ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

উত্তর-অভিব্যক্তিবাদ থেকে জাদুবাস্তববাদের দীর্ঘ পরিক্রমা -সৌম্য ঘোষ


যে
ঐতিহাসিক পটভূমিতে জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিংয়ের উদ্ভব ঘটে, বিশ্বে কালখন্ড ছিল খুবই উত্তাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের পরবর্তী সময় এবং ১৯১৮ সালে কায়জারের নির্বাসন। কায়জারের অপসারণের ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, রাজনৈতিক অস্থিরতারও সৃষ্টি হয়। বামপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। চারদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। তখন যুদ্ধের কারণে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেঙে পড়ে। যুদ্ধে জয়ীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণেরও চাপ বাড়াতে থাকে। খুব দুর্বল জোট রাজনীতির কারণে উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও বৈপ্লবিক কার্যক্রমের ফলে একধরনের জাতীয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার তৈরি হয়। পুরোনো সাম্রাজ্যের পতন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে আটকা পড়া সময়, বাস্তববাদী হওয়ার বাসনা-- এইসব কিছু তখন জাতীয় ভাবনার কেন্দ্রে চলে আসে। সংযত ও নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা এবং  অভিব্যক্তিবাদী ও যৌক্তিক অযৌক্তিকতাবাদী এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব উঠে আসে। 
          জার্মানির ফ্রাঞ্জ রুহর (Franz Roh) জাদুবাস্তববাদের বিশ্লেষণধর্মী ও তত্ত্বীয় কাজের যে সূচনা, তা ছিল  অভিব্যক্তিবাদ থেকে ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তা উদ্ভূত আন্দোলন। যেমন, ভ্যান গঘ ও পরাবাস্তববাদী সলভাদর ঢালীর পেইন্টিং। বাস্তবিকই ১৯২৫ সালে  অভিব্যক্তিবাদ থেকে জাদুবাস্তববাদকে আলাদা করে দেখা হয়। যেখানে জাদুবাস্তববাদীরা মস্তিষ্কজাত এবং মানসিক বাস্তবতাকেই খোঁজেন। 

       "জাদুবাস্তববাদ"-কে ইংরেজিতে তিনটি নামে ডাকা হয়- magic realism,  magical realism   mavellous realism . তার ইতিহাসও  বেশ দীর্ঘ।  আট যুগব্যাপী  ইতিহাস এবং তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। প্রতিটি বাঁকে রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। 

                      প্রথম পর্যায়ের সূচনা ১৯২০-এর দশকে জার্মানিতে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মধ্য আফ্রিকায় ১৯৪০-এর দশকে এবং তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৫৫ সালে লাতিন আমেরিকায় শুরু হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপ্তি। প্রতিটি পর্যায়ের বা ধাপের সূতিকাগার আসলে ওই সময়ের শিল্পী ও সাহিত্যিক, যাঁদের সাহিত্যকর্মই আসলে জাদুবাস্তববাদকে ছড়িয়েছে। ইউরোপ ও তার আশপাশে, ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকায় এবং লাতিন আমেরিকা থেকে সারা বিশ্বে। ‘জাদুবাস্তববাদ'-এর  প্রবক্তাদের অগ্ৰগণ্য জার্মানির ফ্রাঞ্জ রুহর (Franz Roh), যিনি ১৯২০-এর দশকে তাঁর বিভিন্ন কাজের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কিউবান লেখক আলেজো কার্পেন্তিয়ার (Alejo Carpentier), ১৯২০-১৯৩০-এর মাঝামাঝি সময়কার ইতালীয় লেখক মাছিমো বন্টেমপেল্লি, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের লাতিন আমেরিকান সাহিত্য সমালোচক এনজেল ফ্লোরেস এবং ওই সময়ের শেষের দিকের লাতিন আমেরিকান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।

                   উত্তর-অভিব্যক্তিবাদ-কে জাদুবাস্তববাদের অন্যতম শাখা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ ধারার অনেকেই জাদুবাস্তববাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাঁরা ছিলেন মূলত ১৯২০-এর দশকের জার্মান পেইন্টার। আরও আছেন বিশ শতকের প্রথম দিকের আধুনিকতাবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী ইউরোপীয় এবং বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের লাতিন আমেরিকান ও ইংরেজি বলা বিশ্বের লেখকেরা। যদিও এটি এখন লাতিন আমেরিকার বলেই বেশি পরিচিত, তার অনেক প্রভাবই ইউরোপীয় সাহিত্যে দৃশ্যমান, বিশেষ করে বিশ শতকের শুরুর দিকের আধুনিকতাবাদী ধারায়।    

             জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং ও আধুনিকতাবাদ- দুটি বাদই আসলে বাস্তবকে আরও গভীরভাবে তুলে আনার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির অনুসন্ধান করে। চিত্রশিল্পীরা নিরীক্ষা করেন পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে এবং লেখকেরা করেন রচনাশৈলীতে। এটি আগের ধারাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে। যেমন ধরুন, আগের স্টাইলে ফটোগ্রাফি ও রেনেসাঁ-শিল্পের একটা মিশেল প্রভাব ছিল। এটা করা হতো মূলত ছবির স্পষ্টতা ও মসৃণতার জন্য। জাদুবাস্তববাদী লেখা, বিশেষভাবে জড়িয়ে গেছে আধুনিকতাবাদী কৌশল ক্রমানুগ সময়ের ভাঙন ও ইতিহাসের ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

       জাদুবাস্তববাদ একটি ‘বিবদমান’ টার্ম, কারণ বেশির ভাগ সমালোচকই যা করেন, তা হচ্ছে জাদুবাস্তববাদের ইতিহাসের যেকোনো একটি ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় আনেন না। এ কারণেই সমালোচক রবার্তো গঞ্জালেজ ইসেভারিয়া মনে করেন, এর ‘প্রকৃত ইতিহাস’ উদ্ঘাটন করা খুব কঠিন।  আমেরিকান সমালোচক সেমার মেনটন, গুটি কয়েক সমালোচকের মধ্যে অন্যতম, যিনি এই তত্ত্বের ইতিহাস উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। ‘জাদুবাস্তববাদের আসল ইতিহাস’ বইয়ের নির্ঘণ্টের সময়ানুক্রমিক ইতিহাস দেওয়া আছে। এই বইয়ের উপশিরোনামটি শিরোনামের জন্য একটি আইরনী বটে। মেনটন তাঁর নির্ঘণ্ট সাজিয়েছেন সেসব সাল দিয়ে, যে সালগুলোকে জাদুবাস্তববাদের প্রকৃত উৎস সাল হিসাবে তিনি দাবি করেন। সালগুলো হচ্ছে ১৯২২, ১৯২৩, ১৯২৪, ১৯২৫,১৯৯৮-২০০৯.

                  অধিকাংশ সমসাময়িক সমালোচক, যেমন আমারিল চ্যানেভি, সেমার মেনটন, লুই পারকিনসন জালোরা এবং ওয়েল্ডি ফরিস একমত যে জার্মান চিত্রসমালোচক ফ্রাঞ্জ রুহ-ই (১৮৯০-১৯৬৫) ওয়েমার বিপারলিকের সময়কালীন উত্তর অভিব্যক্তিবাদী পেইন্টিংয়ের নতুন একটি ফর্মকে নামকরণ করতেই প্রথম জাদুবাস্তববাদ টার্মটি ব্যবহার করেন। ১৯২৫ সালে লেখা তাঁর বই Nach-Expressionismus, Magisher Realismus : Probleme der neusten europaischen Malerei (Post- expressionism, Magic Realism: Problems of the Most Recent European Painting) -এ এই টার্মটি আত্তীকরণ করেন এবং সেই টার্মটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় Magic Realism বা জাদুবাস্তববাদ নামে।

            টার্মটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে এক নতুন ধরনের পেইন্টিংয়ের নামকরণে, যা অভিব্যক্তিবাদী আর্ট থেকে বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে অনেক আলাদা। নতুন এই ধরনের শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য ছিল নিখুঁত বর্ণনার, গভীর মনোযোগ, ছবিতে ফটোগ্রাফির মতো মসৃণ স্বচ্ছতা এবং বাস্তবের মরমি দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপনা। রুহ এই ধারার প্রায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করেছেন, যাঁরা একসময় জার্মানিতে খুব সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন আট্টো ডিক্স, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আলেকজান্ডার কানল্ডট, জর্জ গ্রসজ ও জর্জ শ্রিম্প। তাঁদের প্রত্যেকের পেইন্টিংই একে অন্যের থেকে অনেক আলাদা। কিছু জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং যেমন ধরুন অট্টো ডিক্স এবং জর্জ গ্রসজের পেইন্টিংগুলো একেবারেই অদ্ভুত রকমের অতিরঞ্জিত। মনে হয় তাঁদের পেইন্টিং ও বিষয়বস্তুগুলো বাহ্যিক গঠনের সঙ্গে আসামঞ্জস্যপূর্ণ।

       আলেজো কার্পেন্তিয়ার কাছে জাদুবাস্তববাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বাস্তবিকভাবে পেইন্টিংয়ে দৃশ্যমান বস্তুর রহস্যময়তাকে ধরা।‘বস্তু ও বিষয়'কে অবশ্যই নতুন করে তৈরি করা। এতে রুহ চেয়েছিলেন যে শিল্পীরা সিগমান্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবিদ্যা ও কাল জাংয়ের পরাবাস্তববাদের দ্বারা প্রভাবিত হোক এবং এ দুটোর সংমিশ্রণে এমন পদক্ষেপ নিক যে বিষয়বস্তু স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। শিল্পীরা জাংয়ের দ্বারা খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাদের ‘সাবকনশাস’ ও আনকনশাসের ব্যাখ্যা চিন্তায় ও কাজে বিশেষ করে ‘মানুষের’ স্বপ্নে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের শিল্পের অপ্রাচুর্য বুঝতে সাহায্য করে। এবং এই বোধ তাদের লুকায়িত জীবনকে না ধরে বাহ্যিক ও বস্তুগত বিশ্বকে তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ করে। ফ্রয়েডের স্বপ্নের ব্যাখ্যা এমন সময় আসে, যখন ওই শতাব্দী একটি নতুন মোড় নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ে পরাবাস্তববাদীদের ওপর। ওয়ালেস ফাইল তাঁর পাঠ থেকে ব্যাখ্যা করেন যে ফ্রয়েড ও জাংয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরাবাস্তববাদীরা মনে করবেন যে ‘মানুষের চেতন অবস্থা’ তাকে, ‘সে নিজেকে’ (myself) এবং অন্যদের ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। রুহর কাছে ব্যাপারটা এমন যে জাদুবাস্তববাদীদের, মানুষের ভেতরের জীবনকে বস্তুগত জীবনের মাধ্যমেই শিল্পে তুলে ধরার বিষয়টি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রুহ মনে করতেন, মানুষের জীবনের রহস্য, অন্তর্গত জীবনের জটিলতা অবজেক্টের গভীর পর্যবেক্ষণ দ্বারাই উপলব্ধি করা যায়। তিনি শিল্পীদের আহ্বান জানান তাঁর এই নতুন আবিষ্কারের ওপর কাজ করার জন্য। নতুন শিল্পীরা সত্য ও বাহ্যিক দুনিয়ার অন্তর্গত চরিত্রকে, আমাদের চোখের সামনে অভিনব কৌশলে দেখানোর জন্যও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।

       জাদুবাস্তববাদ পরাবাস্তববাদের সমসাময়িক হওয়ার কারণেই যত জটিলতার সৃষ্টি। পরাবাস্তববাদের ইশতেহার লেখা হয় ১৯২৫ ও ১৯৩০ সালে এবং কেউ কেউ মনে করেন পরাবাস্তববাদ জাদুবাস্তববাদেরই একটি শাখা। এই দুটি শিল্প আন্দোলনেরই অনেক মিল রয়েছে এবং জেনে রাখা ভালো, পরবর্তী সময়ে অনেক জাদুবাস্তববাদী লেখক, বিশেষ করে আলেজো কার্পেন্তিয়ার  লেখনী এবং পরাবাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরাবাস্তববাদীদের কথা না বললেই নয় যে তারা মানুষের মনের অন্তর্গত বিষয়কে শিল্পে আনতে চেয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নতুন ধরনের শিল্পের প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল এবং তারা স্ববিরোধ (contradiction) এবং আপাতবৈপরীত্য (Paradox)-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার চেষ্টা করেছিলেন। যা-ই হোক, পরাবাস্তববাদের তাত্ত্বিকেরা এবং রুহর জাদুবাস্তববাদ- এই দুটি শিল্পান্দোলনই শৈল্পিক পার্থক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তাদের আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন।

                    প্রাথমিক পর্যায়ের এই জাদুবাস্তববাদী পেইন্টিং শুধু জার্মানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যত্রও। একই রকম অনেক পেইন্টিং দেখা যায় ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালিতে। ১৯৩১ সালে নিউইয়র্কে জার্মান জাদুবাস্তববাদী শিল্পীদের একটি প্রদর্শনী হয়। এর প্রভাবে আমেরিকান বাস্তববাদী ও জাদুবাস্তববাদী (১৯৪৩) নামে আরেকটি প্রদর্শনী হয় এডওয়ার্ড হপার (১৮৮২-১৯৬৭)-এর সম্মানে। তিনি মূলত বিখ্যাত তাঁর মসৃণ, ফটোগ্রাফিক আঙ্গিক এবং শান্তস্নিগ্ধ, নগরদৃশ্যসমৃদ্ধ ছবি আঁকার জন্য। এসব বৈশিষ্ট্যও জাদুবাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য।

            হোসে লুই বোর্হেসকে ধরা হয় আধুনিক লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের জনক এবং জাদুবাস্তববাদের অন্যতম অগ্রদূত। অ্যাঞ্জেল ফ্লোরেসের মতে বোর্হেসই প্রকৃতভাবে জাদুবাস্তববাদী লেখক। তিনি বলেন যে বোর্হেসের ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ছোট গল্পের সংগ্রহ A Universenl History of Infamy ছিল লাতিন আমেরিকান পরাবাস্তববাদী লেখনীর প্রথম উদাহরণ। ফ্লোরেস বলেন যে জাদুবাস্তববাদ, ইউরোপীয় সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তার প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছেন বোর্হেস। বোর্হেস ১৯২১ সালে আর্জেন্টিনার আধুনিকতাবাদী সাহিত্যতত্ত্বের কৌশলগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেন। স্পেনে থাকাকালে তিনি ‘Ultraismo’ আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্পেনে এই আন্দোলন ছিল আধুনিকতাবাদী নিরীক্ষার একটি অন্যতম ফর্ম। এই আন্দোলন কৌশলকে অবলম্বন করে কবিতা লেখার জন্য। এ ধরনের কবিতায় প্রায় অসম্পর্কযুক্ত উপমাকে যুক্ত করার চেষ্টা থাকে, অলংকার থাকে না বললেই চলে। বোর্হেস এই কৌশলটি লাতিন আমেরিকায় প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।  তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন যাঁর দ্বারা, তিনি কাফকা, যাঁর বাস্তববাদী লেখনী আসলে পরাবাস্তববাদের দিকেই যায়। বোর্হেস বাস্তববাদী লেখনী সংকলিত করেছিলেন এবং অনুবাদ করেছিলেন। যদিও বোর্হেস তাঁর লেখনীতে রুহর প্রভাব সরাসরি স্বীকার করেননি, তবু মনে করা হয় যে বোর্হেস যখন ১৯৩২ সালে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘আখ্যান শিল্প এবং জাদু’ লেখেন, তখন তাঁর মাথায় রুহর জাদুবাস্তববাদী ধারণার প্রতিফলন ছিল। এসব কারণেই তাঁকে বর্তমানে জাদুবাস্তববাদের পূর্বসূরি হিসেবে ধরা হয়, কারণ তিনি ইউরোপীয় ও লাতিন আমেরিকান এই দুই সাংস্কৃতিক ধারা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক প্রভাবের মিশ্রণের একটা প্রভাব জাদুবাস্তববাদী লেখায় রয়েই গেছে।

      ফ্লোরেসের প্রবন্ধ প্রকাশের ফলে লাতিন আমেরিকা, কার্পেন্তিয়ার ও তাঁর ‘আশ্চর্য বাস্তবতা’র দিকে নতুন করে সবার নজর পড়ে। এসব প্রভাবের সমন্বয় জাদুবাস্তববাদের দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিকে যায়, যেটি আসল ‘জাদুবাস্তববাদ’ বা Magical Realism নামে পরিচিত। কিছু তা আসলে ফ্লোরেসের দেওয়া সংজ্ঞার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, শুধু এটি ছাড়া যে তা শুধু ‘আশ্চর্য বাস্তবতা’ এবং জাদুবাস্তবতা, এ দুটি টার্মেরই অনেক বৈশিষ্ট্যকে সমন্বয় করে। খুবই লক্ষণীয় যে তা শুধু জাদুর মতো ঘটে যাওয়া বিষয়কে বর্ণনা করে। ১৯৫৯ সালে কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারা ধরে এটি আজ লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য আন্দোলনের ধারা। একটু রমরমা কাটতি হবে ভেবে লাতিন আমেরিকায় এক নতুন সাংস্কৃতিক ঢেউ লাগে, যার প্রভাবে পরবর্তী সময়ে উপন্যাস লেখার হিড়িক পড়ে যায়। ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী সাহিত্যতত্ত্ব আমদানি করে অনেক লাতিন আমেরিকান লেখকই লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মার্কেস, কাফকা ও জেমস জয়স দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।

       কার্পেন্তিয়া ও গার্সিয়া মার্কেসের আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারণে মানুষের একটি ভুল ধারণা হয় যে জাদুবাস্তববাদ একান্তই লাতিন আমেরিকান। এখানে বিশ শতকের ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য, বিশেষ করে জার্মান শিল্প আন্দোলনের বিষয়টি নাকচ করা হয়। তথাপি, জাদুবাস্তববাদের লাতিন আমেরিকান দর্শনটিই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং গৃহীত হয়। জাদুবাস্তববাদী লেখকেরা আজ ভারত, কানাডা, আফ্রিকা, আমেরিকা ও সারা বিশ্বে স্বীকৃত। সালমান রুশদী, গার্সিয়া মার্কেস ও গুন্টার গ্রাসের জাদুবাস্তববাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। প্রভাবিত হওয়ার এসব দৃশ্যমান লক্ষণ জাদুবাস্তববাদের বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মধ্যকার জটিলতা এবং তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককেই ইঙ্গিত করে। প্রত্যেক জাদুবাস্তববাদী লেখকেরই প্রভাবিত হওয়ার নিজস্ব ইতিহাস আছে। কেউ একেবারে সেই উৎসমূলের দ্বারা, আবার কেউ যখন এই টার্মটির আত্তীকরণ হয়নি, তখন থেকে। যে যেভাবেই প্রভাবিত হোক, কেউ এই টার্মটির উৎস অনুসন্ধান নিয়ে এত আগ্রহী নয়। যাহোক, সমালোচনামূলক বিষয় হিসাবে তাকে আলোচনায় আনলে তার বিকাশের ক্ষেত্রটি এবং বিষয়ের বিভিন্নতা সম্পর্কে জানাটা জরুরি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ