ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

রবিতীর্থ কালিম্পং -মিতা রায়চৌধুরী


আমার আনন্দে আজ একাকার
ধ্বনি আর রঙ, 
জানে তা কি এ কালিম্পঙ।
(১৪ নম্বর কবিতা। “জন্মদিনে”  কাব্য।)

এভাবেই কবি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন কালিম্পং নামক এই পাহাড়ি শহরটির প্রতি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০, এই তিনবছরে বিভিন্ন সময় প্রায় চারবার এসে থেকেছিলেন এখানকার মংপু ও গৌরিপুরভবনে। দামামা ঐ বাজে, আত্মছলনা, মানসী, মায়া, অদেয় প্রভৃতি কবিতা ঐ সময়কালের রচনা।

আমাদের এবারের কালিম্পং ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল পাহাড়ে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি দেখে নেওয়া। কালিম্পং পৌঁছনোর পরদিনই আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে একটি গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম মংপুর উদ্দেশ্যে। শাল, সেগুন, অর্জুন গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা গিয়েছে এঁকেবেঁকে। হিমালয়ের এই জঙ্গলে দেখা মেলে নানা প্রজাতির ওষধি গাছের। আর দেখা মেলে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ গাছের। আমাদের সারথি সুন্দরভাবে চিনিয়ে দিচ্ছিল নানা আকৃতির বাঁশের জঙ্গলকে। ছোট,বড়,মাঝারি,রোগা,মোটা- কত না তাদের আকৃতি। বাঁশ যে এতরকমের প্রজাতির হয় তা তো আমাদের মত শহুরেদের ধারণারও  বাইরে।

মংপুর বাড়ি

সত্যিই! কত বিচিত্র যে প্রকৃতি! আর এই বৈচিত্র্যের পরশ পেতেই তো আমাদের ছুটে ছুটে আসা। চলতে চলতে মাঝেমাঝেই দেখা দিচ্ছে সবুজ ঘেরা চা বাগান। প্রতিদিনের ব্যস্ততার দৌড়ে যে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকে না এই পথ চলার বাঁকে বাঁকে তার সঙ্গে গড়ে ওঠে এক আত্মিক সম্পর্ক। শ্বেত ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘা, আকাশ ছুঁতে চাওয়া পাইনের সারি, পাহাড় থেকে নেমে আসা নির্ঝরিণী, জংলা ফুলের মনমাতানো গন্ধ, শান্ত নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে ক্লান্তি মোচনের সঞ্জীবনী। তবে আর একটি প্রাণদায়ী সঞ্জীবনীর দেখা মেলে এই পাহাড়ে। সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরী কুইনাইন যে ম্যালেরিয়ার মত প্রাণঘাতী অসুখের সঞ্জীবনী সেই সিঙ্কোনা গাছের চাষাবাদ উত্তরপূর্ব ভারতের মংপুতেই প্রথম শুরু হয়। ভারতের প্রথম কুইনাইন কারখানাটিও এখানেই স্থাপিত হয় ১৮৬৪ সালে। আর কারাখানাটির পাশেই রয়েছে আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত রবীন্দ্র ভবন। মৈত্রেয়ী দেবীর “মংপুতে  রবীন্দ্রনাথ” বইটি  থেকে জানা যায়,  মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী মনমোহন সেন ছিলেন তখন এই কারখানাটির ডিরেক্টর আর সে সুত্রেই তাঁর বাসভবনটি ছিল কুইনাইন কারখানার লাগোয়া। তাঁদের আতিথেয়তায় কবি প্রায় চারবার এই মংপু পাহাড়ে এসেছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিলেন মংপুর সৌন্দর্যে। "মংপু পাহাড়ে" কবিতাটির মধ্যেও পাওয়া যায় তাঁর মুগ্ধতার কথা।

শিলিগুড়ি থেকে মাত্র ৫০ কিমি দূরেই এই পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ের পাকদন্ডী পেরিয়ে বড় বড় গাছেদের সাথে রোদের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামল রবীন্দ্রভবনের গেটে। চারদিকে পাহাড় ও গাছপালা ঘেরা প্রকৃতির মাঝে সাদা রঙের কাঠের বাংলো। প্রবেশপথের বাঁদিকে রয়েছে কবির আবক্ষ মূর্তি। লম্বা লম্বা  সবুজ  ঘাসের লন পেরিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভূত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কবি যেন এখানেই রয়েছেন আশেপাশে কোথাও। নানা মরশুমি ফুলে সাজানো সামনের বাগান, ওই দূরে সবুজ পাইনের গাছ, চারদিকে সবুজ পাহাড় ঘেরা এই শান্ত, মনোরম স্থানটি অচিরেই আমাদের সমগ্র মন দখল করে নিল। চটি, জুতো খুলে সিঁড়িতে প্রণাম করে খোলা কাঁচের দরজা দিয়ে ঢুকতেই কাঠের প্রশস্ত বারান্দা। সামনের চেয়ারেই রয়েছে কবির ছবি যার সামনে দেওয়া রয়েছে সুন্দর আলপনা আর সামনে রাখা নানা রংবেরঙের ফুলে সাজানো ফুলদানি। বাংলোর টানা লম্বা বারান্দায় পা দিতেও কুণ্ঠাবোধ হয়। যেই ঘরটিতে বসে কবি লিখতেন এখনও সেখানে রয়ে গিয়েছে কাঠের চেয়ার, টেবিল, আলমারি প্রভৃতি আসবাবপত্র। আর বড় বড় কাঁচের জানালার ওপারেই ঢেউ খেলানো পাহাড়। প্রথমবার এই গৃহে পদার্পণের মুহূর্তের উপলব্ধি ধরা রয়েছে মৈত্রেয়ী দেবীর লেখনীতে–
 এতো চমৎকার বাড়ি! তুমি কেন আপত্তি করেছিলে?- কত সুন্দর এই সামনের এই ঢালু পাহাড়টি, আকাশের কোল থেকে সবুজ বন্যা নেমে এসেছে। এই সামনের মাঠটিও তোমার ভালো, আমি মাটির কাছাকাছিই থাকতে চাই, চলচ্ছক্তি কমে আসছে, মাটির স্পর্শ তাই চোখ দিয়েই মিটিয়ে নিতে হয়।......... এই  কাঁচের ঘরটি বুঝি আমার লেখবার? এতো খুবই  ভালো, একেবারে উত্তম বলা যেতে পারে। এ চৌকিতে সকালবেলায় বসব আর রোদ্দুর এসে পড়বে কাঁচের ভেতর দিয়ে। তোমার ঐ বৃহদাকার বনস্পতির পাতার ফাঁক দিয়ে শতধারায়  ঝরে পড়বে সকালবেলার আলো, ভোরের সেই রৌদ্রস্নানটি আমার কত সুন্দর হবে।

কবি যে সময় এই পাহাড় ভ্রমণে আসতেন, সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। এই বাড়ি পর্যন্ত মোটর গাড়ি এসে পৌঁছত না। একবার ঘোরতর বর্ষায় তিনি এসে পৌঁছন মংপুতে। প্রায় দু মাইল রাস্তা পালকির মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে বাড়িটি যিনি দেখভাল করেন তিনি সেই পাল্কি বাহকদেরই উত্তরসূরি। পাহাড়ি এই মানুষটি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সাথেই পুরো বাড়িটি আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন। কবির ব্যবহার করা খাট, বায়োকেমিক ওষুধের শিশি, বহু ছবি আজও রয়ে গিয়েছে। কবি এই ভবনে বসেই জন্মদিন, নবজাতক, সানাই, আকাশপ্রদীপ, মংপু, ক্যামেলিয়া প্রভৃতি কবিতাগুলি লিখেছেন। কবির স্নানঘরটিও বেশ দেখবার মত। রথী ঠাকুরের পরিকল্পনায় গরম জল/ ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য। বাড়িটি থেকে বের হলেই দেখতে পাওয়া যায় কবির নিজের হাতে লাগানো ক্যামেলিয়া গাছটি। চারদিকটা যখন ঘুরে ঘুরে দেখছি শুনতে পেলাম পাহাড়ি মানুষটির গলায় “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে...” মংপু কিন্তু ভোলেনি, ভীষণভাবেই  মনে  রেখেছে বিশ্বকবিকে যিনি পাহাড়ের কোলের ছোট্ট একখানি অখ্যাত গ্রামে কাটিয়ে গিয়েছেন তাঁর জীবনের  মহামূল্যবান  সময়ের  খানিকটা  অংশ। আর এই অবকাশ যাপনের ভারী মনোরম একটি চিত্র ধরা আছে মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায়।  যেখানে আমাদের পরিচয় ঘটে অন্য এক রবীন্দ্রনাথের সাথে। আটপৌরে, ঘরোয়া, কৌতুকপ্রিয়, কনিষ্ঠদের সাথে রঙ্গতামাশায় মেতে ওঠা, আবার অতিথি অভ্যর্থনার দিকে কঠোর নজর, সংসারের নানা খুঁটিনাটি যার নজর এড়ায় না- কোথাও যেন তিনি বিশ্ববরেণ্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবির খোলস ছেড়ে হয়ে ওঠেন সকলের বড় আপন এক প্রিয়জন।  
  
এত শান্ত, সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে মন না চাইলেও গিয়ে বসতে হল গাড়িতে। মাঝখানে পথে লাঞ্চ সেরে এবার গাড়ি এগোল গৌরিপুর ভবনের দিকে। রিঞ্চেঙ্প্ঙ রোডের ফুল বিছনো রাস্তা ধরে পৌছে গেলাম  পরিত্যক্ত  বাড়িটির  সামনে।  ময়মনসিংহর  জমিদার  ব্রজেন্দ্র্কিশোর রায়চৌধুরীদের  এই শীতকালীন  আবাসে  কবিগুরু  প্রায় বার তিনেক  এসেছিলেন।  ১৯৪০ সালে  তার  আশিতম  জন্মদিন এই বাড়িতে পালিত হয়েছিল। এই   উপলক্ষে  কবি   ‘জন্মদিন’  কবিতাটি  টেলিফোনের  মাধ্যমে এখানে বসেই আবৃত্তি  করেছিলেন  যা   বেতারে  সম্প্র্চারিত  হয়েছিল। সেই সময় এই ঘটনাটি ছিল খুবই  অভিনব ও  চমকপ্রদ। এই ঘটনার পর থেকেই  কালিম্পঙে টেলিফোনের প্রচলন হয়। আর রবীন্দ্রনাথের পাহাড় থেকে শেষ বিদায়ও এই বাড়িটি থেকে। বাড়িটির বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে দেখতে মনে পড়ল তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর “নির্বাণ” বইটির একটি বর্ণনা। তাঁর কথায় 
আজকাল বিকেলে চায়ের পর গৌরীপুর ভবনের লম্বা বারান্দায় আমার হাত ধরে বেড়ান, বলেন, বউমা, আমার একটু বেড়ানো দরকার, বসে থেকে থেকে আমার পাগুলো অসাড় হয়ে আসছে।
গৌরিপুর হাউস

রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য সুরম্য অট্টালিকাটি যথাযোগ্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নপ্রায়। এতখানি ঔদাসীন্য, অবহেলা সত্যিই কি এই ঐতিহাসিক ইমারতটির  প্রাপ্য? যদিও হেরিটেজ কমিশন একটি ফলক লাগিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। কালিম্পঙে একটি নিজস্ব শৈলাবাস তৈরির বাসনা ছিল কবির। চেয়েছিলেন পাহাড়ে পুত্র ও পুত্রবধূকে একটি বাসভবন তৈরী করে দিতে। ১৯৪০ সালে কালিম্পঙের আতিশারোডে পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর নামে একটি জমি কেনেন। যদিও কবি বাড়িটি দেখে যেতে পারেননি। বাড়িটির পাথরের ফলক থেকে জানা যায় ১৯৪৩ সালে এটি সম্পূর্ণ হয়, নামকরণ হয়েছিল রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের স্টুডিও “চিত্রভানু”র নামে। পরবর্তিকালে প্রতিমা দেবী দীর্ঘদিন এই বাড়িতে বসবাস করেছেন এবং স্থানীয় ছেলেমেয়েদের হাতের কাজ শেখানোর জন্য একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করেছিলেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বাড়িটি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল।কিছুদিন হল নতুন করে সারিয়ে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

চিত্রভানু বাড়িটি একটি ছোট উচু টিলার একপ্রান্তে অবস্থিত। সামনে নির্জন উপত্যকা,  পিছনে অনন্ত সৌন্দর্য নিয়ে দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা। সুন্দর বাগান ঘেরা বাড়িটির সৌন্দর্য শিল্প সুষমামণ্ডিত। শান্তিনিকেতনের পুনশ্চ বাড়িটির আঙ্গিকের সঙ্গে খানিকটা মিল পাওয়া যায়। এখানে বেশ কয়েকটি ঘর। বৈঠকখানা ঘরটি কাঠের নানা আসবাবে পূর্ণ।রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বহস্তে তৈরী কাঠের কারুকাজে ভরা টিপট, লাঠি,  বাতিদান,  কলমদানি,  সেন্টার টেবিল,  ফটো ফ্রেম প্রভৃতি বিচিত্র উপাদানে ঠাসা ছোট্ট মিউজিয়ামটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহর করা বেশ কিছু জিনিস সযত্নে রক্ষিত রয়েছে।কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যে ঘরটি তাতে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। জানা যায়, প্রতিমা দেবী বেশ কয়েকবার পাহাড়ের স্থানীয়দের নিয়ে চিত্রভানুর গোল বারান্দায় কবির জন্মদিবস পালন করতেন। শান্তিনিকেতন থেকেও তাঁর আমন্ত্রণে আসতেন বিভিন্ন মানুষ। কল্পনা করার চেষ্টা করলাম এই সুন্দর পরিবেশে কতখানি মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠত সে অনুষ্ঠান। এসব ভাবতে ভাবতে চিত্রভানুতে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম আমাদের আস্তানায়। মনের মণিকোঠায় ধরা রইল রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত কালিম্পং সফরের উজ্জ্বল ছবি।

 চিত্রভানু 

কিভাবে যাবেন- নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বাসে, শেয়ার গাড়িতে অথবা গাড়ি ভাড়া করে পৌছনো যায় কালিম্পং। নিকটতম বিমানবন্দর বাগডোগরা।  
থাকবেন কোথায় -  কালিম্পঙে রয়েছে সরকারি/ বেসরকারি নানা বাজেটের হোটেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ