গলি জেলার অন্যতম প্রসিদ্ধ স্থান তারকেশ্বর। অষ্টাদশ শতক থেকে এই স্থান
শৈব তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। এখন যেখানে তারকেশ্বর মন্দির পূর্বে সেই স্থান
জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। জনসাধারণ সেই স্থানে তেমন যেতনা। মাঝেমধ্যে রাখাল
বালকেরা গরু খুঁজতে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করত। তাছাড়া গ্রীষ্মের সময় রাখাল
বালকেরা মাঝেমধ্যে জঙ্গলের মধ্যে একটি উঁচু ঢিবিতে পাথরের ওপরে কাঁচা আম
ফাটিয়ে খেত। গল্প গুজব করত যতক্ষণ না আঁধার নেমে আসে, এমন কথা শোনা যায়। এক
গোয়ালা মুকুন্দ ঘোষ তার গাভী দুধ দেয়না কেন এই সন্ধানে গাভীকে লক্ষ্য করে
জঙ্গলে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সে আশ্চর্য হয়ে দেখে গাভীর দুধ মাটিতে পাথরের
উপর পড়ছে। মুকুন্দ ঘোষ তারকেশ্বরের সন্ধান পায় এবং স্বপ্ন পেয়ে সন্ন্যাস
গ্রহণ করে সেবায় নিয়োজিত হয়। পরবর্তীতে ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের
জমিদার সেই স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন। এরপর সেখানকার ঐশ্বর্য ধীরে
ধীরে বাড়তে থাকে। এই স্থানের পূজা অর্চনার জন্য উড়িষ্যা থেকে গিরি
উপাধিধারী মহন্তদের আনা হয়। তারাই এই মন্দিরের সমস্ত দায়িত্ব নেয়। বাংলার
নবাব মুর্শিদকুলি খানের কাছ থেকে মন্দির সংলগ্ন প্রচুর জমি ও সম্পত্তির
অধিকার পেয়ে মহন্তরা হয়ে ওঠেন ওই স্থানের রাজা। তাদের প্রভাব ধীরে ধীরে
বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাদের কথায় শেষ কথা বলে স্থানীয় অঞ্চলে গণ্য হতে
থাকে। এই মহন্তদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে গ্রামবাসী ও প্রজাদের
ওপর অত্যাচারও করত। তেমনি এক মহন্ত ছিল মাধব গিরি।
মন্দিরের সেবায়েত হয়েও এই মহন্তদের লোভ লালসা উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ ভারতে
এক আলোড়ন তৈরি করেছিল। সময়টা ছিল ১৮৭৩ সাল, তারকেশ্বরের কাছেই অবস্থিত ছিল
কুমরুল গ্রাম। গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিল নীলকমল মুখোপাধ্যায়। আজকের
দিনে ব্রাহ্মণদের মত সে সময়ের ব্রাহ্মণদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালোছিল না।
অধিকাংশ ব্রাহ্মণী ছিল দারিদ্র যোজমান যা দিত তাতেই তাদের দিন গুজরানো হতো।
নীলকমলের প্রথম স্ত্রীর মারা যাওয়ার পর বিবাহ করেন মন্দাকামীকে(মতান্তরে
মন্দাকিনী)মন্দাকামীর একটি মেয়ে মুক্ত গেছি আর নীলকমলের প্রথম স্ত্রী নিয়ে
নাম কে লিখেছি এই চারজনের সংসার চালাতে নীলকমলকে হিমশিম খেতে হয়। কোনরকমেও
চলেনা তার সংসার।
মন্দিরের মহন্ত মাধব গিরির প্রিয় পাত্রী ছিল মন্দকামি। প্রায়ই সে
তারকেশ্বর মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার নামে মাধবগিরিকে সঙ্গ দিত। তার পরিবর্তে
পেত প্রতিদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী থেকে শুরু করে পরনের কাপড়।
দরিদ্র নীলকমল সব বুঝেও মুখ বুজে থাকতো, কিছু বলত না। হয়তো দারিদ্রতায় তার
মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। উচ্চ বংশজাত ব্রাহ্মণ হয়েও তার পরিণতির যে কতটা
করুন, তা নীলকমলকে দেখলেই বোঝা যায়। হতদরিদ্র পরিবার তার ওপর দু'দুটো মেয়ে।
সৎ মা মন্দাকামী এলোকেশীকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায়। এলোকেশীর বয়স মাত্র
ন'য়। তা নিয়ে নাকি পাড়া-প্রতিবেশীরা নানা কথা বলছে, এত বড় মেয়ে বাড়িতে
রেখে দিয়েছে ইত্যাদি। অর্থাৎ তৎকালীন সমাজের ন'বছরের কন্যা সন্তানও বিয়ে না
দিয়ে বাড়িতে রেখে দেওয়াটাও অপরাধ ছিল। বাল্য বিবাহের করুন পরিণতি হয়েছিল
এলোকেশীর। আজকের সমাজেও বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি, সে সময় মেয়ের বিয়ের বয়স ৯
বা ১০ ছিল তার থেকে আজকে সেখানে ১৬ কি ১৭ তেই বিবাহ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে
পরিবর্তন টা কোথায়!
উচ্চ বংশের ব্রাহ্মণ কন্যা, পিঠ ঢাকা চুল, নম্র স্বভাবা মুখ দিয়ে রা
কাটে না। তার উপর সমস্ত কুমরুল গ্রামে এলোকেশীর মতো আর কোনো সুন্দরী মেয়ে
নেই। এমন মেয়ের পাত্র পাওয়া খুব একটা কঠিন কাজ সে যুগেও ছিল না। এলোকেশীর
বিবাহ হলো কলকাতায় সরকারি ছাপাখানায় কাজ করা যুবক নবীনচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।তার আত্মীয় স্বজন কেউ নেই ।আবার বেতন খুব বেশি নয়
যে, স্ত্রীকে নিয়ে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে রাখবে।তাই শ্বশুরবাড়িতেই
এলোকেশীকে বিবাহের পর রেখে দেয়। সপ্তাহান্তে আসে দেখা করতে, একদিন থাকে
এলোকেশীর সমস্ত খরচ দিয়ে আবার কলকাতায় ফিরে যাই। এই ভাবেই তাদের চলে যায়
পাঁচ- ছয় বছর। ষোড়শী এলোকেশী একদিন দুশ্চরিত্র প্রোঢ় মহন্ত মাধব গিরির চোখে
পড়ে। মাধব গিরি মন্দকামিকে টাকা,সোনার গহনা, সম্পত্তির লোভ দেখায় এলোকেশীকে
তার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। নীলকমল ও এই লোভ এড়িয়ে যেতে পারেনি, হয়তোবা
মাধব গিরির নিষেধ অমান্যের পরিণতির কথা ভেবে হার মেনেছিল।
বয়স মাত্র ষোলো এলোকেশীকে বন্ধ্যা বলে নানা খোঁটা দিতে শুরু করে
পাড়া-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সৎ মা মন্দাকামি পর্যন্ত। মাত্র ষোলো বছরের
বালিকাকেউ এই অপবাদ শুনতে হচ্ছে, যদিও আজকের সমাজেও এই মন্দাকামিদের একেবারেই
যে দেখা যায় না তা নয়, সংবাদপত্র খুললেই এমন হামেশাই চোখে পড়ে।
এলোকেশীকে সন্তান হওয়ার ওষুধের জন্য মন্দাকামি নিয়ে যাই তারকেশ্বর মন্দিরে
পূজা দিতে। লম্পট মাধব গিরি প্রসাদের সঙ্গে মাদক খাইয়ে অচৈতন্য করে এলোকেশীর
সম্ভ্রম নষ্ট করে। তারপর নানাভাবে লোভ দেখিয়ে ভীতি প্রদর্শন করে তার সঙ্গে
থাকতে বাধ্য করে। সমাজের কাছে এলোকেশী হয়ে উঠলো নষ্টা। প্রথমে লোকে আড়ালে
আবডালে নানা কথা বললেও ধীরে ধীরে তা গ্রামের প্রধান আলোচ্য হয়ে দাঁড়ালো।
কমরুল গ্রামে নীলকমলের পরিবার একঘরে হলো। খবর পৌঁছালো কলকাতায় নবীনচন্দ্রের
কানেও। হঠাৎ করে কোনো খবর না দিয়ে নবীন শ্বশুর বাড়ি চলে এলেন। বাড়িতে
ঢুকেই এলোকেশীর খোঁজ করলেন , এলোকেশী না থাকাই মন্দাকিনী মিথ্যা মিথ্যা বলে
যে পুজো দিতে গেছে তারকেশ্বরে নবীন সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় তারকেশ্বরে, ঘন্টা
তিনেকের মধ্যে মন্দির থেকে এলোকেশীকে না পেয়ে আবার ফিরে আসে বাড়িতে, এসে
দেখে এলোকেশী বাড়িতে আছে। নবীনের জেরায় এলোকেশী ভেঙে পড়ে সমস্ত ঘটনা
নবীনকে জানাই। সমস্তটা শুনে শিক্ষিত ভদ্র শান্ত মেজাজের নবীন স্ত্রীকে ত্যাগ
করেনি। মহন্তের হাত থেকে স্ত্রীকে বাঁচাতে তাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যেতে
চাইলো। কিন্তু মোহন্ত মাধব গিরির লোকবলের প্রভাবে নবীনচন্দ্র এলোকেশীর
কলকাতার ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেল।ঠিক করলো ভোররাতে কুমরুল থেকে পালাবে। কিন্তু
পালানোর জন্য পালকি বা গরুর গাড়ি কোনটাই পেল না। যদিও বা গরুর গাড়ি পেল
তারা কেউ যেতে চাইলো না উল্টে স্ত্রীর নামে অপবাদ শুনতে হল। ক্ষুধা তৃষ্ণা আর
রাগে মাথা আর ঠিক থাকল না নবীনের ।ভোর থেকে পালকি গরুর গাড়ি না পেয়ে শেষে
অপবাদ শুনে দিশেহারা হয়ে দুপুর গড়িয়ে বাড়ি ফিরল নবীন। বাড়ি ফিরে দেখে
স্ত্রী মাছ কাটতে বসেছে, তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে সেই আঁশবঁটি দিয়ে
এলোকেশীর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। নবীন হরিপাল থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ
করে। পরে হুগলির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিজের ফাঁসির সাজা চায়।
ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে যে সেতার পরলোকগত স্ত্রীর কাছে যাওয়ার জন্য অধৈর্য্য
হচ্ছে এখনই যেন তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়, এই ঘটনায় ১৮৭৩ সালের বিখ্যাত
"তারকেশ্বর হত্যা মামলা" নামে পরিচিত হয়।
সরকারপক্ষ নবীনের নামে মামলা করে, পরে দায়রা আদালতে নবীন খুনের কথা
অস্বীকার করে। উল্টে মহন্ত মাধব গিরির নামে শ্লীলতাহানির মামলা করে। এর মধ্যে
নবীনের স্ত্রী মন্দাকামির আকর্ষিক মৃত্যু ঘটে, নবীনের পক্ষের উকিল
বললেন-মহন্ত সাক্ষী লোপাটের জন্য তাকে হত্যা করেছে। এই মামলার ঘটনা প্রতিদিন
প্রকাশ হতে লাগলো ব্রিটিশ সংবাদ পত্রপত্রিকা গুলিতে।মামলা চলাকালীন আদালত
চত্বরে জনতার ভিড় থাকতো চোখে পড়ার মতো। নবীন হত্যাকারী হলেও জনতার কাছে
নবীনের দোষ আর দোষ রইল না। সমাজের কাছে প্রধান অপরাধী হয়ে উঠলো মহন্ত মাধব
গিরি নবীনের পক্ষের উকিল ছিলেন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি(
যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন)। নানা সাক্ষী জোগাড়
করে নবীনের সাজা কামানোর চেষ্টা করলেন। অন্যদিকে সরকার পক্ষের আইনজীবী নবীনের
শ্বশুর নীলকমল শালিকা মুক্তকেশী ও কয়েকজনের সাক্ষীর পরিপ্রেক্ষিতে এলোকেশীকে
বারবনিতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি নীলকমল মুক্তকেশীদের সাক্ষীকে টাকার লোভে মিথ্যা
বলেছে প্রমাণ করেন। সবশেষে জুরি প্যানেল রায় দিল (তখন আদালতে কয়েকজন জুরি
থাকতেন তারা নিজেরা আলোচনা করে রায় দিতেন জজ সাহেব শুধু তাতে স্বাক্ষর
করতেন) নবীন নির্দোষ সে স্ত্রীকে খুন করেছিল ঠিকই, কিন্তু পরিকল্পিতভাবে খুন
করেনি। আদালতের বাইরে জনতার উল্লাস ছড়িয়ে পড়েছিল। সবাই চাইছিল নবীর
নির্দোষ প্রমাণিত হোক। কিন্তু জর্জ সাহেব এই রায়ে সন্তুষ্ট হলো না, রায়
পাঠালো হাইকোর্টে।
হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি ছিলেন এ জি ম্যাকরসন এবং জি জি মরিম। সরকার পক্ষের
উকিল ছিলেন জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং নবীনের পক্ষে ছিলেন প্রখ্যাত
ব্যারিস্টার উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি। কিন্তু রায় আগের মতো নবীনের পক্ষে গেল
না। কেননা নবীন প্রথমেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হত্যা স্বীকার করেছিলেন।
রায়ে নবীনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হলো আন্দামানে।এই রায়ের পরেই জনতার মধ্যে
উত্তেজনা বাড়তে লাগলো।নবীনকে ক্ষমাকরা এবং তার সাজা মুকুবের দাবিতে সই সংগ্ৰহ
শুরু হল।প্রায় দশহাজার সই সহ একটি আবেদনপত্র জমা পরে সরকারের কাছে।এই আবেদনের
ভিত্তিতেই দুবছর পরে ই নবীনচন্দ্রকে মুক্তি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে নবীনের করা মামলায় মাধব গিরির গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল কিন্তু
তাকে ধরা গেল না। অবশেষে তিনি নিজেই আত্মসমর্পণ করলেন হুগলি আদালতে
(শ্রীরামপুরে)। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হাইকোর্টে গেলো। তাতেও শেষ রক্ষা
হলো না। সমস্ত সাক্ষ্য তার বিরুদ্ধে গেল তারকেশ্বর মন্দিরের মহন্ত মাধব গিরির
তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করেছিল প্রধান বিচারপতি।জনসাধারণ বহু দিন পর
উল্লাসে ফেটে পড়েছিল এই রায়।
দেড়শ বছর আগে ঘটে যাওয়া "তারকেশ্বর হত্যা মামলা"র ঘটনার পুনরাবৃত্তি
কি আজও ঘটে! ঘটে। তবে সেই সময়ের জনসাধারণের মতো আজকের জনসাধারণ অপরাধীর সাজা
ঘোষণার পর উল্লাস হয়তো করে না। নাকি উল্লাস করার সুযোগ পায় না! অপরাধী
হয়তো সাজা পায়, তবে তা কত বছর পর তা কেউ বলতে পারবে না।
তথ্যসূত্র:
১.হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ- সুধীরকুমার মিত্র
২.দেবগণের মর্তে আগমন-দূর্গাচরণ রায়
৩.সুলভ সমাচার পত্রিকা- ১২৮০ বঙ্গাব্দ ২৯শে জ্যৈষ্ঠ
৪.উপন্যাস-হারিয়ে যাওয়া খুনিরা- দেবারতি মুখোপাধ্যায়।
৫.আনন্দবাজার পত্রিকা-প্রবন্ধ,আগষ্ট,২০১৫
0 মন্তব্যসমূহ