চরিত্র- সত্য, ক, খ, জেনারেল
[পর্দা সরে
যাওয়ার পরেই দেখা যায় মঞ্চে পাঁচজন নিথর মানুষ শুয়ে আছে। সকলেই সাদা পোশাক
পরিহিত। ধু ধু মরুপ্রান্তর। ফায়ারিং এর শব্দ— কিছুক্ষণ পর পর। এরপর দুইজন কালো
পোশাক পরিহিত সশস্ত্র মানুষের প্রবেশ— আমরা এই দুইজন -কে 'ক ' এবং 'খ ' বলবো।]
ক— (রাইফেল দিয়ে একটা দেহকে স্পর্শ করতে করতে, হতাশ হয়ে) বুঝলে
ভাই, মনে হয় এরা খতম।
খ— যাক্, ব্রাদার! এইবার
জেনারেল সাহেব খুব খুশি হবেন।
ক— কিন্তু কাজটা কি ঠিক করছি
আমরা?
খ— চুপ! খবরদার।
আমাদের কড়া নির্দেশ আছে; একদম সহানুভূতিশীল হওয়া যাবে না।
ক— এদের দোষটা কী
আসলে?
খ— মানে? এরা সবাই 'সত্য'-এর সাপোর্টার।
সত্যবাদী। আর আমরা 'মিথ্যা'-এর! মিথ্যাবাদী।
ক— 'সত্য' কে? কোনোদিন কেউ দেখেছে?
খ— ঐ ব্যাটাকে
ধরতেই তো এত লড়াই। একবার পেলে হয়! জেনারেল সাহেব বলেছেন 'সত্য'-কে একবার ধরতে পারলে
আমাদের পদোন্নতি হবে।
ক— আচ্ছা, বলছি যে 'মিথ্যা'-ই কি সর্বদা সঠিক?
খ— আহা। 'মিথ্যা'র আশ্রয়েই তো
শান্তি রে ভাই। চোখে বাঁধা পট্টির মতন— না কিছু দেখার প্রয়োজন, না কিছু বোঝার
প্রয়োজন। শুধুই শান্তি আর শান্তি। ‘সত্য’র আশ্রয় অত্যন্ত পাশবিক এবং নিষ্ঠুর। 'সত্য'র পথ বড় কন্টকময়।
ক— কিন্তু, আমার মনে হয়....
খ— (চিৎকার করে) তুমি কি বিদ্রোহী হয়ে উঠছো? তাহলে তোমার অবস্থাও
এদের মতন হতে চলেছে। সাবধান!
[জেনারেলের
প্রবেশ]
ক— জেনারেল!
খ— জেনারেল!
জেনারেল— (দেহগুলি দেখতে দেখতে) কোয়াইট ইম্প্রেসিভ!
নাইস ওয়ার্ক, গাইস্।
ক— স্যার, একটা কথা ছিল— আপনি কখনও 'মিথ্যা’র মুখোমুখি হয়েছেন?
জেনারেল— ইয়েস্। হি ইজ উইথ মি অল দ্য টাইম। উনিই তো সব। সত্য সবসময়
মানুষকে পাগল বানিয়ে তোলে— মানুষকে দিয়ে যা নয় তাই করায়; কতটা বোকা বানালে
একজন মানুষ নিজের অপরাধ স্বীকার করে! 'মিথ্যা' কোনোদিন আমাদের দিয়ে এসব করায় না— সবসময় আমাদের
সেফ জোনে রাখে এবং মানসিক শান্তি প্রদান করে।
খ— একদম স্যার।
জেনারেল— 'ক'!
ক্লিয়ার?
ক— (হেসে কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে) স্যার, একজন মিথ্যাবাদী কী করে ক্লিয়ার হয়? 'সত্য'-ই একমাত্র মনের
আয়নাকে পরিষ্কার করতে পারে এবং সেই আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবি যতক্ষণ না দেখতে
পাচ্ছি ততক্ষণ আমি শান্তি পাবো না।
জেনারেল— (প্রচন্ড রেগে গিয়ে) শাট আপ্! হোয়াট রাবিশ? আই নো দ্যাট। তুইও
শেষে সত্যের দালালি করছিস? 'খ'! আমি অর্ডার দিচ্ছি, ওকে গুলি করো। এটাই
ওর শাস্তি।
খ— (নৃশংস দৃষ্টিতে 'ক'-এর দিকে তাকিয়ে) বলেছিলাম তোকে এসব থেকে দূরে থাক। নে এবার
মরার জন্য তৈরী হ।
['খ' ট্রিগার টিপতে যাবে,
এমন সময়ে সবাইকে চমকে দিয়ে নেপথ্য থেকে
দরাজ কন্ঠে অস্পষ্ট কোনো গান শোনা যেতে লাগল।ধীরে ধীরে সেই গান আরও স্পষ্ট হতে হতে
মঞ্চে স্বয়ং 'সত্য'র প্রবেশ]
সত্য— (আপন মনে গাইতে গাইতে)
নতুন দিনের সেই আঙিনায়,
সকল পাখির কলরবে—
আঁধার ঘেরা শেষ সীমানায়
আমার আলো তোমায় ছোঁবে;
নতুন দিনের...
['ক', 'খ' ও জেনারেলের সম্মুখে এসে 'সত্য' দাঁড়িয়ে যায় এবং গানও
থামিয়ে দেয়। দেহগুলো তখনও পড়ে আছে]
জেনারেল— (বিকৃতভাবে হেসে) এ যে শিকার নিজে থেকে শিকারীর হাতে এসে
পড়েছে! দেখছো কী? শুট অ্যাট হিম। আই সেইড শুট!
['সত্য' মুচকি হেসে
চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো। গুলিতে তাঁর কোনো ক্ষতিই হচ্ছে না। বরং যত বার তাঁর দিকে 'খ' গুলি ছুড়ছে ততবার
আগের মৃতদেহ গুলির সবাই এক এক করে জীবন্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে। 'খ' হতভম্ব হয়ে
রাইফেল ফেলে দিলো। 'ক', 'সত্য'র পায়ে লুটিয়ে পড়লো— 'সত্য' তাকে আলিঙ্গন
করলো।]
জেনারেল— (অত্যন্ত রেগে গিয়ে হিংস্রভাবে) রাবিশ! তোদের সবগুলোকে আজ আমি শেষ করবো। কেউ বাঁচবি না। আমি 'মিথ্যা'র রক্ষক! 'মিথ্যা'-ই সর্বশ্রেষ্ঠ।
[এরপর জেনারেল
তাঁর পিস্তলটা বের করে বিক্ষিপ্তভাবে গুলিবর্ষণ করলেন। কোনো পরিবর্তনই হলো না।
কারুর কিছুই হলো না।]
সত্য— (শান্তভাবে) এদের কাউকে তুমি শেষ করতে পারবে না। আসলে এরা সকলেই 'সত্য'। 'সত্য'র আশ্রয়ে কেউ একবার
এলে সে অসীম মৃত্যুহীন প্রান্তরের যাত্রীতে পরিণত হয়ে
যায়; এই পথ কখনোই 'মিথ্যা'র মত মসৃণ নয়— তবে
শান্তির পথ। আমি মহৎ কিছু নই। তবে যে ‘মিথ্যা’র জন্য তোমাদের এত লড়াই,
সে কিন্তু
আমার সামনে কোনোদিন দাঁড়াতে পারবেনা। সে তোমাদের অন্তরে লুকিয়ে
থেকে তোমাদের ভয় দেখাবে— সে নিজেও যে ভীত। 'সত্য'-কে ভয় পায় সে।
জেনারেল— (হতাশ হয়ে শেষে নিজের মাথায় পিস্তল
ঠেকিয়ে) আমি 'মিথ্যা'র প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমি তোমার কাছে কখনোই মাথা নত করবো না।
বিদায়...
[এবারেও গুলি চালিয়ে কিছু হলোনা! জেনারেল হতাশ হয়ে দুইহাতে মুখ
ঢেকে শিশুর মতন কাঁদতে লাগলেন। 'সত্য' এগিয়ে গিয়ে জেনারেলের কাঁধে হাত রাখল।]
সত্য— (বিনম্রভাবে, মুচকি হেসে) তুমি দ্বন্দ্বের শিকার, বন্ধু। তুমি নির্দোষ।
'মিথ্যা' নামক যে পর্দা
দ্বারা তোমার দুই চোখ বাঁধা ছিল, সেটা খোলার সময় এসে গেছে। তুমি আমার স্পর্শ পেয়েছো কিছুটা হলেও; তাই তুমিও এখন আমাদের সহযাত্রী। 'মিথ্যা'কে ভুলে যাও। 'মিথ্যা' বলে কিছু নেই— কিছু হয় না। 'সত্য'র আশ্রয়েই যে অমরত্ব! এসো বন্ধু, এসো...
[মঞ্চের সমস্ত
আলো নিভে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তারপর যখন আবার আলো জ্বলে ওঠে, তখন দেখা যায়
সকলে একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিক খুব উজ্জ্বল এবং আনন্দময়। এবার 'ক','খ', জেনারেল-ও সাদা পোশাক পরেছেন। সকলের মুখেই হাসি। সবাই মিলে
কোরাসে গাইছেন :
নতুন দিনের সেই আঙিনায়,
সকল পাখির কলরবে—
আঁধার ঘেরা শেষ সীমানায়
আমার আলো তোমায় ছোঁবে;
নতুন দিনের...
পর্দা ধীরে ধীরে মঞ্চটাকে ঢেকে দিলো]
1 মন্তব্যসমূহ
darun
উত্তরমুছুন