এই গল্পটি এপ্রিল ২০২০ সংখ্যার প্রকাশিত হয়েছে।
আঁকাবাঁকা ছোট্ট ধারাটা যেখানে নদীর সাথে মিশেছে, তারই একপাশে এই পার্কটা যার শেষ প্রান্তে একটা ভাঙ্গা
সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চ। হাজার হাজার যুবক-যুবতী একদিন এখানে বসেই কত যে স্বপ্নের রং গায়ে মেখেছে তার
হিসেব মহাকালের কাছে থাকলেও পৃথিবীর নিতান্ত ক্ষুদ্র মানুষ এর কোন খোঁজ রাখেনা। সে-সবই আজ অতীত।ইদানিং
একমাত্র রমাপদ ছাড়া আর কেউই এখানটাতে বসে-টসে না, চেয়েও দেখেনা একবারটির জন্য। প্রতিদিনের মতোই শরীরটাকে
বেঞ্চটার ওপর অর্ধেক শুইয়ে দিয়ে রমাপদ চেয়ে আছে-আর দেখছে- একটা বাচ্চা বাবা-মা'র হাত ধরে কি একটা বায়না করতে করতে চলে যাচ্ছে। কোনো
এক বাউন্ডুলে ছেলে আম গাছ বেয়ে উপরে উঠতে থাকা পিঁপড়েগুলো কে টিপে টিপে মারছে এক
এক করে।একদল তরুণ তাদের সাইকেল গুলোকে ছোটাচ্ছে কোন এক অজানা পিছনে এবং সবশেষে
একটা লোক সিগারেট টানতে টানতে চলে যাচ্ছে দূরে-বহুদূরে।এদের কেউই আর
ফিরবে না কোনদিন, শুধু তাদের ফেলে যাওয়া শুকনো পায়ের ছাপ রমাপদর মনকে বড্ড বিচলিত করে, সে দিন গোনে- এক, দুই, তিন...।
"আপনার বাড়ি কোথায়?’
"কে? কে জিজ্ঞাসা করল?’জীবনে ফেলে আসা সত্তর টি বছর?যারা মুখভাঙিয়ে এতদিন একের পর এক প্রশ্ন করে গেছে আর
নিরুত্তর রমাপদ কে পদানত করে পরাজয়ের মালা পরিয়ে দিয়েছে ,সেই কি? রমাপদ ঘাড়টাকে উঁচু করে দেখবার চেষ্টা করলো।
"
না এ যে আমারই মত একজন মানুষ, ছি: ছি:, কি ভুলভাল বকছি- আমার মত হতে যাবে কেন, নানা আমার মত কেন’, নিজের অজান্তেই বিড় বিড় করল সে।
"কিছু
বললেন"-জিজ্ঞাসা করল লোকটি।
"না না, ও কিছু নয় হঠাৎ কোন মানুষের গলা পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম, কে তুমি?"
"আমি কিছুদিন যাবত রোজ আপনাকে দেখি, এখানটাতে বসে থাকেন একা একা, তাই.."
"রোজ
দেখো? এখানে তো
আর কেউ আসে না ,তুমি আসো
কেন রোজ..."হাজারটা গাম্ভীর্য মিশিয়ে যেন একপ্রকার নিঃশব্দেই কথাগুলো বলল
রমাপদ।
"আপনি
যে কারণে আসেন।"
কথাটা রমাপদর কানে গেল না,সে বলল-"এই পরিতক্ত স্থানে এই
পরিতক্ত মানুষটিকে দেখে আলাপ করতে আসো বুঝি।"
"
না না, ওই যে
বললাম আপনি যে কারণে আসেন।"
এবারের
কথাটা রমাপদ শুনতে পেয়েছে,আর শুনেছে বলেই আজ বহুকাল পর নিজের অজান্তেই হাসিতে ফেটে
পরলো সে, বোধহয়
হাসিটা বিদ্রুপের, তবে
নিজের প্রতি না সামনের লোকটির প্রতি তা বোঝা যায় না। এরপর হাসির ছলেই
বললো"এর আগে তো তোমায় দেখিনি কখনো।"হাসির অর্থটা খুব সম্ভবত সামনের
লোকটির বোধগম্য হয়নি,এই
অপরিচিত বৃদ্ধের এই অপরিচিত ব্যবহারটা খুব সহজেই সাধারন রসিকতা হিসেবে মেনে
নিয়েছে সে। "দেখবেন কি করে আমি তো গত সপ্তাহে ই এ শহরে এসেছি, কে সি ভট্টাচার্য লেনের বড়
বটগাছটার ধারে যে বাড়িটা আছে আপাতত ওখানটাতেই আছি কিছুদিনের জন্য, ভাড়া আছি।"কে সি
ভট্টাচার্য্য লেনের শেষ প্রান্ত- বটগাছ- বাড়ি- এসব শোনামাত্রই বুকের ভেতরটা হা হা
করে জ্বলে উঠলো রমাপদর। ওঁর মনে পড়ে গেল-কত বিকেলবেলা ওই বাড়িটার বারান্দায়
কেরাম ঠুকতে ঠুকতে কেটে গেছে, এমনকি পরীক্ষার শেষে কত রাতও যে
কেটেছে একসাথে-রতনলাল আর রমাপদর ,তার হিসেব কে রাখে । সে সময় কেনা জানতো রমা - রতনের
দোস্তির কাহিনী। তারপর, কত বসন্ত এসেছে, কত বসন্ত কোকিল এর গান থামিয়ে চলেও গেছে ,আবার এসেছে কালের নিয়মে কিন্তু
রতন - সেই যে গেল-আর ফেরেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত এক নিতান্ত মামুলি
মানুষ রতনলাল ভাদুড়ী চিরদিনের জন্য মিশে গেছে পদ্মার অভিশপ্ত চরে।রমাপদর আরো মনে
পরলো কৌমুদীর কথা,সেই
ম্যাট্রিকুলেশনের সময় থেকে নিরবে ভালোবেসে গেছে, কোনদিন বলতে পারেনি, আর যেদিন বলল- তারই দশদিন পরে..., ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, তারিখটা আজও মনে আছে...।রতনের সেই কথাটা আবার কানে বাজছে
রমাপদর -"সত্যি কথা বলতে...। তোকে কিছু বলিনি, আসলে সেভাবে অনুভব করিনিতো, তাই..,বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য জোর করছিল, কি জানি কেন ফট্ করে কৌমুদীর নামটা বলে ফেললাম, আরে.. আমাদের গাঙ্গুলী কাকার মেয়ে
রে.. সামনের ১০ ই মার্চ আমাদের বিয়ে।"সে চাইলে খুব সহজেই রতনকে সব কথা বলে
দিতে পারতো এবং তাতে করে হয়তো বিয়েটাও আটকানো যেত কিন্তু সেদিন এসব কিছুই করেনি
রমাপদ, তার বদলে দুটো
প্রশ্ন করেছিল মাত্র-"কৌমুদী রাজি?" আর" "আমায় আগে বলিসনি কেন?" সেদিন, এই দুটোর কোনটারই উত্তর রতনের কাছে ছিলনা, ছিলনা রমাপদর কাছেও ,সে কেবল বুকের উপর হিমালয় চাপিয়ে
সমস্ত জীবন ধরে সব কিছু নিরবে সয়ে যেতে পারত। কে সি ভট্টাচার্য লেনের বাড়িতে যথা
দিনেই সানাই বাজল, শোনা
গেল উলুর আওয়াজ আর সমস্ত আয়োজনকে পরিহাসে পরিণত করে পরের দিনে ওই বাড়ি থেকেই
শোনা গেল কান্নার ধ্বনি। বিধবা কৌমুদির ব্যথা ভরা চোখ দুটো থেকে বিন্দু বিন্দু ঝরে
পড়া জল সেদিন বুকের ভেতরটা ভাসিয়ে দিয়েছিল রমাপদর।আর, কৌমুদী সাদা থান গায়ে জড়িয়ে বাবার সাথে চোরের মত শহর
ছাড়লো কিছুদিনের মধ্যেই। ওর বাবা বোধহয় বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিয়েছেন- সেসব
খবর রমাপদ জানে না, জানতেও
চায় না আর।
ইতিমধ্যেই আগন্তুক লোকটি পাশে এসে বসেছে রমাপদর মুখে একগাল
হাসি নিয়ে বলল- "আমার নাম তপেশ,জানেন কাকাবাবু আপনাকে দেখে আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো।
কিন্তু দেখুন তো আমি এর আগে এ শহরে আসিইনি কোনদিন..আমার মা বলতো জানেন - যাকে আপন
মনে হবে তাকে ভালবেসে বুকে জড়িয়ে ধরলে ক্ষতি কি?সম্পর্ক তো ভালোবাসা দিয়ে হয় রক্ত দিয়ে নয়।জানেন এই পয়তাল্লিস
বছর বয়সে এসেও এসব কথা ভাবলে কেমন যেন যুবক যুবক মনে হয়। ওহো, আপনাকে তো বলাই হয়নি.. আমার মাও
এই শহরের মেয়ে ছিল,এই
শহরেরকত যে গল্প শুনেছে তার মুখে,সেই যে...." এরপর আর কোন কথা কানে যাচ্ছেনা রমাপদর, তার মন বড় অস্থির,মন যেন কিছু একটা বলতে চাইছে, এক অপরিচিত লোকের মুখে কাকাবাবু
ডাকটাও তার আপনার মনে হলো কেন?আর তাছাড়া সেই বা নিজে থেকে এতটা ঘনিষ্ঠতা করবার চেষ্টা
করছ কেন করছে? কপাল
বেয়ে ঘাম ঝরছে তার, রমাপদ
তৃষ্ণার্ত হরিণের মত জিজ্ঞাসা করল-
"কি নাম তোমার মায়ের?"
"কৌমুদী
গ.."
তপেশ
কে শেষ করতে না দিয়েই "কি বললে" বলে চেঁচিয়ে উঠলো রমাপদ, দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।যে
নামটা আর কোনদিন ভাবতেও চায়নি, সেটাই যে এভাবে জীবনের সত্তর টা বছর পার করে এসেও তাকে আনত
করবে তা যেন মেনে নিতে পারছে না এই বেচারা বৃদ্ধ।কয়েক ফোঁটা ঘাম ওঁর কপাল থেকে
নিরবে মিশে গেল শুকনো প্রাণহীন ধুলোয় ঢাকা ঘাসের ওপর।
"একি, আপনি কি... মানে এতটা বিচলিত
হচ্ছেন কেন..."
রমাপদ
কেমন যেন ভয় পেল, তারপর
নিজেকে সংযত করে বলল -"আসলে ছেলেবেলায় আমার এক খুব ভালো বন্ধু ছিল..
"
ওনার নামও কৌমুদী ছিল বুঝি?"
"হ্যাঁ"
চাপাস্বরে এই একটি কথাই কানে এলো তপেশের। খানিকক্ষণের স্তব্ধতা...।
"
জানেন কাকাবাবু মাকে হারানোর পর সেই কবে থেকে কেমন যেন একা হয়ে গেছি.." তপেশের
অশ্রু মেশানো দীর্ঘশ্বাস..। রমাপদর বোঝা হয়ে গেছে যে তার সেই কাঙ্গালী তন্দ্রাহরিণী
স্বশরীরে আর কোনদিনই কারো তন্দ্রা হরন করতে আসবে না,এই সর্বগ্রাসী পৃথিবীর কাছে আজ সে অতীত। ওঁ তপেশের দিকে
খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল-এই তাহলে কৌমুদীর ছেলে। কৌমুদীর রূপের কোন গুণ
এর চোখে- মুখে- নাকে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে তা বোঝার চেষ্টা করল রমাপদ কিন্তু খুঁজে
পেল না কিছুই।
"আপনি
একদিন আসুন না আমার ঘরে, একা থাকতে আর ভালো লাগেনা, আসবেন তো?
" "যাবো ,যেতে তো হবেই.." একটু অন্যমনস্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো রমাপদ।
****
যত
দিনযায় তপেশের সাথে কোন এক সুদৃঢ় বন্ধনে আটকে যায় রমাপদ,গড়ে উঠতে থাকে এক নাম না জানা
সম্পর্ক, এ সম্পর্ক
আত্মার, বড়
ভয়ঙ্কর এ..।আজকাল সময়ের করাল
আঘাত রমাপদকে স্পর্শ করে না ,কোন এক অজানা কারণে ওঁর সময়টা যেন একেবারেই থমকে গেছে।আজ
সন্ধ্যায় তপেশের সাথে সেই কে সি ভট্টাচার্য লেনের বাড়িতে এসেছে সে। কৌমুদীর
একাদশতম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সেই উঠোন, সেই বারান্দা- সেই ঘর -শুধু মাঝখানে সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান
আর তার প্রমাণস্বরূপ দেওয়ালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জীর্ণতা।
"
এইটি আমার মায়ের ছবি, তাঁর
নিজের হাতে আঁকা, বিয়ের
আগের.." বারান্দার এককোনে রজনীগন্ধার মালা পরানোর পুরনো ফ্রেমে বাঁধা
হাস্যময়ী রমাপদর চেনা ছবিটির দিকে তাকালো সে। আজ বহুকাল পর কৌমুদিকে দেখে
প্রথমবারের জন্য বড্ড হিংসে হচ্ছে রমাপদর, ওঁর চোখের কোনটা চিক্ চিক্ করে উঠল। হাতে আঁকা সেই চেনা
ছবিটিতে নিজের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কে যেন প্রথমবারের জন্য স্পষ্ট দেখছে এই
সত্তর বছরের বৃদ্ধটি।
"
কি নাম বলেছিলে তোমার মায়ের?" "কৌমুদী,কৌমুদী কি?
"
আজ্ঞে কৌমুদী
গঙ্গোপাধ্যায়"উত্তর দিলো তপেশ। অর্থাৎ
কৌমুদির আবার বিয়ে হয়েছিল -নিশ্চিত হলো রমাপদ।কিন্তু কৌমুদির বাপের
বাড়িও তো গাঙ্গুলী- তবে কি? না- না সে কিভাবে হয়-বিধবা মেয়ে... নিশ্চয়ই একই গোত্রে
বিয়ে করেছিল-রমাপদ হঠাৎ কেমন যেন
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে- মনে মনে কিসব বিড়বিড় করছে।"কিছু ভাবছেন কাকাবাবু ?" না আর কোন ভাবনা নয়, যে প্রশ্ন এতদিন ভাবতেও চায়নি
রমাপদ তারই উত্তর পাওয়ার জন্য আজ সে উদ্ভ্রান্ত-" আচ্ছা তোমার বাবা কি এখনো
বেঁচে আছেন?’
খুবই
দ্রুত শেষ করলো সে।" আমি নিজে কোনদিনই তাকে দেখিনি, তার আগেই..
"
নাম কি তার?" তপেশকে
আরও একবার বাকিটা বলতে না দিয়েই জিজ্ঞাসা করল সে। দুরন্ত তপেশ হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। একটা মুহূর্তে রমাপদর দিক থেকে
দৃষ্টি ঘুরিয়ে সেই দৃষ্টি সন্তর্পনে হাস্যরতা কৌমুদির দিকে রাখলো, তারপর যেন খুবই গোপনে- মৃদুস্বরে-
এক নিঃশ্বাসে উত্তর দিল-"রমাপদ মৈত্র"
নিজের
নাম শুনামাত্রই বসে পরলো রমাপদ, চোখের জল আজ কোন বাধা মানবে না, ওঁর আজ মনে পড়ার সময়, সেই ছেচল্লিশ বছর আগের কিছু চাপা পড়ে যাওয়া লাল-নীল- হলদে
মুহূর্ত,কিছু গোপন, কিছু ভয়ের ,আবার কিছু মাধুরী মেশানো।স্মৃতির
মণিকোঠার অন্তঃপুরে নিজের অজান্তেই প্রবেশ করবে সে, দেখতে পাবে লালচে রোদ্দুরে সিক্ত সেই লাবণ্যময়ী একলা
বিকেলটিকে, দেখতে
পাবে সেই নিয়ম ভাঙার অবাক গোধূলিটাকে এবং সবশেষে দুটো শরীরের পরস্পরকে পাগল করার
হাতছানি আর পরস্পরে মিশে যাওয়া দুজন যুবক-যুবতির নিষিদ্ধ প্রেমে ভরপুর সেই নিষিদ্ধ
রাত।।
0 মন্তব্যসমূহ