ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

করোনার আবহে দূতকন্যার স্মৃতি - সুভাষ কর

 তদিন করোনা নিয়ে আমরা সবাই ভীষণ আতঙ্কে ভুগেছি। অবশ্যি এখনো যে সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত একথা বলার জো নেই। আতঙ্কে ভোগার কথাই। মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রায় একই সময়ে সারা পৃথিবীতে ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়া এমন সংক্রামক রোগ আগে আর কখনো আসে নি। না আছে ওষুধ, না প্রতিষেধক। এমনকি সংক্রমণের লক্ষণ ধরা পড়তে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়, অথচ সেই সময়টায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের অজান্তে চোরাবাহক হিসেবে আপনপর নির্বিশেষে বহু মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলতে পারে। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি! রাষ্ট্র ও সমগ্র সমাজ মিলে এর মোকাবিলায় সচেষ্ট হয়েছি, হচ্ছি এবং আরো বেশী করে হ'ব। সর্বোচ্চ প্রয়াস আর সর্বনিম্ন ক্ষতিই আমাদের লক্ষ্য। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত সাধনায় শেষ অব্দি কিছু ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃতও হয়েছে। মানুষ তা নিচ্ছেও; কিন্তু সেগুলি নাকি ঠিক প্রতিষেধক নয়, রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তিবর্ধক মাত্র। তবুও অনেকটাই রক্ষা বলতে হবে! প্রয়োজনীয় যাবতীয় নির্দেশাবলী যথাযথভাবে মেনে এক সার্বিক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আমরা নিশ্চয় তুলনামূলক আরো বড় সাফল্য আদায় করব।

এদিকে গত ক'দিন ধরে একটা বিশেষ মানুষের মুখচ্ছবি আমার খুব বেশী করে মনে পড়ছিল। কোন মানুষেরই কি? নাকি এক দূতকন্যার? সে যে কয়েক দশক আগে ছেলেবেলায় আমাদের ছোট শহর আগরতলায় দেখা এক দিদিমণির দৃপ্ত, প্রশান্ত মুখচ্ছবি! তিনি স্কুলের কেউ ন', কিন্তু তবুও সবাই তাকে শুধু স্কুলেই দেখতাম। বছর বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম করে তিনি আসতেন- হালকা নীল পাড়ের সাদা কাপড় পরে, হাতে একটা চামড়ার বড় ব্যাগ নিয়ে। তিনি এলেই কিছুক্ষণ বাদে স্কুলের দপ্তরী-দাদা একটা নোটিশ নিয়ে ক্লাশে ক্লাশে ঢুকতেন। যে টীচার তখন ক্লাশ নিচ্ছিলেন তিনি ঘোষণা করে দিতেন, "তোমাদের নেক্সট ক্লাশটা আজ হচ্ছে না, টীকা-দিদিমণি আসবেন। সবাই ক্লাশে থেকে সুশৃঙ্খলভাবে টীকা নেবে। টীকা হয়ে গেলেই ছুটী; নীরবে যার যার বাড়ী চলে যাবে। সাবধান, অন্য কোন ক্লাশের যেন ডিষ্টার্ব না হয়। আর হ্যাঁ, টীকার ব্যাপারে টীকা-দিদিমণির সব নির্দেশ মেনে চলবে কিন্তু"।

যাই হোক, সেই বিশেষ দিনটায় তো আমরা ভীষণ খুশী! প্রথম প্রথম উপরবাহুর পেশীতে সূচ-ঢোকানো, কিংবা কব্জির উপরে কনুইয়ের নীচে হাতের পাতলা চামড়ায় "ক্রস নিডল"- এর ডাবল ঘোরানোটাকে বেশ ভয়ই লাগত। কিন্তু পরে সেই সাময়িক কষ্টগুলি সয়ে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেছল। যাদের যত নীচের ক্লাশ, তাদের তত আগের দিকে টীকা নেয়া শেষ, আর তত আগেই ছুটী। সেই সাথে জুটত এক প্রশান্তি- নানা পাঁজি রোগের আক্রমণ থেকে অগ্রিম রেহাইয়ের পরম নিশ্চিন্তি। কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা, আরো ভয়ানক কত কী রোগ!

একবার অবশ্যি বসন্তের টীকা নেবার পরেও আমার বসন্ত হয়েছিল। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের উপর খুব রাগ, অভিমান ও অনাস্থা হয়েছিল। শেষে জানতে পারি আমার রোগটা আসলে ছিল জলবসন্ত, আর টীকাটা দেয়া হ'ত গুটিবসন্তের জন্যে। মাঝেমধ্যে মুখে ছোটবড় গর্তের মতো দাগওয়ালা কিছু মানুষকে দেখতাম। জেনেছিলাম ওদের নাকি কোন একসময় গুটিবসন্ত হয়েছিল- খুব ভাগ্যগুণে প্রাণে বেঁচে গেছেন। আরো জেনেছিলাম সেইসময় গুটিবসন্তে দেশে প্রতিবছর বহু মানুষ মারা যেতেন। সর্বত্র পোষ্টার দেখা যেত, "সাবধানের মার নেই, অবিলম্বে বসন্তের টীকা লউন"।

সরকারী উদ্যোগে শীতের সময়টাতে আগেভাগেই স্কুলে স্কুলে সব ছাত্রছাত্রীদেরকে নানারকমের টীকাদানের এই ব্যবস্থাটা ছিল। আর সংশ্লিষ্ট এই দিদিমণি ছিলেন আগরতলা মিউনিসিপ্যালিটির খুব পুরনো একজন কর্মী উনার আসল নামটা কি তা বোধহয় খুব কম লোকেই জানত। সেই সময়ের ছোট রাজ্য ত্রিপুরার সেই রাজধানী-শহরটি তাকে 'টীকা-দিদিমণি' নামেই চিনত। আমি বড় হয়ে যখন মাদার টেরেসা সম্পর্কে জানলাম, তখন আমার কিছুদিন উনাকেই মাদার টেরেসা বলতে ইচ্ছে করত; কারণ দু'জনই যেন ছিলেন দুঃখের অবসান যোগানো মুক্তির দূত!

যাক, এখন আমি একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তর ছুঁয়েছি। চাকরীর পাট সেই কবেই চুকে গেছে। করোনার কারণে লকডাউনে বহুদিন নিজ হাতে বাজার করা বা অন্য সব আড্ডাবাজিও বন্ধ ছিল। ঘরবন্দী হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধুই পুরনো স্মৃতিচারণ করতাম। ঠিক তখনই কল্পনায় বা স্বপ্নে  টীকা-দিদিমণি কতবারই যে এসেছিলেন! ওকে দেখেই মনে বড় আশা জেগে উঠত। এই বুঝি এসে গেছেন আমাদের সকলের ত্রাণকর্ত্রী। আর ভয় নেই; করোনা সংক্রমণের ভয় থেকে এবার বুঝি চিরমুক্তি!

কিন্তু না, দিদিমণি ঘোমটায় মুখ ঢেকে আমাদেরকে এড়িয়ে দ্রুত আকাশপথে ভেসে আবার যেন কোথায় চলে যেতেন! বয়সের বিচারে এতদিনে তার আকাশবাসী হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবুও তিনি কেন যে বারবার ফিরে আসতেন- অন্ততঃ আসতে চেষ্টা করতেন- বুঝতে কষ্ট হতো! হয়তো বা ঘোর অন্ধকারে আশার আলোকরশ্মি জাগিয়ে রাখতেই ছিল তার সেই দেখা দেওয়া! কিন্তু সেই সময়টায় উনি যে বড়োই অসহায় ছিলেন! উনার চামড়ার ব্যাগের ভেতরে রাখা সেই বিখ্যাত টীনের বাক্সটায় পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকেই করোনার ভেক্সিন যে তখনো এসে পৌঁছয় নি!

তবে চারদিকে বিজ্ঞানীরা কিন্তু বসে ছিলেন না। ওষুধ ও ভেক্সিন দু'টোর জন্যেই জোরদার চেষ্টা চলছিল।অবশেষে স্বর্গ থেকে দূতকন্যা হয়ে নেমে আসা সেই টীকা-দিদিমণিকে আর বেশীদিন ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে আমাদেরকে এড়িয়ে চলে যাবার প্রয়োজন পড়েনি। দৃষ্টান্তস্বরূপ রেখে যাওয়া তার সেই সদিচ্ছা আর কর্তব্যের নীরব একনিষ্ঠা নতুন প্রজন্মের হাত ধরে  আবারো আরো একটা পাঁজি ভাইরাসকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করতে না পারলেও প্রায় কাবু করে ফেলেছে! ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন বিপুল উদ্ভাবনী শক্তি। আর কিছু পুণ্যাত্মা মানুষ এই সমাজকে দিয়েছেন সেই শক্তির সদ্ব্যবহারের মানসিকতা ও নিষ্ঠা। আসুন আমরা নিজেরা অন্য কোন বড় কাজ করতে নাইবা পারলাম, সবাই মিলে দিনদিন অন্ততঃ তাদেরকেই সাধ্যিমতো মদত দিই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ