।শ্রী শ্রী জগৎপালিকা আদ্ধাশক্তি ও সনাতনীর। আর্য সভ্য তাই
দেবতাদের প্রাধান্য ছিল। ভারতবর্ষের দ্রাবিড় সভ্যতা ও মাতৃ দেবীর পূজার প্রচলন
ছিল। আর্য সভ্যতাই দেবতাদের প্রাধান্য থাকলেও অনার্য সভ্যতার প্রাধান্য ছিল
দেবীদের। তারা পূজিত হতেন আদ্যা শক্তির প্রতীক রূপে। অনার্য সমাজ ছিল
মাতৃতান্ত্রিক এই কারণে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারণা গড়ে ওঠে। হরপ্পা ও
মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায়ও আমরা মাতৃ পূজার প্রমাণ পায়।
"প্রথমে
পূজিতা শা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মা না।
বৃন্দাবনে
চ সৃষ্ঠ্যাদ্যৌ গলকে বাগমন্ডলে।
মধুকৈটভ ভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব
তৃতীয়ে ত্রিপুরারিনা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া
মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা।
চতুর্থে
পুজিতা দেবী ভক্তা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈ
সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মনিমানবৈঃ।
পূজিতা
সর্ববিশ্বেষু বহভূব
সর্বতঃ
সদা।।"
অর্থাৎ
সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বইকুন্ঠের আদি বিন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম
দুর্গাপুজো করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামের দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গা
পূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়ে
তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দূর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র
যে পুজোর আয়োজন করেছিলেন সেটি ছিল চতুর্থ দূর্গা পূজা এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনি
ঋষি,সিদ্ধপুরুষ,দেবতা ও মানুষের নানান দেশে নানা সময়
দূর্গা পূজা করে আসছে।
শ্রী শ্রী
চন্ডিতে বর্ণিত আছে, আনুমানিক
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে কলিঙ্গের চেদী রাজবংশের রাজা সুরথ ও তার সহযোগি সমাধি
রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করে বনে চলে যান।
বোনের মধ্যে এক মুনির আশ্রমে যান। মেধা মুনি নামে ওই ঋষি তাদের সব কাহিনী শোনার পর
বলেন বিশ্ব সংসারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জগতের পালনকর্তা বিষ্ণুর যে মহামায়া
শক্তি তারই প্রভাবে এইরকম হয়। শ্রী মহামায়া প্রসন্না হলে মানুষের মুক্তি লাভ
হয়। মুনির উপদেশ পেয়ে সুরথ ও সমাধি মাটির প্রতিমা গড়ে তিন বছর কঠোর তপস্যার পর
দেবী তুষ্ট হয়ে তাদের দেখা দেন এবং মনবাঞ্জনা পূর্ণ করেন। পরবর্তীতে বসন্তকালে
দূর্গা পূজার উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করে বাসন্তী পূজা প্রচলন করেন যা দুসেহেরা
নামে পরিচিত ছিল।
রামায়ণ
অনুসারে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র যাকে অকালবোধন বলা
হয়। তিনি রাবণের হাত থেকে সিতাকে উদ্ধার করার জন্য লঙ্কাগমন করার আগে অকালবোধন
করে শরৎকালের দূর্গা পূজা করেন। কালিকাপুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার পরামর্শে রাম
অকালবোধ করেন।
বৌদ্ধ
পন্ডিত হিয়েনসাং সম্পর্কে দুর্গাপূজার কাহিনী প্রচলিত আছে তবে সেই কাহিনী দুর্গা
না কালি না দেবীচন্ডী সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
আদি
মধ্যযুগে বা মধ্য যুগৈদুর্গা পুজোর কথা জানা যায় সেই সময় বাংলার কালী পূজার
পাশাপাশি দুর্গাপূজোও করা হত। পন্ডিতদের মতে ১৫০০ খ্রিস্টাব নাগাদ দিনাজপুরের
জমিদার প্রথম দুর্গাপুজো করেন। আবার কোন কোন পণ্ডিত বলেছেন ষোড়শ শতকে রাজশাহীর
রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দূর্গা পূজা করেন আবার অনেকের মধ্যে ১৬০৬ সালের নদীয়ার
নদী ভবনানন্দ মজুমদার দূর্গা পূজার প্রবর্তক।
কলকাতার
দুর্গাপূজার প্রচলন হিসেবে ১৬১০ সালের সুবর্ণ রায়চৌধুরীর পুজোর কথা বলা হয়। তবে আধুনিক
দুর্গা পূজার প্রচলন হয় ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণদেব
লর্ডক্লাইভের সম্মানে
দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। আজ পর্যন্ত বাংলায় এই বনেদি বাড়ির পূজা থেকে
বারোয়ারী পুজো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
◆এই সময়, অক্টোবর, ১৭,২০২০
◆প্রবন্ধ-শব্দঞ্জলিতে দুর্গাপুজো, হরিপদ ভৌমিক।
◆উইকিপিডিয়া।
0 মন্তব্যসমূহ