বই – ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে
লেখিকা – নবনীতা দেব সেন
প্রকাশনী – আনন্দ
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ১৭৫
প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৮৪
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সমীর সরকার
সত্তরের দশকের মাঝামাঝির সময়। এক মহিলা লেখকদের সম্মেলনীতে যোগদান করতে লেখিকার আসামের জোরহাটাতে যাওয়া। তারপর সেখান থেকে কাজিরাঙা, তেজপুর হয়ে ওনার যাত্রা বমডিলা, ডিরাং, তাওয়াং পর্যন্ত।
সম্মেলন শেষে হঠাৎ “উঠলো বাই তো কটক যাই” রূপে সম্পূর্ণ প্রস্তুতিহীনভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন অরুনাচল প্রদেশের ম্যাকমোহন লাইন দর্শনে যাবেন। সেখানে তিব্বতী গুম্ফায় প্রাচীন পুঁথি দেখার অনেকদিনের শখ পূর্ণ করার এত বড় সুযোগ কিছুতেই তিনি হেলায় হারাতে চাইলেন না। কিন্তু সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ওই এলাকায় যেতে গেলে ইচ্ছা করলেই যাওয়া যায় না। চাই বিশেষ ধরণের সরকারী অনুমতি, যা রাতারাতি যোগাড় করাও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।প্রতি মুহূর্তে যাওয়া বাতিল হতে পারার ভয়। কিন্তু দুঃসাহসিনী লেখিকাকে দমন করার সাধ্য কার আছে। এক অদ্ভুত উপায়ে যোগাড় করে ফেললেন অনুপতি পত্র। সাথে যোগাড় করলেন বা বলা ভালো ধার করলেন তীব্র ঠাণ্ডার জায়গার উপযুক্ত পোশাক-আশাক। গ্লাভস থেকে শুরু করে মাথার মাঙ্কিটুপিটি অবধি সবই চেয়ে চিন্তে যোগাড়ও হয়ে গেল। এরপর যাওয়ার পালা। না না, এই ভ্রমণ কোনো ট্রেন, বাস বা প্লেনের সুখকর যাত্রা নয়। তিনি গেলেন ট্রাক সওয়ারি হয়ে। সেনাবাহিনির মালবাহী এক ট্রাকে চেপে অজানা অচেনা কিছু মানুষের সঙ্গী হয়ে চললেন।গম্ভীর মেজাজের এক তরুন ডাক্তারের সলজ্জ আচরণকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে, প্রায় গায়ে পড়ে সঙ্গী হয়ে গিয়ে তাঁকেই নিজের একমাত্র ভরসার স্থল করে তুলে সমগ্র ভ্রমণ এক অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে তুললেন। ডাক্তারের সাথে তাঁর যাবতীয় কথোপকথন অত্যন্ত মজার ও হাস্যরসের উদ্রেক করে, যা এই বইকে একঘেয়েমি মুক্ত করেছে।
নিজের অসুস্থ শরীরের পরোয়াও করলেন না, বেঁধে নিলেন প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। মধ্যবয়সী শরীরে এক তরুন ভ্রমণ পিপাসু মন শরীরের যাবতীয় বাধা সহজেই অতিক্রম করতে পারে। লেখিকার কথায় তাই প্রকাশ পেল।
মিশুকে স্বভাবের এবং অতিরিক্ত কথা বলতে ভালোবাসা লেখিকার ট্রাক ভ্রমণ ও তৎসহ তিব্বতের রাস্তার বর্ণনা অত্যন্ত সুন্দর ও মুগ্ধকর।অবশেষে যখন শাংগ্রিলার আবির্ভাব ঘটল তখন সেই বিস্ময়ের বর্ণনা পাঠককে বহুদিন আবেশে মোহিত করে রেখে দেয়।
তিব্বতী লামা এবং সেখানকার নারীদের জীবনযাপন, সামাজিক ব্যবস্থাদি, রীতিনীতি, দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা এই বইয়ের অমুল্য সম্পদ। নারীরা বহুপতি গ্রহন করতে পারেন, প্রয়োজনে বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে পারেন, সন্তান তাঁর পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন—এই সমস্ত যাবতীয় বিস্তারিত তথ্যও আমরা এই বই থেকে জানতে পারি। এক স্বাধীনচেতা, কর্মঠ এবং অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় জাতির সম্পর্কে মুল্যবান নথী এই ভ্রমণকাহিনী। যে কাহিনী আপাত দৃষ্টিতে ভ্রমণকাহিনীর অতি বিস্তারিত রূপ থেকে মুক্তি দেয়। লেখিকার কৃতিত্ব এখানেই যে তাঁর চিরসবুজ মনের হাস্যরস পূর্ণ আচরণকে এক সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে মেলে ধরেছেন নির্দ্বিধায়। বইয়ের প্রতি ছত্রে সেই রসের আস্বাদ আমরাও গ্রহন করতে পারি। এই কাহিনী আজকের নয়।১৯৭৭ সালে এক একাকী নারীর অসুস্থ শরীর ও বন্ধু – শুভাকাঙ্ক্ষীদের যাবতীয় বারণ উপেক্ষা করে ভ্রমণ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। একজন মানুষ কতটা দুঃসাহসী ও নিজ স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারেন, তার শিক্ষা আমরা এই বই থেকে জানতে পারি। ভ্রমণসাহিত্যের ইতিহাসে নবনীতা দেব সেনের এই কীর্তি চিরকাল এক অমুল্য সম্পদরূপে পরিগণিত হবে।
0 মন্তব্যসমূহ