ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

মজার পুরুলিয়া - সব্যসাচী হালদার


আজ একটা পৃথক ভাবের ভ্রমণ কথা বলবো, আমি এর আগে কোনো ভ্রমণ কাহিনী লিখিনি এটা সত্যি কথা। ঘুরতে গিয়েছি অনেক জায়গায়। তবে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ভ্রমণটা আমার প্রথম পরিবেশের সংস্পর্শে যাওয়ার স্মৃতি বহন করে তার ওপর আবার পাহাড়ে। ভারী লাগে ঘটনা গুলো ভাবতে। তাহলে চলুন পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ শুরু করি

    

        কোচিং সেন্টার থেকে ঠিক করা হলো একটা ট্যুর হবে। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি।

          অনেক খুঁজে খুঁজে পাওয়া গেল পুরুলিয়া। অন্য জায়গা পাওয়া যায়নি তা নয়, তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের সামর্থ্যের কথা ভেবে এটায় অগত্যা। আমার বাড়ি থেকে যেতে দিতে একদমই রাজি না। তবে কোচিং সেন্টারের প্রথম সারির ছাত্র হওয়ার সুবাদে টিচাররা বাবা-মা কে বার বার করে বোঝানোর পর আমার যাওয়া ঠিক হলো।

          বাস ছাড়বে বিকেল সাড়ে পাঁচটা, সবাইকে  সঠিক সময় পৌঁছাতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখলাম একটা পেল্লাই সাইজের ভলভো বাস দাঁড়িয়ে আছে। মোট যাত্রী হলো আটষট্টি জন। তার রয়েছেন মধ্যে ছয় জন টিচার, আর দুজন রান্নার মাসি তার মধ্যে ফ্যাসাদ হল বাসের সিট সংখ্যা মাত্র ছেষট্টি। অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঠিক হলো দুজন টিচার বাকি টিচারদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে দাঁড়িয়ে যাবে। অবশেষে বাস ছাড়লো দৈয়েরবাজার নদীয়া থেকে। বাস ছাড়তেই রান্নার মাসি দুজন গলা ছেড়ে হুলু ধ্বনি করতে শুরু করলো। তাতেই এক পশলা হাসির রোল উঠলো বাসের মধ্যে। কেউ একজন পিছন থেকে বলে উঠলো, ও মাসি; আমরা ট্যুরে যাচ্ছি তীর্থ করতে নয়। সম্ভবত মানুষটা ছিলেন অমিত দা আমাদের বাংলার টিচার।

         বাস ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে। আমার আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অর্নব এর সিট দেওয়া হয়েছিল দরজার একদম পাশের সিটটা দেখতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সত্যি বলতে কি, তখন বয়স খুব অল্প ছিল, কিন্তু বাসের মধ্যে থেকে  মিটমিটে আলো জ্বলতে থাকা মাঠের পরিবেশটা ভীষণ ভাবে উপভোগ করছিলাম। সঙ্গে ফুড়ফুড়ে হাওয়া এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে মনের ভিতরটা।

       বর্ধমানের মধ্যে দিয়ে বাস যাচ্ছে। তবে অযোধ্যা পাহাড়ের দৌলতে সেবার প্রথমবারের জন্য আমার আসানসোল শিল্পাঞ্চল দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাস একটা পেট্রোল পাম্পে থামলো। সেখানেই রাতের জন্য রান্না হবে। তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে আবার যাত্রা শুরু হবে। সকলে নেমে পড়লাম বাস থেকে। একটা পুরো ফাঁকা মাঠের মধ্যে পাম্প টা। ঝড়ের বেগে হাওয়া বইছে। চারিদিকে হালকা অন্ধকার। ভাবলাম একটু রাস্তার দিকটা ঘুরে আসি। কিন্তু কঠোর নিষেধ আসলো কেউ কোথাও যাবে না। অগত্যা সবাই একটু মন মরা হয়ে নিজেদের মধ্যে খেলায় মেতে উঠলো।

          ওই সময়ের মধ্যে এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। খাওয়া দাওয়া হলো ভাত, ডাল আর আলু সেদ্ধ।

          বাস আবার চলতে শুরু করলো। বেশ খানিকক্ষণ যাওয়ার পর আর একটা বিপদে পড়লাম। আমার বমি শুরু হয়েছে। বাসে একটানা অনেকক্ষণ থাকলে আমার বমি হয়। সেই জন্য বাড়ি থেকে ট্যাবলেট খাইয়ে পাঠিয়েছে মা। সঙ্গে পাতি লেবু দিয়েছে, বমি হলে শুকার জন্য টিচাররা আমার সিটে খবরের কাগজ পেতে দিলেন। তার ওপর বসলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বমি করতে করতে অনেক রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঠিক নেই।

        সকালে ঘুম ভাঙলো অমিতদার ডাকে। দাদা বলছে, কিরে আর কত ঘুমাবি? বাইরের দিকে দেখ। হ্যাঁ, চোখ মুছে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম চারিদিকে বড়ো বড়ো পাহাড়। আর সারা রাস্তার ধার জুড়ে উই এর ঢিবি। বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল সবটা মিলিয়ে। এতদিন পাহাড়ের কত গল্প শুনেছি। আজ প্রথমবার তার কাছে আসতে পারলাম।

          একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামলো। সকলে নামলাম। ভাবলাম অযোধ্যা চলে এসেছি। কিন্তু বাস এখানে থামানো হয়েছে ব্রাশ করে একটু ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। একটা দাদা বললো অযোধ্যা এখান থেকে এক-দেড় ঘন্টার পথ। আসল সৌন্দর্য ওখানেই। অবাক হয়ে গেলাম গ্রামটির ঘর গুলো দেখে। বেড়া দেওয়া ঘেরা কুঁড়ে ঘর। সব থেকে আশ্চর্য হলাম ছাউনির টালি গুলো দেখে। না আমি এখানে টালির গঠনটালিখে প্রকাশ করতে পারবো না। বাস আবার চলতে শুরু করলো। সবাই অবাক চোখে বাইরে টাকে লক্ষ্য করছে একটা ছোট খাটো প্রবহমান জল ধারা দেখতে পেলাম পাথুরে জমির ওপর দিয়ে। কিছু মানুষকে দেখলাম সকাল বেলা স্নান করছিলো। চারিদিকে নানা রকম গাছ আর ছোট বড়ো নানা রকম পাথর আর কুঁড়ে ঘর মন ভরিয়ে দিচ্ছিলো।

       সর্বপরি পৌঁছানো গেল অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে একটা গ্রামে গ্রামটার কোথাও মাটির দেখা পেলাম না। ছোট ছোট পাথুরে জমি পুরো এলাকায়। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশ অঞ্চলে। সমস্ত কিছু ভুলে সবাই উঠতে শুরু করলাম পাহাড়ে। নিচে বাকি কাজ কর্ম টিচার আর রান্নার মাসিরা করবে। আবারও অবাক হলাম পাহাড়ের ধার ঘেঁষে থাকা এতো সুন্দর পিচ রাস্তা দেখে।

    রাস্তা বেয়ে উঠলাম না। পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠার মজায় আলাদা অনেক উঁচুতে উঠে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। ওখান থেকে নিচে দেখতে কি যে ভালো লাগছে। প্রথমবারের জন্য পাহাড় কেটে, তার গায়ে ঝুম চাষ দেখলাম। ওখানে থেকে বোঝা যায় গ্রামটা খুব একটা বড়ো নয়। পুরো গ্রামের একটা মানচিত্র তৈরি হয়ে গেল মাথার মধ্যে।

    খুব খিদে পাওয়ায় আর ওপরে যাওয়া হলো না। নিচে নেমে এসে গরম গরম লুচি আর ছোলার তরকারি। খাওয়া শেষে গ্রামটা ঘুরে দেখার কথা ঠিক হলো।

        খুব গরিব একটা গ্রাম। ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। সারা গ্রামটাতে একটাই কল। একটা বিশাল বাঁধানো পুকুর। বিশাল মানে সত্যিই বিশাল। দুটো মন্দির রয়েছে। একটা ভোলানাথ আর একটা মা দূর্গার মন্দির। ভারী সুন্দর দেখতে মন্দির দুটো। একটা বিশাল কুয়ো চোখে পড়লো। নিচের দিকে চেয়ে দেখতে পেলাম জল নেই। একদম খটখটে শুকনো নিচটা। পানীয় জলের উৎস্য বলতে ওটাই আমাদের সঙ্গে যদিও ড্রামে করে জল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

       এগারোটা নাগাদ সবাই বেড়িয়ে পড়লো পাহাড় ঘুরতে। গাড়ি ঠিক করা হয়েছিল কিছু। ডিল করা হয়েছিল সব দর্শনীয় স্থান দেখাবে। ভাড়া নিয়েছিল মাথা পিছু দেড়শো টাকা। আমি যায়নি। সারা রাস্তা বমি করে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই  থেকে গেলাম রান্নার মাসি দের সঙ্গে। এর মধ্যে আমার নাম চেঞ্জ হয়ে গেছে, এত পরিমাণ বমি করায় আমার নাম দেওয়া হয়েছে বমি কুমার। সবাই ওই নামেই ডাকতে শুরু করেছে। অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম নাম টার কারণে।

        সকলে ঠিক করে ছিল পাহাড়ের ওপরের ঝরনায় স্নান করবে। আমি ঘুরতে না যাওয়ায় ওই পুকুরটাতে স্নান করে নিলাম দুপুরে। তারপর একা একা ঘুরে দেখতে গেলাম চারিদিকটা। লক্ষ্য করলাম এখানকার মহিলারা ভীষণ কাজের। পাহাড় থেকে এক বোঝা করে কাঠ মাথায় নিয়ে অনায়াসে নেমে আসছে।

          খুব রোদ চড়ে গেছিল দুপুর বেলা শুনেছিলাম প্রচুর মহুয়া গাছ আছে অযোধ্যা পাহাড় এলাকায়। কিন্তু তার দর্শন হলো না।

ফিরে এসে রান্নার মাসি দের সাহায্যের জন্য একটু রসুন ছাড়িয়ে দিচ্ছিলাম। দুপুরে মাংস ভাত রান্না হয়েছে। ঘোরা শেষে সবাই আড়াইটে নাগাদ পাহাড় থেকে নেমে আসলো।

           একজন লোককে রাখা হয়েছিল আমাদের ছোট খাটো কাজ গুলো করার জন্য। তিনশো টাকা আর দুপুরের খাবারের বিনিময়ে তিনি সমস্ত কাজ করলো। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সারা হলো। বেশ অনেকটা ভাত মাংস বেঁচে ছিল। কাছের কিছু বাচ্চাকে সেই খাবারটা দিয়ে দেওয়া হলো। ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে পথে বাঘমুন্ডিতে নামা হবে ছৌঁ নাচ দেখার জন্য।

         আসার পথে চারিদিক খুঁজে একটাও ভালো সুন্দর পাথর টুকরো পেলাম না স্মৃতি হিসেবে নিয়ে আসবো বলে।

          একদম নাগাদ বৈকাল বাঘমুন্ডি পৌঁছানো হলো। তবে কপাল খারাপ হওয়ায় ছৌঁ নাচ দেখা হলো না। স্থানীয় সূত্রে জানতে পারলাম নাচ হয় শুক্র বারে হাটের দিন। কিন্তু আমরা গিয়ে ছিলাম বৃহস্পতিবার।

           সারা বাঘমুন্ডি বাজার জুড়ে বেশির ভাগ মানুষ দেখলাম ছৌঁ মূর্তি বানায়। সেখানে থেকেই একটা ছোট গণেশ মূর্তি কিনলাম। সকলেই ছোট খাটো অনেক কিছু কিনলো। আমাদের অর্ঘ দা একটা বিশাল দূর্গা মূর্তি কিনলো। দাম দেখে তো সবাই অবাক। আঠারোশো টাকা। যদিও সৌন্দর্যের কাছে দাম টা কিছুই না।

        রান্নার মাসি দুজন আমাদের কেনা মূর্তি গুলো দেখে ভালো লাগায় একজনের কাছে টাকা দিল একই রকম গণেশ মূর্তি কেনার জন্য টাকা দিলেন। কিন্তু ওই মূর্তি গুলো ফুরিয়ে যাওয়ায়, ছেলেটা অন্য মূর্তি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু মূর্তি গুলো মাসি দের পছন্দ হলো না। সারা রাস্তা ওনারা ঘ্যান ঘ্যান করেই চললো।

        মাঝে মাঝে ওনাদের কথায় হাসির রোল উঠছিল। হাসি, আনন্দ, নাচ গানের মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ শেষ করে রওনা দেওয়া হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ