ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

হৃদয়ের পৃষ্টা – ৩ -তুষার সরদার


খন এক গ্রাম্য জুনিয়র হাই স্কুলে পড়তাম। এর আগের এই রকম এক টুকরো লেখায় বলেছিলাম আমাদের স্কুলটার নাম ছিল  কাদিপুকুর জুনিয়র হাই স্কুল। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে স্কুলটা অবস্থিত। এটাই হল আমাদের সবচেয়ে কাছের স্কুল। ওই স্কুলে যেতে হলে এক দীর্ঘ অসমান মেটে অপরিসর রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সেই রুগ্ন রাস্তাটা আরো পাঁচটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে অতি কষ্টে এঁকেবেঁকে যেতে যেতে আমাদের স্কুলটার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। স্কুল পেরিয়ে সেই ক্লান্ত রাস্তাটা না থেমে আরও এগিয়ে গিয়ে আরও কয়েকটা গ্রাম ছুঁয়ে কোথায় যেন চিরকালের মতো চলে গেছে।

শীতে ও গ্রীষ্মে অভাগা রাস্তাটা কমবেশি ঘন ধুলোয় ভরে থাকে। সেই অত বেশি গ্রাম্য পথে পায়ে জুতোমোজা বা চটি পরে যাবার কোনো বালাই ছিল না। ধুলোভরা নরম রাস্তায় হেঁটে যেতে খুব খারাপ লাগত না, যদি না পথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন কাঁটা-গাছের কাঁটা মাঝে মাঝে ঝরে পড়ে ধুলোর মধ্যে ঢুকে থাকত। পুরো বর্ষাকালে ও শরৎকালে প্রথম দিকে রাস্তাটা সম্পূর্ণ বিপরীত রূপ ধারণ করত।  তখন পুরো রাস্তাটা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডোবা কাদায় থকথক করত। সতর্ক পায়ের নিরুপায় নখগুলো টিপে টিপে সেই পিচ্ছিল রাস্তায় এক যন্ত্রণাকাতর হা-ক্লান্ত পথ চলা যেন আর শেষ হতে চাইত না।

যে সময়ের ঘটনাটা বলতে যাচ্ছি সে সময় আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছি। আমাদের স্কুলটা জুনিয়র হাই স্কুল ছিল বলে সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তই পড়া যেত। আমাদের গ্রাম থেকে আরও তিন চারজন ছেলে সেই স্কুলে পড়তে যেত। তবে নানা কারণে আমাদের যাওয়া আসাটা প্রত্যেক দিন একসঙ্গে হয়ে উঠত না। তাছাড়া সবাই একই ক্লাসে পড়তাম না। সেজন্য স্কুলে যাওয়াটা মোটামুটি একসঙ্গে হলেও ফেরাটা একসঙ্গে হত না। কারণ বিভিন্ন ক্লাসের আগে পরে ছুটি হত। আমাদের ক্লাসের ছুটি হত সবশেষে।


বিকেলে স্কুল ছুটির পর ফেরার পথে তৃতীয় গ্রামটার নাম ছিল চৌকিতলা। এই গ্রামটা থেকে বেরোবার মুখে মাঝে মাঝে একটা মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যেত। কখনও গ্রামের ভিতরের সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বা কখনও রাস্তার পাশের বাগানে বা গাছতলায় ঘোরাঘুরি করতে করতে সে আমাকে দেখতে পেলে দাঁড়িয়ে পড়ত। আমাকে দেখলে তার মুখে দেখা দিত অজানা হাসির ফিনকি। 

আমার দিদি আমার থেকে তিন বছরের বড়ো। এই মেয়েটা আমার দিদির থেকেও বয়সে বড়ো বলে আমার মনে হয়েছিল। সেজন্য সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসত বলে প্রথম প্রথম আমার আলাদা করে বিশেষ কিছু মনে হয়নি। কিন্তু কিছুদিন পরে তাকে, মানে তার হাবভাব কিছু কিছু বিশেষ রকমের বলে মনে হতে লাগল। 

মেয়েটাকে সব দিনই শাড়ি পরে থাকতে দেখতাম। অবশ্য তখনকার সময়ে গ্রামের দিকে সব মেয়েরাই একটু বড়ো হয়ে গেলেই শাড়িই পরত। মাথার চুল সব সময় হাতখোঁপা করে বাঁধা থাকত। যতদূর মনে করতে পারছি, তার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলাটে। সে দেখতে ভালো ছিল কী ছিল না তা বিচার করার ক্ষমতা তখনও আমার মধ্যে ঠিকমতো তৈরিই হয়নি। মেয়ে বা পুরুষ যেই হোক, আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করলেই তাকে দেখতে মোটামুটি ভালো বলেই আমার মনে হত।

একদিনের কথা। তখন বেশ গরম পড়ে গেছে। আকাশে বাতাসে একটা খাঁ খাঁ ভাব। সময়টা খাতায়-কলমে অবশ্য গ্রীষ্মকাল নয়। তবুও অতি বৃদ্ধ চৈত্র দেমাকী বসন্তের পায়ে পড়ে কাকুতিমিনতি করলেও সে প্রায় চলেই গেছে। সেদিন আমি একা একা স্কুল থেকে ফিরছি। আমাদের গ্রামের যে ছেলেটা আমার ক্লাসে পড়ত সে সেদিন স্কুলে আসেনি। আমাদের গ্রামের বা অন্য গ্রামের ছাত্ররা যারা সেদিন এসেছিল, তাদের ক্লাস আগে ছুটি হওয়ায় তারা সবাই আগে চলে গেছে।   


চৌকিতলা নামের গ্রামটা থেকে বেরিয়ে আসার শেষে রাস্তার ডানপাশে একটা খুব বড়ো বটগাছ আছে। সারাবছর সেই গাছটা তার তলার রাস্তার অনেকটা জুড়ে ঘন ছায়ার ছাতা ধরে থাকে। গ্রামে ঢোকার আগে সময় থাকলে পথিকরা সেখানে বিশ্রাম নেয়। রাস্তার ডানপাশের সেই  বটগাছের গোড়া থেকে হঠাৎ অচেনা মেয়েলি গলায় কেউ বলে উঠল - 
‘এ্যাই ছেলেটা! ভেল্‌ভেলেটা, আমাদের বাড়ি যাবি? ...’

চমকে গিয়ে তাকিয়ে দেখি সেই মেয়েটাই বটগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে আমাকেই প্রশ্নটা করেছে। কারণ আমার আশেপাশে আর তো অন্য কেউ নেই। প্রশ্নটা আসলে ছিল একটা মুখে মুখে প্রচলিত ছড়ার অর্ধেকটা। ছড়াটার বাকি অংশটা অবশ্য বলল না সে। কিন্তু তার সেই অভাবিত বলে ওঠায় বেশ ঘাবড়ে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর উত্তরে কিছুই না বলে খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলাম। বেশ খানিকদূর গিয়ে পিছন ফিরে দেখি তখনও সে আমার দিকে একমুখ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে।

 তার পর থেকে তার সঙ্গে আমার দেখা হলে সে দু’চোখে অনেক কথা আর কীরকম যেন এক হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। কেন জানিনা তার সেই রকম হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার ভালো লাগত না। সংকোচে কিছু বলতেও পারতাম না। তাছাড়া আমি তখনও পর্যন্ত তেমন বলিয়ে-কইয়ে স্বভাবের হয়ে উঠতে পারিনি। অবশ্য এই এখনও পর্যন্ত সেই স্বভাবের হওয়া আর হয়ে ওঠেনি।

আমার সঙ্গে কেউ থাকলে সে আমাকে কোনো কিছু বলত না। কিন্তু যেদিন আমি একা ফিরতাম সেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কিছু না কিছু সে বলতই। বেশির ভাগ সময়েই তাদের বাড়িতে আমার যাওয়ার কথা বলত, কখনও ওই রকমের ছড়াটড়া বলত বা ছড়া ছাড়া এমনিই বলত। দেখা হয়ে গেলে আমাকে কেন যে সে তাদের বাড়িতে যাবার কথা বলত তা বুঝে উঠতে পারতাম না।

বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যৌনতা তখন আমার মনে দেহে স্বাভাবিক অনুক্রমে গুটি গুটি পা ফেলছে। আমার গলার স্বর মোটা হয়ে গেছে। নারী পুরুষের বাহ্যিক ও দৈহিক তফাৎগুলোর কিছু কিছু বুঝতে পারছি। কিন্তু সে সবই খুবই ভাসা ভাসা ধারণা। সেসব ধারণার তেমন কোনো গভীরতা ছিলই না। এসব ব্যাপারে কিছু কিছু জানলেও সেই জানার পর আরও বেশি কিছু জানার কৌতূহল তখনও তৈরিই হয়নি। 

তবে সেসময় প্রায়ই দেখা যেত আমার মতো এইরকম বয়সের ও মনের ছেলেদের একা একা পেলে গল্প করার ছলে তাদের মনে যৌনতার নানা কদর্য পাঠ জোর করে গেঁথে ঢুকিয়ে দেবার মতো বয়স্ক ছেলে দু’চার জন প্রায় সময়েই জুটে যায়। এখন তো আর ওই রকম কাউকে লাগেই না। স্মার্ট ফোন আর টিভি এইসব দায়িত্ব অতি সফল দক্ষতায় পালন করছে।

অবশ্য আমাদের গ্রামে বা আমাদের ক্লাসে সেইরকম কোনো পোক্ত বয়স্ক ছেলে আমার বন্ধুত্বে ছিল না। ফলে এসব ব্যাপারে তখনও ঠিকমতো পেকে উঠতে পারিনি। তবুও মনে হত বয়সে বেশ বড়ো ওই মেয়েটি আমার সঙ্গে অন্য কোনো এক রকম আচরণ করতে চাইছে। কিন্তু কেন যে করতে চাইছে আর ঠিক কী যে চাইছে সেটা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারতাম না।

একদিন বিকেলে স্কুল থেকে একা ফিরছি। তাদের গ্রামের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা রাস্তার পাশের সেই বটগাছটার গোড়ায় সে বসেছিল। আমার জন্যে নাকি? কিন্তু তাই বা কেন হতে যাবে? আমি কাছে আসতেই সে বলে উঠল - 
‘এ্যাই ছেলেটা! তুই আমাকে ভয় পাস কেন বল তো? তুই না ব্যাটাছেলে! এমনি একটা মেয়েকে দেখে তোর এত ভয় কেন?’ 
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বুকটা ধুকপুক করছিল। হাঁটাও কখন যেন থেমে গিয়েছিল। সে এবার আর একটু এগিয়ে এল -
‘চল্‌ না বাপু আজ আমাদের বাড়িতে। তোর সঙ্গে কত গল্প করব। যা যা খেতে পছন্দ করিস তাই খাওয়াব তোকে, যাবি?’ 
মুখে কিছু না বলে অথবা বলতে না পেরে শুধু জোরে দুদিকে মাথা নেড়ে হন্‌হন্‌ করে আমি আবার সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।  পিছন থেকে তার ফিনকি হাসি এবার শব্দের ফেনা তুলে আমার কানে এসে পৌঁছুতে লাগল।


বিকেলে বাড়ি এসে পড়ার ঘরে দিদিভাইকে আলাদা ডেকে সেদিনের ব্যাপারটা না বলে পারলাম না। দিদিভাই বরাবরের মতো মুখে সর্বজ্ঞের ভাব এনে আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনল। কথার মাঝে মাঝে তার বরাবরের অভ্যাসমতো এবারে কিন্তু আমার কথার মাঝখানে কোনো ফুট কাটল না। অবশ্য গত ক’দিন হল আমাদের মধ্যে তেমন মারপিট হচ্ছে না। সবটা শুনেটুনে দিদিভাই জিজ্ঞাসা করল -
‘তা তুই নিজে এখন কী চাইছিস ভাই, সেটা বল্ আগে। একদিন সেই মেয়েটার বাড়িতে যেতে চাস্ নাকি? চাইলে কোনো...’
‘একদম না! অচেনা অজানা কেউ ডাকল তাদের বাড়ি যাবার জন্য, আর আমি চলে যাব তাদের বাড়িতে? কক্ষণো না!’
‘এত ছিটকে ওঠার কী আছে ভাই? হয়তো মেয়েটার নিজের কোনো ভাইটাই নেই। হয়তো তোর সঙ্গে ভাই পাতাতে চায়। যা চাইবি তাই খাওয়াবার অফার যখন দিচ্ছে, আমি বলি কী একদিন চলেই যা তাদের বাড়িতে। তোর পছন্দমতো খাওয়া দাওয়ার পর যদি তোকে কুলের আচার খেতে দেয়, তুই তো ওসব খাস না, সবটুকু আমার জন্য নিয়ে আসিস। যদি ওটা তোকে খেতে নাও দেয়, তবে খানিকটা কুলের আচার ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিবি ভাই আমার জন্য। সব বাড়িতেই আজকাল কুলের আচার থাকে।’ 

দারুণ অবাক হয়ে তার গম্ভীর মুখের দিকে তাকালাম। দিদিভাই আমাকে এসব কী বলছে! অচেনা কারো বাড়িতে ডাকলেই সেখানে খেতে চলে যাব! খেয়েদেয়ে আবার তাদের বাড়ি থেকে ওর জন্য কুলের আচার নিজের মুখেই চেয়ে আনব?
‘ক্কী বলছিস তুই দিদিভাই? আমি তাদের বাড়িতে একাই চলে যাব? গিয়ে খাবার খেতে চাইব? আবার তোর জন্যে কুলের আচার চাইব? অসম্ভব! আমি যাবই না, আর কোনোকিছু চাইতে পারবই না!’
‘না চাইতে পারবি তো চাইবি না। তুই যেটা সহজে করতে পারবি সেটাই কর্! তুই বরং একটা খুব সহজ কাজ কর্‌। তুই তোর ‘চার পা তুলে হট্টমূলার গাছে ঝুলে থাকগে’! খুব খিদে পেলে ‘হট্টমূলা’ পেড়ে পেড়ে খাবি! হি হি হি-! 
অনেক চেষ্টায় ধরে রাখা এতক্ষণের নকল গাম্ভীর্য আর ধরে রাখতে না পেরে দিদিভাই কুলকুল করে হাসতে হাসতে পালাতে লাগল। আমি ওর পিঠ লক্ষ্য করে একটা জোরালো কিল ছুঁড়লাম। কিন্তু সেটা হাওয়ায় ঘুরে এল। ইস্‌! কেন যে ওকে এসব কথা বলতে গেলাম! আমাকে কোনো ভালো পরামর্শ দেওয়া দূরে থাক, সব শুনে শুধু শুধু মজা করল আমার সমস্যাটা নিয়ে।


পর পর কয়েকদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মেয়েটার সঙ্গে দেখাটেখা হল না। মনে হয় কোনো আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতেটুরতে গেছে। ঘুরুক ঘুরুক, ভালো করে লম্বা লম্বা মেয়াদে তার মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি, প্রাণভরে ঘুরুক। আমাদের স্কুলে সেই গ্রীষ্মের ছুটি না হওয়া পর্যন্ত বাইরে বাইরে ঘুরুক। স্কুল থেকে ফেরার পথে দ্বিতীয় গ্রামে রাস্তার পাশে একটা ঠাকুর থান আছে। কিন্তু কোন ঠাকুরের থান সেটা খেয়াল করিনি। আজ দেখলাম সেটা শিবঠাকুরের থান।

মায়ের কাছে শুনেছি শিবঠাকুর খুব সরল সোজা আর বড়ো দয়ালু দেবতা। আজ সেই থানে গিয়ে মাথা ঠেকালাম। এমন কী আমার কাছে বহুমূল্য একটা পঁচিশ পয়সার কয়েন প্রণামীর বাক্সে দিয়েই ফেললাম। জোড় হাতে প্রার্থনা জানালাম, স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়া পর্যন্ত  মেয়েটাকে এখানে ফিরে আসতে দিও না ঠাকুর। যদি তাকে আটকে রাখো তাহলে গ্রীষ্মের ছুটির নোটিশ যেদিন দেবে সেদিন ফেরার পথে তোমাকে পঞ্চাশ পয়সার কয়েন প্রণামী দেব বলে মানত করলাম।

দিন চারেক পরে স্কুল থেকে ফিরছিলাম। আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। সেদিন আমি একাই ফিরছি। তবুও চৌকিতলা গ্রামটায় ঢুকে নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছি। শিবঠাকুরের কাছে মানত করা আছে। গ্রীষ্মের ছুটি পড়া পর্যন্ত আমার কোনো সমস্যা নেই। গড়ানো দুপুরের রাস্তায় লোকজন নেই বললেই হয়।

প্রায় সব গ্রামের শেষের দিকে লোকবসতি কমে আসে। চৌকিতলা গ্রামেও তাই একেবারে শেষের দিকটায় লোকজনের বসতবাড়ি নেই। রাস্তার দুদিকেই শুধু আনাজপাতির বাগান আছে। ছোটো বা মাঝারি গাছপালাও আছে। সেরকম এক জায়গার কাছে আসতেই তার গলা শোনা গেল। সেই গলা শুনে দারুণ চমকে গিয়ে সেদিকে তাকালাম। মানত করলেও মেয়েটা তাহলে এর মধ্যে ফিরেই এল! কবে এল! -
‘এ্যাই! আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরছিস যে? আজ তো শনিবার নয়? তবে স্কুল পালালি নাকি?’
সে আমার স্কুল পালানোর কথা বলতে আমার খুব অপমানবোধ হচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার কথার উত্তর দেবার কোনো চেষ্টা না করে আবার এগোলাম। সেও আমার দিকে খানিক এগিয়ে এল। তার চাপা গলা শোনা গেল - 
‘এ্যাই ছেলে, শোন্‌ না! আমার সঙ্গে ওপাশের ওই কলাবাগানের ভেতরে একবারটি যাবি? ওখানে গিয়ে আমি তোকে  একটা দারুণ মজার জিনিস দেখাব। আয় না আমার সঙ্গে!’

খুব জোরে মাথা নেড়ে হন্‌হন্‌ করে আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সে হি হি করে হেসে উঠল। সেদিন থেকে তাকে কী এক অদ্ভুত রকমের ভয় পেতে শুরু করলাম। যদিও আমি এমনিতে দারুণ ডানপিটে ধরনের ছেলে ছিলাম। ভূতপ্রেতের, সাপখোপের, অন্ধকারে একা একা থাকতে বা পথ চলতে – কোনোকিছুর থেকেই আমার কোনো রকম ভয়ডর ছিল না। কিন্তু এটা ছিল অন্য একরকমের ভয়। শুধু ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলেই এই বিশেষ ধরনের ভয়টা আমার মনের ভিতর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠত। 

তার পর থেকে ফেরার সময় আমি সঙ্গী জোগাড় করে আসার চেষ্টা করতাম। কারণ আমার সঙ্গে কেউ থাকলে সে কিছু বলত না। কিন্তু সবদিন সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। অবশ্য প্রত্যেক দিনই যে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত, তা নয়। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে একা ফিরছি দেখে আমাকে সে বলল - 
‘এ্যাই ছেলেটা, শোন! আমি বাঘ না ভাল্লুক যে তুই আমাকে এত ভয় পাস? আমি তো একটা মেয়ে বই আর কিছু নয়। তুই একা একা আমার কাছে এলে আমি কি তোকে ধরে কাঁচা খেয়ে ফেলব?’ 

যথারীতি এবারেও কোনো উত্তর দিয়ে সেইরকম ধুকপুক বুকে যত জোরে পারি হেঁটে চলে গেলাম। অবশ্য তার ওই সব প্রশ্নের কোনো ঠিকঠাক উত্তরও আমার কাছে ছিল না। মনে ভাবতাম এরকম অস্বস্তিকর ব্যাপার আমার সঙ্গে আর কতদিন ধরে চলবে? 

মেয়েটা আমাকেই বা এভাবে বিব্রত করছে কেন? এভাবে বেশি দিন চললে স্কুলে যাওয়া আসার পথ বদলাতে হবে। কিন্তু তাতে পথের দূরত্ব, সময় ও কষ্ট অনেক বাড়বে। হঠাৎ একদিন ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারে অভাবিত এবং চরম পর্যায়ে চলে গেল।


সেদিনটা শনিবার ছিল। দুটোর মধ্যেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমাদের গ্রাম থেকে সেদিন আমি ছাড়া অন্য কেউ স্কুলে যায়নি। ফলে আমি একা একাই বাড়ি ফিরছিলাম। শেষ চৈত্রের খাঁ খাঁ গড়ানো দুপুরে গ্রামের পথঘাট শুনশান – একেবারেই নির্জন। বড়ো নিঃশব্দও বটে। আশপাশের বা দূরের গাছ থেকে ভেসে আসা হালকা পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। 
সেই গ্রামটায় ঢুকে মনে হল আজকে আর সেই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবার কোনো ভয়টয় নেই। এই বেশি গরমের দুপুরে সবার মতো নিশ্চয়ই সে বিশ্রাম নিতে ঘরেই থাকবে। কিন্তু সেই বটতলার খানিকটা দূরে আসতেই অকারণেই আমার বুকের সেই চেনা ধুকপুকুনিটা শুরু হয়ে গেল। আজও যদি সে ওখানে আশেপাশে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে! 

বটতলার আরও কাছকাছি এসে হাঁটার গতি কমিয়ে ভালো করে নজর চালিয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। বটগাছটার আশ্বাসভরা ছায়ায় ঢুকে এসে ভালো করে বড়ো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। শুধু ক্লান্ত বাতাস আর বোবা গাছপালা ছাড়া সেখানে কেউ ছিল না। শুধু একটা ধুলোরঙের শীর্ণ গিরগিটি মৃত রাস্তাটার মাঝ বরাবর ধুলোর রঙ গায়ে মেখে প্রায় অদৃশ্য হয়ে শুয়েছিল। আমি খানিকটা কাছে আসতেই সেটা ফরফর করে বটগাছের গুঁড়ির দিকে ছুটে গিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। 

জায়গাটা গ্রামের শেষপ্রান্ত। বটতলার খানিক পরেই ডানদিকে আদিগন্ত ফাঁকা ধানক্ষেত। একটু এগিয়ে বাঁদিকে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, শিরীষ ইত্যাদি গাছ ও ঝোপঝাড়ের ঘন জটলা। তার পরে দু’দিকেই ফাঁকা মাঠ। বেশ নিশ্চিন্ত আর ফুরফুরে মনে সেই জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় পরিচিত সেই গলায় ডাক এল - 
‘এ্যাই -!!’ 
একেবারেই অপ্রত্যাশিত জায়গায় চলে এসে সেই পরিচিত ডাকে ভীষণ চমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে সেদিকে ঘুরলাম। প্রথমে তাকে ঠিকমতো দেখতেই পাচ্ছিলাম না। বাঁদিকের গাছপালার সেই জটলার মধ্যে থেকে সে অন্য রকমভাবে বেরিয়ে এসে আমার কাছে এগিয়ে এল। তার মাথার চুল আজ পুরো খোলা... তার শাড়ির আঁচল আজ তার বুকে নেই, কোমরে গোঁজা... তার মসৃণ অনাবৃত পেট, এলোমেলো ব্লাউজে আধঢাকা তার বুকদুটোর দিকে তাকিয়ে আমার যেন দম আটকে এল। এরকম ভাবে জীবনে কখনও কাউকে দেখিনি। খুব রহস্যময় হাসি হেসে পিছনের গাছের জটলার দিকে আঙুল দেখাল সে -
‘ওখানে ভেতরের দিকে একটা জামগাছ আছে। পাকা জামে ভরতি। সেই গাছটা থেকে আমাকে কটা পাকা জাম পেড়ে দিবি আয়।’
আমি জড়িয়ে মড়িয়ে কোনোমতে না বলতে যাচ্ছি, তার আগেই খুব ঘেঁষে এসে খুব নরম করে আমার বাঁ-হাতটা ধরে নিয়ে বলল -
‘আয় না রে ছেলে, ওখানে গিয়ে আমাকে পাকা জাম পেড়ে দিলে আজ তোর সব ভয় কাটিয়ে দিয়ে আমি না তোকে একদম একটা সত্যিকারের বড়োছেলে করে দেব!’
তার কথাগুলো ঠিক ঠিক বুঝলাম না। বোঝার কথাও নয়। তবুও কী যেন একটা খুব ঝাপসামতো কিছু বুঝলাম। হ্যাঁচকা টান মেরে কোনোমতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে রাস্তা বরাবর প্রাণপণে দৌড় দিলাম। পলায়মান আমার পিছন পিছন তার খিল্‌খিলে
হাসির ছররাগুলো ধাওয়া করে আসতে লাগল...।


তার পর থেকে আমি সেই গ্রামের পথটকু এড়াবার জন্য চৈত্রের ফসলশূন্য মাঠে নেমে গিয়ে ঘুরপথে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। তাতে আরও বেশি ঘুরতে হত, অনেক কষ্টও হত। তবু তাই-ই করতাম। এতে কষ্ট বেশি হলেও নির্ভয়ে আর নিশ্চিন্তে স্কুলে যেতে পারতাম। কিছুকাল পরে স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে যেতে আমার সব সমস্যা তখনকার মতো মিটে গেল।

গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হবার পরও আবার ওই রকম কিছুটা গ্রামের পথে আর কিছুটা মাঠের পথে স্কুলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এই সুযোগ খুব বেশিদিন পেলাম না। মাসখানেক মধ্যেই বর্ষা নামতে জলে মাঠ ভরে গেল। ফলে আবার সেই ধুকপুকে বুক নিয়ে গ্রামের পথ দিয়ে যেতে আমি বাধ্য হলাম। কিন্তু আমার সৌভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে দেখা হল না। 

বর্ষা পেরিয়ে পুজোর ছুটি পড়ে গেল। পুজোর ছুটির পর আবার স্কুল শুরু হল। অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা না হবার ফলে ততদিনে  আমার সাহস বেশ কিছুটা বেড়ে গেছে। পুরোটাই এবার গ্রামের ভিতরের পথ দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম। কিছুদিন পর স্কুলে যাবার পথে গ্রামের ভিতরে হঠাৎ একদিন তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। প্রথমে একটু থমকে তার পর খুব অবাক হয়ে গেলাম তাকে দেখে। 

তার সিঁথিতে সিঁদুর। দু’হাত ভর্তি শাঁখা পলা চুড়ি। সে যেন এই ক’মাসে বেশ বড়ো হয়ে গেছে। বুঝলাম যে এর মধ্যে কোনো এক  সময়ে তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন অন্য কোথাও অর্থাৎ তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে। সেজন্যই এই গ্রামের রাস্তায় তার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছিল না। সেদিন রাস্তায় সে আমার বিপরীত দিক দিয়ে হেঁটে আসছিল। হাঁটতে হাঁটতেই সে আমার দিকে চোখ তুলে ভুরু নাচিয়ে একবার মিচকে হাসল। কিন্তু আমাকে মুখে কোনো কিছু বলার চেষ্টা করল না। 

অকারণে, অন্তত তখন আমার কাছে দুর্বোধ্য কারণে, তাকে দেখে সেদিন কিন্তু আমার ভয় করছিল না। তার পর থেকে তার সঙ্গে আর আমার দেখাই হয়নি। আমি নিশ্চিন্তে গ্রামের পথে স্কুলে যেতাম আসতাম। দু’মাস পরে আমার পড়া সেই স্কুলে শেষ হয়ে গেছিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ