'বন্দেমাতরম'।। এই সেই গান যা সাহস জুগিয়েছিল দেশের বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। এই গানটির রচয়িতা যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেটা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু গানটির সুর কে দিয়েছিলেন সেটা কি জানেন? বর্তমানে ভারতের জাতীয় স্তোত্র এই গানটির সুর তৈরি করেছিলেন সরলা দেবী চৌধুরাণী। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যেখানে বাংলার মেয়েদের পরিচয় তৈরি হতো পুরুষের সাহচর্যে ও পরিচয়ে, সেখানে কিছু নারী নিজেরাই এগিয়ে এসে তৈরি করেছিলেন আত্মপরিচয়। সেরকমই একজন ছিলেন সরলা দেবী । তাহলে চলুন আজ জেনে নিই একাধারে সাহিত্যিক, সমাজসেবী, বুদ্ধিজীবী এই মহীয়সী নারীর কাহিনীঃ
![]() |
সরলা দেবী চৌধুরাণী |
১৮৭২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সরলা দেবীর জন্ম। কলকাতার বিখ্যাত এই ঠাকুর বাড়ি ছিল সরলা দেবীর মাতুলালয়। তাঁর মা স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সাহিত্যিক। সম্পর্কে কবিগুরু ছিলেন সরলা দেবীর ছোটোমামা। আর তাঁর পিতা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন বেঙ্গল কংগ্রেসের সেক্রেটারি এবং প্রতিষ্ঠাতা। পিতার বিলাত প্রবাসকালে ছোট্ট সরলার শৈশব কাটে ঠাকুরবাড়িতে ;আরো অনেক মামাতো , মাসতুতো ভাই-বোনেদের সাথে মিলে, এক উৎকৃষ্ট সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক পরিবেশে । আর এই সব সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সকলের প্রিয় 'রবি মামা'।
![]() |
স্বর্ণকুমারী দেবী |
সরলা প্রথম নজরে পড়েন ১৩ বছর বয়সে এন্ট্রান্স এক্সাম দিয়ে যখন বেথুন কলেজে তিনি ঢুকলেন। এন্ট্রান্সের ইতিহাসে তিনি মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন । এরপর ১৮৯০ সালে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজিতে সাম্মানিক নিয়ে বি.এ পাশ করেন। সেসময় তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর । ভালো ফলের জন্য তিনি পেয়েছিলেন 'পদ্মাবতী স্বর্ণপদক '। মেয়েদের হয়ে এই পদক তিনিই প্রথম পেয়েছিলেন।
![]() |
গ্র্যাজুয়েট সরলা দেবী |
সরলা দেবী কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি। এরপর তিনি চিন্তা করেন জীবিকা অর্জনের বিষয়ে। এর আগে মেয়েরা যতই বিলেতে যান, লেখালেখি করুন কিংবা কঠিন পরীক্ষায় বসার কথা ভাবুন না কেন জীবিকা অর্জনের কথা সেসময় তারা চিন্তাই করতেন না। কিন্তু সরলাদেবী ছিলেন ব্যতিক্রমী। এমনকি ঠাকুরবাড়ির সর্বময় কর্তা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর স্বাধীন সত্তায় বাধা দিতে পারেননি।
দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সময় সরলার দেখা হয় মহীশূরের দেওয়ান নরসিংহ আয়েঙ্গারের সাথে। সরলার ব্যক্তিত্ব ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে নরসিংহ তাঁকে মহীশূরের মহারাণী গার্লস কলেজে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে আহবান জানান। সরলা দেবী সাগ্রহে গ্রহণ করেন সেই চাকরি। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই অবশ্য অতদূরে চাকরি করতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু এসবের কিছুই তিনি গ্রাহ্য করেননি। যেটা করতে চেয়েছেন, সেটাই তিনি করেছেন।
মায়ের সম্পাদিত 'ভারতী 'পত্রিকার সঙ্গে সরলা ও তাঁর বোন হিরন্ময়ী যুক্ত ছিলেন সেই বালিকা বয়স থেকে।এরপর ১৮৯৫ সালে এলো পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব।'ভারতী 'হলো সেই পত্রিকা যার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরলা দেবী এই পত্রিকাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। শুধু পত্রিকার কাজ নয় , তখনকার সময়ের মহিলাদের দ্বারা সৃষ্টি করা হস্তশিল্পকে আরও অনুপ্রানিত করতে ১৯০৪ সালে তিনি কলকাতার বৌবাজারে 'লক্ষ্মী ভান্ডার 'নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
![]() |
লক্ষ্মী ভান্ডারের মহিলারা কাজে ব্যস্ত |
এরপর ১৯১০ সালে তিনি 'ভারত স্ত্রী মহামন্ডল' নামে আরেকটি সংস্থা তৈরি করেন। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন এটিই ভারতের প্রথম সর্বভারতীয় সংস্থা যেটি শুধুমাত্র নারীদের জন্য তৈরি হয়েছিল। এটির কর্মকাণ্ড সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। সারা দেশজুড়ে বিস্তৃত ছিল এর শাখা, যেমন-দিল্লি,হায়দ্রাবাদ,এলাহাবাদ ,কানপুর ইত্যাদি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই সংস্থায় নারীদের পড়াশোনা ও হাতের কাজ শেখানো হতো।
সরলা দেবী ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর তিনি একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ছিল 'অহিতাঙ্গিকা'। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগীতশিল্পী। বন্দেমাতরম গানটির সুর তাঁর তৈরি করা। এটি ছাড়াও বহু দেশাত্মবোধক গান তিনি লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন।
১৯০৫ সালে পরিবারের চাপে পড়ে সরলা দেবী বিয়ে করতে বাধ্য হন রামভূজ দত্ত চৌধুরীকে। রামভূজ দত্ত ছিলেন একজন আইনজীবী , সাংবাদিক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী । বিয়ের পর সরলা দেবী স্বামীর সাথে পাঞ্জাবে চলে যান । সেখনে তিনি তাঁর স্বামীকে উর্দুতে প্রকাশিত 'হিন্দুস্তান' পত্রিকা সম্পাদনা করতে সাহায্য করেন। পরে অবশ্য এই কাগজটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হতো। এর পাশাপাশি বিধবাদের জন্য তিনি তৈরি করেন ' বিধবা শিল্পাশ্রম'। যেখানে বিধবাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজও শেখানো হতো।
অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য পুলিশ রামভূজ দত্তকে গ্রেফতার করে। সেসময় গান্ধিজি তাঁদের পাঞ্জাবের বাড়িতে অতিথি হিসেবে যান। সেসময় সরলা দেবী গান্ধিজির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সরলা দেবীর সাথে সেসময়কার বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর যোগাযোগ ছিল যাঁদের চিন্তাভাবনা তাঁকে খুব প্রভাবিত করেছিল। এও শোনা যায় যে, স্বামী বিবেকানন্দ সরলাকে বলেছিলেন বিদেশে গিয়ে নারী স্বাধীনতা সম্বন্ধে সেখানকার মানুষকে সচেতন করতে। কিন্তু নানা কারণে তা আর তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। একটা সময় তিনি নেতাজীর দ্বারাও খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন । যার ফলে গান্ধীবাদী স্বামীর সাথে তাঁর মতানৈক্য তৈরি হয়। এছাড়া আরও নানা সমস্যার কারণে তিনি তাঁর স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যান।
![]() |
সরলা দেবী ও মহাত্মা গান্ধী |
![]() |
সরলা দেবীর আত্মজীবনী |
অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১৮ ই আগস্ট জাগতিক সব মায়া কাটিয়ে সরলা দেবী পরলোক গমন করেন। সরলা দেবী আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের জোরে সমাজে নারীদের প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সরলা দেবীর লেখা গ্রন্থগুলো হলো –
• নববর্ষের স্বপ্ন
• জীবনের ঝরাপাতা
• শিবরাত্রি পূজা, প্রভৃতি।
0 মন্তব্যসমূহ