ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় কেচ্ছাঘটিত এক হত্যা - মোহন্ত এলোকেশী সম্বাদ


  • বই - মোহন্ত এলোকেশী সম্বাদ
  • লেখক – শ্রীপান্থ
  • প্রকাশক – আনন্দ পাবলিশার্স
  • প্রকাশকাল – মে, ১৯৮৪
  • পৃষ্ঠা – ৪৮৩

 

 

আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগের কথা। সালটা ১৮৭৩, ভারত তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। এইসময় হুগলী জেলা আদালতে এমন একটি মামলার শুনানি হয় যাতে সম্পূর্ণ দেশ কেঁপে ওঠে। শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা নয়, মামলার অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির – যা উন্মুক্ত করে দেয় তখনকার সমাজপ্রধানদের ন্যাক্কারজনক আচরণ। এই ঘটনা নিয়েই শ্রীপান্থ রচনা করেন "মোহন্ত এলোকেশী সম্বাদ"

হুগলী জেলার তারকেশ্বর, বাবা ভোলানাথের স্থান হিসাবে বিখ্যাত হিন্দু ধর্মীয় শৈবপীঠ।  তারকেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন মাধব গিরি মোহন্ত, যার প্রবল প্রতাপ, অর্থ ও প্রতিপত্তির কারণে সে তারকেশ্বর অঞ্চলের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠে। যার নজরে নারী মাত্রই ভোগ্যবস্তু। নবীনচন্দ্র ব্যানার্জির অনুপস্থিতিতে তার পরমা সুন্দরী ষোড়শী স্ত্রী এলোকেশীর দিকে মোহন্তর কুনজর পড়ে। এলোকেশীর সৎমায়ের সাথে যোগসাজশ করে এবং পুত্র সন্তানের লোভ দেখিয়ে এলোকেশীকে ফাঁদে ফেলে মোহন্ত। কথিত আছে শুরুতে এলোকেশী এই যৌন শোষণের প্রতিবাদ করলেও ধীরে ধীরে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনা বাড়ি ফেরার পর নবীনচন্দ্রের কানে গেলে সে সস্ত্রীক গ্রাম ত্যাগ করার চেষ্টা করলেও মোহন্তের ক্রূরতায় অসফল হয়। রাগে অপমানে অন্ধ হয়ে নবীনচন্দ্র একদিন ধারালো আঁশবটি দিয়ে এলোকেশীর মাথা ধড় থেকে এক কোপে আলাদা করে দেয়।

পরবর্তী ঘটনা নবীনচন্দ্রের কেস সংক্রান্ত এবং সেই কেস নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বর্ণনা করে। শ্রীরামপুরে হুগলী সেশন কোর্টে মামলাটির শুনানি শুরু হয়। নবীনচন্দ্রের পক্ষে উকিল ছিলেন ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। জনসাধারণের সহানুভূতি নবীনচন্দ্রের পক্ষেই ছিল। বাঙালী জুরিরা নবীনকে পাগল বলে সাব্যস্ত করেন এবং তাকে মুক্তি দিতে প্রার্থনা জানান, কিন্তু বিচারক ফিল্ড তাতে রাজী না হয়ে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন। তবে বিচারপতি স্বীকার করেন যে মেয়েটির বাবা-মা তাদের নিজের মেয়েকে মোহন্তের কাছে পাঠালেও ক্রমশঃ মোহন্ত এবং মেয়েটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে নাকি ঠাট্টা-তামাশাও চলত। হাইকোর্টের বিচারপতি মার্কবি-ও এটি মেনে নেন এবং সব দিক বিবেচনা করে নবীন ও মোহন্তকে দোষী সাব্যাস্ত করেন। খুনের দায়ে নবীনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং মোহন্তর তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড সহ দু’হাজার টাকা জরিমানা হয়। কিন্তু এই ঘটনায় তৎকালীন বঙ্গসমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। গুজব-কৌতুকে বাতাস ভারী হয়ে যায়। ধর্মান্ধ সমাজের নগ্ন রূপ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এই সমস্ত কিছুর নিখুঁত বর্ণনায় শ্রীপান্থ রচনা করেছেন এক অনবদ্য সামাজিক উপন্যাস।



ধর্মের আড়ালে অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজ করার প্রবণতা আমাদের সমাজে বহু প্রাচীন। সাধারণ মানুষের অন্ধ ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টার অসংখ্য ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তবে নিঃসন্দেহে যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বা যা জনসমাজে খবর হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ঘটনা বাস্তবে সংঘটিত হয়েছে যার কোনও তথ্য নেই। এই ঘটনা যুগের পর যুগ ধরেই সমানতালে সম-পরিমাণে বহমান। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে কোনও ধর্মস্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাধু-পুরোহিত-ঋষিরা অর্থাৎ ধর্মের তথাকথিত ধ্বজাধারীরা অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, এবং তাদের সন্তুষ্টি বিধান ক’রে এবং সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সমস্যাসঙ্কুল জীবনের বৈতরণী পার হওয়া সহজসাধ্য। কিছু তথাকথিত ‘সাধু-সন্ন্যাসী’ সাধারণ লোকের এই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করেই নিজেদের অনৈতিক ও অন্যায় লোভ-কামনা-বাসনা চরিতার্থ করে থাকে। তারকেশ্বরের এলোকেশী ও মোহন্তের ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ঘটনাটি ১২৮০ বঙ্গাব্দের ২৯ শে জ্যৈষ্ঠ ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায় ‘একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ