ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

এক যুগান্তকারী আবিষ্কার আর এক মেধাবিনীর প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস (অন্তিম পর্ব) - সোমনাথ দত্ত

 


➤প্রবন্ধের প্রথম পবর্টি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

৯৫২ সাল পর্যন্ত রোজালিন্ড একাই একমাত্র বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি ডিএনএ নিয়ে পূর্ণ সময়ব্যাপী কাজ করছিলেন। তিনি B type DNA কে আরও আর্দ্রতার ভিতর দিয়ে এক্স-রে’র সামনে আরও বেশী সময় রেখে পরীক্ষা করছিলেন। এভাবে এক সময় wet B type DNA ফাইবারকে এক্স-রে’র সামনে ৬২ ঘণ্টা পর্যন্ত রেখে দিয়ে তিনি সবচেয়ে সুন্দর ডাবল হেলিক্সের ছবি পান। এই ছবিই এখন জীববিজ্ঞান বইগুলোতে দেখা যায়। এরপর তিনি A type DNA নিয়ে কাজ করতে থাকেন। কারণ এই ডিএনএ’র ছবিতে B type এর চেয়ে অনেক বেশী তথ্য পাওয়া যাচ্ছিলো।

কিন্তু এর পরপরই ঘটে যায় রোজালিন্ডের জীবনের সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, তাও তাঁর সম্পুর্ণ অজ্ঞাতসারে।

১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে ওয়াটসন কিংস কলেজে এলেন। সেই সময়ে উইলকিন্স তাকে রোজালিন্ডের তোলা একটা এক্স-রে ফোটোগ্রাফ দেখতে দেন, যা পরবর্তীতে ‘ফোটোগ্রাফ ৫১’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেই ছবি দেখে ওয়াটসনের মাথায় বিদ্যুত খেলে গেল। 

চিত্রএই সেই বিখ্যাত ফটো  ৫১

ডিএনএ-র প্যাঁচালো চেহারাটা ছবির মতো ভেসে উঠল তার চোখে। নিজের পিএইচ ডি-র সময় থেকে উনি এই রকম দ্বি-সূত্রক বা ডাবল স্ট্র্যান্ডেড অণু নিয়ে কাজ করেছেন। তাই ছবিটা দেখে উনি অতি সহজে অনেকটা বুঝে গেলেন। 

কিংস থেকে ফেরার পথে চরম উত্তেজিত ওয়াটসন ছবিটা নিজের হাতেই নোটবইতে যতটা সম্ভব একে ফেললেন। ফিরেই ফ্রান্সিসকে বোঝাতে হবে এই দ্বি-সূত্রক গঠনই আসলে ঠিক। কারণ জীববিজ্ঞানে বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকেই জোড়ায় জোড়ায় থাকতে দেখা যায়।

 অন্যদিকে দুর্ভাগ্য যেন কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না এই মেধাবিনী বিজ্ঞানীর পিছু। বলা হয়, রজালিন্ডের প্রাপ্ত ছবিগুলো দেখার জন্য কেমব্রিজে আসতে চেয়েছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিংকিন্তু কমিউনিস্ট হিসেবে দোষারোপ করে ব্রিটেন সরকার তাকে আসতে দেয়নি কোনোভাবে। কারো কারো মতে, পাউলিং যদি একবার ছবিগুলো দেখতে পারতেন, তাহলে গাণিতিক মডেলের কাজটি তিনি অনেক সহজেই করে ফেলতে পারতেন আর ওয়াটসন ক্রীকের বহু আগেই এই গবেষণায় তারা সফল হতে পারতেনসাথে পাউলিংও একমাত্র বিজ্ঞানী হিসেবে তিনবার নোবেল পুরস্কার জয়ের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারতেন। এছাড়াও ফ্রান্সিস-ক্রিক একবার রোজালিন্ডকে একসাথে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যদি সেই পরামর্শটুকুও রোজালিন্ড বিবেচনা করতেন তাহলে তারা দুজনেই সবার আগে এই ডিএনএ’র আবিষ্কার করে ফেলতে পারতেন।

চিত্র: বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিং

রোজালিন্ডের তোলা ছবির হাত ধরে ক্রিক তার গণনার জন্য দরকারি তথ্য পেয়ে গেলেন এবং নতুন করে কাজ শুরু করলেন। শুধু ছবিটাই নয়, ক্রিস্টালোগ্রাফির যে খুঁটিনাটি তথ্য দরকার ছিল, তাও ক্রিক পেয়ে গিয়েছিলেন। মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের এক আলোচনা চক্রের সূত্রে রোজালিন্ডের কাজের ছবি ও তথ্য গিয়েছিল কাউন্সিলের অধিকর্তা ম্যাক্স পেরুজের কাছে। পেরুজের এমন কাজ করা বেআইনি ছিল কারণ এই রিপোর্টটি ছিল হাইলি কনফিডেন্সিয়াল। এই রিপোর্ট প্রকাশ করবার আগে রোজালিন্ডের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়া হয়নি। এমনকি রোজালিন্ড যে টিমে কাজ করতেন সেই টিমের প্রধান রেন্ডেলের কাছ থেকেও কোনো অনুমতিপত্র নেয়া হয়নি।

ডিএনএ যে দ্বি-সূত্রক এক অণু এবং এর সূত্র দু’টি প্যাঁচালো এবং পরিপূরক, একটা ডান দিকে পাক খেলে দ্বিতীয়টা বাঁ দিকে পাক খায়, নিউক্লিয়োটাইডগুলোর যে অসংখ্য বিন্যাস হতে পারে এবং এই বিন্যাসের তারতম্যই যে জীবজগতের যাবতীয় বৈচিত্রের গোড়ার কথা এসব কিছুই ব্যাখ্যা করে ১৯ মার্চ পেপার লিখছেন রোজালিন্ড।

সেই পেপার জার্নালে পাঠানোর আগেই ওয়াটসন ও ক্রিক তাদের ডিএনএ মডেল দেখাতে কেমব্রিজে ডেকে পাঠাচ্ছেন রোজালিন্ড আর উইলকিন্সকে। ঠিক করা হলো, ডিএনএ মডেল ওয়াটসন-ক্রিকই প্রকাশ করবেন। তার সপক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ হিসেবে রোজালিন্ড-উইলকিন্স তাদের পেপার প্রকাশ করবেন।

১৯৫৩ সালের ১৮ এপ্রিলঅবশেষে ওয়াটসন এবং ক্রীক মিলে তাদের কাজ বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশ করে ফেলেন। সেই গবেষণায় রোজালিন্ডের অবদানের কথা স্বীকৃতিস্বরূপ দিলেও তার কোনো পেপারের রেফারেন্স দেয়া হয়নি।

২৫ এপ্রিল নেচার-এ আলাদাভাবে প্রকাশিত হলো ফ্রাঙ্কলিন-গসলিং আর উইলকিন্স ও সহকর্মীদের দুটো পেপার। রোজালিন্ড তার পেপারে একটা নোট সংযোজন করলেন, এই কাজ এই জার্নালেই আগে প্রকাশিত তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, সবই ঠিক হলো। শুধু রোজালিন্ড জানতেও পারলেন না যে, তার কাজ থেকে অন্তত দু’বার তথ্য নিয়েছেন ওয়াটসন-ক্রিক।

চিত্রওয়াটসন ক্রিকের প্রকাশিত গবেষণাপত্র

এই সময় জীবন তার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ রসিকতাটা করল। জরায়ুর ক্যান্সার তাকে কেড়ে নিল মাত্র ৩৮ বছর বয়সে (১৯৫৮)। সুতরাং ভাবার সুযোগ থেকে গেল যে, রোজালিন্ড বেঁচে থাকলে ওয়াটসন-ক্রিক-উইলকিন্স-এর সঙ্গেই নোবেল পুরস্কার পেতেন। তবে ওয়াটসন-ক্রিক তাদের নোবেল পুরস্কারের বক্তৃতায় রোজালিন্ডের কথা উল্লেখই করেননি। খুব সহজভাবে ভাবলেই বোঝা যায় ডি এন এর যে আণবিক গঠন, তার উদঘাটন করার মতো গবেষণার জন্য রসায়নশাস্ত্রে দক্ষতার প্রয়োজনঅথচ নোবেল বিজয়ী এই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে কেউই রসায়নবিদ ছিলেন না, রোজালিন্ড ছিলেন তাদের মধ্যে একমাত্র রসায়নবিদ।

আবিষ্কারের কৃতিত্ব না পেলেও ওয়াটসন এবং ক্রীকের প্রতি তার তেমন কোনো ক্ষোভ ছিল না। ক্রীকের সাথে তার সম্পর্ক ভাল ছিল, কিন্তু ওয়াটসনের সাথে যোগাযোগ তিনি রক্ষা করেননি। তাকে “That Horrible American” বলে সম্বোধন করতেন তিনি। তবে B type DNA নিয়ে রোজালিন্ড তার গবেষণাগুলোকে জার্নাল আকারে প্রকাশ করেছিলেন তার ছাত্র গস্লিংয়ের সাথে। সেখানে তারা B type DNA থেকে কী কী জানা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন।

পরবর্তীতে ভাইরাস নিয়ে এমনসব উন্নত মানের গবেষণা রোজালিন্ড করেছিলেন, বিশেষ করে টোব্যাকো মোজাইক ভাইরাস নিয়ে, যেগুলো ছিল কাটিং এজ গবেষণা। সেই গবেষণাগুলোর কল্যাণেই ভাইরাসের মৌলিক আণবিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে জানতে পারি। ঐ গবেষণাগুলোর উপর ভিত্তি করেই পরে ভাইরাস নিয়ে আরও উন্নত মানের এবং জটিল রকমের গবেষণা সম্ভব হয়েছিল।


তবে একটা প্রবচন বোধ হয় সত্যিই ফলে- “সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না সত্য ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা সেই অগ্নিশিখার মতো, যাকে ছাইচাপা দিয়ে খানিকক্ষণ  ঢেকে তো রাখা যায়, কিন্তু  নিভিয়ে  দেওয়া যায় না কখনোআধুনিক বিজ্ঞানের জগৎ তাই জানছে, সত্যের মুখোমুখি হচ্ছে, আর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে ফ্রাঙ্কলিন এর মতো প্রতিভাময়ী বিজ্ঞানীর নাম, কুর্নিশ জানাচ্ছে তার অবদানকে। আর এসবই হচ্ছে ওয়াটসনের মতো বিজ্ঞানীর জীবিত থাকা অবস্থাতেই। সত্যি এমন গৌরবও যে কখনো কখনো কলঙ্কের কারণে পরিণত হতে পারে, তা তার মতো ব্যক্তিত্ব না থাকলে বোঝা যেত না (শেষ)


সোমনাথ দত্ত


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ