ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

গ্রাস - হৃদয় আহাম্মেদ



আজ এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। ঘরে কোন মোবাইল নেই। তাই বাধ্য হয়েই স্কুলে যেতে হচ্ছে জোনাকির। জোনাকির বাবা আজ এখনো ফেরেনি; সকাল  দশটা বেজে যাচ্ছে। আজ হয়তো মাছ বিক্রি করতে পারছে না। গতকাল মাছ ধরতে যাওয়ার সময় বারবার জোনাকি মনে করিয়ে দিয়েছে সকাল সকাল বাড়ী ফেরার জন্য। ভাবনায় পড়ে যায় জোনাকি। একটু দেরিতে গেলে স্কুল বন্ধ করে শিক্ষকেরা চলে যেতে পারেন। তাহলে রেজাল্ট আর জানা হবে না। সে অপেক্ষা করতে লাগল বাবার জন্য। একসময় অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডাক পাড়লো কুদ্দুস মাঝি, জোনাকির বাবা।

"কইরে জোনাকি, মা আমার? এদিকে আয়। দেখ্ আইজ মেলা মাছ পাইছি! নে ধর মাছগুলো ঘরে নিয়া যা"।

জোনাকি কি বলবে বুঝতে পারছে না। "বাবা তোমাকে গতকাল কত করে বলে দিলাম আজ আমার রেজাল্ট দিবে তাড়াতাড়ি আইসো"

"হায়! হায়! মা, চল চল তাড়াতাড়ি চল!" এই বলে কুদ্দুস মাঝি নৌকার বৈঠাটা হাতে নিতে যাবে এমন সময় মেয়ে বাধা দিয়ে বলে,

"না বাবা, আমি ভাত রেঁধে রেখেছি। আগে খেয়ে নাও। যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো। আমি বারান্দায় ভাত বাড়ছি।"

"না না মা! তুই চল, আগে তোর রেজাল্ট জানব। মিষ্টিমুখ কইরা পরে ভাত খাব"।

মেয়ে বাবার এমন বিশ্বাস দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। 

"বাবা কিভাবে বুঝলে আমি ভাল রেজাল্ট করব?"

"করবি না মানে?  কি কস্ মা? তাইলে তুই ডাক্তার হইবি কেমনে? তুই বড় পাস দিবি দেখিস! তুই মাছগুলো বড় ডেকচিটাতে রেখে দরজাটা খিলি লাগিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়। আমি নৌকায় যাচ্ছি।"


বাবার আত্মবিশ্বাসে জোনাকি পুলকিত হলেও মনে আচমকা আশঙ্কা জাগে, যদি রেজাল্ট ভাল না হয়?তাহলে কি বাবার স্বপ্নটা ঘুমের ঘরেই থেকে যাবে?

মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে জোনাকি। দরজা লাগিয়ে বাবার পিছন পিছন চলল জোনাকি। নদীর পাড়েই নৌকা বাঁধা। ঘরের পিছন দিয়ে যাওয়া যায় নদীতে। কুলের কিনারাতে ধ্বজাভাঙ্গা ঘর। এই বুঝি যাচ্ছে নদীর বুকে। 


নদীর পাড় থেকে স্কুল এক ঘন্টার পথ। বাবা মেয়ে দুইজনে নৌকায় উঠলো। ছোট নৌকা মাছ ধরার জন্য বানানো- আবার নদী পারাপারেও ব্যবহার করা যায়। ডিঙি নৌকায় ইঞ্জিনটাও অনেক ছোট। বড় নৌকার সাথে বড় ইঞ্জিন কেনার সাধ্য কি আর কুদ্দুস মাঝির আছে? চরের জায়গার জন্য মামলা আর ঋণের ভারে কুদ্দুস মাঝি উঠেই দাঁড়াতে পারছে না!

"কি রে মা জোনাকি। তোর ভাই বোন দুইডারে দেখলাম না।  সকালে ভাত খেয়েছে তো?"

"হ্যা বাবা দুইজন কে-ই খাওয়াইছি। তারা পাড়ার ছেলেমেয়ের সাথে খেলতে বের হয়েছে। তাই হয়তো দেখোনি"

"হু মা, তুই না থাকলে পোলা-মাইয়া দুইডার যে কি হইতো!"


এই বলে কুদ্দুস মাঝি লগি ঠেলে নৌকা ভাসিয়ে দিল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে মেয়েকে ডাকল নৌকার পিছনে আসার জন্য। গোলই ভার হয়ে গেছে । পিছনে না এলে পাখার পাতা পানি স্পর্শ করবে না, আবার বৈঠাও কাজ করবে না।

জোনাকি পিছনের দিকে সরে আসতেই নৌকা পুরোদমে চলতে শুরু করল। এক ঘন্টা পর নৌকা স্কুলের ঘাটে এসে লাগলো।

নৌকাটি রশি দিয়ে বেঁধে দিয়ে কুদ্দুস মাঝি তার মেয়েকে বলল,

"মা তুই স্কুলে যা। আমি দেখি সামনে বাজার আছে ঐ হানে- ভালা মিষ্টি পাওয়া যায়।"

"বাবা এখন মিষ্টি কেন? আর তুমি টাকাই বা পাইবা কোথায়? লাগবে না মিষ্টি। তুমি আসো আমার সাথে। আমার খুব ভয় করছে"।

"দ্যাহ ঐ পাগলী  মাইয়া কয় কি? কিসের ভয় তোর? কুদ্দুস মাঝির মাইয়া ভয় পায় এই কথা হুনলে হগলে হাসবো" আর কি বললি টাকা পাবো কই? তুই জানস না তোর লাইগা রোজ বেলা পঞ্চাশ ট্যাকা কইরা জমায় রাখি। আর আইজকা মাছ বেইচা মেলা ট্যাকা পাইছি। দোকানের হগল মিষ্টি কিনবার পারুম"।

এই কথা বলে কুদ্দুস মাঝি হা হা হা হা করে হেসে উঠলো।

"আমি যাই মা তুই ভালা কইরা দেইখা আসিস কত বড় পাস দিছোস!"

"বাবার এমন অস্ফুটে বলা কথার যেন ব্যতিক্রম না ঘটে আল্লাহ তুমি সহায় হও"। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রাথর্না করলো জোনাকি।


জোনাকি ধীর পায়ে কাঁপতে কাঁপতে স্কুলে প্রবেশ করলো। সবকিছু বন্ধ; কেউ নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল। রেজাল্টের দিন ঢাক-ঢোল থাকে না। দপ্তরী এসে একটা সাইনবোর্ডে রেজাল্ট শীট টাঙিয়ে চলে যায়। আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জোনাকি দেখলো স্কুলের অফিসের সামনে একটা সাইনবোর্ডে রেজাল্ট শীট ঝুলানো। প্রথম থেকে নাম দেখতে শুরু করলো। কয়েকটা নাম দেখার পর খুঁজে পেল জোনাকির নাম। নিজের নামের পাশে রেজাল্ট দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় জোনাকি। স্তব্ধ চারদিক- চোখের কোণায় জল বিন্দু। এই বুঝি টপ করে মাটিতে পড়বে। চোখের কোণার জল বিন্দুটা বড় হতে হতে ঝাপসা লাগছে চারদিক। সেখানে আর এক মুহুর্তও থাকে নি  জোনাকি। দৌড়ে চলে আসে নদীর পাড়ে। 


নৌকার কাছে এলে জোনাকি দেখে, নৌকায় বাবা আর দপ্তরী খৈলেশ বাবু বসে আছে। সামনে অনেকগুলা মিষ্টির বাক্স। 

"তুই আইছিস মা? আয় আয়। নৌকায় আয়। দেখ্ দেখ্, আমি কতলা মিষ্টি আনছি? মাস্টার মশাইরে আমি তোর আগেই মিষ্টিমুখ করাইছি। এহন তুই আয় তরে মিষ্টি খাওয়াই। কি হইল আয় না ক্যান? আয়!

জোনাকি দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঝাপটে ধরে জোর গলায় কান্না করতে লাগলো। এতক্ষণ যাবৎ কান্না করছে। চোখ ফুলে গেছে। কথা বলতে গেলে সুর আসে না। জোনাকি চিৎকার করে বলল, 

"বাবা আমি পাশ করি নাই।  আমি ফেইল করেছি?"

"দেখো আমার পন্ডিত মাইয়ার কারবার দেখো! তুই কি মাস্টরের থেইকা বেশি বুঝস? বাজারে গিয়া মাস্টরের থেইকা তোর আগেই রেজাল্ট জানছি। পরে মাস্টররে লইয়া ই তো মিষ্টি কিনলাম। মাস্টররে লইয়া আজকা সারা পাড়ায় মিষ্টি দিমু কইরা সাথে লইয়া আইছি। মাস্টর আমারে কইলো না? তুই বড় পাশ দিছোস! 

 

"কিয়ো মাস্টর সাব কথা কওনা ক্যান? মাইয়া আমার কি কয় এইসব? ও নাকি ফেইল করছে?"

বাবার এমন কথা শুনে জোনাকি একটু অবাক হল। খৈলেশ বাবু জোনাকির বিচলিত চেহারা দেখে বলে- 

"অবাক হইয়ো না জোনাকি। 

তুমি নৌকায় আসো। তোমাকে কে বলল, তুমি ফেইল করছো?" 

কুদ্দুস মাঝি মনমরা মেয়ের চোখের পানি তার নিজের ছেঁড়া গামছা দিয়ে মুছে দিয়ে,নৌকায় নিয়ে এল।

"মাস্টর তুমি এই পাগলী মেয়েকে বুঝাও তো দেখি"।

খৈলেশ বাবু জোনাকির হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে নরম সুরে বলল, 

"তুমি কি জানো তুমি স্কুলের সেরা রেজাল্ট করেছো?"

জোনাকি মুখ উপরে তুলে দপ্তরির দিকে তাকিয়ে বলল,

"কি বলেন স্যার? আমি তো নিজের চোখে দেখে আসলাম আমি ফেইল। আমার নামের পাশে অকৃতকার্য লেখা।" 

খৈলেশ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, পরে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই বললো-

"আরে বোকা মেয়ে ঐটা তো হানিফা ছিল। তোমার ক্লাসমেট হানিফার রেজিষ্ট্রেশনে নাম দেওয়া হইছে জোনাকি। তুমি তো আমাদের স্কুলের মান রেখেছো। 

এই দেখো তোমার রেজাল্ট।"


খৈলেশ বাবু সামনে রেজাল্ট শীটের মূল কপিটা দেখালো। সত্যিই তো। একমাত্র জোনাকি জি.পি.এ -পাঁচ পেয়ে স্কুল সেরা রেজাল্ট করেছে। রেজাল্ট দেখে জোনাকির চোখে আবার জল চলে এল। ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো। এই কান্না সুখের কান্না। সুখের সময় এই কান্নাটা চিরন্তন সত্য। কিন্তু বাবা আর কাঁদতে দিলো না জোনাকিকে। জড়িয়ে নিল বুকে।

"বাবা আমি পাশ করেছি। আমি ফেইল করিনি।"

মেয়ের কান্না দেখে কুদ্দুস মাঝির চোখেও জল টলমল করছে-

"হু মা,আমি আগেই জানতাম তুই বড় পাশ দিবি। আর কাঁদবি না কইলাম। নে মিষ্টি খা। আইজ আমি পাড়ার সবাইরে মিষ্টি খাওয়ামু। আমার মাইয়া বড় পাশ দিছে। আবার বড় একটা ডাক্তারি পাশ দেওয়ার লাইগা যেন দোয়া করে সবাই। কি মিয়া মাস্টরমশাই, মাইয়া আমার ডাক্তারি পাশ দিবার পারবো তো?"

কুদ্দুস মাঝির এমন সরলতা আর আত্মবিশ্বাস দেখে খৈলেশ মুচকি হেসে বললো-

"পারবো মাঝি পারবো। জোনাকি একদিন বড় ডাক্তার হইবো।  আমাদের জোনাকির সব সাব্জেক্টেই ভাল রেজাল্ট আছে। জীব বিজ্ঞানে বেশি মার্ক পাইছে। গঞ্জের ভাল একটা কলেজে ভর্তি করায় দিও।"


বাড়ী ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। খৈলেশ বাবুকে সাথে নিয়ে সমস্ত পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করছে জোনাকির বাবা। এ যেন এক অন্যরকম আনন্দ। এ গ্রামের গর্ব জোনাকি। জোনাকি একদিন বড় ডাক্তার হবে। কুদ্দুস মাঝি সবার মাঝে শুধু এই কথাটাই ছড়িয়ে দিচ্ছে। মিষ্টি বিতরণ শেষের দিকে। মনে পড়লো জোনাকির দাই মা'র কথা। উনাকে যে মিষ্টি পাঠাতে হবে। 

"আচ্ছা খৈলেশ বাবু, চল তোমাকে ফিরায় দিয়া আসি। অনেক তো কষ্ট করলা। ঘরে ভালা মন্দ রান্ধন নাই যে তোমারে চাইডা খাওয়াই দিমু। একদিন আবার দাওয়াত কইরা আনমো নে বাবু। গরীবের বাড়ী আইবা তো মিয়া?"

কুদ্দুসের কথা শুনে খৈলেশ অবাক হয়ে ভাবে-

"কেমন নির্দ্বিধায় সব স্বীকার করে ফেলে! কোন রহস্য নাই মানুষটার মনে। ঘরে খাবার নেই, বলতে একটুও সংকোচ করে নাই। কি স্পষ্টতা! এত কষ্টের  মাঝেও মেয়েকে নিয়ে ঘুম হারাম স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে মানুষটা। নেই বিশ্বাসের একটু ঘাটতি? এ যেন মহাসমুদ্রে দ্বীপ জাগার আশা। বাবারা সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে আবার বুনায়। কুদ্দুস মাঝি স্বপ্ন বুনাচ্ছে"।

খৈলেশ কুদ্দুসের আন্তরিকতার ছোঁয়ায় আপ্লুত হয়ে বলে-

"কি যে বল মাঝি, তোমার বাড়ী আসবো না তো কার বাড়ি আসব?"

পুলকিত মাঝিও প্রতিক্রিয়া দেয়-

"এ আমি জানি, তোমার মনের ব্যাপারই আলাদা"।


কুদ্দুস মাঝি যাওয়ার সময় জোনাকিকে বলে গেছে

জোনাকি যেন তার দাই মা'র কাছে মিষ্টি নিয়ে যায়।

জোনাকি আরিফাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। আরিফা জোনাকির ছোট বোন। ছয় বছর বয়স।

"শাকিলটা আবার গেল কোথায়?"

এমন সময় শাকিল শরীরে কাঁদা মাখা অবস্থায় কোথা থেকে যেন এলো।

শাকিলকেও নিজ হাতে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে জোনাকি। এ যেন মায়ের জায়গায় অভিনয় করে যাচ্ছে। 

বেলা দেরি হয়ে যাচ্ছে। দাই মা'র বাড়ী মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে জোনাকি। দাই মা'কে রেজাল্টের খবর দিয়ে মিষ্টিমুখ করালে দাই মা বলতে লাগলেন, 

"আইজকা সখিনা বাইচ্চা থাকলে কত খুশি হইতো! মাইয়ার বড় পাশ দেওয়ার খবরটাও জুটলো না। হায়রে কপাল!" 

সখিনা, জোনাকির মা গত দুই বছর আগে আরিফাকে জন্ম দিতে গিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। জোনাকির মা মারা যাওয়ার পর থেকে জোনাকিই এই সংসারের সব কাজ করে।  আরিফাকে দুই বছর এই দাই মা লালন পালন করে করে রাখে। দাই মায়ের কাছে নিজের মায়ের বেঁচে থাকার এমন আকুতি শুনে নিজেকে সামলাতে পারে না জোনাকি। অঝোর ধারায় গাল বেয়ে জল পড়তে লাগল। নিয়তির এই খেলা জোনাকি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। 

"মা আমি যাই। রান্না করতে হবে। বাবা মনে হয় চলে আছসে।" এই বলে জোনাকি বাড়ি ফিরে এল।

ঘর-দোর গুছিয়ে ভাই-বোন দুইটাকে পড়াচ্ছে। এমন সময় জোনাকির বাবা এলো। ক্লান্ত দেহ। গতরাতে সমস্ত রাত মাছ ধরেছে। আজকে সারাদিন একটুও বিশ্রাম নেই। এমন ভাবে চললে সুস্থ মানুষের অসুস্থ হতে বেশি সময় লাগে না।

"বাবা তুমি গোসল করে আসো। আমি তোমার জন্য ভাত বাড়ছি। "

রাত প্রায় নয়টার দিকে কুদ্দুস মাঝি মেয়েকে নিয়ে ভাত খেতে বসলো। প্রচন্ড গরম পড়েছে। ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঝড় হওয়ার আগে গরম একটু বেশিই হয়। নদীর পাড়ে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। হাত পাখায় বাবাকে বাতাস করছে জোনাকি।

"মা তুই খেয়েছিস? তোর ভাই বোন দুইডা কি খাইছে?"

"হু বাবা খাইছি। আরিফা আর শাকিলও খাইছে।"

মেয়ের জবাব শুনে বাবা তাকালো মেয়ের দিকে।মনমরা মেয়ে। চোখে দুশ্চিন্তার চাপ। কি যেন হারানোর ভয়। চোখের কোণে জল দেখে কুদ্দুস মাঝি জিজ্ঞেস করলো-

"কিরে মা কাদছিস কেন?"

"বাবা আমি আর পড়াশোনা করব না। ভাল কলেজে ভর্তি হতে অনেক টাকা লাগবে। তুমি এত টাকা পাবে কোথায়? আমি তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা"। 

"দেখ্ জোনাকি আমার সামনে এমন অলক্ষুণে কথা বলবি না। তুই জানিস না?  তোর মা'য়  তোর জন্য ট্যাকা জমায় রাখতো সবজি বেইচা। আমিও তো ট্যাকা জামাইছি। মেলা ট্যাকা আছে। আর তোর মা'র গয়না আছে না কদ্দুর? এইডা না'য় বেইচা দিমু!" তোর এইসব নিয়া ভাবতে হইবো না। তুই শুধু একটা বড় ডাক্তারি পাশ দিবি। আর কিছু চাই না। তোর মায় আইজ বাঁইচা থাকলে কতকিছু করত। মানুষটা কেমনে চইলা গেল বুঝবার পারলাম না। আইজ যদি গাঁয়ে একটা ডাক্তার থাকতো, তাইলে তোর মায় আর মরতো না। তুই মা ডাক্তার হইয়া আমগোর চরের জায়গায় একটা হাসপাতাল দিবি। এই গাঁয়ের মানষের সেবা করবি। করবি না? বল?"


বাবার এমন স্বপ্নের বাস্তবতা কি জোনাকি জানে না। শুধু বাবার বিশ্বাসের উপর ভর করে সামনে এগুচ্ছে।

"বাবা দোয়া করো তোমার স্বপ্ন যেন আমি পূরণ করতে পারি"।

বাবা মেয়ের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আচমকা ঝড়ের আবেশ। প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছে; এই বুঝি ঘরটা আকাশে উড়লো। ঘরের খুঁটি এত শক্ত না। শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। ঘরের চালের কয়েকটা ছিদ্র দিয়ে টপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কয়েকটা পাতিল সেখানে সেঁটে দেয় জোনাকি। কুদ্দুস মাঝি হঠাৎ লক্ষ্য করলো ঘরের এক কোণের মেঝেতে অনেক বড় একটা  ফাটল তৈরী হয়েছে। একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের চালাটা কোথায় যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। মূহুর্তেই উদলা হয়ে গেল সব। 

আরিফা আর শাকিল চিৎকার করে উঠে বসল। সবাই ভিজছে। এমন সময় কুদ্দুস মাঝি বুঝতে পারলো ভিটা বাড়িটি এখন এই মেঘনা গ্রাস করবে। তাড়াতাড়ি আরিফ আর শাকিলকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। জোনাকিও বেরিয়ে পড়লো তাদের সাথে। বৃষ্টির পানি আর ঝড়ের বেগ যেন সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের সব হালকা আসবাবপত্র। কুদ্দুস মিয়ার চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে তার বাপের ভিটাটি। 

অকস্মাৎ কুদ্দুস মাঝির  মনে পড়লো তার জমানো টাকাগুলির কথা। মাটির নিচে একটা বড় পাতিলে টাকা রাখত। বউয়ের সোনাগুলোও ছিল সেখানে। মেয়েকে ডাক্তারী পড়ানোর খরচ এই টাকা। টাকাগুলি আনতে যাবে এমন সময় বাঁধা দেয় জোনাকি। বাবাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। জোনাকির চোখে মুখে বাবাকে হারানোর ভয়! সাথে শাকিলও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আরিফা যেন না বুঝেই কান্না করছে বাবার গলা জড়িয়ে। পাড়ার সবাই যার যার ভিটা নিয়ে ব্যস্ত কেউ কাউকে সাহায্য করছে না। মেয়ের কাছ থেকে নিজেকে ছোটাতে পারছে না কুদ্দুস মিয়া। 

হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো কুদ্দুস মিয়ার ভিটাবাড়িটি এক নিমিষেই নদীর গহ্বরে চলে গেল। চোখের সামনে সব শেষ। প্রকৃতি ধংসে আরও তীব্র হয়ে উঠলেও বাবা মেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন কথা হচ্ছে না। বৃষ্টির পানিতে মিশে যাচ্ছে চোখের জল। দেখা যাচ্ছে না নীরবে বেয়ে পড়া চোখের জলকে। বাবা মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে। সাথে ছোট ছোট বাচ্চা দুইটাও। কুদ্দুস মিয়ার চোখে ঘুম নেই দুই রাত। মা মরা তিনটা সন্তান নিয়ে কোনভাবে অন্যপাড়ার তাহেরের রান্নাঘরে ভয়ানক রাতটা কাটায় কুদ্দুস মাঝি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ