- বই- প্রথম প্রবাহ
- লেখক- সৌরভ মুখোপাধ্যায়
- প্রচ্ছদ– সুমিত্র বসাক (১ম প্রকাশ ) / ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য (২য় প্রকাশ )
- প্রকাশকাল– জানুয়ারী ২০১৭ (১ম প্রকাশ) / জুলাই ২০২২ (২য় প্রকাশ)
- প্রকাশক– আনন্দ পাবলিশার্স (১ম প্রকাশ) / মিত্র ও ঘোষ (২য় প্রকাশ)
- পৃষ্ঠা সংখ্যা– ১৬৪
- মুদ্রিত মূল্য- ₹২০০
“মহাভারতের কাহিনী অমৃতসমান।
মহাভারত। পৃথিবীর
বৃহত্তম মহাকাব্য। এমন এক গ্রন্থ যার কাহিনী যুগ যুগ ধরে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন
দৃষ্টিকোণে লিখিত হয়ে আসছে। এই গ্রন্থের রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর সহযোগী
শ্রুতিলেখক বিঘ্নহরণ গনেশকে মহাভারত প্রসঙ্গে বলেছিলেন –
আচখ্যু কবয়োঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে। আখ্যাস্যান্তি তথৈবান্যে ইতিহাস মিমং ভুবি।।
অর্থাৎ এ মহা ইতিবৃত্ত বহুভাবে বহুবার বর্ণিত হবে এই পৃথিবীতে। যুগে যুগে কবিরা এ ইতিহাস নিজ নিজ ভাষ্য অনুযায়ী বলবেন।
এই কথার উপর ভিত্তি করে বহু গল্প উপন্যাস রচিত হয়েছে। সৌরভ মুখোপাধ্যায় রচিত “প্রথম প্রবাহ” মহাভারতের আখ্যানকে ভিত্তি করে লেখকের এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণে ভিন্ন ভাষ্যে রচিত উপন্যাস।
নদীতীরে শরক্ষেপণ অভ্যাসরত হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু ও গঙ্গার পুত্র রাজপুত্র দেবব্রতকে দেখে বিমোহিত হয়ে ধীবরকন্যা দাসরাজের পালিতা কন্যা এবং স্বর্গের গণিকা অদ্রিকার পুত্রী মৎস্যগন্ধা সত্যবতী তাঁকে প্রেম নিবেদন করেন। বংশ গরিমায় গর্বিত এবং কাশীরাজ কন্যা অম্বার প্রনয়াসক্ত রাজকুমার দেবব্রত দাসকন্যা তথা গণিকা কন্যা সত্যবতীর প্রেম নিবেদনে সাড়া না দিয়ে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যান সত্যবতীর অন্তরে আজীবন প্রতিশোধ স্পৃহার জন্ম দেয়। রাজকুমার দেবব্রতকে নিজের করে পাওয়ার বাসনায় সত্যবতী গুঢ় অভিসন্ধি নিয়ে এক চরম খেলায় মেতে ওঠেন। পরাশর মুনিকে সেবা করার পরিবর্তে বরপ্রাপ্ত সত্যবতী মৎস্যগন্ধা থেকে রূপান্তরিত হন যোজনগন্ধায়। যোজনব্যাপী শারীরিক পদ্ম সুবাসের দ্বারা আকৃষ্ট করে বশ করেন দেবব্রত পিতা রাজা শান্তনুকে। উদ্ভিন্নযৌবনা সত্যবতীর রূপ-গন্ধে পাগল শান্তনু তাঁকে বিবাহ করতে বদ্ধপরিকর হলে সত্যবতী এক অদ্ভুত শর্ত আরোপ করেন। যার পালনে দেবব্রত ভীষণ প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে ভীষ্মে পরিনত হন। এরপরে সত্যবতী ও কালচক্রের এক নির্মম দ্যূতক্রিয়া সমন্বিত ইতিহাস রচিত হয়। যার পরিণতি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধবাসর।
মহাভারত যে যথার্থই এক এপিক এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য সে নিয়ে কোনো তর্কের অবকাশ নেই। এই মহাসৌধের অলিন্দে অলিন্দে ধূসর, সূক্ষ্ম কিন্তু সম্ভাবনায় পূর্নগর্ভ ইঙ্গিত ছড়ানো। বহুবিধ ঘটনার ও চরিত্রের জটাজালে ব্যাপ্ত কাহিনী বিন্যাস। আদিপর্বের এক পরিচিত আখ্যান ও চেনা কিছু চরিত্রকে নতুন ভাবনায় উদ্ভাসিত করেছেন লেখক সৌরভ মুখোপাধ্যায়। মহাভারতের ঘটনাক্রম নিয়ে শৈল্পিক স্বাধীনতা, এর আগেও বহু লেখক বহু ভাবে উপস্থাপনা করেছেন। বাণী বসু রচিত “কালিন্দী” উপন্যাসেও আমরা সত্যবতী ও ভীষ্মের চির পরিচিত মাতা – পুত্রের পরিবর্তে ভিন্ন এই আখ্যান পড়তে পাই। হরিশংকর জলদাস রচিত "দূর্যোধন" উপন্যাসও এই ধরণের এক ভিন্ন আঙ্গিকের কাহিনীর বর্ণনা করে। ‘প্রথম প্রবাহ’ উপন্যাসে মূল নায়ক-নায়িকা হলেন রাজপুত্র ভীষ্ম এবং রাজমাতা সত্যবতী। কিন্তু এঁরা এই কাহিনীতে দুই যুযুধান পক্ষরূপে অবতীর্ণ। সম্পূর্ণ উপন্যাস সত্যবতীর মৎস্যগন্ধা থেকে যোজনগন্ধায় রূপান্তরের মাধ্যমে ধীবর প্রদেশ থেকে হস্তিনাপুরের রাজমাতা হয়ে ওঠার কাহিনী, যে উত্থানে ইন্ধন যোগায় ভীষ্মের প্রতি তার প্রবল প্রতিশোধস্পৃহা। যে উত্থানে মুনি পরাশর, রাজা শান্তনু, নিজ সন্তান চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য, অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা সবাইকে তিনি দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করবেন আর যে উত্থানের নিরব সাক্ষী তার জারজ সন্তান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। এই উত্থান ডেকে আনে একের পর এক বিপর্যয়, মৃত্যু, ধ্বংসলীলা। কালের চক্রে বহুবিধ বাধার সম্মুখীন হয়ে যদি গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম নিজের অবস্থান থেকে সরে নমনীয় মনোভাব দেখাতেন তাহলে হয়ত এই বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হত। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা পালনে দৃঢ়বদ্ধ ভীষ্ম সত্যবতী প্ররচিত লোভ, অনুনয়, বিনয়সহ সমস্ত প্রকারের অনুভূতিকে নীরবে তাচ্ছিল্য করে নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করলেও ইন্ধন যুগিয়েছেন তাঁর প্রতিশোধস্পৃহাকে।
দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপট, পরিবেশ ও মানসিকতার এক জোড়া মানব – মানবীর এক অসম্ভব প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেখক অসাধারণ মুন্সিয়ানায় অপূর্ব লেখনী দিয়ে বর্ণনা করেছেন। ভাষাপ্রয়োগ, মহাকাব্যের বিনির্মাণ এবং চরিত্র চিত্রণে লেখক যে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন তাও বিস্মিত করে। এই গল্পের উপসংহার পড়ে স্তব্ধ হতে হয়। মহাভারতের এমন এক অংশ যেখানে পাণ্ডব নেই, কৌরব নেই, নেই স্বয়ং কৃষ্ণ - সেই অংশও যে লেখনীর গুণে মহাকাব্য হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ এই বই।
মহাভারত রচনার শুরুতে বেদব্যাসকে শ্রুতিলেখক গণপতি শর্ত দিয়েছিলেন তাঁর লেখনী যেন না থামে। যদি লেখনী থেমে যায় তাহলে তিনি আর পরবর্তীতে লিখবেন না। প্রত্যুত্তরে বেদব্যাসও শর্ত আরোপ করেছিলেন যে তাঁর রচিত শ্লোকের অর্থ না বুঝে গজানন লিখতে পারবেন না।উদ্দেশ্য ছিল কঠিন শ্লোক বোঝার ফাঁকে বেদব্যাস রচনা করতে পারবেন পরবর্তী নতুন শ্লোক। এই শ্লোক বোঝার জন্যই গনেশ প্রশ্ন করতে বাধ্য হতেন। এই উপন্যাসের বিস্তার সেই প্রশ্নোত্তর পর্বকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। শ্লোক রচনা এবং তার ব্যাখ্যা পর্ব সুন্দর করে সাজিয়ে পেশ করেছেন লেখক এই উপন্যাসে, যা এক কথায় পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে। এই উপন্যাসের মুখ্য দুই চরিত্র বেদব্যাস ও গণপতির উপন্যাসের মাঝে প্রশ্নোত্তর পর্ব এক কথায় অনবদ্য।
যেমন উদাহরণস্বরূপ একটি অংশ বলি –
ব্যস রক্তিম চক্ষু তুলে তাকালেন– “আবার কী প্রশ্ন?”
“আপনি আবাল্য যোগমগ্ন ঋষি, নির্জন দ্বীপবাসী, জিতেন্দ্রিয়। একটি আহ্বান মাত্রই রাজপুরীতে এসে রাজবধূর যুবতীদেহে উপগত হয়ে পড়লেন, অনিচ্ছুক নারীকেও স্বচ্ছন্দে সঙ্গম করতে পারলেন, এমনটি বেশ বিস্ময়কর, নয় কি? প্রথম রমণীসংসর্গেই এত আত্মবিশ্বাসী যে বলেই দিলেন, এক সঙ্গমেই গর্ভাধান করে দেবেন!”
ব্যাস অপ্রস্তুত মুখে, একটু কেশে বললেন, “আপনি বিস্মৃত হয়েছেন দেব, যোগ সাধনায় বহুতর শাস্ত্রজ্ঞান আয়ত্ত করার আবশ্যক পড়ে। রতিশাস্ত্রও তার বাইরে নয়।”
গণপতি একটু কূট হেসে বলেন, “কিংবা ধরে নিতে পারি, সেই দ্বীপেরই অধিবাসী কোনও রমণীর কাছে এ শাস্ত্রের প্রাথমিক পাঠ প্রাপ্ত হয়ে থাকবে আপনার, হে দ্বৈপায়ন! কেবল পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে আর যে-কোনও ক্ষেত্রে সাফল্য আসুক, শয্যায় তা সম্ভব নয়। সেখানে নিশ্চিত লক্ষ্যভেদের জন্য চাই পূর্ব অভিজ্ঞতার অনুশীলন।”
ব্যাস আবার একটু কেশে গলাটি পরিষ্কার করে নিলেন। ঈষৎ বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, “বড় অপ্রাসঙ্গিক চিন্তাধারা আপনার দেব গজানন, এ সব আলোচনা এখন থাক।”
এই বইয়ের বিষয়ে আরও কিছু কথা বলার দরকার।
বর্তমান বাংলা
সাহিত্যে সাম্প্রতিক কালের অন্য কোনো বইতে এত সুন্দর ভাবে যৌনতার বর্ণনা সহজে চোখে পড়েনা। বিশেষ করে একটি পৌরাণিক তথা ঐতিহাসিক মহাকাব্যের যৌনতাকে ব্যাখ্যা
করতে যে ধরণের পরিশীলিত ও পরিমার্জিত সংযমী ভাষা এই উপন্যাসে লেখক ব্যবহার করেছেন
তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। যৌনতাকে অশ্লীলতায় পরিণত না করে কিভাবে শৈল্পিক ভাবে বর্ণনা করে আদ্যান্ত
পরিণতবয়স্ক ও পরিণতমনস্ক উপন্যাস রচনা করা যায়, তার জন্যে এই বই সব সময়ই বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে
থাকবে। স্বাভাবিক নিয়মে যে যৌনতা আসে তার বর্ণনা যে সাহিত্যে কত সুন্দরভাবে
ব্যবহার কোরা যায়, তা অত্যন্ত দক্ষ ও নিপুণভাবে প্রয়োগ করে লেখক রচনা করেছেন
মহাকাব্যের এক অন্যতম জটিল অধ্যায়ের।
0 মন্তব্যসমূহ