ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

আমেরিকার মুক্তগ্রামে কয়েকদিন -মলয় সরকার




এতদিন দেখেছি সারা আমেরিকার বড় বড় নামী শহর, নদী সমুদ্র পাহাড়। ইচ্ছা ছিল দেখব এর গ্রাম কেমন। গাড়ি চড়ে যে গ্রামের পাশ বা ভিতর দিয়ে যাই নি তা তো নয়, গেছি অনেক গ্রাম পেরিয়ে। কিন্তু গ্রামের মধ্যে থেকে খুব কাছ থেকে গ্রাম দেখা এর আগে হয়ে ওঠে নি।


তাই সুযোগটা আর ছাড়িনি। মেয়ে ভর্তি হল নিউ ইয়র্কের কাছে কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘর নিয়েছিল একটু দূরে, যাতে একটু কম ভাড়ায় থাকা যায়। ওখানে পড়ার সুযোগ পেয়েই বলেছিল, তোমাদের নিয়ে যাব। তাই যখন সুযোগ এল, ছেলেকে বলতেই টিকিট কেটে দিল। এসে নামলাম নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে গাড়িতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার পথ (৪২০ কিমি) পথ পেরিয়ে এলাম এখানে, যেটা কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ইথাকার পূর্বে একটি প্রায় গণ্ডগ্রাম। গণ্ডগ্রাম বলছি কেন, এখানে লোকবসতি ভীষণ কম, মাত্র পাঁচশ’র আশেপাশে এবং কোন দোকানপাট, স্কুল কলেজ কাছাকাছি কিচ্ছু নেই। আসল ইথাকা থেকেও এটা একটু দূরে এই গ্রামের নাম 'ফ্রী ভিলে' বা মুক্ত গ্রাম।



সামনে দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে বহুদূর, গ্রামের বুক চিরে। সেখান দিয়ে অনবরত দিবারাত্রি অসংখ্য ছোট বড় গাড়ির যাতায়াত এবং সেটাই এখানকার জমাট নিস্তব্ধতাকে ভাঙার মত একমাত্র আওয়াজ।'মুক্ত গ্রাম' নামটি বোধ হয় এর পক্ষে যথোপযুক্ত নাম।


আমরা আসার দিনই এখানে বেশ বরফ পড়েছিল।যখন পৌঁছালাম সন্ধ্যায়, তখনও এখানে ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ বরফ পড়ে রয়েছে। তার পরদিন এবং তারও পরদিন যে বরফ পড়বে তার বার্তাও আবহাওয়া অফিস আগেই জানিয়েছিল। তৈরীই ছিলাম।



রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বরফ পড়া।বরফ পড়ে থাকা অবস্থায় অনেক জায়গা দেখেছি সারা পৃথিবীতে। কিন্তু এরকম শুধুই শুকনো বরফ পড়া বা বরফ ঝড়ের কোন ছবি আমার স্মৃতিতে নেই।



সকালে উঠে দেখলাম চারিদিকে মাঠ ঘাট রাস্তা সব বরফে ঢেকে আছে। বাড়ীর মাথায়, গাড়ীর মাথায়, গাছের মাথায় ডালে বরফে ঢাকা। তখনও চারিদিকে গুঁড়ো গুঁড়ো 'টাটা নমক' নুনের মত বরফ পড়েই চলেছে।মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ায় চারিদিকে উড়েও যাচ্ছে।এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তাপমাত্রা দেখাচ্ছে -১০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ঘরে রুম হীটার চলছে গোটা কতক।তার সঙ্গে গায়েও চড়িয়ে রেখেছি গোটা দুই তিন জামা, গরমজামা। রাস্তায় চলেছে ঘন ঘন বরফকাটার গাড়ি।একটা যাচ্ছে, পিছন পিছন আবার একটা।ছোট বড় নানা ধরণের গাড়ি।বরফ যতই হোক, রাস্তাকে সচল রাখতেই হবে।কাজেই গাড়ি চলার বিরাম নেই। আর এমনিতেই এখানে রাস্তায় হাঁটার মানুষজন দেখা যায় না, কাজেই এই পরিস্থিতিতে তো ও প্রশ্নই আসে না। চারিদিকে কোন সবুজের চিহ্নই নেই। আসলে এখন এখানে তো শীতের শেষ, তাই কোন গাছেই কোন পাতা নেই, শুধুমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকা পাইন জাতীয় গাছ ছাড়া। আজ এখন তাও ঢেকেছে সাদা বরফে।অন্যান্য  সমস্ত গাছ পাতা ঝরিয়ে রিক্ত সন্যাসী হয়ে বসে আছে। ক'দিন পরেই এই সন্যাস জীবনের মুক্তি। তখন আসবে আবার নতুন জীবনের শুরু, নতুন পাতা ফুল ফল, গাছে গাছে পাখী। আবার নতুন সাজে সেজে উঠবে প্রকৃতির সংসার। এই ক’টা মাস তার বৈরাগ্যের সাধনা।


আমাদের জীবন সঠিক ছন্দে শুরু হতে কয়েকদিন সময় নিল। আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা শারীরিক ঘড়ি আছে, যা পুরানো অভ্যাস ছেড়ে নতুনকে মানিয়ে নিতে একটু সময় নেয়।আমাদের শরীরের ঘুম খিদে ও অন্যান্য কাজকর্মগুলো পুরানো ছন্দ থেকে তবলার ছন্দ পরিবর্তনের মত চট করে মানিয়ে নিতে পারে না। তাই অসময়ে ঘুম খিদে ইত্যাদি পাচ্ছিল।


 আস্তে আস্তে অবশ্যই সব ঠিক হয়ে এখানকার ছন্দে বাজতে শুরু করবে।তাই প্রায় একসপ্তাহ আমরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোই নি। জানালা থেকেই দেখেছি চারিদিকের অবস্থা। আমাদের অবস্থা এখন ‘ডাকঘরের অমলে’র মত। তাকিয়ে আছি শুধু বাইরের দিকে, যেখানে  অনন্ত পৃথিবী চলেছে তার আপন ছন্দে, উন্মুক্ত বাঁধন ছাড়া প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা মেয়ের মত। আমরা তার সঙ্গী হতে পারছি না। শুধু এখানে কোন সুধা বা দইওলা আসেনি আমাদের সাথে গল্প করতে। এর মধ্যে শুধু জানালার বাইরে দেখেছি ,একটি আপাদমস্তক কালো কুচকুচে বেড়াল , হয়ত বাড়িওলার পোষাই হবে, এসে জানালার কাছে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে খোঁজ  খবর নিয়ে গেছে। তবে খুব আলাপী বলে বোধ হয়নি। তার আবার বুকের কাছে দেখি, তুলি দিয়ে সাদার এক পোঁচ মারা আছে। সম্ভবতঃ শুধু কালোয় রংটা শিল্পীর চোখে সাদামাটা অশৈল্পিক লেগেছে, তাই একটু কন্ট্রাস্টের ছোঁয়া দেওয়া হয়েছে। আমাদের না বেরোনোর আর একটি বড় কারণ হচ্ছেআমাদের এখনও পর্যন্ত, এখানের জন্য, হাতে কোন ফোন আসেনি, আর দেশের ফোন এখানে চলবে না। শীঘ্রই তার ব্যবস্থা হচ্ছে।হলেই বেরোতে পারব, তার কারণ ছেলেমেয়েদের ভয়, রাস্তায় বেরিয়ে কোথাও কিছু হয়ে গেলে খবর দেওয়া যাবে না। 



একদিন, যদিও ফোন হাতে আসে নি, আমরা দুজনে যুক্তি করে বেরোলাম। ছেলে মেয়ে কেউ তখন কাছে নেই, খাঁচার দরজাটা খুলে ভাবলাম, গায়ে একটু হাওয়া লাগিয়ে আসি সাবধানে। ওরা আসার আগে যদি আবার যদি এসে খাঁচায় ঢুকে পড়ি, কেউ কিছু টেরও পাবে না। গায়ে জাব্বাজোব্বা এঁটে বেরোলাম দুজনে গুটিগুটি।


আঃ কি আনন্দ ,বাইরে অনন্ত , দিগন্তে ঠেকে যাওয়া ফাঁকা জমি। মাথার উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ।  এতটুকু ধুলো ময়লা নেই।বেশ ঝকঝকে সোনা সোনা রোদ। রাস্তার একেবারে ধার দিয়ে চললাম দুজনে। এখানে তো আবার রাস্তার ডানদিক দিয়ে চলতে হয়।রাস্তায় জনমানব নেই। মাঝে মাঝে একটি দুটি গাড়ি দুপাশ দিয়ে আসছে যাচ্ছে।তারা অবশ্য আমাদের দেখে বেশ দূর দিয়েই যাচ্ছে, বেশ ভদ্র এরা সেদিকে। মানুষের থাকার বাড়িও এখানে খুব কম। যা আছে তাও একজনের থেকে আর একজনের অনেক দূরে । সব বাড়ি গুলোই বেশ ছবির মত, অনেক জায়গা নিয়ে বাড়িগুলো, সামনে অনেক জায়গা। ঘরের সামনে ঝুলছে পাখী খাওয়ানোর পাত্র। নানা ধরণের পাখীরা এখানে আসছে যাচ্ছে, কলকাকলি তুলছে। বেশ সুন্দর শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ লাগছে।বাড়ির পাশে , হয় বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা করা আছে , নয়ত’ কিছুটা ঘেরা জঙ্গল। জঙ্গলের গাছগুলো অবশ্য এখন বেশির ভাগই শুকনো। এখানে লক্ষ্য করে দেখলাম, অনেক গাছই মেপল গাছ, যারা পাতা ঝরিয়ে রিক্ত হয়ে আছে। সেজে উঠবে আগামী বসন্তে।এছাড়া রয়েছে ওক, রেড মেপল, রডোডেন্ড্রন, নানাধরণের পাইন এইসব গাছ।



ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, মানে, ঢুকে পড়েছিলাম কয়েকটি বাড়ির এলাকায়। আসলে কোনটি বাড়ির এলাকা, আর কোনটি নয় বুঝতেই পারি না।কেউ কোন সীমানা রাখে নি।মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথকে। বুঝি, ওনাকে ছাড়া বোধ হয় আমার মত মানুষের হাঁটা চলা নিঃশ্বাস নেওয়াই মুস্কিল। 



তাঁর কথায়, "আপনারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি" অথচ আমাদের চেনা কোলকাতায় নিত্য বাড়ি উঠছে।আর সেই সব প্রোমোটার বা বাড়ি নির্মাতারা সবাই দেওয়াল তুলছে রোজ।সেটা করতে গিয়ে নিজেদের বাঁচার জন্য সরকার নির্ধারিত যে দূরত্বটুকু বজায় রাখার কথা তাও গ্রাস করছে, টাকা এবং ক্ষমতার জোরে।ক্ষুদ্র হতে হতে কোথায় পৌঁছাচ্ছে সে বলা যাবে না।


এখানে দেখলাম, কারোর সে প্রয়োজনও বোধ হয়নি। কাজেই কোনটা মুক্ত আর কোনটা কারোর অধিকারের জমি বোঝা মুস্কিল। এর মধ্যেই রয়েছে শুকনো ঝোপ ঝোপ জঙ্গল বা বড় বড় উদ্বাহু রিক্ত পাতাঝরা নানা রকমের গাছ।



একদিন ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দেখি একটি জলা, তবে বেশ বড়,এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, সেটি পুরোটাই জমে সাদা বরফ হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, অন্য জায়গার বরফ অনেকখানি গলে গেলেও এখানে এখনও গলেনি। ছাঙ্গু লেকে গিয়েও আমার লেক দেখা হয়নি, মেঘ আর কুয়াশার জন্য। এখানে এসে আমার সেই অভাব মিটল।একটা গোটা লেক জমে গেলে কেমন লাগে দেখে এক আশ্চর্য অনুভূতি হল। 



আমরা এগোলাম। একটু পাশে কোথায় যেন কুলকুল আওয়াজ আসছে শুনলাম।এগিয়ে দেখি মাঠের একপাশ দিয়ে ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে লুকিয়ে দুষ্টু মেয়ের মত ঝুম ঝুম করে নূপুর বাজিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমার মনে হল, দুপুরবেলা ঠাকুমার রোদে দেওয়া আচার চুপি চুপি চুরি করে খেয়ে কোন দুষ্টু মেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বেশ খরস্রোতা। পাহাড় থেকে নেমে আসা বরফ গলা জল বয়ে চলেছে আরও নীচে আরও নীচের দিকে।হ্যাঁ, জায়গাটা খুব পাহাড়ী না হলেও, বেশ উঁচু নিচু তো বটেই।এই যে আমরা রাস্তায় হাঁটছি, দূরে দেখছি, রাস্তাটা সোজা গ্রামের বুক চিরে মেয়েদের মাথার সিঁথির মত এগিয়েছে, সোজা উঁচুর দিকে। বেশিক্ষণ হাঁটলে বুকে একটু চাপ লাগে বৈকি।



বেশ ভাল লাগল নদী, থুড়ি, ঝরণাটাকে। মনে পড়ল, প্রকৃতির কবি, ওয়ার্ডসওয়ার্থকে,



"The width of those huge forests, unto me

A novel scene, did often in this way

Master my fancy while I wandered on

With that revered companion. And sometimes.

When to a convent in a meadow green.

By a brookside, we came, a roofless pile,

And not by reverential touch of Time

Dismantled, but by violence abrupt,—

In spite of those heart-bracing colloquies,

In spite of real fervor, and of that

Less genuine and wrought up within myself, —

I could not but bewail a wrong so harsh."



এই পরিবেশে আমারই কবিতা এসে যাচ্ছে, আর সত্যিকারের কবি হলে তার মনে তো সুর আর গান বাজবেই। চারদিকে পাতা ঝরা গাছের ডালে ডালে পাখীরা খুঁজছে লুকানোর জায়গা। কখনও বা আসন্ন বসন্তের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে সঙ্গিনীকে।




আজ বেশ কয়েকদিন মেঘলা আর ঠাণ্ডা হাওয়ার পর কিছুটা মেঘ কেটে দুপুরের দিকে একটু বাইরে হাঁটার মত অবস্থা হল।

আপাদমস্তক হুডি কোট টুপিতে মুড়ে বেরোলাম দুজনে খাওয়া দাওয়ার পর।চারধারে তো রাস্তায় লোকজন নেই প্রায়। ক্বচিৎ কেউ কুকুরকে চরাই করতে বেরিয়েছে হয়ত।এ ছাড়া যা আছে, তা হল, হুস হুস করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ি।সোনা রোদে পিঠ দিয়ে হাঁটতে ভালই লাগছে। আশপাশের যত শুকনো গাছ, যাদের দেখে মনে হচ্ছিল একেবারে মরে শুকিয়ে গেছে তাদের সব কোল জোড়া সন্তান আসার সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে বসন্তের আগমনে।কোন কোন জায়গায় দেখি শুকনো মাটির ভিতর থেকে উঁকি মারছে নতুন পাতারা বা কুঁড়ি মাথায় কোন লিলির দল।বুঝতে পারি আগামী দিনের জন্য জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রকৃতি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেয়।সমস্ত শুকনো গাছে অবিশ্বাস্য ভাবে অসংখ্য নতুন কলির উন্মেষ দেখা যাচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে , কদিন পরেই প্রকৃতি সেজে উঠবে পত্রপুষ্পে। প্রতিদিন তাদের দ্রুতলয়ে ঘুম ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা দেখতে বেশ ভালই লাগে।তাদের বৃদ্ধি হচ্ছে যথেষ্ট দ্রুত।মনে হচ্ছে দুরন্ত শিশুরা পণ করেছে আর ঘুমিয়ে বন্ধ থাকবে না ঘরে, তারা ছড়িয়ে পড়বে এই  বিশাল পৃথিবীর আলো হাওয়ার মাঝে, যেখানে রয়েছে তাদের জন্য উন্মুক্ত পৃথিবীর অনন্ত আহ্বান।



 পাশ দিয়ে বরফ গলা ঝর্ণার জল বয়ে চলেছে কুলকুল করে।শুকনো ঝোপে ঝাড়ে প্রচুর পাখী ঢুকছে বেরোচ্ছে। মনে হল এই ঝোপেই ওদের বাস।হয়ত এটাই বোধ হয় ওদেরও সংসার বৃদ্ধির সময়। চারিদিকে এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ।মনে হচ্ছে যেন কোন স্বর্গলোকে সুন্দরের স্বপ্ন রাজ্যে এসে পড়েছি।কোন কোলাহল নেই, চিৎকার হল্লা,নেই।মুক্ত হাওয়া হুড়হুড় করে বুকের ভিতর আপনি ঢুকে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশ দিয়ে চলেছি এদিক সেদিক দেখতে দেখতে।



আজ সারাদিন আবার ঝুর ঝুর করে বরফ পড়ে চলেছে পেঁজা তুলোর মত। বরফ পড়ার কথা শুনেছি, পড়েছি, সিনেমাতে ছবিও দেখেছি , কিন্তু চর্মচক্ষে এরকম বরফ পড়া কোনদিনও দেখেছি বলে মনে হয় না।কাল রাত থেকেই বরফ পড়ছে।কয়েকদিন আর বাইরে বেড়ানো হয় নি। কিন্তু প্রকৃতির এই সাদা ধবধবে পবিত্রতার ভাবের মধ্যেও যে অদ্ভুত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, আগে না দেখলে জানতে পারতাম না। সমস্ত আকাশ বাতাস বরফ কুঁচিতে ভর্তি।ধীরে ধীরে বাড়ি ঘরের ছাদ গাছপালার ডাল, পাতা সব ছেয়ে যাচ্ছে সাদা বরফে।আমার মনে হচ্ছে প্রকৃতিদেবী যেন শরীরের সমস্ত রঙ সরিয়ে দিয়ে বৈধব্যের বা সন্ন্যাসী জীবনের সাদা রংটিকেই বরণ করে নিচ্ছেন।কখনও মনে হচ্ছে দিনটিকে একরাশ সাদা ফুলে সাজিয়ে দিচ্ছেন বা জরির কুঁচি উড়িয়ে এই দিনটি সাজানোর চেষ্টা হচ্ছে। 



মাঝে খানিকক্ষণ সময় বরফের গতি হাল্কা হয়ে একটু রোদের আভা দেখা দিল।সেই সময়ে দেখি, বেশ কিছুটা বরফ গলে গেছে।এখান যে সমস্ত গাছ আছে, একমাত্র পাইনের মত চিরহরিৎ বাদে, তারা দেখি আগেই বুঝতে পারে যে এই সময় ঠাণ্ডায় লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকাই ভাল।তাই প্রায় সবাই ডাল পালা নিষ্পত্র করে গভীর ঘুমে মগ্ন।যতক্ষণ না সুয্যিদেব এসে নিজের হাতে লেপ সরিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে বলবেন, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল–”, ততদিন তারা কুঁড়ে বা আলসে ছেলের মত ঘুমোতেই থাকে।



আজ বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা, প্রায় ১ডিগ্রী বা শূন্য ডিগ্রীর কাছে তাপমাত্রা , ঘরেও তাই ২৪ ঘণ্টা চলছে বেশ কয়েকটা হীটার।বাইরের গাছ গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে, ধবধবে সাদা সাদা ফুলে গাছ ভরে আছে।

ঘরে সেন্ট্রাল রুম হীটার ছাড়াও চলছে আরও দুটি বাড়তি হীটার।ফলে ঘরে দুটো তিনটে গরম জামা চাপিয়ে থাকা গেলেও, বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য নেই একান্ত প্রয়োজন না হলে।



সকালে একটু পরেই দেখলাম, অদ্ভুত কাণ্ড। কোথায় রোদ, কোথায় কি! এক মিনিটের মধ্যেই চারিদিক অন্ধকার করে একেবারে প্রচণ্ড বরফের ঝড় শুরু হল। অসংখ্য ধূলা ঝড়ের বালুকণার মত কুচি কুচি বরফের সাদা গুঁড়ো চারিদিক বর্ষিত হতে লাগল।কয়েক হাত তফাতে লোক দেখা যাচ্ছে না এমন অবস্থা।  গাছপালাঘরবাড়ির ছাদ সব ভরে গেল সাদা 'টাটা নমকে' র মত গুঁড়ো গুঁড়ো বরফে। মাঠ ঘাট যা দেখা যাচ্ছে চারিদিকে সব পুরো সাদা চাদরে ঢেকে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই আবার দেখলাম বরফ ঝড় থেমে গিয়ে হাল্কা রোদ উঠল। এইরকমই চলছে আজ, কখনও বরফের হাল্কা বা বেশি ঝড়, কখনও আবার ঝকঝকে রোদ।

এর মধ্যেই মেয়ে বেরিয়ে গেল তার ইউনিভার্সিটিতে।



সেদিন ঠাণ্ডার প্রকোপ কম (১২/১৩ ডিগ্রী) অবশ্য  হাল্কা বৃষ্টির ছাপ দেখা যাচ্ছে চারিদিকে। আকাশটাও মেঘলা।মাঝে সূর্য একেবারে নতুন কচি বউয়ের মত একঝলক উঁকি মেরে যাচ্ছে, আবার যেন শ্বশুর ভাসুরের ভয়ে বা লজ্জায় মুখ লুকোচ্ছে। মেয়ের পড়ার চাপটাও কম।তাই ও-ই বলল, চল আজ ঘুরে আসি। অনেকদিন বসে আছ।তাই সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে বাসে কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় বিশাল বিশাল রিক্তপত্র বৃক্ষের জঙ্গল।এগুলো  দেখে, এগুলোর যৌবনের ছবিটা অনুমানের চেষ্টা করলাম।



কর্ণেলে এসে খুব ভাল লাগল। এর আগে অনেক গুলো ইউনিভার্সিটি দেখেছি আমেরিকায় স্ট্যানফোর্ডওয়াশিংটন, পার্দু , বার্কলে এই সব।এটাও মোটামুটি সেই রকমই। ধরণটা প্রায় একই।সব জায়গাতেই রয়েছে একটা আইকনিক টাওয়ার, বেল টাওয়ার। বেশ উঁচু, আর তাতে রয়েছে একটা ঘড়ি। তার আওয়াজ শোনা যায় বহুদূর।এখানে সব ইউনিভার্সিটিতেই প্রায়, লক্ষ্য করেছি, রয়েছে একটা করে বেল টাওয়ার।



এক একদিন এক একদিকে হাঁটতে যাই। সেদিন হাঁটতে গিয়েছিলাম আর এক দিকে। ছোট একটি পরিচ্ছন্ন চার্চ রয়েছে। বেশ সুন্দর সুন্দর ছিমছাম ছোট ছোট সাজানো ছবির মত সব বাড়ি।প্রত্যেকের আশে পাশে অনেক জায়গা।উঁচু নীচু জায়গাগুলো মোটামুটি সবুজ কার্পেটের মত ঘাসে মোড়া।কোথাও এতটুকু নোংরা,বা অসুন্দর কিছু নেই। অর্থাৎ এই গ্রামেও প্রত্যেকেরই একটা আলাদা সৌন্দর্যবোধ আছে।ঠিক নির্দিষ্ট দিনে নোংরা তুলে নেওয়ার গাড়ি আছে। 


পাহাড়ের কোল পর্যন্ত সবুজ গাছ আর ঘাসের কার্পেট চলে গেছে।জঙ্গলে গাছের গায়ে জড়িয়ে আছে বুনো আঙ্গুরের লতা।মাঝে মাঝে দেখা পাই চকিত ত্রস্ত চমকিত হরিণ হরিণীর।শাবকের সঙ্গে হয়ত নিশ্চিন্তে ঘাস পাতা খেয়ে যাচ্ছে।সবুজ কার্পেটের মত ঘাসে এখানে ওখানে দেখা যায় পাঁশুটে রঙের, বড় বড় কান তুলে , কালো গভীর চোখের বুনো খরগোস আপন মনে ঘাস চিবোচ্ছে।অবশ্য মাঝে মাঝে যে নিশাচর রেকুন বা বিশী গন্ধ ছড়ানো অথচ সুন্দর দেখতে স্কাংক দেখা যায় না ,তা নয়।



মাথার উপরে নীল আকাশ, তাতে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। বাতাস একেবারে নির্মল বাধাবন্ধহীন স্রোতঃস্বিনীর মত নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে ফুসফুসের বেলুনকে অনায়াসে ফুলিয়ে দিচ্ছে। এরকমটা আমি কোলকাতায় পাই না।



এখানে ওখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বিভিন্ন ধরণের ভুঁইফোঁড় লিলির দল। তাদের মাথায় মাথায় ছোট ছোট কুঁড়ি। বুঝলাম, নানা রঙের ছোট বড় লিলির দল আর কয়েকদিনের মধ্যেই ছেয়ে ফেলবে চারিদিক। আমারও মন সেই আনন্দে ভরে উঠছে।অধীর আগ্রহে বসে রয়েছি।



এই সঙ্গে দেখছি নানা ছোট বড় পাখীর ঝাঁক।কি সুন্দর সুন্দর পাখীরা সব গাছের ডালে, মাটিতে এখানে ওখানে উড়ে বেড়াচ্ছে।মনটা হাল্কা হয়ে যায়। পৃথিবীতে যে এত আনন্দ আছে এখানে না এলে বোঝানো যায় না। এখানে যেন দুঃখের কোন জায়গা নেই মনে হয়।সেদিন দেখলাম একটা বাড়িতে দুটো ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু দূরে রয়েছে একটা শ্যুটিং গ্রাউন্ড। লোকেরা শ্যুটিং প্র‍্যাকটিস করছে জঙ্গলের ধারে। আশে পাশে পুরো একটা নিটোল গ্রামের চিত্র।একটা ‘কার রেসিং’ এর প্র্যাক্টিসের স্কুলও দেখলাম একজায়গায়। ছেলেমেয়েরা এসে এখানে রেসিং কার চালানোর অভ্যাস করছে।



আজ আবার বেশ কয়েকদিন পরে রোদ উঠেছে ভোরের একটু পরেই। বেশ ঝলমলে রোদ। মনটা নেচে উঠল। আজ আবার তাহলে কয়েকদিন গৃহবন্দী দশার পর বাইরের মুক্ত হাওয়া নিতে পারব। এখন বেশ ভাল করে বুঝতে পারছি, আন্দামানের বন্দীদের যে অন্ধকার ঘরের বন্দীদশার মধ্যে কাটানোর শাস্তির কথা শাস্তিদাতারা ভেবেছিলেন, তাঁরা কি পরিমানে অভিজ্ঞ ছিলেন , আর যাঁরা ঐ দশা কাটাতে বাধ্য হতেন, তাঁদের অবস্থাটা যে কি হত সেটাও অনুমান করতে পারছি ভালভাবেই।এর পরেও যে সমস্ত শ্রদ্ধেয় বিপ্লবীরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে পড়া শোনা করতেন বা পরে ফিরে এসে আবার সুস্থ মস্তিষ্কে দেশ কে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা কি শক্তধাতের মানুষ ছিলেন।



যাই হোক, জানালার সামনেই দেখি বেশ কিছু ছোট ছোট পাখি এসে হাজির হয়েছে। তারা দেখি মুখ ভর্তি কাঠিকুটি জোগাড় করে উড়ে যাচ্ছে। এরা যে একটি ঘাস নিচ্ছে তা নয়।মুখ ভর্তি করে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘাস পাতা নিয়ে যাচ্ছে।কয়েকদিন ধরেই দেখলাম, পরপর পাখীরা আসছে আর নিয়ে যাচ্ছে।বুঝলাম, প্রকৃতির নিয়মে,বাইরে যেমন বসন্ত এসে গেছে বুঝতে পারছি, ওরাও দেহে মনে বুঝতে পারছে , ওদেরও শরীরে মনে বসন্ত এসেছে। ওরাও বংশ বিস্তারের জন্য আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষায় রাখার জন্য তৈরী হছে নিরাপদ আশ্রয়ের প্রস্তুতিতে। এখানে বুঝতে পারি প্রকৃতি কেমন আপন নিয়মে নাচতে নাচতে চলেছে তার আপন রঙ্গ নিয়ে।



সারাদিনই আজ রোদের তেজ ছিল। আমরা বের হলাম বেলা ৬টায়। এখানে সন্ধ্যা হয় প্রায় রাত (?) আটটায়।কাজেই তখনও রোদ বেশ রয়েছে। আজ হাঁটতে লাগলাম হাইওয়ে ধরেই পাশে পাশে । যদিও তাতে ভীষণ বেগে গাড়ী চলাচল করছে , তবু রাস্তার অনেক ধার দিয়েই সন্তর্পণে দুটি বৃদ্ধবৃদ্ধা শিশুমনের ঔৎসুক্য নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চলল। দূরে চারপাশ ঘিরেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি। তারা যেন ঘিরে রেখেছে এই জায়গাটিকে আদর করে, কোথাও থেকে কোন আপদ বিপদ  আসতে দেবে না এই সঙ্কল্পে। পাহাড়ের রঙ কোথাও বেগুনী , কোথাও কালচে, কোথাও ধূসর । একেই বলে বোধ হয় রোলিং হিলস। আমরা চলেছি আর দেখতে দেখতে যাচ্ছি পরিষ্কার নীল আকাশ। ডাইনে বাঁয়ে উঁচু নীচু ফাঁকা জমি। কিন্তু সব জায়গাই কেমন সমান সবুজ আদিগন্ত ছাঁটা ঘাস।ভাবি আমাদের ওখানে কেন এরকম হয় না। ফাঁকা জায়গাগুলো কি আমরা ঘাসে ভরাতে পারি না। সে কি অনেক খরচ, না আমরা চাই না  বলেই পারি না।বুঝি অনেকটাই, আমাদের নিজেদের ও  শাসকদের সদিচ্ছার অভাবেই অনেক কিছু হয় না।এই ঘাসগুলো ছেঁটে সেই ঘাসগুলোকেও নানা কাজে লাগায় এরা। হয় গরুজাতীয় প্রাণীর খাদ্য হয়, নচেৎ কাগজ তৈরী বা প্যাকিং এর কাজে লাগে।এতেও ভালই আয় হয়। 



আমরা যেতে যেতে রাস্তার পাশে দেখলাম, একটা কবর খানা, নাম Willow Glen Cemeteryসেটি, লেখা দেখে বুঝলাম ১৮৮৭ সালে তৈরী। অর্থাৎ যে বছর আমেরিকার মানুষ উত্তাল হয়েছিলেন শ্রমিকদের আট ঘন্টা কাজের দাবিতে, প্রাণ দিয়েছিলেন , তার পরের বছরেই এই গণ সমাধিক্ষেত্রের স্থাপনা। বেশ শান্ত জায়গাটি। রাস্তার পাশে নিরিবিলিতে অনেক গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে রয়েছেন হাজার মানুষ। মনটা হঠাৎ দার্শনিক হয়ে উঠল এটি দেখতে দেখতে।


মনে হল, এই যে আজ প্রায় ১৩৫ বছর ধরে এখানে ঘুমিয়ে রয়েছেন এত হাজার হাজার মানুষ, এঁরা তো সব একসময় এই পৃথিবীর বুকেই ঘোরাফেরা করেছেন। তখন কি এতজনকে এইটুকু জায়গায় রাখা যেত? তখন এঁদের প্রত্যেকের জন্যই কত জমি, জায়গা , লোকজন জিনিসপত্র লাগত। কত ঝগড়া রাগ দর্প অহংকার হিংসা ভালবাসা স্নেহ মমতা এঁদের জড়িয়ে থাকত। কত মানুষ এঁদের ঘিরে থাকতেন। অথচ আজ এতজন কেমন নিঃসঙ্কোচে সবাই সবার পাশে এত টুকু জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থেকে নির্বিবাদে ঘুমিয়ে আছেন। আজ সঙ্গে রয়েছে শুধু উপরে নিস্তব্ধ নীল বিস্তৃত আকাশ, তার নীচে কিছু শান্ত গাছের নরম মোলায়েম ছায়া, আশেপাশে ছড়ানো মখমলের মত কালচে সবুজ ঘাসের কার্পেট আর মাটির উপরে স্মৃতি হিসাবে বংশধর বা আত্মীয়স্বজনের চাপিয়ে দেওয়া কিছু পাথরের ফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ। হয়ত স্মৃতিস্তম্ভ দিয়েই আত্মীয়রা নিজেদের আভিজাত্য বা ভালবাসা প্রকাশ করতে চেয়েছেন, যেটির জন্য যিনি নীচে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁর কোনই দাবী ছিল না। কোন কোন স্মৃতিস্তম্ভ এক একটি কিছু উঁচু বেদীর মত তার উপরে হয়ত কোন স্বর্গীয় পরীর মূর্তি, কারোর বা কিছু নীচু -শুধু মৃতের নাম খোদাই করা আছে আবার কারোর হয়ত অত সামর্থ্য নেই - শুধু একটি ছোট পাথরের টুকরো চাপানো আছে।সবাই সাধ্যমত স্বর্গগত পরিজনদের জন্ম মৃত্যুর তারিখ, ঠিকানা জানানোর চেষ্টা করেছেন।কিন্তু এ নিয়ে কারোর কোন বাদ প্রতিবাদ নেই।আজ কারোর কোন চাহিদা নেই, দর্প নেই, অহংকার, রেষারেষি,কিচ্ছু নেই। বন্ধুবান্ধব স্বজন বিচ্ছিন্ন হয়ে এত দূরে কত অপরিচিতদের সঙ্গে পাশাপাশি রয়েছেন।এক নিস্তব্ধ অনাবিল শান্তির রাজত্ব বিরাজ করছে এখানে। কোন অসুবিধাই নেই। তাহলে আসলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়? আমাদের অহং বোধই কি? আমাদের প্রখ্যাত নাট্যকার শম্ভু মিত্র, তাঁর কন্যা শাঁওলি মিত্র ইত্যাদিরা চেয়েছেন, এরকমই লোকচক্ষুর আড়ালে আড়ম্বরহীন এক নিঃশব্দ শোকযাত্রা, এক নীরব প্রস্থান।



যেতে যেতে দেখি বেশ কিছু প্রাকৃতিক নালা বা ঝরণা ঝোপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে এসে কুল কুল শব্দ করে আপনার মনে বয়ে চলেছে বেশ অনেকটা করে জলের ধারা নিয়ে। নিঃশব্দ ঝোপ ঝোড়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় এই কুলুকুলু ধ্বনির যে এক অদ্ভুত মাধুর্য্য আছে, তা, যে না  শুনেছে তাকে বোঝানো যাবে না।ভগবান ‘ভদ্রলোক’ এত সুন্দর করে পৃথিবীকে সাজিয়ে রেখেছেন শব্দ, গন্ধ বর্ণ দিয়ে  তা  উপভোগ না  করতে পারলে মনে হয় জীবনই বৃথা।




আমাদের ঘরের পাশে একদিন দেখি একটি বোর্ডে লেখা আছে, Here lives a kind lady  বলে পাশে একটি বিড়ালের ছবি আঁকা আছে।আমরা বেশ কিছুদিন সেই ‘দয়ালু ভদ্রমহিলার’ দেখা পাই নি।একদিন দেখি, প্রচণ্ড বরফ পড়ার পর একটু বিরতি হয়েছে, চারিদিক সাদায় সাদা, তার মধ্যে একটি কালো কুচকুচে তুলোর বড় বল, গুটি গুটি পায়ে সাদা বরফের উপর লক্ষ্মীর পায়ের মত আলপনা আঁকতে আঁকতে আমাদের রান্নার জায়গায় জানালার পাশে এসে হাজির হয়েছেন।সেই বরফের মধ্যে মুখ দিয়ে চেটে চেটে কি খাচ্ছে কে জানে।আমাদের সাড়া পেয়ে দেখি, ঘুরে তাকাল আমাদের দিকে। দেখি, একটা বড় কালো বলের মধ্যে দুটি ঊজ্বল নীল মার্বেলের মত চোখে আশ্চর্য বিস্ময়। মুখে অল্প একটু সাদা দাগ যেন বরফের সাদা এখানে ওখানে লেগে গেছে কোন ভাবে। তাকে আদর করে ডাকতে, পাত্তা তো দিলই না, উপরন্তু পিছন ঘুরে হেলতে দুলতে চলে গেল পাশের ঝোপের দিকে। বুঝলাম, সে যতই "Kind" হোক আমাদের ডাকে তার "সাড়া দিতে বয়েই গেছে"।



এখানে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। যেমন, আজ সকাল থেকে, ‘নেটে’ দেখাচ্ছিল, সারাদিন রোদ আছে, ভাল পরিষ্কার আকাশ।অথচ একটু আগেই দেখলাম, ঝরঝর করে বরফ গুঁড়ো করাতের কাঠ গুঁড়োর মত বা টাটার নুনের গুঁড়োর মত পড়তে আরম্ভ হল। ভাবলাম, এ আবার কি! বৃষ্টি কিন্তু নেই।কিছু ভিজছে না। একটু পরেই দেখি, ঝকঝকে রোদ। তাপমাত্রা কিন্তু শূন্য ডিগ্রী। বাইরে মুখ বের করলেই মুখ কেটে দিচ্ছে একেবারে।আকাশ কিন্তু প্রচণ্ড নীল। মুস্কিল হচ্ছে, এই ঠাণ্ডায় হাঁটতে যেতে বা বাইরে বের হতে পারছি না। আমাদের তো অভ্যেস নেই।কিন্তু এর মধ্যেই দেখি, কিছু ছেলে মেয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে।স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছে।ওরা এই ঠাণ্ডাকেও জয় করেছে।এই হচ্ছে, তরুণের রক্ত।ওরা কি আর আমাদের মত ঘরে বসে থাকার লোক।



কয়েকদিন পর বাইরে হাঁটতে বের হলাম।কদিন ধরে বৃষ্টিপ্রচণ্ড ঠান্ডা ইত্যাদিতে বের হতে পারি নি। অথচ বেশি দিন চুপচাপ ঘরে বসেও মন খারাপ হয়ে যায়। চারদিকে কত ফুল আপনার মনে ফুটে রয়েছে অনাঘ্রাত অবস্থায়। দেখে এসেছি কয়েকদিন আগেই, মাটিতে লিলিগুলো কুঁড়ি নিয়ে উন্মুখ হয়ে রয়েছে। বেশ লাগেঠিক সময়ে যেন এদের কেউ ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে, বলেছে, যাও ফুল নিয়ে যাও প্রকৃতির দরজায়, আর ওরা চকচকে জামাকাপড় পড়ে হাতে ফুলের গোছা নিয়ে প্রকৃতিরাণীর হাতে উপহার দিতে এসেছে। 



আজ একটা সুন্দর ঘটনা ঘটল। আমরা জানতাম, আজ বেলা তিনটা থেকে বৃষ্টি পড়বে, তাই আগেই দুজনে হেঁটে এলাম।খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টি এল। কিছুক্ষণ বাদেই দেখি দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। খুলে দেখি, বৃষ্টির মধ্যে  বর্ষাতি চাপিয়ে প্রায় আশীবছরের বৃদ্ধ বাড়ীওলা, সুঠাম চেহারা নিয়ে একমুখ হাসি সমেত এক গোছা সদ্য কেটে আনা হলুদ সাদা লিলি ফুল আমার হাতে এগিয়ে দিল।আমি শশব্যস্ত হয়ে বলি, এই বৃষ্টিতে কেন এনেছেন? উনি বলেন, ঝড়ে পরে নষ্টই তো হয়ে যাবে তার থেকে উপহার দিলাম আপনাদের। 

আমি তো সত্যিই অভিভূত। আমি কি বলে যে ওনাকে ধন্যবাদ দেব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।  ফুলের চেয়ে ভাল উপহার আর কিছু হয় কি জানি না।সত্যিই ভালবাসার বোধ হয় জাতি, দেশ, বয়স,ধর্ম হয় না। এ স্মৃতি আমার কাছে অক্ষয় হয়ে থাকবে।বিদেশে এসে মানুষের এই অযাচিত ভালবাসার কি কোন পরিমাপ হয়!




আমরা যখন আসি তখন এখানে দেখেছি, সমস্ত গাছের কঙ্কালগুলো দাঁড়িয়ে আছে।স্ত্রী বলছিল, এর আগে যে দেখেছি, আমেরিকায় সবাই সুন্দর গাছ লাগায়, ঘরের চারপাশ সুন্দর পরিচ্ছন্ন করে রাখে, এখানে যেন কোন শ্রী ছাঁদ নেই। সব অগোছালো মরা গাছের ঝোপ। এগুলোকে না কেটে রেখে দিয়েছে কেন? জায়গাটা ফাঁকা, সেটা ঠিক আছে, কিন্তু গাছপালার ব্যাপারে বড়ই উদাসীন। 



কিন্তু বরফ কেটে গিয়ে রোদ উঠতেই দেখি, সবাই নেমে পড়েছে মাঠে ঘাস কাটার গাড়ী, নানা যন্ত্র নিয়ে। গাছ পরিষ্কার করা, নতুন ফুলের গাছ লাগানো ,বাগান সাজানো চলছে।আমাদের গ্রামে যেমন বাড়ি বাড়ী  পৌষের পিঠে পুলি বানানোর সাড়া পড়ে যায় আর তার মিষ্টি মন কেমন করা  গন্ধ ওঠে , এখানেও তেমন ঘরঘর করে চলছে সব বাড়ীতে ঘাস কাটার গাড়ী আর বাতাস ভারী হয়ে আছে কাটা কচি ঘাসের অদ্ভুত গন্ধে, যে গন্ধ আমি ভুলে গিয়েছি গ্রাম ছাড়ার পর।শুকনো জঙ্গল পরিষ্কার করা হচ্ছে অনেক জায়গায়। বাড়ির আশেপাশের ঘাসগুলো মসৃণ করে ছাঁটা হচ্ছে।



এই করেই কেটে গেল আরও একটা মাস। বরফ আর বৃষ্টি নিয়ে গড়িয়েছে অনেক দিন।আমরা বিকালে বেড়াতে যেতে পারি নিসেও অনেক দিন। শেষে একদিন হাঁটতে গিয়ে দেখি ,চারিদিক ছেয়ে  রয়েছে রডোডেন্ড্রন ফুল, এখানে ওখানে ফুটে আছে নানা রকমের সুন্দর সব লিলি, পিটুনিয়া ইত্যাদি ফুলেরা। অনেক বড় বড় গাছে দেখি ফুলে ফুলে ভর্তি হয়ে রয়েছে।তার মধ্যে কিছু আপেল গাছ ভরে গেছে সাদা অসংখ্য ছো্ট ছোট ফুলে।আর তার সঙ্গে তার চার দিকে ভরে রয়েছে চঞ্চল একরাশ মৌমাছি।সে যে কি অপূর্ব শোভা তা বলে বোঝানো যাবে না। 



একসময় মেয়ের প্ড়া শেষ হতে চলে আসতেই হল সেই স্বর্গের মত গ্রাম ছেড়ে। তবে সঙ্গে যে স্মৃতি নিয়ে এলাম, তা বুকে জমা থাকবে আমৃত্যু।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ