ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বাঁশি -দেবাংশু সরকার

বে
শ সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে গোপ বালিকারা। যমুনার শীতল জলে ডুব দিয়ে স্নানের পর জল ভরা গাগরী কাঁখে কুটিরে ফিরেই আবার দুধের পসরা নিয়ে ছুটতে হয় যমুনার তীরে। ওপারের গঞ্জ থেকে ব্যাপারীরা হয়তো এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি যেতে পারলে হয়তো ভালো দাম পাওয়া যাবে। তাড়াতাড়ি যমুনার ঘাটে পৌঁছে যেতে পারলে হয়তো এড়ানো যাবে  গোপ বালকদের, মাটির তৈরি দুধের কলসকে বাঁচানো যাবে কোনো গোপ বালকের গুলতি থেকে ছুটে আসা পাথরের টুকরো থেকে। শয়ে শয়ে গোপ বালিকারা ছুটে চলে যমুনার তীরে। রাইও থাকে তাদের সঙ্গে।


      ভোর হতে না হতেই রকমারি নাও এসে ভেড়ে যমুনার ঘাটে। মহাজন, ব্যাপারীরা ভিড় করে খরিদ্দারির জন্য। এখান থেকে দুধ, ছানা, ননী, মাখন যাবে মথুরাতে। সেখান থেকে আবার হাত বদল হতে হতে চলে যাবে দুর দূরান্তরে। কত রকম মানুষ আসে! কত রকম তাদের হাঁকডাক। দুধ, ছানা, মাখন কেনাবেচার কড়ি, পারাণের কড়ি নিয়ে কত রকম দরাদরি, চিৎকার, চেঁচামেচি, হৈচৈতে মুখরিত হয়ে ওঠে যমুনার তীর। যমুনার জলে ঢেউ তোলা নৌকার বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেন মিলে মিশে যায় গোপ বালিকাদের গুঞ্জনের সঙ্গে।


     যমুনার ঘাটে আসা ব্যাপারীদের মধ্যে রসিক ঠাকুরকেও দেখা যায় প্রতিদিন। ঘাটে নেমে বাঁকা দৃষ্টিতে কাকে যেন খুঁজতে থাকে সে। বড়ই বাঁকা সেই দৃষ্টি! গোপ বালিকারা ভীষণ অপছন্দ করে তাকে, তার দৃষ্টিকে। নারীরা যে ভালো করে চেনে সেই লোভাতুর দৃষ্টিকে! সেসব নিয়ে রসিক ঠাকুর অবশ্য মাথা ঘামায় না। সে খুঁজে খুঁজে বের করে রাইকে। রাইও পছন্দ করে না রসিক ঠাকুরকে। কিন্তু রাইকে দুধের দামটা একটু বেশি দেয় রসিক ঠাকুর, কড়ি দিয়ে রাইয়ের আঁচল ভরিয়ে দেয়। কড়ি গুনে এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ায় না রাই। দুধের কলস কাঁখে দৌড়ায় কুটিরের দিকে।


      ভোর হওয়ার আগেই ধবলীর ডাকে ঘুম ভাঙে কানুর। খুলে দেয় গোয়াল ঘরের দুয়ারের অর্গল। একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে গরুর পাল। কানুও মাথায় শিখি পাখা গুঁজে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যমুনার ঘাটে ভিড় জমার আগেই যে তাকে ঘাট পেরিয়ে যেতে হবে। ভিড় জমে গেলে মুশকিল হয়। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে গরুর পাল নিয়ে চলা বেশ মুশকিলের। ঘাট ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দুরে যেতে হয় কানুকে। মানুষের পায়ের চাপে ঘাটের আসে পাশের ঘাস নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুটা দুরে গেলে যমুনার তীরে বেশ বড় বড় ঘাস পাওয়া যায়। ধবলীরা মনের আনন্দে ঘাস খায়। গাছের নিচে বসে কানু লক্ষ রাখে গরুর পালকে। ছটফটে ধবলীকে নিয়ে তার যত চিন্তা! অনেক সময়ে ঘাস খেতে খেতে ধবলী বেশ দুরে চলে যায়। উদ্বিগ্ন কানু হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ধবলীকে।


      গো পালকে নিয়ে চলতে চলতে কানুর নজরে পড়ে মাটিতে, ঘাসের আড়ালে পড়ে আছে একটা বাঁশি। কি সুন্দর বাঁশি! কি উজ্জ্বল তার রং! বাঁশির মাথায় বাঁধা দুই ময়ূর পুচ্ছ যেন আরো শোভা বাড়িয়েছে বাঁশির। মাটি থেকে বাঁশিটাকে তুলে নেয় কানু। বাজানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না বাঁশি থেকে। আবার চেষ্টা করে। বারে বারে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। কি করবে সে এই অকেজো বাঁশিটাকে নিয়ে? একবার ভাবে ফেলে দেবে। আবার কি যেন ভেবে রেখে দেয় নিজের কাছে। 


      কানু বারে বারে চেষ্টা করে বাঁশি বাজাতে। কিন্তু পারে না। নীল আকাশে উড়ে চলা বলাকার দল তাকে বাঁশি বাজাতে বলে, সে চেষ্টা করে। যমুনাতে জলকেলিরত মরাল মরালী তাকে বাঁশি বাজাতে বলে, সে চেষ্টা করে। পেখম তুলে নাচতে থাকা ময়ূর তাকে বাঁশি বাজাতে বলে, সে চেষ্টা করে। কিন্তু বোবা বাঁশি বাজে না!


      বাঁশি থেকে চোখ সরিয়ে সে তাকায় যমুনার তীরে। সবতো ঠিক আছে, কিন্তু ধবলী কোথায়? আবার সে খুঁজতে থাকে ধবলীকে। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে ডাকতে থাকে, "ধবলী, ধবলী"। 


      ধবলীকে খুঁজতে খুঁজতে এলোমেলো ভাবে হেঁটে চলে কানু। হাঁটতে হাঁটতে মুখোমুখি হয়ে যায় রাইয়ের। দুধ বিক্রি করে কুটিরে ফিরছে রাই। সেও থমকে দাঁড়ায়।


      - "ধবলীকে তুমি দেখেছো?"


      - "ধবলী! সে কে গো? তোমার সখী? সে কি আমার থেকেও সুন্দরী?" খিল খিল করে হেসে ওঠে রাই।


      - "না গো,  সে কন্যে নয়। সে আমার পোষা বাছুর। খুব ছটফটে চঞ্চল। এক মুহুর্ত স্থির থাকে না। দেখেছো তাকে?"


      - "ওটা কি গো তোমার সঙ্গে? বাঁশি!" রাইয়ের চোখ যায় কানুর বাঁশির দিকে, "না বাবা, তোমার সঙ্গে কথা কব না। তোমরা যমুনা তীরের বাঁশরিয়ারা যাদু জানো! বাঁশি শুনিয়ে তোমরা কন্যেদের বশ করো। তাদের পাগল করে দাও। তাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখাও। তারপর একদিন কোনো কিছু না বলে, সেই কন্যেকে ছেড়ে দুর দেশে চলে যাও। সব কিছু হারিয়ে একা হয়ে যায় সেই কন্যে। পথের পাণে পড়ে থাকে সে, কেউ তার খবর রাখে না! কেউ না! বড় নির্দয় গো তোমরা। মন বলে কিছু নেই তোমাদের! অন্যের মনের খবর রাখো না তোমরা। না না তোমার সঙ্গে আমি কথা কব না। তোমাদের মত মন চোরাদের সঙ্গে আমি কথা কব না। আমি চলি।" নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ তুলে ছুটতে থাকে রাই।


      - "যেও না কন্যে, যেও না। আমি বাঁশরিয়া নই। আমার বাঁশিতে সুর বাজে না। ওযে বোবা বাঁশি! দাঁড়াও কন্যে দাঁড়াও। বলে যাও, তুমি ধবলীকে দেখেছো?" কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তে কখন যেন হাতে বাঁশি তুলে নেয় কানু। বাজাতে থাকে। সাত সুরের সুর তরঙ্গ বেজে ওঠে তার বাঁশিতে।


      থেমে যায় নূপুরের রিনিঝিনি। দাঁড়িয়ে পড়ে রাই। পায়ে পায়ে ফিরে আসতে থাকে কানুর দিকে। বাঁশির মিঠে সুরের মাদকতা যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায় রাইকে। অনাবিল আনন্দে সে নেচে ওঠে। বাঁশি নূপুরের যুগলবন্দী ঢেউ তোলে যমুনার জলে। পেখম মেলে ময়ূর। ডানা ঝাপটাতে থাকে জলকেলিরত হংস মিথুন। 


      তবে কি রাইয়ের নূপুরের রিনিঝিনির জন্য সুর খুঁজে পেল কানুর বোবা বাঁশি? হয়তো! প্রেম আর প্রকৃতির কোনো ব্যাখ্যা হয় না। সে যে বড়ই জটিল, বড়ই রহস্যময়!


      রাইয়ের নূপুরের ধ্বনি যেন কানুর কানে আটকে গেছে। কেবল কানে আটকে না থেকে সেই রিনিঝিনি কানুর মনের মনি কোঠায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সর্বদা সে বেজে চলেছে কানুর মনের অন্তরালে। সেই রিনিঝিনির সুরে সুর মিলিয়ে কানু তার বাঁশিতে সুর তোলে। ঝড় তোলে রাইয়ের মনে, রাইয়ের সত্ত্বায়। সারা দিন কানু বাঁশি বাজায়। কখনো রাইয়ের গোচরে, কখনো অগোচরে।


      বাঁশি শুনে অস্থির হয়ে ওঠে, পাগল হয়ে যায় রাই। বারে বারে ছুটে আসে যমুনার তীরে। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে কানুর দিকে। মোহিত হয়ে শুনতে থাকে ডাকাতিয়া বাঁশির সুর। কখনো নেচে ওঠে বন ময়ূরীর মত।


     - "বাঁশরিয়া তুমি কেন সারাদিন বাঁশি বাজাও? কেন আমাকে পাগল করে দাও? কেন বারে বারে আমাকে টেনে আনো যমুনার কিনারে?"


      - "আমিতো বাঁশি বাজাতে পারি না কন্যে। বাঁশিকে বাজিয়ে নেয় তোমার নূপুর। যখন আমার মনের মধ্যে বেজে ওঠে তোমার নূপুর, তখনই সুর তোলে বাঁশি।"


      - "আমার কি হবে বাঁশরিয়া? তোমার বাঁশি শুনলে  আমি যে স্থির থাকতে পারি না! কোনো কাজে মন বসে না! তোমার বোবা বাঁশিতে সুর এলো, আর আমার সর্বনাশ হলো।"


      - "আমারওতো কাজে মন বসে না। গরুর পালের দিকে নজর রাখতে পারি না। সারাক্ষণ তোমার নূপুর যেন বাজতে থাকে আমার কানে, আমার মনে, আমার প্রাণে। আমার অজান্তে সে যেন আমাকে দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে নেয়। আমার মনে হয় সারাদিন, সারারাত ধরে বাঁশি বাজিয়ে যাই।"


      - "আমারো ইচ্ছা করে সারাদিন, সারারাত তোমার বাঁশির সুর শুনি। বাঁশির সুর শোনা ছাড়া আর কিছুই আমার ভালো লাগে না!"


      - "তাহলে চলো আমরা একসঙ্গে ঘর বাঁধি। সেখানে আমরা সারাদিন, সারারাত বাঁশি নূপুরের সুর শুনবো।"


      ঘর বাঁধে রাই কানু। রাইয়ের উৎসাহে কানু জগৎ সংসার ভুলে দিনরাত বাঁশি বাজাতে থাকে। কানুর বাঁশির সুরে সুর মিলিয়ে বাজতে থাকে রাইয়ের নূপুর। এভাবে দিন যায়, মাস যায়। মাঝে মাঝে রাই ভাবে কানু কাকে বেশি ভালোবাসে? রাইকে? নাকি বাঁশিকে? সারাদিন তার বাঁশি নিয়ে মশগুল থাকে কানু। যৌবনবতী সুন্দরী তরুণী রাইয়ের দিকে সে তাকায় না! রাইয়ের যে কানুর থেকে নিজস্ব কিছু চাহিদা থাকতে পারে সে সব নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। ঐ বাঁশিটাই তার কাছে সব! বাঁশিটার জন্য সে রাইকে অবহেলা করে। বাঁশি নাকি সতীন? তবে কি রাই দুয়োরাণী হয়ে বাঁশি নামক সতীনের ঘর করছে? ক্রমশ যেন বাঁশির প্রতি আসক্তি কাটতে থাকে রাইয়ের মন থেকে। তার বদলে জন্ম নিতে থাকে ঘৃণা। বাঁশির প্রতি ঘৃণা। একদিন সেই পুঞ্জীভূত ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটে যায়। 


      - "রাই আমার বাঁশিটা দেখেছো? সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না!"


      - "বাঁশি বাঁশি বাঁশি!  বাঁশি ছাড়া কি আর কিছু মাথায় নেই? বাঁশি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাও না? আর কাউকে দেখতে পাওনা?" প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে থাকে রাই।


      - "আহা, রাই এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আমিতো তেমন কিছু বলিনি!"


      - "না, বলোনি! আমার দিকেতো তাকাও না, তাহলে আমার সঙ্গে ঘর বেঁধে ছিলে কেন? থাকতে পারতে তোমার বাঁশিকে নিয়ে। আমিতো ভালোই ছিলাম। কেন তোমার ঘরে আনলে আমাকে?"


      - "আমিতো সব সময়ে তোমার সঙ্গে আছি। তোমার পাশে আছি। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই, কিছু নেই! তোমার নূপুর না বাজলে আমি যে বাঁশিটাও বাজাতে পারি না! সেটা কি জানো না? সেটা কি বোঝো না?"


      - "থামো! সব কথায় বাঁশি আর বাঁশি! তুমি কি জানো তুমি কত দিন গরুগুলোকে মাঠে নিয়ে যাও নি? গরুগুলো কত দিন ভালো করে খেতে পায়নি? গরুগুলোর দুধ কত কমে গেছে? এমনকি ধবলীটা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে!"


      - "আজই আমি ওদের মাঠে নিয়ে যাবো। তুমি বাঁশিটা খুঁজে দাও।"


      - "না, না। আর তুমি বাঁশি পাবে না। বাঁশি পেলে তুমি সব ভুলে যাবে। তোমার বাঁশিকে আমি যমুনার জলে ফেলে দিয়েছি। আর পাবে না।"


      - "সেকি! না না এ হতে পারে না! বাঁশি ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি এক্ষুনি জলে ঝাঁপ দিয়ে বাঁশিকে খুঁজে আনবো।" দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কানু।


      দিনের পর দিন যায়। কানু আর ঘরে ফেরে না। রাই কানুর পথ চেয়ে বসে থাকে যমুনার কিনারে। দিন যায়, রাত যায়, সূর্য ওঠে,  সূর্য ডোবে রাইয়ের অপেক্ষার শেষ হয় না। একদিন নিশ্চয়ই কানু ঘরে ফিরবে, রাইয়ের জন্য না হোক ধবলীর জন্য অন্তত সে ফিরবে। আশায় বুক বাঁধে রাই। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় রাইয়ের প্রতীক্ষা।


      এমনই একদিন দেখা হয়ে যায় রসিক ঠাকুরের সঙ্গে, "কন্যে, ও কন্যে, এতোদিন কোথায় ছিলে? এতোদিন ধরে  তোমাকে খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান হয়ে গেছি! কোথায় ছিলে তুমি? কি রোগা হয়ে গেছ! চোখ মুখ একেবারে বসে গেছে! মনে হচ্ছে অনেক দিন ভালো করে খাও নি। তোমার কি দুঃখ গো কন্যে? কেন তুমি নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ? আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়ে গেছে, আর তোমাকে দুঃখ করতে হবে না, কষ্ট করতে হবে না, যমুনার ঘাটে বসে চোখের জল ফেলতে হবে না। চল আমার সঙ্গে চল। আমার কোঠা বাড়িতে থাকবে। ঘি, দুধ, ছানা খাবে। দাস দাসীরা তোমাকে ঘিরে রাখবে। তোমার সেবা যত্ন করবে। তুমি খাট পালঙ্কে শুয়ে বসে থাকবে। তোমাকে এভাবে মাটিতে বসে থাকতে হবে না। একেবারে রাণীর মত থাকবে। চল আমার সঙ্গে। ভালো না লাগলে ফিরে আসবে।"


      অনেক করে রাইকে বোঝায় রসিক ঠাকুর  কিন্তু রাই রাজি হয় না। অবশেষে রসিক ঠাকুর ফিরে যায়। রাই একাকী বসে থাকে কানুর অপেক্ষায়। কখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে খেয়াল থাকে না রাইয়ের। অন্ধকার নেমে আসে নিস্তব্ধ চরাচরে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে একটা নৌকা এসে ভেড়ে যমুনার ঘাটে। কাপড়ে মুখ ঢাকা কয়েকজন নেমে আসে নৌকা থেকে। রাইয়ের চোখে, মুখে, হাতে, পায়ে কাপড় বেঁধে তুলে নিয়ে যায় নৌকায়। কিছুক্ষণ পরে তার চোখ খুলে দেওয়া হয়। রাই একটা বন্ধ ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিজের মনে বলে ওঠে, "হায়রে বাঁশি, আর কত বিপর্যয় নেমে আসবে আমার জীবনে!"


      বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেছে। ক্লান্ত রাই ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ।  ঘরে ঢুকেই রসিক ঠাকুর হম্বিতম্বি করতে শুরু করলো, "তোরা কাকে ধরে এনেছিস? এক্ষুনি হাত পায়ের বাঁধন খোল। কন্যের জন্য দুধ, ছানা, ননী, মাখন, লাড্ডু নিয়ে আয়। ঠাণ্ডা জল নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি যা তোরা।" একটু থেমে রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, "তুমি কিছু মনে করোনা কন্যে। মুখ্যুগুলো ভুল করে ফেলেছে। একটু কিছু খেয়ে চাঙ্গা হও। তারপরে একটা বড় ঘরে তুমি থাকবে। তোমার অনুমতি ছাড়া কেউ সে ঘরে ঢুকবে না। এমনকি আমিও না। তিনজন দাসী তোমার দেখাশোনা করবে। কাল থেকে মথুরার সঙ্গে আবার নন্দ গাঁওয়ের লড়াই শুরু হবে। এখন কয়েক দিন তুমি এখানে থাকো। নির্ভয়ে থাকো। লড়াই থামলে, পরিস্থিতি শান্ত হলে আমি নিজে তোমাকে যমুনার ওপারে পৌঁছে দেব।"


      বেশ কয়েক দিন কেটে যায়। একটু একটু করে রাইয়ের অস্থির মন স্থির হয়। মাঝে মাঝে রসিক ঠাকুর খোঁজ নিতে আসে। ঘরে ঢোকে না।  জানালা দিয়ে কথাবার্তা বলে। কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চায়। রাই ভাবে রসিক ঠাকুরকে সে যতটা খারাপ ভেবেছিল ততটা খারাপ সে নয়। তাকে যথেষ্ট সম্মান করে রসিক ঠাকুর। কানুতো কোনো দিন সেভাবে রাইয়ের দিকে তাকালো না! তার মন বোঝার চেষ্টা করলো না। তাহলে রসিক ঠাকুর কানুর থেকে মন্দ কিসে? আস্তে আস্তে কানুর স্মৃতি ঝাপসা হতে থাকে রাইয়ের মন থেকে।


      ঠক ঠক করে খড়মের শব্দ আসে। রাই বুঝতে পারে রসিক ঠাকুর আসছে। এখন অবশ্য রাই অনেকটা সাবলীল হয়ে গেছে রসিক ঠাকুরের কাছে।


      - "কেমন আছো কন্যে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো?"


     - "ঠাকুর তুমি বাঁশি বাজাতে পারো?"


      - "না গো কন্যে। ছোটো থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করছি, ওসব শিল্প কলা শেখার সুযোগ পেলাম কোথায়! তুমি বাঁশি শুনবে? ঠিক আছে কাল আমি ব্যবস্থা করে দেবো।"


      পরের দিন রসিক ঠাকুরের লোকজনেরা
 একদল বাঁশরিয়া, কাঁড়া নাকাঁড়া বাদককে নিয়ে আসে। তাদের বাদ্যির আওয়াজে গমগম করে ওঠে গোটা বাড়ি। কিন্তু রাইয়ের ভালো লাগে না।  তার অবচেতন মনে যে সুর খেলা করছে, সেই সুর সে খুঁজে পায় না! 


      আরো বেশ কয়েক মাস কেটে যায়। এখন রাই আর নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখে না। সে রসিক ঠাকুরের কোঠা বাড়ির চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ এক রাতে একটা সুর ভেসে আসে। চঞ্চল হয়ে ওঠে রাই, কান পেতে শোনে। হ্যাঁ সেই যাদুকরী সুর, সেই ডাকাতিয়া সুর! তবে আজ কেমন যেন করুণ লাগছে সুরটা! মনে হচ্ছে যেন আকুল হয়ে কাউকে ডাকছে! মনে হচ্ছে যমুনার দিক থেকে সুরটা আসছে। সবার অলক্ষ্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় রাই। যায় যমুনার তীরে। শূন্য চরাচরে কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। সুরটা ভেসে আসছে যমুনার অপর দিক থেকে। মোহগ্রস্থ হয়ে শুনতে থাকে রাই। ভাবে ওপারে যাবে। কিন্তু কিভাবে যাবে? এতো রাতে ঘাটে যে কোনো নৌকা নেই। ভাবতে ভাবতে নিকষ কালো অন্ধকারে, ততোধিক কালো যমুনার জলে সে ঝাঁপ দেয়। সাঁতার কাটতে থাকে। তাকে যে যমুনার ওকুলে  যেতে হবে। ধরা দিতে হবে বাঁশির কাছে, বাঁশরিয়ার কাছে!   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ