ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

দেব-দেউলের কথা (পর্ব-১) : নানা উত্থানপতনের সাক্ষী, ৩০০০ বছরের প্রাচীন মুণ্ডেশ্বরী মন্দির -সুমনা সাহা


প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতেই একটি ঠাকুরঘর, কিম্বা স্থানাভাবে যেকোন ঘরেই গৃহদেবতার একটি সিংহাসন, তারও অভাবে নিদেন পক্ষে ঘরের মধ্যে কোনও একটি কুলুঙ্গিতে রাখা থাকে প্রিয় দেবতার পট বা মূর্তি। ব্রাহ্মণ পরিবারে আমার জন্ম, ফলে আশৈশব পুজো অর্চনার আবহে অভ্যস্ত। শিশুকে যা শেখানো হয়, তাই শেখে। কিন্তু বড় হয়ে নিজের যুক্তিতর্ক দিয়ে সে বুঝতে চায়, কাকে ভক্তি করি, কেন করি। পারিবারিক বিশ্বাস, পরম্পরা এসব ছাপিয়েও অনেক সময় অন্তরের জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল হয়ে উঠে ঠেলে দেয় নিরন্তর এক সন্ধানে। অন্তরের সেই আর্তির প্রেরণাই ভক্তি ও তর্কহীন বিশ্বাসকে একপাশে রেখেও খোলামনে সবটুকু দেখতে চায়। এই দেখা প্রকৃতপক্ষে এক খোঁজ—মন্দিরে স্নান করে শুচিবস্ত্রে যাওয়ার নিয়ম পালনের থেকেও মন্দিরের দেওয়ালে খোদিত সুদূর অতীতের কোনও শিল্পী মনের অপরূপ সৃজন দেখার আগ্রহ যখন বড় হয়ে দাঁড়ায়। মন্দিরের চার-দেওয়াল কি শুধু উপাসনাকেই ধরে রাখে? কত যুগের কত গল্পও তো বলে। হিন্দু পরিবারে জন্ম বলেই সুযোগ হয়েছে হিন্দু মন্দিরগুলোই দর্শন করার, তাই আমার লেখায় মসজিদ বা গির্জার কথা থাকবে না, একদিক থেকে তা ধর্মনিরপেক্ষ বিশাল ভারত-ভূখণ্ডের সর্বপ্রকার উপাসনা-পদ্ধতি, উপাসক-সম্প্রদায় তথা বিভিন্ন ধর্মমতের উপাসনালয়ের সামগ্রিকতাকে ধরতে না পারার অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট। আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে পঠিত ও লব্ধ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করেই ভারতের দেব-দেউল নিয়ে লেখার এই চেষ্টা। কোনও ধর্মীয় মতবাদের সমর্থন, বিরোধিতা বা পক্ষপাত কিম্বা কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও এটি লেখা হয়নি। ভারতের প্রাচীন কয়েকটি মন্দির, সেসব গড়ে ওঠার নেপথ্য ইতিহাস, মন্দির ঘিরে নানা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিংবদন্তী—এসমস্তই এই লেখার উপজীব্য। এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বাণী স্মরণ করি—“The moment I have realized God sitting in the temple of every human body, the moment I stand in reverence before every human being and see God in him – that moment I am free from bondage, everything that binds vanishes, and I am free”.



পর্ব ১

নানা উত্থানপতনের সাক্ষী, ৩০০০ বছরের প্রাচীন মুণ্ডেশ্বরী মন্দির

জ থেকে অনেক কাল আগের কথা। ভারতে তখন বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রবল। ভগবান বুদ্ধের কথা ভিক্ষু পরিব্রাজকদের মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিল এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে। বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আরও গভীর ভাবে জানতে, বৌদ্ধ পুঁথি ইত্যাদির উপর অধ্যয়ন করতে এশিয়ার নানা দেশ থেকে পরিব্রাজকরা ভারতে আসতেন। সেসময়, বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত স্থানগুলির মধ্যে বিহারের পাটলিপুত্র ছিল অন্যতম, যার বর্তমান নাম পাটনা, সেখানেই ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। চীন দেশ থেকে একজন জ্ঞানপিপাসু মানুষও (৬৩৬-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ) ভারত-ভ্রমণে এসেছিলেন। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি পৌঁছালেন পাটলিপুত্র নগরের কাছাকাছি, একটি মালভূমি অঞ্চলে। উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো সেই উপত্যকা গভীর জঙ্গলে ঢাকা। পাহাড়ের শানুদেশ বেয়ে বয়ে চলেছে শোন নদের ধারা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। জঙ্গলের ভিতরে প্রায় ২০০ লি* দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি পাহাড়ের চূড়ায় তিনি একটি আলো জ্বলতে দেখতে পেলেন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে অতদূর থেকেও তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন সেই আলো। তাঁর মনে হলো, ওখানে একটি মন্দির আছে। দিনলিপিতে লিখে রাখলেন এই দর্শন। সহজেই অনুমান করা যায় যে, সেইসময় সন্ধ্যা হয়েছিল। অন্ধকার না হলে কি করে আলো দেখবেন? আর এটাও হয়তো অনুমান করা যায় যে, জঙ্গলাকীর্ণ সেই দুর্গম পার্বত্য পথটি দ্রুত অতিক্রম করে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সেই মন্দিরটি তাঁর আর দর্শন করা হয়ে ওঠেনি। তখন না ছিল এত রাস্তাঘাট, না বৈদ্যুতিক আলো, না হোটেল, গেস্ট-হাউজ বা দ্রুত যোগাযোগের কোনরকম ব্যবস্থা। মানুষ বহু কষ্ট স্বীকার করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। বাণিজ্যের প্রয়োজনে, শাস্ত্র-অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে কিম্বা দুঃসাহসী কেউ নতুন দেশ দেখার নেশায় ঘরের বার হতেন। পথে কারো দস্যুর হাতে প্রাণ যেত, কেউ পথ হারিয়ে ফেলে চিরতরে ঘরছাড়া হয়ে যেতেন, কেউ রোগব্যাধিতে বা হিংস্র জন্তুর আক্রমণে প্রাণ খোয়াতেন। তবুও মানুষের অন্তরের অভিযাত্রী সত্তা কিছুতেই বাধা মানে না। দূর থেকে আগত এই মানুষটিই বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং। তাঁর দেশের মানুষ, তাঁর আপনজনেরা নিশ্চয় তাঁকে নিষেধ করেছিলেন, দূর দেশের বিপদের কথা বলে ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, “এক জায়গায় শান্তিতে বেঁচে থাকার চেয়ে বরং ঝুঁকি নিয়ে দূর দেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে মরাও ভালো।” বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পাঁচ বছর বৌদ্ধ ধর্ম ও নানা বিষয় অধ্যয়ন করেছেন। ভাগলপুরের কাছে চম্পা বৌদ্ধবিহারও দর্শন করেছেন। যুগে যুগে এমনই কত শত অভিযাত্রীরা দেশে দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন, অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েও লিখে রেখেছেন তাঁদের ভ্রমণের কথা, সেই সমস্ত সময়ের কথা, নতুন নতুন জায়গার নতুন ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতির কথা। বিশ্বের ইতিহাসে সেসবের মূল্য অপরিসীম। হিউয়েন সাং তাঁর ডায়রিতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নোট করেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা, সাজ-পোশাক, খাবার দাবার, শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজে নানা স্তরের মানুষের পেশা ও জীবনযাপন সম্বন্ধে। যে মন্দিরের আলো দেখবার কথা তিনি তাঁর ভ্রমণকথায় লিখলেন, বৃহত্তর বিশ্বের মানুষের কাছে সেই মন্দির পরিচিতির আলোয় এল এর আরও অনেক পরে। হিউয়েন সাং-এর লিখিত বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে জানা গেল যে, সেটাই ভারতের প্রাচীনতম মন্দির, মুন্ডেশ্বরী পাহাড়ের উপরে দেবী মুণ্ডেশ্বরীর মন্দির। লি-এর মান এখন পরিবর্তিত হয়েছে, হিউয়েন সাং যখন লিখেছিলেন, তখন ‘লি’ ছিল এক মাইলের এক-তৃতীয়াংশ। এখন এর দৈর্ঘ্য ৫০০ মিটার বা আধ-কিলোমিটার বা ১৬৪০ ফুট। 
তৎকালীন মুণ্ডেশ্বরী মন্দিরের চিত্রাঙ্কন

বর্তমান মুণ্ডেশ্বরী মন্দির (২০১৭ সালে তোলা ছবি)


দেশে প্রচুর প্রাচীন মন্দির থাকা সত্বেও কেন মুণ্ডেশ্বরী মন্দিরকে কেবল ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রাচীনতম মন্দির বলে দাবী করা হয়, তার কারণ আছে। ভারতে প্রাচীন মন্দিরের সংখ্যা অনেক। যেমন- আইহোলের দুর্গা মন্দির, আদি কুম্ভেশ্বর মন্দির, বদ্রিনাথ মন্দির, বৃহদীশ্বর মন্দির, চেন্নাকেশব মন্দির, দ্বারকাধীশ মন্দির, কেদারনাথ মন্দির, মীনাক্ষী আম্মান মন্দির, লিঙ্গরাজ মন্দির, সোমনাথ মন্দির, তুঙ্গনাথ মন্দির, শ্রীরঙ্গনাথস্বামী মন্দির প্রভৃতি। কিন্তু কোন না কোনও কারণে সেসমস্ত মন্দির বারম্বার ধ্বংস হয়েছে, প্রাকৃতিক কারণে বা বিধর্মীদের আক্রমণে, আবার পুনর্নির্মিত হয়েছে। কিন্তু প্রায় ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত মুণ্ডেশ্বরী মন্দিরে ২৫০০ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বজায় রয়েছে পুজোর ধারা, আজ পর্যন্ত এক দিনের জন্যেও এখানে পুজো বন্ধ হয়নি। মন্দিরের কাছেই পাওয়া গেছে একটি প্রাচীন বৃক্ষের জীবাশ্ম বা ফসিল, যার বয়স প্রায় ৩০০০ বছর।
[পাদটীকা- লি= দূরত্বের একটি চীনা একক।]


দেব-দেউলের আদিকথা
 
ধর্ম ভারতবর্ষের প্রাণবায়ু। আর হাজার হাজার বছর ধরে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিশাল ভারত ভূখণ্ডের শিরায় উপশিরায় এই প্রাণবায়ু প্রবাহিত ও সঞ্চারিত হয়ে চলেছে অগণিত মন্দির ও তীর্থে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা ভক্তি ও বিশ্বাসের সজীব ধারার মাধ্যমে। 

সভ্যতার ঊষা লগ্নে আদিম মানুষ ছিল অরণ্যচারী, শিকারী। তার না ছিল কোন সমাজ, না ধর্ম। পশুদের মতোই কেবল প্রাণধারণের জন্য শিকার ও আত্মরক্ষার জন্য লড়াই। সে ভয় করত প্রাকৃতিক শক্তিকে। হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে বনের আগুন, কখনও আকাশ থেকে নেমে আসে বজ্র-বিদ্যুৎ, ঝড়ে-বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় প্রকৃতি। প্রকৃতির এই রোষকে সে ভয় পায়। সময়ের রথ চলে। ধীরে ধীরে মানুষ সমাজবদ্ধ হতে শেখে। শেখে কৃষিকাজ। দেখে এতে তার লাভ। প্রকৃতির শক্তিগুলোকে কাজে লাগানোর বুদ্ধি বিকশিত হতে থাকে ক্রমশ। নদীর গতি, বাতাসের বেগ, আগুন সব কিছুকে সে ব্যবহার করতে শেখে ক্রমে। যাযাবর মানুষ থিতু হয়, তার ধন-সম্পদ ও পরিজনদের সুরক্ষার জন্য ব্যাকুল হয়। তখন থেকেই আরম্ভ হয় উপাসনার। যে শক্তির সঙ্গে সে যুঝে উঠতে পারে না, সেই বিরাট, বিশাল শক্তির কাছে নতজানু হয়ে কৃপা প্রার্থনা করে। নানা দেশে, অঞ্চলভেদে নানা ভাবে মানুষ সেই প্রাকৃতিক শক্তির রূপকল্পনা করে তার উদ্দেশ্যে ভয়মিশ্রিত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। সে অগ্নিদেব কিম্বা মারাং বুরু বা বনবিবি যেই হোক না কেন, মূল ভাব ছিল অভিন্ন। 

সভ্যতার রথ এগিয়ে চলল। সেই সঙ্গে বিকশিত হতে থাকল মানব-মনীষা। ভয়ের পুজো ধীরে ধীরে প্রেমের আরাধনায় উন্নীত হতে আরম্ভ করল। সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা ঈশ্বরীকে উদ্দেশ্য করে সভ্য মানুষের সৃজনী শক্তি রচনা করে চলল শ্লোক থেকে কাব্য ও কাব্য থেকে মহাকাব্য। সৃষ্টি হল বেদ-পুরাণ-ইতিহাস-মহাকাব্য। সমগ্র প্রকৃতিতে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনুস্যুত সেই শক্তি ধরা দিলেন ঘটে ঘটে, পটে পটে, সাধক ও কবির কল্পনায় বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করে। দিকে দিকে গড়ে উঠল দেব-দেউল। মানুষ তার অন্তরের সৌন্দর্যচেতনাকে অপরূপ শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশের পথ খুঁজে পেল ঐ সমস্ত দেবালয়ের স্থাপত্যে, প্রাচীর চিত্রে, মূর্তিতে। 

ভারতে মন্দিরের সংখ্যা অগণ্য। দেব ও দেবীর মন্দির পৃথক ভাবে যেমন গড়ে উঠেছে, আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক দেবতার মন্দিরে তাঁর শক্তিরূপিণী দেবীও রয়েছেন কিম্বা এর বিপরীত, অর্থাৎ সতীর অঙ্গ পতিত হয়ে যে-স্থানে সতীপীঠ গড়ে উঠেছে, সেখানে অবধারিত ভাবে অবস্থান করছেন সতীর পতি, ভৈরব। ঠিক যেমন একটি সংসারে থাকেন দুজন অভিভাবক, মাতা ও পিতা। আমাদের দেশে মাতৃ-আরাধনা উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে। বিশেষত বঙ্গদেশে এই ভাব অত্যন্ত বিকশিত হয়েছে। সাধক রামপ্রসাদ, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখ মাতৃ-সাধকগণ ভয়ংকরী দেবীকেও স্নেহময়ী জননী করে ছেড়েছেন। 

ভারতে যত ধর্ম ও মত প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্য কোন দেশে তত হয়নি। তাই ভারতের দেবস্থান, উপাসনালয় ও দেব-দেউলের সংখ্যা অগণিত। মানুষ যেদিন থেকে চিন্তা করবার শক্তি অর্জন করেছে, সেই দিন থেকেই তার সৃজন শক্তির উন্মেষ ও স্রষ্টা বা বিশ্বনিয়ন্তার অস্তিত্বের অনুভব জাগ্রত হওয়ার সূত্রপাত। সুখদুঃখ, জন্মমৃত্যু, উত্থান-পতনের চক্রাকার আবর্তন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তার মনে এক অনাদি, অনন্ত, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাব জাগ্রত করেছে। তাই দৈহিক বলে বা চিন্তার দ্বারা যা কিছু সে অর্জন করে, সেসমস্তই সে ঐ রহস্যময় এক শক্তির তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদন করবার আকাংক্ষা অনুভব করেছে। সেখান থেকেই পালিত পশু-পাখি এমনকি আপন প্রিয়জন পর্যন্ত সেই শক্তিমানের সন্তোষ বিধানের জন্য বলি দিতে বা উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু আদিম যুগে মানুষের দেব-আরাধনা ও দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য দান চলত বেদীর উপরে। বৈদিক যুগেও যজ্ঞ ও অন্যান্য উপাসনা ক্রিয়া বেদীর উপরেই সম্পাদিত হতো। আজও কোন কোনও নগরে বা গ্রামে বৃক্ষ মূলে বাঁধানো প্রাচীন বেদী ও দেবদেবীর পীঠবেদী পথের পাশে দেখা যায়। তবে উপাসনালয় স্থাপনের ইতিহাস আরও পরবর্তী কালের। আগেই বলেছি, মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশ ও সভ্যতার ক্রমোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার কল্পনাকে মাটি, কাঠ, পাথর ও অন্যান্য ধাতুর মাধ্যমে স্থায়ী রূপ দেওয়ার আগ্রহ বোধ করল। নিজের গড়ে তোলা প্রিয় মূর্তিকে সযত্নে রক্ষা করবার জন্য আলয়ের প্রয়োজনও বোধ করল। ফলে গড়ে তুলতে আরম্ভ করল দেবের আলয়, দেবালয়। জাতির শিল্প ও সংস্কৃতি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের মেলবন্ধনে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে বিকশিত হয়ে চলল। 

মন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্য ও উপায় ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগল। মন্দিরের আয়তন ও জাঁকজমকও সেই হারে বৃদ্ধি পেল। কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপার কখনও একটানা সমানুপাতিক হারে হয়নি। ভারতে প্রাচীন কাল থেকেই মৌখিক পরম্পরার প্রাধান্য থাকায় এই বিষয়ে কোন লিখিত নথিরও একান্ত অভাব। তাই প্রাচীনতম মন্দির সম্বন্ধে নিশ্চিত ভাবে কিছুই বলা সম্ভব নয়। এ নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু এমন অনেক মন্দিরই ভারতের মাটিতে আজও দাঁড়িয়ে আছে, যাদের ইতিহাস ১০০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন।
(ক্রমশ) 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ