ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

প্রাচীন তিব্বতীয় জীবন ও জৈবিকতার অন্যতর রসায়ন - উধোতকাণি চিত্তাণি -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

  • বই- উধোতকাণি চিত্তাণি 
  • লেখিকা– সুতপা বসু 
  • প্রকাশক– আনন্দ পাবলিশার্স 
  • প্রথম প্রকাশ– ডিসেম্বর ২০২২ 
  • প্রচ্ছদ শিল্পী-  সুব্রত চৌধুরী 
  • পৃষ্ঠা– ২০৮
  • মুদ্রিত মূল্য– ₹ ৫৫০/- 

উধোতকাণি চিত্তাণি অর্থাৎ আলোকপ্রাপ্ত মন 

গদ্যের সময়কাল ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬। সুদূর তিব্বতের কোনও এক রাজার রাজ্য। বয়স্ক রাজার ক্ষমতাশালিনী দ্বিতীয় স্ত্রী যিনি বর্তমানে রাজ্যের হাল ধরে আছেন, রাজার সাথে এক সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কন্যাসমা সামতেনের বিয়ে দিতে উদ্যত। যে বিবাহ প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা বজায় রাখার এক চাল ভিন্ন অন্য কিছুই নয়। রাজার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র অবহেলিত কন্যা ইয়োনতেন আজ উচ্ছৃঙ্খল, উদ্ধত, নেশায় আশক্ত, উদ্দাম যৌনতায় মত্ত এক যুবতী রাজকুমারী । রাজ্যের দুই প্রান্তে দুই বৌদ্ধ সংঘ। যারা রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে আভ্যন্তরীণভাবে যুক্ত। তাঁদের গতিবিধির উপর রাজার ক্ষমতা – অক্ষমতা নির্ভরশীল। 

রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিমপ্রান্তের দুই মঠের দুই ক্ষমতাশালী সন্ন্যাসী - লোবসাং ও ইয়েশে। যাদের জীবন কাহিনীর বৈপরীত্য তাঁদের স্বভাবগতভাবেও বিপরীত মতির করে তুলেছিল, তাঁরা নিজ নিজ মতানুযায়ী রাজ্য তথা মঠের মঙ্গলকামনার্থে ক্ষমতাশালী হওয়ার অভিপ্রায়ে সন্ন্যাসীর সর্বত্যাগী আচার ভুলে কূটনৈতিক খেলা খেলতে বাধ্য হন। এবং জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক দুর্বিপাকে। 

রাজ্যের এক দরিদ্র কামার জিনপা। বিধবা মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে স্বল্প আয় সম্বল করে জীবনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় রাজকুমারীর অন্দরমহলে তাকে হাজির করানো হয়। বিস্ময়ে হতবাক কামার যখন রাজকুমারীর অভূতপূর্ব রূপ ও  বিলাস ব্যাসনে হতবাক, তখন রাজকুমারী এক অদ্ভুত আদেশ করেন। গড়ে দিতে হবে গয়না। কিন্তু কামার কেন গয়না গড়বে সুবর্ণকার থাকা সত্ত্বেও? কারণ গয়নার মোড়কে গড়তে হবে ধারালো গোপন অস্ত্র। কিন্তু কেন এমন গয়নারূপী অস্ত্র প্রয়োজন রাজকুমারীর? গয়না গড়ার সময়কালে রাজকুমারীর প্রেমজনিত ছেলেখেলার পাত্রে পরিণত সুদর্শন কামার ভুলে যায় নিজের সামাজিক অবস্থান। সমর্পণ করে নিজেকে। জড়িয়ে পড়ে রাজপ্রাসাদের এক গোপন গভীর ষড়যন্ত্রে। শেষ অবধি কি হয় জিনপার? 

এক ছোট্ট শিশু দাচেন। যাকে প্রধান বৌদ্ধ মঠের পক্ষ থেকে উত্তরাধিকারী রূপে নির্বাচিত করা হয়েছে, মায়ের থেকে দুরে সরিয়ে মঠে রেখে কঠোর বৌদ্ধ ধর্মীয় সন্ন্যাস জীবনে অভ্যস্ত করানো হচ্ছে, সে পালিয়ে যেতে চায় মঠ থেকে। অথচ ক্ষমতা লোভীরা তার ক্ষণস্থায়ী সময়কালেই তাকে প্রাণে মারার চেষ্টা করে বারংবার। কি ভাবে কার দয়ায় কিংবা কার দুরদরশিতায় সে বেঁচে যায়? কিই বা হয় তার পরবর্তী জীবনরেখা। 

এই সমস্ত চরিত্রর তৈরি করা গোলকধাঁধায় জটিল পঙ্কের ন্যায় জড়িয়ে যায় রাজপ্রাসাদের অলিন্দের ক্ষমতার লালসা, চিনা সৈন্যবাহিনী, বৌদ্ধ মঠ, রাজ্যের যৌথ কমিশন এবং জিনপার স্ত্রী পেমা, রানি সামতেন, দুটি গর্ভস্থ শিশু এবং আরও অনেকে। সমগ্র কাহিনী জুড়ে লোভ, লালসা, যৌন ঈর্ষা, প্রেম, মমতা, ত্যাগ সহ ভিন্ন ভিন্ন মানব অনুভূতির সমাহারে কাহিনী নিজ সমাপ্তি খুঁজে নেয়। কিংবা হয়ত সমাপ্তির পথে অগ্রসর হয়। 

লেখিকা সুতপা বসুর লেখা এর আগে পড়ার সুযোগ হয়নি। ২০২২ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এই আখ্যানটি প্রকাশিত হয়েছিল। রোমাঞ্চ ঘরানার বই রূপেই এর আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০২৩ -এ। লেখার গতি সাবলীল। প্রায় নব্বই বছর পূর্বের ঘটনাকাল বজায় রাখার তাগিদে অযথা জটিল ভাষা ব্যবহৃত হয়নি বলে পড়তে বা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আনন্দ প্রকাশনীর বইয়ের গুণগত মান নিয়ে আঙুল তোলার দুঃসাহস নির্বোধও করবেন না। যদিও নতুন বই পড়তে শুরু করে জানতে পারি অন্তত ১৫ টি পৃষ্ঠা ছেঁড়া ও মোড়ানো। কিন্তু তখন আর পাল্টানোর উপায় নেই। ফলত দুঃখের সাথেই বই পড়া শুরু। 

এক বিন্দুও দ্বিধা না রেখে বলতে পারি ২০০ পৃষ্ঠা বইয়ে প্রকৃত কাহিনী খুব বেশি হলে ৭০ পৃষ্ঠার হবে। বাকি শুধুই প্রাকৃতিক বিবরণ, লেখিকার নিজস্ব দার্শনিক মতামত, চরিত্রদের দৃষ্টিকোণ দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আনুষঙ্গিকে তাঁদের দার্শনিক চিন্তা ভাবনার প্রকাশ। সাথে জুড়ে যায় বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসনের বিভিন্ন কার্যকলাপ, মঠের নিয়ম নীতির বিস্তারিত বিবরণ। শুরুর দিকে এই ধরণের বর্ণনা পড়তে ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে তা একঘেয়েমি ও শেষে বিরক্তি উৎপাদন করে। ফলে পড়ার গতিও রোধ হয়। 

২০০ পৃষ্ঠার বই পড়তে আমার মত সাধারণ পাঠকের দুই থেকে তিনদিন লাগে। এই বইটি আমি প্রায় ১০ দিন ধরে শেষ করলাম। শুধুমাত্র বেশ মোটা অঙ্কের কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে বইটি কিনেছি বলেই শেষ করতে বাধ্য হলাম খানিকটা। নাহলে হয়ত মাঝ পথেই থেমে যেতাম।  

উপরন্তু সমগ্র কাহিনী পড়ার পর বোঝা যায় বেশ কিছু প্রসঙ্গের উত্থাপন অকারণেই করা হয়েছিল। যার সাথে মূল কাহিনীর যোগাযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ, কিছু ক্ষেত্রে প্রায় নেই বললেই হয়।

বইয়ে এত বিবরণের পর যখন সমাপ্তি আসে, তখন শেষের ৫-৭ পৃষ্ঠায় যেন লেখনী হঠাৎ উদভ্রান্ত হয়ে শীঘ্র শেষের দিকে ধাবিত হয়। ফলে ওর ছেলেকে নিয়ে গেল, তার মেয়েকে হারিয়ে ফেলল, ও চলে গেল, সে ভাবতে লাগল গোছের একাধিক ঘটনা অতি দ্রুত ঘটে যায়। এবং শেষাবধি ধর তক্তা মার পেরেক দশায় পরিণত হয়। যা সম্পূর্ণ উপন্যাসের লয় ও তাল ভঙ্গ করে। 

উপন্যাসের শেষে বেশ কিছু ঘটনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। হয়ত ওপেন এন্ড রেখে পরবর্তী খণ্ডের প্রত্যাশা তৈরি করাই উদ্দেশ্য। কিন্তু তাতে পাঠক কতটুকু আগ্রহ বোধ করবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে যায়। 
কাহিনীর ট্যাগ লাইন রূপে ব্যবহৃত রাজকুমারী ও কামারের আশ্চর্যজনক সাক্ষাৎকারকালে গহনারূপী অস্ত্র তৈরির যে রোমাঞ্চকর আদেশ দিয়ে কাহিনীর শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীতে বিবরণের বিপুলতায় খেই হারিয়ে ছোট্ট একটি দুর্ঘটনা মাত্র হয়েই রয়ে যায়। তবে এই সাক্ষাৎকারের ফলাফল গল্পের এক  বিশেষ স্থান অধিকার করে। 

বইটি ভূমিকাহীন। এজন্য লেখিকা বা গল্পের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়না। বইয়ের শেষে লেখিকার সম্পর্কে যা জানানো হয়েছে তাও বড়ই ভাসা ভাসা। লেখিকা লিখিত অন্য কোনও বইয়ের নামও উল্লেখ করা হয়নি। 

 নামকরণের বিষয়ে কোথাও পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়নি। অনেক খুঁজে পেলাম এর অর্থ আলোকপ্রাপ্ত মন। বইয়ের উৎসর্গে লেখা আছে - “শুভেচ্ছাসহ, সকল আলোর পথযাত্রীকে”। গল্পের শেষে চরিত্রদের আত্মার পরিশুদ্ধিকরণকেই আলোকপ্রাপ্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে নামকরণ সুন্দর অর্থবহন করে। পাঠকও বিভিন্ন ভাবে সেই আলোককে স্পর্শ করে মুগ্ধ হন। 

দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত অলংকরণ 

বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী সুব্রত মাঝি। প্রচ্ছদ বেশ মনোরম। দেখে আকর্ষণ তৈরি করতে বাধ্য। দেশ পত্রিকায় প্রকাশকালে গল্পের সাথে কিছু অলংকরণও থাকত। যা অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে প্রাচীনকালের গল্পের ক্ষেত্রে আঁকা অলংকরণ বইয়ে আলাদা মাত্রা যোগ করে। কিন্তু বইয়ে একটিও অলংকরণ রাখা হয়নি। কারণ বুঝলাম না। রাখলে সত্যিই খুব সুন্দর হত বইপাঠ। 

কিন্তু তবুও এই বই অন্তত একবার পড়তে হয়। কারণ লেখিকার লেখনীর গুণ। যদি এই উপন্যাস কেউ শুধুমাত্র গল্প কাহিনী না ভেবে পড়েন তাহলে নিরাশ হবেন না। সুন্দর, বাঙময়তা ফুটে উঠেছে লেখার মাধ্যমে। কিছু কিছু বর্ণনা এত সুন্দর যে পাঠক যেন সত্যিই সেই পরিস্থিতি পরিবেশকে অনুভব করতে পারবেন। কোনও কোনও সময় যেন মনে হবে সেই বরফ ঘেরা রহস্যময় পাহাড় বেষ্টিত উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছি। তথাগত বুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত মঠের থেকে ধীর ও গম্ভীর লয়ে প্রার্থনা মন্ত্র ভেসে আসছে। শুদ্ধ করে দিচ্ছে শরীর ও আত্মা। এখানেই এই উপন্যাসের সফলতা। শুধুমাত্র লেখনীর গুণেই লেখিকা যেন তুলি বুলিয়ে এঁকে দিয়েছেন এক অজানা অচেনা জগতকে। যা অনুভব করা যায় আত্মার অন্তঃস্থল দিয়ে।     


Document

পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ গৃহবধূ। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ায় শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহ ও ভালোবাসা। বর্তমানে স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিদেশে এসে সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অভাববোধ থেকে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণের অবলম্বনরূপে লেখার শুরু। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও লেখা পড়তে ক্লিক করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ