ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

ছাতা - অমিত দত্ত


  এক গুরুতর সমস্যা নিয়ে আমরা তিন ভাই আজ সন্ধ্যেয় বাড়ির বৈঠকখানায় বসেছিআমরা তিন ভাই মানে বড়দা যতীন্দ্র, মেজ ভাই আমি রথীন্দ্র আর ছোটন অতীন্দ্র। আমরা সবাই সরকার বাড়ির উত্তরপুরুষ। ইছাপুর নবাবগঞ্জের এই সরকার বাড়ির বয়স হতে চলল নয় নয় করেও তা প্রায় তিনশ বছর। ঝড় ঝাপটার প্রভাব যে ভালই পড়েছে, তা বাইরে থেকে দেখলে মালুম হয়। তবে চওড়া গাঁথুনি আর লোহার কড়ি বড়্গা এখনও কাঠামোটাকে ধরে রেখেছে। আমরা তিন ভাই-ই এই বাড়িতে থাকি। তবে প্রত্যেকের হেঁশেল আলাদা। এখনও যে বাড়ি বেচে দিয়ে আলাদা আলাদা জায়গায় চলে যাইনি, তার কারণ হল মা। আর মাকে নিয়েই আমাদের বর্তমান সমস্যার সূত্রপাত।

 

   কিছুক্ষণ সবাই চুপ। সেন্টার টেবিলের উপর তিন কাপ চা ঠান্ডা হয়ে জুড়িয়ে গেল। কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘরে একমাত্র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার চলমানতার।

 

   বড়দা নিস্তব্ধতা ভাঙল- “তোর দরকার কি ছিল, ছোটন, মাকে সিটি নার্সিংহোমে ভর্তি করার? কেন, মহকুমা হাসপাতাল ছিল না? কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলি না, জানালি না, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সোজা নার্সিংহোমে ঢুকিয়ে দিলি’’।

 

   অতীন্দ্র উত্তর দিল- “তখন মাথায় কিছুই আসছিল না। তোমরা দুজনেই বাড়িতে ছিলে না। তুমি ছিলে আসামে। জঙ্গলে কাঠ নিয়ে ব্যস্ত। মেজদাও অফিসের কাজ নিয়ে আসানসোলে। রাত তখন কটা হবে…এই একটা ধরো। দরজায় জোরে ধাক্কা আর রত্নামাসির চিৎকার। জানই তো এখন রত্নামাসি রাত্রিবেলা মায়ের সঙ্গেই থাকে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে শুনি, মায়ের বুকে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলাম মা বুকে হাত দিয়ে ছটফট করছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। বড়বৌদি, মেজবৌদি কাউকেই ডেকে কোন সাড়া পেলাম না। যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে যদি তখন মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যেতাম, রাতটুকুও কাটত না। তুমি তো জানই ওখানে স্যালাইন দেবার ব্যবস্থা করতেই ঘাম বেরিয়ে যায়। ওইরকম ক্রিটিক্যাল পেশেন্টকে রাতে কে অ্যাটেন্ড করবে? তাই সিটি নার্সিংহোমে নিয়ে এলাম”।

 

   -- “সিটি নার্সিংহোমে নিয়ে এলাম!” আমি মুখ না বেঁকিয়ে পারলাম না।“ এখন নার্সিংহোমের কড়ি কে গুনবে? এই মাসেই এ.সি. কিনবার পরিকল্পনা ছিল। তোরা তো থাকিস গ্রাউন্ড ফ্লোরে। উপরে থাকতে হয় আমাকে। এই জৈষ্ঠ মাসের গরমের কষ্টটা তো আর তোদেরকে পেতে হয় না। সুদেষ্ণা বলেই দিয়েছে, এইবার যদি এ.সি. টা না কেনা হয়, তাহলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। এখন গাঁটের কড়ি কোনদিকে ঢালব?”

 

-- “এই তিন দিনে নার্সিংহোমের কত বিল হয়েছে জানিস? চল্লিশ হাজার!” বড়দা মুখ খুলল। “আজ বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে দেখা করে এলাম। ক্যাশ কাউন্টারে খোঁজ নিলাম। তুই যে দশ হাজার টাকা অ্যাডমিশনের সময় দিয়েছিলিস, তারপর থেকে আর কিছু জমা পড়েনি। ইমেডিয়েটলি কিছু জমা করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ডাক্তারের সঙ্গেও কথা বললাম। তিনটে ব্লকেজ আছে। বাইপাস করতে হতে পারে হয়তো। তাতে আরও লাখ দেড়েকের ধাক্কা। কে দেবে? তুই?”

 

  -- “আমি একা দিতে যাব কেন?” আপত্তি তুলল ছোটন। “এই দু বছর হল আমি এস. বি. আই তে চাকরি পেয়েছি। কতটুকুই বা সেভিংস করতে পেরেছি? সব যদি এখনই খরচ করে ফেলি, তাহলে হাতে আর থাকবে কী? আমার কোন ফিউচার নেই? শর্মিলার সাথে এই বছরেই এনগেজমেন্ট হওয়ার প্ল্যান আছে”।

 

  বড়দা চেঁচিয়ে উঠল- “তুমি বিয়ে করবে, মেজ এ. সি. কিনবে, তাহলে পুরো মোটটা বইবে এই বুড়ো খচ্চর? খুব চালাক, না? এই সোজা বলে দিলাম, দশ হাজারের একটা পয়সা বেশি আমি দিতে পারব না। বাকিটা তুই আর মেজ মিলে দিয়ে বন্ডে সই করে মাকে রিলিজ কর্ আর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যা। তাতে যা হবে, তাই হবে”।

 

   দুম দুম করে পা ফেলে বড়দা বেরিয়ে গেল। আমিও সোফা থেকে উঠে পলাম। দেখি, একটু সুদেষ্ণার সাথে কথা বলতে হবে। ছোটনকে বললাম- “শুনলি ত সবই। যতদিন ফেলে রাখবি, তত বেশি বিল উঠবে। কালকেই দেখি যদি রিলিজ করা যায়। মা যে এত ভোগাবে সেটা কি আর ভেবেছিলাম?”

 

   ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা রাখতেই দেখি, রত্নামাসি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা খালি ট্রে। সম্ভবত এঁটো কাপগুলো নিতে এসেছে।

 

    রত্নামাসি অনেকদিন ধরেই আমাদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। ঘর মোছা, বাসন মাজা, টুকটাক ফাইফরমাশ খাটা, এইসব আর কি। ছোটবেলা থেকেই দেখছি। এখন তো অনেক বয়স হয়ে গেছে। বাসা নিরঞ্জন পল্লীতে। ঘরভাড়া নিয়ে থাকে। একাই। বিধবা। ছেলেরা যে যার রোজগারের ধান্দায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। আমাদের বাড়ি আর অল্প দু-তিনটে বাড়িতে ঠিকে কাজ করে মাসির চলে যায়। মা কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ থাকাতে একদিন নিজেই আমাদের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল- “তুমরা যদি কও তো রেতের বেলা মাসির লগেই শুতি পারি। কহন কি অয়, কওয়া যায়? মাসি এইক্যা থাকে, আর কিছু না পারুম, জলডা তো দিতে পারুম”।

 

বড়দা গম্ভীর হয়ে বলেছিল- “সে তো হল। কিন্তু এর জন্য কত নেবে?”

 

রত্নামাসি সাথে সাথে প্রতিবাদ করেছিল- “এডা তুমি কি কও যতীন? মাসি হইল আপনজন। সেই কুন কাল থিইক্যা মাসির সাথে সম্পর্ক। সব ভুইল্যা, এহন মাসির বিপদকালে তুমাদের থিইক্যা পয়সা নিব? আমারে কি এই চিনলা?”

 

   মাসি সেইদিন থেকেই প্রতি রাতে মায়ের সঙ্গেই শুত। হসপিটালে যাবার আগে পর্যন্ত। সকালে উঠে আবার আমাদের বাড়ির কাজ করে, অন্যান্য দু একটা বাড়ি ঘুরে কিছুক্ষণের জন্য নিজের বাসায় যেত। সন্ধ্যা আটটা নাগাদ আবার আমাদের বাড়ি চলে আসত। এই দিন তিনেক দেখছি মাসি মায়ের ঘরে না থাকলেও প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় একবার করে খোঁজ নিয়ে যায়। আজও এসেছিল। আমদের বৈঠকখানায় ব্যস্ত দেখে বোধহয় অপেক্ষা করছিল। বড়দা উঠে বেরিয়ে যাওয়ার পর গুটিগুটি এগিয়ে এসেছিল কথা বলার জন্য আর এঁটো কাপগুলো নিয়ে যাবে বলে। এখন আমার সাথে মুখোমুখি দেখা। আমি বললাম- “কিছু বলবে? মা ওই একইরকম আছে”।

 

মাসি কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। বুঝলাম কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। আমি একটু নরম গলায় বললাম- “বল না, কি বলতে চাও”।

 

মাসি মুখ খুলল- “দোরের কাছে শুইনতে পাইলাম, মাসির চিকিচ্ছের নাকি খুব খরচ! তা কত লাগব, সেইডাই জিগাইতাম”।

 

আমি চুপ করে থাকলাম। কিছু বলা ঠিক হবে কিনা ভাবলাম। তারপর চিন্তা করলাম, মাসি আমাদের বাড়ি এতদিন কাজ করছে, মাকে এত ভালবাসে। মাসিকে বলা যায়। বললাম- “এখনও তো কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে নার্সিংহোমের ডাক্তার যা বলেছেন, তাতে হয়তো অপারেশন করাতে হবে। তাতে খরচ হবে…তা সব মিলে…হ্যাঁ লাখ দুই তো লাগবেই”।

 

  -- “দুই ল্যাখ ট্যাকা!”

 

  -- “হ্যাঁ, সেই হিসেবই তো হল। তাই আমরা ঠিক করেছি মাকে তাড়াতাড়ি নার্সিংহোম থেকে নিয়ে এসে মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করাব। এত খরচ কি করা যায়? আমদের সবারই ভবিষ্যৎ আছে”। আমি আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।

 

       পরেরদিন সকালে উঠে দেখি খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়ার খবরে বলেছিল বটে যে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এখন আবহাওয়ার খবর দেখছি খুব মিলে যাচ্ছে। নিচে নেমে দেখি রত্নামাসি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা পুঁটুলি। মাসি সাধারণত এত সকালে আসে না। একটু বেলার দিকে আসে। আমাকে দেখে বলল- “একটা কথা কওনের লাইগ্যা খাড়াইয়া আছি। দিন দুই-তিন থাকুম না। একটু দ্যাশের বাড়ি যাওন লাগব”।

 

   আমরা জানতাম মাসির দেশের বাড়ি, মানে বাপের বাড়ি হল গেদে। বহু বছর কোন যাতায়াত নেই। আজ আবার কী হল? বললাম- “কী ব্যাপার? তুমি আবার দেশের বাড়ি চললে কেন?”

 

    -- “যাওন লাগব। বড়দার নাতিডার অন্নপ্রাশন। বেশি দিন না, দুইদিন থাইক্যাই চলে আইব”। কথাকটা বলেই মাসি বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরল। দেখি বাইরে ভালই বৃষ্টি পছে। মাসির হাতে কোন ছাতাও দেখতে পাচ্ছি না। ভিজতে ভিজতে যাবে নাকি? আমি ডাকলাম- “ও মাসি, এই বৃষ্টিতে কেন বেরুচ্ছ? আর ছাতা কোথায়?” মাসি একটু দাঁড়াল। সিঁড়ির কাছে একটা থাম আছে। সেটা ধরে বলল- “ছাতাডা ভাইঙ্গ্যা গ্যাছে গিয়া। মাসি কইছিল বর্ষার আগে একখান ছাতা আমারে দিবে। মাসি তো হাইসপাতালে, অহন আমারে ছাতা দিব কে?”

 

মাসি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে উপরে উঠে গেলাম। আজ আমার আর ছোটনের নার্সিংহোম যাবার কথা। যদি সম্ভব হয় তাহলে বাকি পেমেন্টটা করে আজই ডিসচার্জ করিয়ে নেব মাকে। এই খরচ আর টানা যাবে না। সুদেষ্ণাকে বলা যাবে না যে বেশিরভাগ টাকা আমাকেই দিতে হয়েছে।

 

     ঘন্টাতিনেক পর যখন আমি আর ছোটন নার্সিংহোম যাবার জন্য ঘর থেকে বেরোলাম, তখন বৃষ্টি ধরে গেছে। মাসিকে দেখতে পেলাম না। মনে হয়, অনেক আগেই চলে গেছে। নার্সিংহোম পৌঁছে দেখলাম, মায়ের বাড়াবাড়ি অবস্থা। অক্সিজেন দিতে হচ্ছে, শুগারও ফল করেছে। ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে যা বুঝলাম, এই অবস্থায় যদি পেশেন্টকে শিফট করতে চাই, তাহলে সেটা খুন করা হবে। অপারেশন অনেক পরের কথা, পেশেন্টকে স্টেবিলাইজ না করে নড়ানোও যাবে না। আই. সি. ইউ থেকে আমরা দুজনে নেমে এলাম। নিচে পেশেন্ট পার্টিদের জন্য রাখা চেয়ারে বসে আমি আর ছোটন ঠিক করলাম, আরও অন্তত দুটো দিন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। এই ক্রাইসিসটা কাটলেই মাকে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাব।

 

     দুটো দিন কোনরকমে কাটল। মা একটু ভাল আছে। তৃতীয় দিন সকালে আমরা তিন ভাইই নার্সিংহোম গেলাম। আর রাখা যাবে না। যাই হোক না কেন, আজ মাকে ডিসচার্জ করিয়ে নেব। অবশ্য বন্ডে সই করে। বড়দা ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগোল বিল কত হয়েছে সেটা জানার জন্য। একটু উদার হয়েছে বড়দা। কুড়ি হাজার দিতে রাজি হয়েছে। বাকিটা আমি আর ছোটন দেব। বসে আছি। একটু পরে দেখি হন্তদন্ত হয়ে বড়দা ছুটে আসছে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বড়দা বলল- “আশি হাজার টাকা বিল হয়েছিল আজ পর্যন্ত। কেউ পুরোটা পেমেন্ট করে দিয়েছে একটু আগে। কী করে হল? তোরা কেউ দিয়েছিস?”

আমরা হতভম্বের মত মাথা নাড়ালাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম, কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। ঘুরে দেখি রত্নামাসি দাঁড়িয়ে। তোবড়ানো মুখে একগাল হাসি। হাতে একটা কাগজ। বুঝলাম পেমেন্টের রিসিপ্ট।

-- “ট্যাকা আমি দিয়া দিছি মনা”, মাসি বলতে লাগল-    “একখান কাগজ দিল ওই মাইয়াটা। ইটা তুমাদের কাছেই রাইখ্য”। মাসি রিসিপ্টটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমাদের কারুর মুখেই কোন কথা নেই। অবশেষে ছোটন মুখ খুলল-“ কিন্তু…এত টাকা! তুমি কোথায় পেলে?”

 

 -- “ক্যান? আমার জমি নাই দ্যাশের বাড়িতে?” মাসির চটজলদি জবাব। "মুখপোড়া নকুলডার অনেকদিন ধইর‍্যাই নজর ওই জমিখানের উপর। দুই বিঘা জমি। দর অবিশ্যি একটু কমই দিসে। যাক গিয়া। অহন দরদাম করনের সময় কুথায়? দলিলডা ওই মুখপোড়ারে দিয়া কইলাম, তুই ট্যাকা দে। দিন সাত পরে আবার আসতাসি, বাকি কাম কাইজ তহন হইব খন। কিচ্ছুটি চিন্তা কইরো না মনা, ট্যাকার জইন্য মাসির চিকিচ্ছে আটকাইব না”। মাসির চোখমুখ আশ্বাসের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এত উজ্জ্বল আলো আমাদের চোখে সহ্য হচ্ছে না। একটা ছাতা দরকার আমাদের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ