ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

শহীদ যতীন্দ্র নাথ দাস - অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়

 



শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাস যিনি যতীন দাস নামে অধিক পরিচিত, ২৭ শে অক্টোবর ১৯০৪ সালে জন্মগ্রহন করেন কলকাতার এক কায়স্থ পরিবারে। অল্প বয়সেই যতীন দাস অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন এবং ১৯২১ সালে গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। 


ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।  প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাশ করে তিনি বঙ্গবাসী কলেজে বি.এসসি পড়তে ভর্তি হন।  বি.এসসি পাঠরত অবস্থায় অনুশীলন সমিতি পরিচালিত নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার অপরাধে ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হন।  অন্যান্য বন্দীদের সাথে যতীন দাসকেও ময়মনসিংহের কারাগারে বন্দি করা হয়। 


জেলে ভারতীয় বন্দীদের রাখা হতো অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে।  জেলের রান্নাঘরে হামেশায় ইঁদুর, আরশোলা ঘুরে বেড়াতো এবং যথারীতি সেই রান্না খেয়ে বন্দীরা প্রায় অসুস্থ হয়ে পরতেন।  জেলে ভারতীয় বন্দীদের রাখা হতো অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে  থাকলেও ইউরোপিয়ানরা বেশ স্বাচ্ছন্দেই  থাকতেন।   অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যতীন দাস জেলের মধ্যে অনশন আরম্ভ করেন। কুড়ি দিন অনশনের পরে জেলের সুপারেনটেনডেন্ট যতীন দাসের কাছে ক্ষমা চেয়ে অবস্থার উন্নতি করার আশ্বাস দেওয়ায় যতীন দাস তাঁর অনশন প্রত্যাহার করেন। এই ঘটনার পর বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে যতীন দাস এক পরিচিত নাম হিসেবে পরিণত হন।  এরপর ১৯২৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে বাংলার বিপ্লবীদের সামনে আসে মিলিত হওয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ।  পাক সার্কাস ময়দানে কংগ্রেস অধিবেশনকে সামনে রেখে সুভাষচন্দ্র বসু গঠন করলেন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’।   ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’- এ যোগদান করেছিলেন বাংলার নানা প্রান্ত থেকে আসা বহু বিপ্লবী, যতীন দাসও ব্যতিক্রমী ছিলেন না।


ইতিমধ্যে ১৯২৮ সালের প্রথম দিকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো সাইমন কমিশনের ভারতে আগমনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের রাজপথে লালা রাজপথ রায়ের নেতৃত্বে যে বিশাল মিছিল হয় তাতে অংশগ্রহণকারী কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে স্যান্ডার্সের নেতৃত্বে এক বিশাল পুলিশবাহিনী।  লাঠির আঘাতে গুরুতর ভাবে আহত হন লালা রাজপথ রায় এবং কয়েকদিন বাদে তাঁর মৃত্যু হয়।   মৃত্যুর বদলা নিতে ভগৎ সিং,  সুখদেব ও রাজগুরু রাজপথে স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন।  কার্যোদ্ধারের পর তিন বিপ্লবী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান।  এই ঘটনার পর  ভগৎ সিং আসেন কলকাতায়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলার বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।  ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে ১৯২৮ সালে কলকাতায় দীর্ঘ আলোচনা হয় ‘অনুশীলন সমিতি’-র বিপ্লবী ত্রৈলোক্য চক্রবর্তীর সঙ্গে, যিনি বিপ্লবী মহলে ‘মহারাজ’ বলে পরিচিত ছিলেন। এই আলোচনার পরই ১৯২৯ সালের গোড়ার দিকে বিপ্লবী যতীন দাস আগ্রায় চলে যান ‘হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান  এ্যসোসিয়েশন’ -র সদস্যদের বোমা তৈরি করা শেখাতে। 


ইতিমধ্যেই ১৯২৮ সালে ‘পাবলিক সেফটি বিল’ নামক আইনের খসড়া কেন্দ্রীয় আইন সভায় পেশ করা হল।  এই আইনে ছিল যে ব্রিটিশ সরকার চাইলে কোনো ভারতীয়কেও ভারত থেকে বিতাড়িত করতে পারবে। কিন্তু আইনসভায় বেশ কিছু ভারতীয় সদস্যদের বিরোধিতায় এই বিল তখন পাস করানো গেল না। এই বিলের সঙ্গে আরও একটি বিল আনা হয়েছিল যার নাম ‘ট্রেড ডিসপিউটস বিল’। 

এই বিলে ট্রেড ইউনিয়ন গুলির অধিকার খর্ব করার প্রস্তাব ছিল। বিল দুটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার কিছু রদবদলদল করে ১৯২৯ এর জানুয়ারি মাসের বিল আবার আইন সভায় পেশ করবে বলে ঠিক করে। ‘হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রিপাবলিকান এ্যসোসিয়েশন’ -র কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেন যে বিলটি আইন সভায় পেশ হওয়ার দিন কেন্দ্রীয় আইন সভায় বোমা নিক্ষেপ করা হবে এবং বোমা নিক্ষেপ করে প্রতিবাদের কারণটি লিফলেটে ছেপে  আইনসভা ছড়িয়ে দেওয়া হবে, যাতে আইনসভার সমস্ত সদস্য এই প্রতিবাদের কারণ জানতে পারেন।  সভায় ঠিক হয় যে ওই বোমাটি আইন সভায় ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত নিক্ষেপ করবেন।  ১৯২৯ -র ২রা এপ্রিল পরিবর্তিত বিলটি উপস্থিত করার সময় দর্শক আসন থেকে ভগৎ সিংহ  বোমা নিক্ষেপ করেন কেন্দ্রীয় আইন সভায়।  সেইসাথে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ - ধ্বনীর সাথে  দুজনে ইশতেহার ছড়িয়ে দেন  যে ইশতেহারের বয়ান ছিল “বধির কে শোনাতে হলে জোরালো আওয়াজই দরকার।”  আদালতে তাঁদের বিচারের নামে প্রহসন চলাকালীন দুজনেই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেন যে কেন তাঁরা আইন সভায় বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন।  তাঁদের সবিস্তার বিবৃতি সেদিন আদালতে পাঠ করেছিলেন মিস্টার আশরাফ আলী। দুজনেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। 

একে একে গ্রেফতার হলেন  সুখদেব, রাজগুরু, যতীন দাস সহ আরো অনেকে।  এই মামলা চলাকালীন কিছু বিপ্লবী জেল নামক নরককুণ্ডকে বসবাসের উপযুক্ত করার দাবিতে জেলের মধ্যে অনশন আরম্ভ করলেন। ১৩ ই জুলাই ১৯২৯ লাহোর সেন্ট্রাল জেলে শুরু হয়  ঐতিহাসিক অনশন ধর্মঘট। এই অনশনের মূল দাবী ছিল লাহোর মামলার সকল বন্দীকে রাজনৈতিক বন্দী বলে গণ্য করতে হবে, বন্দীদের প্রতি মানবিক ব্যবহার করতে হবে এবং ভারতীয় ও ইউরোপীয় বন্দীদের প্রতি ব্যবহারে অসামঞ্জস্যতা দূর করতে হবে। এই অনশন ব্যক্তিগত কারণে ছিলনা।  বিপ্লবীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। 


 কিন্তু সরকারি মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।  যে কোনো ভাবেই হোক রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে, বিশেষ করে যারা বিপ্লবের পথে বিদেশি শাসনের উচ্ছেদ চেয়েছে তাদের দমন করতে ভারত সরকার তখন বদ্ধপরিকর।  ভাইসরয়ের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ইমার্সন ৬.৮.২৯ তারিখে এ সম্পর্কে ভাইয়ের কাছে যে নোট দেন, তাতেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকারি মনোভাব। 

এদিকে বন্দীদের জোর করে খাওয়ানোর জন্য এবং অনশন ভঙ্গ করানোর জন্য চেষ্টা চলতে লাগল।  এক-এক জন বন্দিকে চিৎ করে ফেলে পাঠান সিপাই দিয়ে তাদের ধরে রেখে কৃত্তিম উপায়ে খাদ্য প্রবেশ করানো হতে লাগলো।  কিন্তু বন্দী যতীন দাসের ক্ষেত্রে এই জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা সফল হল না।  অনশনব্রতী বন্দীদের মধ্যে অন্যতম শ্রী বিজয় কুমার সিংহ ১৩.৯.৬৬ তারিখের ‘ ডেকান ক্রনিক্যাল ’ পত্রিকায় লেখেন - “আমাদের মধ্যে যতীন দাসই প্রথম এই জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল। আমার মনে আছে দু’সপ্তাহের মধ্যেই ডাক্তারের সঙ্গে জনা আট পাঠান ওয়ার্ডার নিয়ে এলেন। 

 যতীন শক্তিমান যুবক।  সে প্রতিরোধ করলো।  প্রথম দিনই যতীন তাদের বাধা দিল।  কিন্তু পাঠানের দলটি তাকে কাবু করে মাটিতে শুইয়ে দিলো। 

 পরিশ্রমে যতীন হাঁফাতে লাগলো। ডাক্তারও সেই সুযোগে রবারের নলটি ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো আর তার ভেতরে আধসের মত দুধ ঢেলে দিলো।  সঙ্গে সঙ্গে যতীন ভীষণ জোরে কেশে উঠল।  ফলে রবারের নলের  ভেতরের মুখটা তার নিঃশ্বাসের নলিতে ঢুকে গেলো।  দুধের অর্ধেকটাই চলে গেল তার ফুসফুসে, যতীন অজ্ঞান হয়ে গেল।” 


২৭.৭.২৯ তারিখে আই .এম.এস অফিসার এন .ডি.পুরী আই. জি. প্রিজনকে নোট দেন- “বন্দী যতীন্দ্রনাথ দাস কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানোর চেষ্টায় প্রচন্ড বাধা দিয়েছে।  গতকাল সন্ধ্যায় এরকম চেষ্টার পরে সে অজ্ঞান হয়ে যায়।  আজ সকালে তার শরীরের তাপ ১০২ ডিগ্রি এবং নাড়ির গতি ১২০। ...  মুখ দিয়ে তাকে কোন খাদ্যবস্তু বা ওষুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না।  কৃত্তিম উপায়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করাও নিরাপদ নয়।  কারণ, জোর করলে তার শরীর অসুস্থ হতে পারে।  তাকে বিপজ্জনকভাবে পীড়িত ব্যক্তিদের তালিকায় রাখা উচিত।” 


বন্দীদের মধ্যে যতীন দাস যেন মরার জন্য কৃতসংকল্প ছিলেন।  ২-রা আগষ্ট ডক্টর গোপীচাঁদ ভার্গব যতীন্দ্রনাথের  সঙ্গে দেখা করলেন। 

৩ তারিখে জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে রিপোর্ট গেল- যতীন দাসের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ভগৎ সিংকে রাজি করানো গেছে যাতে তিনি যতীন দাসকে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন।  তিনি সে চেষ্টা করেছেন। 

 ৫- ই আগস্ট এর খবর- শুকদেব অনশন ভঙ্গ করেছেন কিন্তু দাসের অবস্থার অবনতির দিকে চলেছে। 


 ৭-ই আগস্ট এর খবর - দাসের অবস্থা গতকালের তুলনায় আরো খারাপ। তার শরীরে ঝিমুনি দেখা দিয়েছে।  ডাক্তার ভার্গবের চেষ্টায় দাস সাদা জল মাত্র পান করেছে।  গায়ের তাপ ১০০ ডিগ্রী, নাড়ির গতি ৭২ মিনিটে। 


পাঞ্জাবের গভর্নর ইমার্সনকে একটি বিস্তৃত রিপোর্ট দিয়ে লিখলেন- “আইন সভার সদস্য ডক্টর গোপীচাঁদ ভার্গব অভিযুক্তদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি মনে করেন, যতীন্দ্রনাথ দাসের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর।... 


... যতীন্দ্রনাথ দাসের ভাই জেলের মধ্যে দিনরাত তাঁর দাদার কাছে রয়েছেন।  দাসকে ওষুধ ও উত্তেজক কিছু খাওয়াবার চেষ্টা তিনিও করছেন। কিন্তু দাস অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় আছেন। তাঁর মনের ভাব পরিবর্তনের কোন লক্ষণ নেই। 

ডাক্তার ভার্গব বলেন যে, কিছু সুখাদ্য দিলে বা বন্দীদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিলে কোনো লাভ হবে না।  কারণ তাঁরা ব্যক্তিগত  সুবিধার জন্য ব্যস্ত নন। তাঁরা চান সরকারী নীতির পরিবর্তন ঘোষণা।”

 ( ফাইল নং ২৪২, পলিটিক্যাল, হোম )


যতীন দাসের প্রসঙ্গে ‘প্রতাপ’ পত্রিকার সম্পাদক গণেশশঙ্কর বিদ্যার্থী বলেন— “আমি শুনলাম যে, জোর করে তার নাকে  ও মুখে দু’দিকে দু’টি পাইপ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এক সঙ্গে দু’টি পাইপ ঢুকিয়ে দেওয়ায় প্রচুর রক্তপাত হয় এবং দাস অসুস্থ হয়ে পরে। তাকে দেখলাম প্রায় অজ্ঞান। কথা বলবার শক্তি নেই বললেই চলে।” 

যতীন দাসের অবস্থা উদ্বেগজনক হওয়ার জন্যই তাঁর ছোট ভাই কিরণ চন্দ্রকে জেলের মধ্যে তাঁর সেবার জন্য থাকতে দেওয়া হয়।


যতীন দাসের অবস্থা মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। ১৮ ই আগষ্ট তারিখে দাসের শরীরের তাপ অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালো। তিনি প্রচণ্ড বমি শুরু করেন। তাঁর অজ্ঞাতে জলের সঙ্গে সামান্য গ্লুকোজ মিশিয়ে দেওয়া হতে লাগল। ২১ তারিখে ভগৎ সিং এসে দেখা করেন দাসের সঙ্গে। ভগৎ সিং এসে কাতর অনুরোধ জানালেন একটু দুধ খাওয়ার জন্যে। কিন্তু দাস অটল। নিরুপায় হয়ে ভগৎ গোপীচাঁদ ভার্গবকে অনুরোধ করলেন যাতে তিনি যতিনকে অনুনয় করেন। ভার্গব ও পুরুষোত্তম দাস টণ্ডন  ভগৎ এবং বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে এসে তাঁকে অনুরোধ করেন।  কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই রাজী করানো গেলনা।


 ভার্গব যতীনের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন - “ যতীনবাবু, আমরা জানি মৃত্যু আপনার কাছে কিছুই না। কিন্তু আমরা চাই আপনি আর কয়েকটা দিন অন্ততঃ বেঁচে থাকুন।  আমরা আপনাকে  নীতি থেকে পেছিয়ে আসতে বলছি না। আপনার এ অবস্থায় ওষুধ খেয়ে আয়ু বাড়ানো যে আপনার যন্ত্রণাকেই বাড়ানো — তাও আমি জানি। তবু, তবু  যতীন বাবু, আরও কয়েকটা দিন মাত্র, আপনাকে জেনে যেতে হবে যে এই দুঃসহ নির্যাতন ভোগের পর জেল কমিটির সুপারিশে কি হল, কি পাওয়া গেল।”


 পণ্ডিত শান্তনম্, এবং অন্য সহযোগী বন্ধুদের সকলের  কাতর অনুনয়ে সামান্য ওষুধ খেতে রাজি হন যতীন দাস। 


২ রা সেপ্টেম্বর সোমবার বেলা পাঁচটায় ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও অন্যান্য সকলে তাঁদের অনশন ভঙ্গ করলেন। অটল রইলেন শুধু যতীন্দ্রনাথ।শরীরের যন্ত্রণাকে কাটিয়ে উঠেছেন তিনি মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। তাঁর সংকল্প, হয় গভর্নমেন্ট মেনে নেবে তাঁদের দাবি আর নইলে মৃত্যু। তখন তাঁর শরীর অবশ হয়ে গেছে। অবশ হয়ে গেছে কোমর থেকে নিম্নাঙ্গের সবটুকু। চোখের পাতা আর খোলে না। জিভ আড়ষ্ট। তব, অটুট  ইচ্ছাশক্তি।


১১-সেপ্টেম্বর জানা গেলো যে, যতীন্দ্রনাথ নিঃসাড়,সংজ্ঞাহীন।  মৃত কি জীবিত বোঝা যায় না। 


১৩ ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯। বেলা ১:০৫ মিনিট। সমস্ত জেল এক নিঃশব্দ বিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালো। সমগ্র লাহোরের মানুষ রুদ্ধ বেদনায় ভেঙে পড়লো জেলের দরজায়। ৬৩ দিন অনশনের পর যতীন্দ্রনাথ চলে গেলেন।

 

জেল কর্তৃপক্ষ যতীন দাসের মৃতদেহ ছেড়ে দেওয়ার পর শোনা যায় যে ভগৎ সিংয়ের জননী শ্রীমতি বিদ্যাবতীদেবী বলেছিলেন,“মেরে বেটে কো মেরে পাস মে লে আও” এবং যতীন দাসের মৃতদেহ লাহোর থেকে ট্রেনে কলকাতা রওনা করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত বিদ্যাবতীদেবী পাষাণ প্রতিমার মত যতীন দাসের নশ্বর দেহের  শিয়রে বসে ছিলেন। এরপর ভগৎ সিংয়ের বাড়ি থেকে মিছিল করে যতীন দাসের দেহ লাহোর রেলস্টেশনে আনা হল। সেখান থেকে পাঠানোর ব্যবস্থা হলো কলকাতায়।  এই মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন  বিখ্যাত

মহীয়সী নারী দুর্গা ভাবী।  যতীন দাসের দেহ যখন লাহোর থেকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালো তখন সেখানে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত,  নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন দাসের ভ্রাতা শ্রী কিরণ চন্দ্র দাস সহ আরো বহু মানুষ উপস্থিত ছিলেন যারা যতীন দাসকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছিলেন।  হাওড়া স্টেশন থেকে কেওড়াতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত এই মিছিল ছিল অভূতপূর্ব।  যতীন দাসের ভাতুষ্পুত্র কিরণ চন্দ্র দাসের সুপুত্র শ্রী মিলন দাসের মুখে শোনা যায় যে উপস্থিত কয়েক হাজার লোকের অনেকেই যতীন দাসের নশ্বর দেহ কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন,  তাই দস্তুরমতো শোভাযাত্রা না করে যতীন দাসের নশ্বর দেহ মানুষের কাঁধে কাঁধেই হাওড়া স্টেশন থেকে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে পৌঁছায়।  এমনকি ভিড়ের পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে ভিড়ের কারণে যতীন দাসের ভ্রাতা শ্রী কিরণ চন্দ্র দাসের মহাশ্মশানে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। 


কিরণ চন্দ্র দাস শহীদ যতীন দাসের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।  তাঁর নশ্বর দেহ আগুনে  ভষ্মিভূত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র সেই ভষ্মের এক চিমটে তুলে নিয়ে তাঁর নিজের ললাটে লাগিয়ে উপস্থিত সকলকে তাই করতে বলেন।  শহীদ যতীন দাসকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার এই ছিল এক অভিনব পন্থা।  তাঁর স্মরণে রবীন্দ্রনাথের কলম থেকে বেরিয়ে আসে এক অমর গাঁথা :-


“হে ভৈরব শক্তি দাও ভক্তপানে চাহো, 

 সর্বখর্ব তারে দহে তব ক্রোধ দাহ....”




তথ্য সুত্র: - 

আমি সুভাষ বলছি - শ্রী শৈলেশ দে, ব্রিটিশ কারাগারে সুভাষ চন্দ্র - প্রিয়তোষ মুখোপাধ্যায়, banglaasianet.com, bongodorshon.com, eisamay.com এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মেজদা শ্রী শরৎ চন্দ্র বসুর পৌত্র শ্রী অভিজিৎ রায়ের থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ