ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

জৈনতীর্থ পরেশনাথ -বাণীব্রত গোস্বামী

 

ভ্রমণ ছাড়া মন, যেন বাতাস-হীন ফুসফুস। কী কষ্ট এই গত দু'বছর! কিন্তু যাব কোথায়? একে হাতে সময় কম, তার ওপর পকেট-ও বেশি দূরে যাবার সাহস যোগাচ্ছে না। তাই এই বছর শীতে একপ্রকার জোর করেই বেরিয়ে পড়লাম। অনেকেরই অনাবিষ্কৃত একটা জায়গায়। ঝাড়খণ্ডের পরেশনাথ। আর অজানা জৈন ধর্মের তথ্যে ভরা।

এক শীতের সকালে স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে উঠে পড়লাম পূর্বা এক্সপ্রেসে। ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা। পাহাড়ের কোলে পরেশনাথ স্টেশন। ওখান থেকে অটো করে মধুবন। সেরা থাকার ঠিকানা ‘উত্তরপ্রদেশ প্রকাশ ভবন'। এককথায় চিপ্ এন্ড বেস্ট্। মাত্র ছ’শো টাকায় শৌচালয়-যুক্ত সুসজ্জিত তিন শয্যার ঘর;  কল্পনাতীত। ঘরে বসে সবুজ পাহাড়ের হাতছানি। এখানে খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ নিরামিষ। তবে এই হোটেলের ‘মনভবন ক্যাফেটোরিয়া’য় মিসা রুটি আর নবরত্ন ডাল অনেকদিন মনে থাকবে। হোটেলের নিজস্ব একটি মন্দির আছে। ছবির মত সুন্দর। আন্তর্জালেই বুকিং করেছিলাম।

মধুবন একটি ছোট পাহাড়ি জনপদ। চারিদিকে শুধু শ্বেতপাথরের বিশালাকৃতির মন্দির। কী অপূর্ব তাদের কারুকার্য! সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল শান্ত আর নির্জন পরিবেশ। পাহাড়ের কোলে সব মন্দিরগুলো ঘুরে দেখলাম। পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট বাজারও আছে। সময় কেটে যায়। হোটেলে ফিরে এসে সন্ধ্যারতি; মনে এক স্বর্গীয় শান্তি এনে দিল। আসলে জৈন ধর্মে আড়ম্বর ভীষণ কম। পূজা-অর্চনার মধ্যে একটা শান্ত নির্লিপ্ত ভাব আছে।

পরেরদিন আমাদের কুড়ি কিমি. ট্রেকিং। গন্তব্য পরেশনাথ পাহাড়ের মাথায় শিখরজী মন্দির। মহাবীরের আগের তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শনাথের মন্দির। ভোরবেলা স্নান সেরেই তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। সবার হাতেই বেতের লাঠি। দোকানে ভাড়া পাওয়া যায়। দশ কিলোমিটার উঠতে হবে তো! অপূর্ব নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য। শ্বাপদসঙ্কুল গভীর জঙ্গল। মাঝেমধ্যে দু-একটা ছোট ঝর্ণা। ওপর থেকে তোপচাঁচি লেকটা অসাধারণ। যাওয়ার পথে কিছু দিগম্বর জৈনের মুখোমুখি হলাম। সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন, কিন্তু কী অসম্ভব পবিত্র তাদের উপস্থিতি! কথাবার্তায় বুঝলাম সকলেই বিদগ্ধ। এটা আমার জীবনে এক চাক্ষুষ বিরল এবং ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। ঐ অসহনীয় ঠান্ডায় ঝর্ণার জলে স্নান করে মন্দিরের পথে হেঁটে আসছেন। বিশ্রাম নিতে নিতেই উঠতে লাগলাম। তবে ডুলির ব্যবস্থাও আছে। হিসাব ভারি সুন্দর। প্রতি কেজি একশো টাকা। হোটেলেই ওজনের যন্ত্র আছে। এছাড়া বেআইনি বাইকের ব্যবস্থা আছে। খুব বিপজ্জনক। প্রায় প্রতিদিনই দূর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ ধরলে জরিমানা করে। পথের বাঁকে চায়ের দোকানগুলো ভারি সুন্দর। তীর্থযাত্রীদের সাথে অপূর্ব তাদের ব্যবহার আর সহযোগিতা। পাহাড়ের ওপর বিলুপ্তপ্রায় ‘কোল' আদিবাসী সম্প্রদায় থাকে। দশ-বারো ঘর। ওদের ভাষাটা অদ্ভুত।

যত ওপরে উঠছি ঠান্ডা বাড়ছে। সঙ্গে হাড়কাঁপানো হাওয়া। ঘন্টাচারেক হাঁটার পর শিখরে পৌঁছলাম। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট। অদ্ভুত সুন্দর মন্দির। এই উচ্চতায় এরকম অসামান্য গঠনশৈলী মুগ্ধ করে। চারিদিকে মেঘ আটকে আছে পাহাড়ের গায়ে। চোখ ফেরানো যায় না। এখানে শুকনো ফল( ড্রাই ফ্রুট) দিয়ে পুজো দেওয়ার রেওয়াজ। প্রচুর বিদেশী পর্যটক ছিল। মন্দিরের পূজারী তাদের জৈন ধর্ম নিয়ে অনেক কিছু বোঝাচ্ছিলেন। সেই সুবাদে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এবার নামার পালা। নামতে লাগলো প্রায় ঘন্টা-দুয়েক।

হোটেলে এসে দেখলাম তীর্থযাত্রীদের পদসেবার ব্যবস্থা আছে। পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। স্থানীয় কিছু গরীব মানুষ গরম জল আর তেল দিয়ে পা মালিশ করে দেয়। বেশ আরাম পেলাম। বিকেলে আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। এ অঞ্চলে প্রচুর হনুমান আছে। তবে তারাও বোধহয় জৈন ধর্মাবলম্বী। একদমই উপদ্রব করে না। সবাই দেখলাম কলা কিনে খাওয়াচ্ছে। আমরাও দিলাম। সময় কেটে গেল।

পরদিন আমাদের ফেরা। অনেকে এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ভাতিন্দা ফলস্ ও তোপচাঁচি লেক দেখতে যায়। আমরা ফেরার পথেই দেখে নিয়েছিলাম। প্রাতঃরাশ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দুটি জায়গাই যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তবে তোপচাঁচি লেকের ধারে মহানায়ক উত্তমকুমারের বাড়িটী বহু চলচ্চিত্রের স্যুটিং-এর স্মৃতি বহন করছে। স্বল্পখরচে ও সীমিত সময়ে এই ভ্রমণ অনেকদিন মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ