পর্ব - ২
প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।কমার্শিয়াল আর্টের প্রতি আগ্রহ ছিল বলেই বিজ্ঞাপনের জগতে চাকরি গ্রহন করেন সত্যজিৎ রায়। সেই সময় আর্ট-ডাইরেক্টর ছিলেন প্রবাদ প্রতীম শিল্পী অন্নদা মুন্সী। এনার ছত্রছায়ায় সত্যজিৎ রায় শিখতে শুরু করলেন লে-আউট, ইলাস্ট্রেশন, টাইপোগ্রাফি, লোগো ডিজাইন সহ বিজ্ঞাপন জগতের বিভিন্ন কাজ। ইংরেজ অধ্যুষিত দেশে তখন বিজ্ঞাপন জগতে বিদেশী শিল্পের অনুকরণে মত্ত দেশীয় বিজ্ঞাপন জগত। প্রায় সমস্ত শিল্পীরাই পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত থাকতেন। সত্যজিৎ রায় সেই জায়গায় দেশীয় শিল্প ঐতিহ্যের ধারায় নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে সুচনা করলেন এক নতুন বিজ্ঞাপনী ধারার।বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনেও সেই ছাপ পূর্ণ মাত্রায় চোখে পড়তে লাগল। শুরু করলেন তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের- বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনের মাধ্যমে। তাঁর জীবনীকালে তিনি প্রায় নব্বইটি বইয়ের প্রচ্ছদ রচনা করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি নিয়ে আজ বলব।


সুকুমার রায়ের নাটকের সংকলন ‘ঝালাপালা‘ বইতেও পাখোয়াজ বাজিয়ের চেহারার মধ্য দিয়ে বেশ একটা কৌতুক ভাব এঁনেছিলেন। সেই সঙ্গে বইয়ের নামও যেন বেশ তাল মিলিয়ে দিচ্ছিল ।বইয়ের মূল চরিত্র রামকানাই চরিত্রটি ছিল পাখোয়াজ বাজিয়ের। সে গান গেয়ে ও পাখোয়াজ বাজিয়ে সবার কান ঝালাপালা করে দিত – এই বোঝাতে রামকানাই-এর সিরিঙ্গে গলা এবং হাতের বেখাপ্পা ভঙ্গী এঁকেছিলেন।সঙ্গে মুখ থেকে বেড়িয়ে আসা তিন ফোঁটা থুতু তার লাগামহীন উচ্ছ্বাসকে স্পষ্ট করে তুলেছিল। যা হাস্যরসের সৃষ্টি করে।
সুকুমার রায় “আবোল তাবোল” বইয়ের প্রচ্ছদ নিজেই এঁকে গেছিলেন। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে সত্যজিৎ রায়কে এই বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে বলা হলে, তিনি মূল ছবির অনুকরণেই ছবি অঙ্কন করেন। দেখে বোঝা মুশকিল ছিল যে এটি সুকুমার রায়ের আঁকা নয়। কিন্তু বাবার ছবির অনুকরণে আঁকতে গিয়ে আবেগ বিসর্জন করতে পারেন নি সত্যজিৎ। তাই এই প্রচ্ছদ মূল প্রচ্ছদের ছায়া হয়ে রয়ে যায়।
তবে বাবা ছেলের সেরা যুগলবন্দী ১৯৫০ এর প্রকাশিত ছড়া সংকলন “খাই খাই” বইতে।এখানে মূল বিষয়টি ছিল নেমন্তন্ন বাড়িতে হই হই করে সবাই খাবার খাচ্ছেন।এই প্রচ্ছদেও দেখা যায় নেমন্তন্ন বাড়িতে পাত পেড়ে খাচ্ছেন কয়েক সারি গ্ৰাম্য মানুষ। সামনে পরিবেশনকারীদের হাঁকডাঁক এবং সবার আলাদা আলাদা ভাব ভঙ্গি । এক চূড়ান্ত হ্যাংলাপনার চিত্র।মাত্র তিনটি রঙেই প্রচ্ছদে গোটা বিশৃঙ্খল পরিবেশটিকে নিঁখুতভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন।এমন ভিজুয়্যাল বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে আগে ভাবাই যেত না।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় লীলা মজুমদারের লেখা “পদিপিসির বর্মিবাক্স”। একশো বছর আগে পদিপিসির কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া বাক্সটি দামী দামী মণিমুক্তোয় ঠাসা ছিল।যা উদ্ধার করার কাহিনী নিয়েই বইয়ের গল্প। এই বইয়ের প্রচ্ছদে শুধুমাত্র মেটে লাল রং দিয়ে এঁকেছিলেন একখানা প্যাঁচালো ড্রাগণ স্বরূপ হাঙ্গর, যার উল্লেখ গল্পে পাওয়া যায়। ডিজাইনটাও বাক্সের ঢাকনার মতো।এক রঙে আঁকা বাক্স আকৃতির প্রচ্ছদ পাঠকমনে রহস্যের এক বিশেষ অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
মাত্র
বাইশ বছর বয়সের তুলনায় সত্যজিৎ রায়ের ভাবনা ছিল এক্ষেত্রে অভাবনীয় ও অতুলনীয়
এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।হ্যাঁ সাধারণ শিল্পীরা প্রচ্ছদ আঁকার ক্ষেত্রে বইয়ের
মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে মানানসই কোনো ভিস্যুয়ালের মধ্য দিয়ে যথা সম্ভব ফুঁটিয়ে
তোলার চেষ্টা করেন। এইখানেই সত্যজিৎ হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ।তাঁর
ব্যক্তিগত শিক্ষা, রুচি ও অনুভূতির সাহায্যে তিনি গড়ে
তুলেছিলেন ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশনের সম্পূর্ণ এক নিজস্ব ধারা।
সিনেমায় যুক্ত হওয়ার আগে ছবি আঁকাই ছিল তাঁর এক মাত্র জীবিকা, তাই তিনি একে নিয়ে অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষাও করেছিলেন। তারপর তিনি যখন সিগনেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলেন তখন তিনি তাঁর প্রতিভা প্রকাশের একমাত্র চাবিকাঠিরূপে অঙ্কন শিল্পকে হাতে পেয়েছিলেন। সিগনেটেই তিনি তাঁর জীবনের প্রায় সবকটি প্রচ্ছদ সৃষ্টি করেছিলেন।
সিগনেট থেকে তাঁর
প্রকাশিত প্রথম প্রচ্ছদ ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'ক্ষীরের পুতুল ' নামক ছোটোদের
রূপকথাধর্মী গল্প।একদম গোড়ায় সিগনেটের জন্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কয়েকটি বইয়ের
প্রচ্ছদ আঁকেন সত্যজিৎ। যার মধ্যে ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘ক্ষীরের পুতুল ‘ ।এই
প্রচ্ছদটিতে দেখা যায় একটা লৌকিক সমাজ । যেখানে বর সেজেগুজে টোপর মাথায় দিয়ে
বসে আছে। পাশে রাখা গোড়েমালাটি অনেকটাই ফুলের আকৃতি নিয়েছে। ব্যাকগ্ৰাউন্ডে লাল
ও হলুদ রঙের আভা যেন একটি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আভাস দিচ্ছে। তাছাড়াও প্রচ্ছদের
নীচে বই ও লেখকের নাম লেখা রয়েছে কিছুটা আলপনার মতো করে।
কয়েক বছর পর আবার এই ক্ষীরের পুতুল গল্পের বইটি পেপারব্যাক সংস্করণ থেকে দ্বিতীয় বার প্রকাশিত হয়েছিল সেই বইটির প্রচ্ছদও সত্যজিৎ রায় এঁকে ছিলেন।লাল ও সবুজ দুই রঙের ব্যবহারে পালকি চেপে বর বিয়ে করতে যাচ্ছে, সাথে বেহারা। আনাক্র মধ্যে ছোট ছোট মোটিফের দুর্দান্ত কাজ ভারতীয় অঙ্কন শিল্পের ছোঁয়া বয়ে আনে। এরপর এই বইয়ের আরও কয়েকটি সংস্করণ বের করা হয়। প্রত্যেকটির প্রচ্ছদই সত্যজিৎ রায়ের আঁকা।
এছাড়াও তাঁর আরও একটি উৎকৃষ্ট প্রচ্ছদের নিদর্শন ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের ‘ কুমায়ুনের মানুষ খেকো বাঘ ‘ বইটির পিঠোপিঠি আঁকা প্রচ্ছদে , করবেটের বাঘ শিকার ,জঙ্গল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখা বইতে রোমাঞ্চকর ছবির সমাহারে প্রচ্ছদ আঁকার বদলে তিনি আঁকলেন সামনে আর পিছনে দু’দিক মিলিয়ে দেখলেন বাঘের গায়ে গুলি লাগার দাগ। দু’পিঠেই হলুদের ওপর কালো ডোরা ডোরা আঁকা।এখানেই সত্যজিৎ নজর রেখেছিলেন খুব জরুরি একটি ডিটেলস এর দিকে। যেহেতু গুলি বেরবার গর্তটা তুলনায় একটু বড় হয়, সেই হিসেবে পিছনের গুলি লাগার অংশটিও বড় করে দেখান। ছিদ্রপথে বইয়ের নাম ও লেখকের নাম লিখে দেন।
১৯৪৮ সালে “হাতে খড়ি” বইটির প্রচ্ছদও তাঁরই ডিজাইন করা।’ দীপঙ্কর ভবন’ থেকে প্রকাশিত বিমলচন্দ্র ঘোষের লেখা ছোটদের অ-আ-ক-খ শেখানোর এই ছড়ার বইটিকে দেখতে হলুদ ফ্রেমের মাঝে কালো অংশের বইয়ের মত আঁকা হয়।যার নাম ও কিছু ছবি আঁকা ঠিক বাচ্চাদের মতো করে ।এটি বইয়ের মাপে লম্বায় ও চওড়ায় ঠিক একটা স্লেটের মতো দেখতে। যাতে বাচ্চারা এটিকে স্লেটের মতো ভাবে।চার কোণকে গোলাকার করে কেটে, প্রচ্ছদের দুই পিঠেই রঙের ফ্রেম এঁকে, মাঝের অংশকে স্লেটের রূপ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে শিশুদের হাতে লেখার অনুকরণ থেকে শুরু করে ক্যালিগ্রাফি করে লেখাও রাখেন। যেন মনে হয় অনুশীলনের মাধ্যমে হাতের লেখার উন্নতি সাধন ঘটেছে। এই প্রচ্ছদ পাঠক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
এরপরের সময়ে তিনি ‘ পথের পাঁচালি’ পড়েননি ঠিক এমতো অবস্থায় মূলত দিলীপ কুমার গুপ্তের সিগনেট প্রেস থেকে ‘ পথের পাঁচালির ‘ একটি কিশোর সংষ্করণ ‘ আম আঁটির ভেঁপু ‘ নাম দিয়ে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তখনও তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত “পথের পাঁচালি” পড়েন নি। প্রচ্ছদ অঙ্কনের জন্য তিনি বইটি পড়লেন এবং এই বই পড়ার সময়েই তাঁর এই বই নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করার চিন্তা শুরু হয়। এই ‘ আম আঁটির ভেঁপু ‘ বইটির প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে কালো ব্যাকগ্ৰাউন্ডের উপর হলুদ রঙের এক আভা। যা গ্ৰাম্য রাস্তা ও পরিবেশকে চিহ্ণিত করে। আর ঠিক এই রাস্তা দিয়ে কিশোর কিশোরী হেঁটে চলেছে । হাতে কাশফুল নিয়ে। বইটির উপর রয়েছে লেখকের নাম সহ সুন্দর ডিজাইন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “বুড়ো আংলা” বইয়ের প্রচ্ছদে সাদা জমির উপর ছাই রং ও লাল রঙের সাহায্যে জ্যামিতিক আকৃতি ও আলপনা দিয়ে অপূর্ব রূপদান করেছিলেন।
১৯৬১ সালে দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সম্পাদিত শিশুতোষ পত্রিকা, যেটি যোগ্য সম্পাদকের অভাবে বহু বছর প্রকাশনা বন্ধ ছিল, সেই “সন্দেশ” পত্রিকার পুনঃপ্রকাশ শুরু করেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে সন্দেশকে ‘রাজকুমার' করে সাজিয়ে তুললেন নতুন মোড়কে, নতুন পোশাকে, নতুন মলাটে বেঁধে।
এই
পত্রিকার যাবতীয় প্রচ্ছদ সত্যজিৎ রায় নিজে আঁকতেন। ছোটদের উপযুক্ত রং-বেরঙের
বিভিন্ন চরিত্র দিয়ে ভরিয়ে তুলতেন সন্দেশের প্রচ্ছদ। সন্দেশের প্রচ্ছদে পত্রিকায় নামের তিনটি
অক্ষর দিয়ে কখনও ঘোড়া বা কখনও হাতির মতো নানা মজার ডিজাইন
করে শিশু সহ বড়দেরও চমক দিয়েছেন।
এছাড়া স্বরচিত ফেলুদা ও প্রফেসর শঙ্কুর বইয়ের যাবতীয় প্রচ্ছদও তিনি এঁকে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে এই সব বইয়ের প্রচ্ছদে বিভিন্ন পরিবর্তন সাধন করে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করে গেছেন সেই সব গল্পের রহস্যগুলির। তাঁর যাবতীয় প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিল ‘ আনন্দ পাবলিশার্স ‘ ।
ফেলুদার গোয়েন্দা গল্পে অদ্ভুত এক দু:সাহসিক
ঘটনা ও পরিবেশ ফুটিয়ে তোলেন তাঁর প্রচ্ছদের মধ্য দিয়ে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে
না।যদিও পরবর্তীকালে ফেলুদার প্রচ্ছদে তাঁর দুই সাগরেদ ‘ তোপসে ও জটায়ু ‘ নিয়মিত হাজির
থাকলেও একদম শেষে ধীরে ধীরে এঁদের দেখাই যায় না।
ঠিক তেমন ভাবেই অন্যদিকে ১৯৮৩ তে ‘ প্রফেসর
শঙ্কু ‘ এঁর প্রচ্ছদে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞান জার্নালের পাতার টুকরো
দিয়ে বানানো হয়েছে তাঁর চুল, দাড়ি, গোঁফ! কিংবা তাঁর নিজের
তৈরি রোবটের কাঁধে হাত রেখে নিজস্ব গবেষণাগারে তিনি একা দাঁড়িয়ে।
এই সময়েই তিনি লেটারিং-এর সাহায্যে নানা ধরণের পিকটোগ্রাফ জাতীয় আঁকা বহু ক্ষেত্রে তাঁর প্রচ্ছদে ব্যবহার করে প্রচ্ছদ্গুলিকে এক অসাধারণ আকর্ষণীয় রূপ দিতে থাকেন। এঁকেছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রচিত “ছোট্ট রামায়ন” এবং “গুপী গাইন বাঘা বাইন”, পুন্যলতা চক্রবর্তীর “ছোট ছোট গল্প”, লীলা মজুমদারের “টং লিং” এবং “ মাকু” , অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ রাজকাহিনী” প্রভৃতির মত আরও বহু বিখ্যাত শিশুতোষ বইয়ের।
শিশুতোষ বই ব্যতীত তিনি বহু প্রাপ্তবয়স্ক
বইয়ের প্রচ্ছদ রচনা করেন। যেমন জীবনানন্দ
দাশের “ধূসর পান্ডুলিপি” ও “রূপসী বাংলা”, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের “ ইন্দ্রানী”, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের “অর্কেস্ট্রা”, বিভূতিভূষণের “চাঁদের
পাহাড়”,প্রমদারঞ্জন রায়ের “ বনের খবর”
মৃণাল সেনের “চার্লি চ্যাপলিন”,
জহরলাল নেহেরুর লেখা “ The Discovery of India” প্রভৃতি
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জীবনানন্দ দাশের লেখা “বনলতা সেন” বইটির প্রচ্ছদ আঁকেন তিনি। ‘বনলতা সেন’ বইটির প্রচ্ছদ ছিল এক নারী মুখ।যেটি ঘন লতাপাতার মধ্য দিয়ে, সরু সরু লাইন বেরিয়ে আসা, এক বাঙালি নারীর কোমল মুখ। এখানে কবির রোমান্টিকতার সাথে এক অদ্ভুত সুন্দর মেজাজ যেন মিশে গেছে।
ক্যালকাটা পাবলিশার্সের জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “স্মৃতির রেখা” বইয়ের প্রচ্ছদে বই ও লেখকের নাম লেখা দেখলে মনে হবে যেন, এক ক্লান্তি ও বিষন্নতা ভাব। সব মিলিয়ে এক সুন্দর ছন্দ বজায় রেখেছেন। নি:সন্দেহেই তা অত্যন্ত অর্থবহ।
সত্যজিৎ রায়ের তৈরি সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচ্ছদ হল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা “পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ”। এই প্রচ্ছদটি সম্পূর্ণ নামাবলীর গড়নে তৈরি করেছিলেন।যেখানে তিনি সহজেই শ্রীরামকৃষ্ণের চিত্র আঁকতে পারতেন, সেখানে তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতির দ্বারা সংস্কৃতি ও বাংলার ঐতিহ্যের মিল ঘটান ।প্রচ্ছদটির মাঝে নামটি লিখেছিলেন পুঁথির আদলে। যেন চিরন্তন আধ্যাত্মিক পরম্পরা , যার মাঝে এসে দাঁড়ালেন কাল অতিক্রম করে যাওয়া দার্শনিক পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ ।
১৯৫২ সালে নরেশ গুহের কাব্য সংকলন “দুরন্ত দুপুর” বইয়ের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করা হয়েছে ওই নামের কবিতাটিকে নিয়েই ।এর পুরোটাতেই রয়েছে কাঁচা হলুদ রঙের ওপর সরু লাইন আঁকা ঘুমন্ত এক নারী। খোলামেলা শরীরী ভঙ্গিমায়। এখানে সত্যজিৎ ফরাসি শিল্পী আঁরি মাতিসের ন্যায় সাবলীল ছন্দময়তাকে ধরতে চেয়েছেন।
১৯৫৩ সালে তাঁর আঁকা আর একটি মনে রাখার মতো নারী মুখ প্রচ্ছদ অচিন্ত্য সেনগুপ্তের “অমাবস্যা”। এখানে কালো জমির ওপর সাদা প্যাস্টেল দিয়ে আঁকা সেই মুখ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা নারী মুখের আদলে আঁকা হয়েছিল।অমাবস্যার অন্ধকারে সেই নারীমুখের অস্পষ্টতা ফুটিয়ে তুলতে তিনি অবয়বটি একটু কাঁপা কাঁপা রেখায় আঁকেন। যার ফলে তৈরি হয় এক রহস্যময়তা।
নারী মুখ দিয়ে আরও দুটি প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৪ সালে “নবনীতা” । এই প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তুলেছেন গয়না পরা আনতচক্ষু এক নববধূর সুন্দর রূপ।আঁকার বৈশিষ্ট্য হল এটি পেপার কাটিং পদ্ধতি অনুসরনে আঁকা। টুকরো টুকরো প্যাটার্ন জুড়ে কালোর উপরে সাদা দিয়ে এক ঝলমলে উৎসবের মেজাজে চিত্র।
আর একটি ১৯৫৫ সালে “জোনাকি”। যে প্রচ্ছদটিতে গাঢ় নীলের ওপর হালকা রঙের একরাশ জোনাকির মধ্যে তুলির আঁচড়ে আঁকা এক মায়াবী মেয়ের মুখ।তুলির কাঠের অংশকে রঙে ডুবিয়ে এক টানে জোনাকিগুলো এমনভাবে আঁকা হয়েছিল যেন মনে হয় অন্ধকারে উড়ন্ত জোনাকির দলে মেয়েটিও জোনাকি হয়ে উড়ে যাচ্ছে।
১৯৪০ সালে আঁকলেন বিজন ভট্টাচার্যের “জনপদ” । সাদা জমির উপরে কালো রং দিয়ে সরু সরু রেখার টানে গ্রাম বাংলার বাড়িঘর, মেঠোপথ,নদী-নৌকা, লোকজন সব ফুটিয়ে তুললেন। অন্যদিকে শচীন্দ্র মজুমদারের “পলাতকা” বইয়ের জন্য আঁকলেন মানসিক টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত এক শহুরে নারীর মুখ।
সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে বলতে গেলে তাঁর একেবারে কাছের
মানুষ সৌমিত্র চট্যোপাধ্যায়ের লেখা অন্তত দু’টো কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আলাদা
করে বলতে হয়। যার
প্রথমটা ১৯৮৩ সালে “পড়ে আছে চন্দনের
চিতা” বইয়ে হলুদের ওপর ছাইরঙে বইয়ের নামটা এমন ভাবে লেখা, মনে হচ্ছে ঠিক যেন কয়েকটা চন্দন কাঠের টুকরো ছড়ানো।
পরেরটা ১৯৭৫ সালে “জলপ্রপাতের
ধারে দাঁড়াব বলে”। এখানে তুলির সরু-মোটা লাইনকে সামান্য
কাঁপিয়ে জলের এলোমেলো নেমে আসাটা প্রচ্ছন্ন ভাবে বোঝানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট্ট
ইঙ্গিত রয়েছে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো একজন মানুষের।
১৯৬১ সাল থেকে প্রকাশিত হতে থাকা সৌমিত্র চট্যোপাধ্যায় ও নির্মল আচার্য সম্পাদিত মূলত সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা “এক্ষণ” -এর প্রস্তুতিপর্ব থেকেই এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন সত্যজিৎ। দীর্ঘ দিন ধরে এই পত্রিকার কমপক্ষে ত্রিশটির মতো প্রচ্ছদ এঁকেছেন। নামের শুধু তিনটে অক্ষর- এ, ক্ষ আর ণ-এর ফর্ম আর বিন্যাসের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র এনে সম্পূর্ণ বাহুল্যবর্জিত এমন এক নান্দনিকতার ধারা তিনি গড়ে তুলেছেন, যা এক কথায় অভাবনীয়! অক্ষরগুলোর নিজস্ব সৌন্দর্য খুঁজে বার করে সত্যজিৎ যেন প্রতিটিকে আলাদা বাদ্যযন্ত্রের মতো কাজে লাগিয়েছেন! সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক সুরের নিখুঁত হার্মনি। ভারতবর্ষের গ্রাফিক ডিজাইন সত্যজিতের হাত ধরে এক সময়ে কোন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছিল অন্তত ‘এক্ষণ’-এর এই প্রচ্ছদগুলি তার সাক্ষী থাকবে চিরকাল।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান’ বইয়ের প্রচ্ছদে ড্রাই ব্রাশের লেখাটি সত্যজিতের ক্যালিগ্রাফির একটি অনন্য ঘরানার কাজ, যা মনে করিয়ে দেয় তাঁর কলাভবনের শিক্ষা।
১৯৭৪ সালের “দেশ” বিনোদন সংখ্যার প্রচ্ছদের কথা অবশ্যই বলা দরকার। কাগজকে জলে ভিজিয়ে ‘ড্যাম্প’ করে কালো কালি দিয়ে ‘দেশ ৮১’ কথাটা লেখা। তুলির মোটা লাইন ভিজে কাগজের ওপর পড়ে কম বেশি ছড়িয়ে গিয়ে দুর্দান্ত একটা এফেক্ট তৈরি করে। একাধারে কালির নিয়ন্ত্রণ ও ভিজে থাকা কাগজের মধ্যে সঠিক রসায়ন সম্পর্কে কতদূর স্পষ্ট ধারণা থাকলে, তবে এ কাজ করা সম্ভব, ক্যালিগ্রাফার মাত্রই সেটা অনুমান করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায় এটি সত্যজিতের অন্যতম সেরা প্রচ্ছদ।
সাধারণত
প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে শিল্পীরা বইয়ের মূল ভাবনাকে কেন্দ্র করে কিছু ছবি এঁকে থাকেন, যার
থেকে পাঠক বইয়ের সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে যান বইয়ের বিষয়বস্তুর। এই জায়গাতেই সত্যজিৎ
রায় স্বতন্ত্রতা সৃষ্টি করছিলেন। তিনি একটা মেজাজ, চিন্তা বা অনুভূতিকে তাঁর প্রচ্ছদে
ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে ভিসুয়াল কম্যুনিকেশনের একটি সম্পূর্ণ নিজস্বতা তৈরি করেছিলেন। যে
কোনও ডিজাইন সত্যজিৎ রায়ের হাতে পড়ে এমন অদ্ভুত এক নিজস্ব রূপ নিত যার তুলনা বাংলা
সাহিত্যের জগতে খুঁজে পাওয়া যায়না। সেই রূপে তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বায় মিশে থাকা শিক্ষা,
রুচি ও জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটত। সিগনেট প্রেস ছাড়াও অন্যান্য প্রকাশনী সংস্থার বইয়েরও
প্রচুর প্রচ্ছদ তিনি এঁকেছিলেন। সিগনেট প্রেস এবং সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বিখ্যাত প্রচ্ছদ
শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী বলেছেন –
“ সে
একটা সময় গেছে যখন সিগনেট-এর সদ্য বেরোনো একটা বইয়ের সৌরভে আমাদের দিন-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত্রী-সপ্তাহ-মাস
খুশীতে বিহ্বল।সে একটা সময় ছিল যখন সত্যজিৎ রায়ের একটা প্রচ্ছদের অভিনবত্ব থেকে আরেকটা
প্রচ্ছদের অনির্বচনীয়তার দিকে অভিযানের নিরবচ্ছিন্ন দর্শক ছিলাম আমরা।“
কথাগুলোর
মধ্যে আবেগ থাকলেও একবিন্দুও মিথ্যা প্রচার বা স্তুতি ছিল না। তাঁর আঁকা প্রতিটি প্রচ্ছদ
একটির সাথে অপরটি ছিল চিন্তায় – ভাবনায় – আঁকায় – রঙে ভিন্ন। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের
নিজস্বতা – অনন্যতা – অভিনবত্ব- অসাধারণতা। যা আজ বহু যুগ পরেও একই ভাবে সমাদৃত।
পরবর্তী
ও শেষ পর্বে আমরা সত্যজিৎ রায়ের অলংকরন সম্পর্কে জানতে পারব আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্য।
0 মন্তব্যসমূহ