ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

হিমঘর -পুষ্পার্ঘ্য দাস


জকাল অনেক রাত অবধি ঘুম আসে না প্রসূ্নের। জীবন সায়াহ্নে উপনীত হয়ে ঘুমের মাসি, ঘুমের পিসি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বুড়ো হলে মানুষের ঘুম কমে যায় ঠিকই, কিন্তু মাসখানেক আগেও ঘুম আসতে খুব একটা অসুবিধে হত না। তখন যে স্ত্রীকে পাশে পেতেন। শিল্পাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন তিনি… বাসতেন কেন বলছি, এখনও বাসেন। স্ত্রী বিয়োগের পর থেকেই এই রোগটা বেশি করে পেয়ে বসেছে। নিজের জীবনটাও কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। এক ঝটকায় কমে গেছে বেঁচে থাকার রসদ।

রাতে খাওয়ার পর শুতে এসে সহধর্মিণী সারাদিনের যাবতীয় গল্পগাছা তুলে ধরতেন তাঁর সামনে। মুখুজ্যেদের মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটা নিজে নিজে কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে, দুদিন ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মিত্রবাড়ির মেয়েটাকে কোম্পানি বিদেশ পাঠাচ্ছে, সেই নিয়ে তার মা-বাবার চিন্তার শেষ নেই। পাশের বাড়ির মেয়ে-জামাই এসেছে, ওদের বাচ্চাটা কী ফুটফুটে; আমরা যে কবে নাতি-নাতনির মুখ দেখব! এরকম নানারকম খবর একটার পর একটা বলে যেতেন শিল্পা। প্রসূন হুঁ-হ্যাঁ করে চলতেন। কিন্তু এত বকবকানির মাঝেও ঘুমিয়ে পড়তেন ঠিক। একসময় শিল্পা তাঁর কর্তাটি ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে গজগজ শুরু করতেন, “বাবু সারাদিন বাইরে সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হাহাহিহি করতে থাকেন। তার বেলায় ঘুম আসে না। বাড়িতে আমি দুটো কথা বললেই ঘুমে ওঁর চোখ জড়িয়ে আসে। যত্তসব! আর এই যা গরম পড়েছে না! উফফ! এত গরমে থাকা যায় নাকি! কতদিন থেকে বলছি একটা এসি লাগাতে। আমার একটা কথাও যদি শোনে…”

এতকিছুর পরেও প্রসূনের ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটত না। আসলে ব্লাড প্রেশারটা বাড়ার পর থেকেই একটুও গরম সহ্য করতে পারতেন না শিল্পা। বারবার এসির কথা বলতেন। কিন্তু পেনশনের ক’টা টাকাই বা আসে! সেখান থেকে এসি কেনা যায় না। ছেলে পরম অবশ্য বেশ ভালো চাকরি করে। ওদের -রুমে একটা দামি এসি চলে সারাদিন। কিন্তু ছেলেকে বলতে কর্তা-গিন্নী কারোরই মন চায় না। ছেলে যদি নিজে থেকে কোনোদিন বলে সেটা আলাদা ব্যাপার। যদিও ছেলে তার বউকে নিয়ে নিজের দুনিয়াতেই মত্ত, বাপ-মায়ের দিকে তেমন একটা নজর দেওয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। তাই সে যে নিজে থেকে কোনোদিন এসি কেনার কথা বলবে, সে গুড়ে বালি।

এসির হাওয়া আর খাওয়া হয়নি শিল্পার। ঘুমের মধ্যেই একদিন চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। আর তারপর থেকেই প্রসূনকে ছেড়ে গেল ঘুম। এখন কেউ বকবক করে না। চারিদিক শান্ত, নিশ্চুপ। ঘুমের জন্য আদর্শ। তবু ঘুম নেই তাঁর চোখে। আজ এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাতই শুনতে পেলেন সেই চিরপরিচিত গলা, “কিগো, ঘুমোওনি এখনও?”

চমকে উঠে বসে পড়লেন প্রসূন। স্পষ্ট দেখলেন, খাটের ধারে বসে রয়েছেন শিল্পা। চোখ রগড়ে ভালো করে দেখলেন, নাহ, কোনো ভুল হচ্ছে না। ভূতের ভয় কোনোদিনই ছিল না তাঁর। আজকেও শুধু একটু চমকে উঠেছিলেন। পরক্ষণেই একরাশ ভালোলাগা ঘিরে ধরল তাঁকে। ভালোবাসার মানুষ ফিরে এসেছে যে! শিল্পার হাতের ওপর হাত রেখে বললেন, “আচ্ছা আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”

“হয়তো স্বপ্ন। হয়তো নয়। তোমার ব্যাখ্যা দরকার নাকি আমাকে?”

“তোমাকে। একশোবার।”

“ঘুমোওনি কেন বললে না?”

হেসে ফেললেন প্রসূন, “আসলে তোমার বকবকানি অনুঘটকের কাজ করত। ওটা আজকাল আর শুনতে পাই না তো, তাই বোধহয়।”

“তাই নাকি? আর আগে যখন কথা বলতাম, তখন তো বেশ বিরক্ত হতে। মুখ দিয়ে ‘চুক’, ‘চাক’ নানারকম বিরক্তিসূচক আওয়াজ করতে!”

“তুমি কি রাতবিরেতে ঝগড়া করতে এসেছ?”

“উফফ, যা গরম! একটু ঝগড়া করারও জো নেই।”

“কেমন আছো তুমি?”

“খুব খারাপ নেই জানো তো! ওদিকের লোকজনও বেশ ভাল। গল্পগুজব করে, খেয়াল রাখে। শুধু তোমাকে খুব মিস করি। তোমার ডাক, তোমার স্পর্শ, তোমার গন্ধ… এখন মনে হয় ঠাকুর কেন যে আমায় এত তাড়াতাড়ি ডেকে নিলেন!”

চোখ ছলছল করছে প্রসূনের। ধরা-ধরা গলায় বললেন, “গল্প বলবে না? শুধু কষ্টই দেবে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গল্প শুরু করলেন শিল্পা, “বেশ, শোনো তাহলে…”। গোটা পাড়ার গল্প। একটু পরেই ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এল প্রসূনের। অনেকদিন পর। প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার মুখে তিনি শুনতে পেলেন, “নিজে তো বেশ ঘুমিয়ে পড়ছ। এই গরমে আমি কিন্তু থাকতে পারব না বলে দিলাম। যদি এসি না লাগিয়েছ, এই আমার শেষ আসা।”

পরেরদিন সকালে উঠে নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগল প্রসূনের। ঘুমটা ভালোই হয়েছে। যাকে বলে এক ঘুমে রাত কাবার। ঘুম থেকে উঠে অবশ্য কিছুক্ষণ দোলাচলের মধ্যে রইলেন। কাল রাতের ঘটনাটা ঠিক হজম হচ্ছে না। সত্যিই কি এসেছিল শিল্পা? নাকি ওটা শুধুই তাঁর কল্পনা? কিন্তু যাই হোক না কেন, একবার যখন শিল্পা ফিরে এসেছে, আর তো তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। জীবনের শেষ ক’টা দিন ভালোবাসায় থাকতে চান তিনি। আর সেই ভালোবাসা একমাত্র স্ত্রীই দিতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে শিল্পার শেষ কথাটা মনে পড়ল। আগের বারে এসি লাগাতে পারেননি। এবারেও কি পারবেন না?

        নিজের মুরোদে কুলোবে না জানেন। কিন্তু নিজেরা নানারকম ত্যাগ স্বীকার করে যে ছেলেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার উপর কি এতটুকু অধিকারও নেই? না খেয়ে, না পরে ছেলে যা চেয়েছে, সব তুলে দিয়েছেন ওর হাতে, শুধু একটু হাসিমুখ দেখার জন্য। সেসবের কি কোনো দাম নেই? শিল্পা অবশ্য ছেলের কাছে চাওয়ার ঘোর পরিপন্থী ছিলেন। কিন্তু এখন যদি কোনো একটা ব্যবস্থা না করতে পারেন, তাহলে হয়ত আবার ছেড়ে যাবে স্ত্রী, জীবনে দ্বিতীয়বারের মত…

        ছেলে অফিসে বেরোবার সময় ফাঁক দেখে আলাদা করে ডাকলেন ছেলেকে, “খোকা, তোকে একটা কথা বলার ছিল।”

        “অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।” তাড়াহুড়ো করে ঘড়ির স্ট্র্যাপ বাঁধতে বাঁধতে বলল ছেলে।

        “বলছি, আমার ঘরটাতে একটা এসি লাগিয়ে দিবি রে? পশ্চিমের ঘর তো! দুপুরবেলার পর থেকে খুব গরম হয়। আগুনের হলকা ছোটে। বিশ্বাস না হয়, তুই একদিন থেকে দেখিস। দিনে দিনে বুড়ো হচ্ছি, সহনশক্তি কমে যাচ্ছে। তোর মাও খুব কষ্ট পেত। এতদিন তোকে বলতে পারিনি। কিন্তু এখন অপারগ হয়ে বলছি। দিবি? কিনে?”

        পরম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। যেন পালাতে পারলে বাঁচে। “হ্যাঁ জানি তোমার ঘরটা পশ্চিমে। আসলে কী বলো তো, এই মাসে অনেক খরচা হয়ে গেছে। পকেট প্রায় ফাঁকা। নেক্সট মাসে নাহয়… দেখছি কী করা যায়!”

        প্রসূন বুঝতে পারলেন, বউয়ের পারমিশন ছাড়া কথা দিতে পারল না ছেলে। যাকগে, তিনি শুধু চেষ্টাটুকু করতে পারেন।

        প্রতিদিন সন্ধেবেলাটা জগার চায়ের ঠেকে কাটে তাঁর। আরও দু-চারজন বন্ধুবান্ধব আসে। সব রিটায়ার্ড। শিল্পা চলে যাওয়ার পর থেকে এটাই তাঁর মন খুলে কথা বলার জায়গা। যদিও কাল শিল্পার আসার কথাটা ঠেকে তুলতে পারলেন না। কে জানে কে কী ভেবে বসবে। হয়ত বলেই ফেলল, “প্রসূন, বুড়ো বয়সে তোর ভীমরতি ধরেছে।” স্ত্রীয়ের কথাটা চেপে গিয়েও এসির কথাটা পাড়লেন তিনি; শুধু কিছু সাপোর্ট পাওয়ার আশায়। পেলেনও বটে। বন্ধুরা একসুরে বলে উঠল, “বেশ করেছিস প্রসূন। ছেলের কাছে চাইবি না তো কার কাছে চাইবি? আমরা জীবনে ওদের জন্য কম তো কিছু করিনি। তার বদলে এই বুড়ো বয়সে একটু ভালো থাকার আশা তো করতেই পারি। আজীবন স্বার্থপর হয়ে থাকার অধিকার ওদের কে দিয়েছে? ছাড়বি না একেবারে, লড়ে যা।” বন্ধুদের কথা শুনে মনে বেশ সাহস পেলেন তিনি। ছাতি চওড়া করেই ঢুকছিলেন বাড়ি। কিন্তু সেই সময়েই শুনতে পেলেন ছেলে-বৌমার গলা।

        “সকালে বাবা কী বলছিল গো?”

        “ও তেমন কিছু না।”

“আবার চেপে যাচ্ছ? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছ? নিশ্চয়ই কিছু চাইছিল। বলো… বলো কী চাইছিল?”

“আরে চেপে যাওয়ার কী আছে! বলছিল, বাবার ঘরটা তো পশ্চিমে। খুব গরম হয়। তাই একটা এসি লাগিয়ে দিতে।”

        “তা তুমি কী বললে?”

        “বললাম দেখছি।”

        “বাঃ! আর আমি যখন বলি, এই ওয়াশিং মেশিনটা পুরনো হয়ে গেছে। একটা নতুন কিনে দাও। তখন তো তোমার টাকা থাকে না। আর বাবা যেই বলল, অমনি…”

        “দেখছি বলেছি শুধু। আর আগের ওয়াশিং মেশিনটা তো তুমিই পছন্দ করে কিনেছিলে। এক বছরও হয়নি। এখনই পুরনো হয়ে গেল?”

        “হ্যাঁ, হল। আমি দিদির বাড়িতে দেখে এসেছি, ওদের নতুন একটা নিয়েছে। বেশ দামী। ফ্রন্ট লোড, তাতে অনেকরকম অপশন। আমার ওটাই চাই। আগে ওয়াশিং মেশিন আসবে। তারপর তুমি এসি লাগাও আর যাই করো।”

        খুব আস্তে করে স্বগতোক্তির ঢঙে বলল পরম, “ওয়াশিং মেশিন কিনতে না কিনতেই তো তোমার আবার অন্য একটা জিনিসের ফরমায়েশ পড়ে যাবে।”

        “ফিসফিস করবে না। যা বলার স্পষ্টভাবে বলবে। এতদিনে কী এমন হাতিঘোড়া দিয়েছ তুমি আমাকে?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো বলবেই। আমি আর কী দিয়েছি!”

“ঠিকই তো বলছি। আর বাবাকেও বলিহারি যাই। বুড়ো হয়ে গেল। এখনও শুধু খাঁই আর খাঁই।”

        “আঃ, আস্তে। কী হচ্ছে কী? উল্টোপাল্টা কথা বলছ কেন? কখন এসে পড়বে তার ঠিক নেই!”

        চোখদুটো জলে ভিজে গেল প্রসূনের। একটা সময় ছিল যখন সারাদিনের স্কুল বাদ দিয়েও সকালে-বিকেলে গাদা গাদা ছাত্র পড়িয়েছেন যাতে করে পরমকে খুব ভালো একটা স্কুলে পড়ানো যায়। নিজের শরীরের তোয়াক্কা করেননি। ঘরের পরিবেশ বদলে যাবে বলে স্কুল থেকে ফিরেই চোখেমুখে কোনোমতে দুটি মুড়ি বা চিঁড়ে গুঁজে সাইকেল নিয়ে ছুটতেন স্টেশনের পাশের ভাড়াবাড়িটায়, যেখানে ততক্ষণে অলরেডি ছাত্রদের ভিড় লেগে গেছে। শিল্পাও উদয়াস্ত খেটেছেন। স্পন্ডেলাইটিস নিয়েও ঘরের কাজের সাথে সাথে সোয়েটার, টুপি বুনে যেতেন দুটো বেশি পয়সা পাওয়ার আশায়। এরই মাঝে ছেলের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যও অন্যদিকে মনোযোগ দেননি। রিল্যাক্স করা কী, তা ওঁদের রুটিনে ছিল না। ছেলের সব দাবী মিটিয়েছেন। নিজেদের সামর্থ্যের বাইরেও। সেসব কি এই দিন দেখার জন্য?

        রাতে খেলেন না প্রসূন। ছেলে এসেছিল ডাকতে, “বাবা, খাবে চলো।”

“নারে, খিদে নেই। তোরা খেয়ে নে।”

“কেন? খিদে নেই কেন? শরীর-টরির খারাপ হল নাকি?”

“না না, সেসব কিছু নয়।”

“তাহলে? রাতে খাওনি এরকম তো আজ পর্যন্ত হয়নি। বাইরে থেকে কিছু খেয়ে এসেছ নাকি?”

একটু চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে জবাব দিলেন, “তোর বউয়ের কথায় যে পেট ভরে গেছে…”

থম মেরে গেল পরম। লজ্জায় তার ঘাড় নুয়ে পড়ল। তারপর পেছন ফিরে ধীরপায়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন প্রসূন, দু চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে। একটু পরেই পেলেন শিল্পার গলা, “কী দরকার ছিল ছেলেকে বলার? শুধু শুধু কতগুলো কথা শুনলে।”

        চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেখলেন শিল্পা খাটের কোণে এসে বসেছে।

“ছেলেকে আমরা কী দিইনি বলো তো?”, গলায় অভিমান ঝরে পড়ল প্রসূনের।

        “সন্তানেরা ওসব মনে রাখে না গো।”

        কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপরেই জ্বলে উঠল প্রসূনের চোখদুটো। দৃঢ়ভাবে বললেন, “তা বললে তো আমি শুনব না আর। কষ্ট তো কিছু কম করিনি। আমার যখন এতই খাঁই, তখন আমার পাওনা আমি নিয়েই ছাড়ব।”

        “শত্রুতা করবে ছেলের সাথে?”, শিল্পার গলায় ভয়, দ্বিধা।

        “শত্রুতার কিছু নেই তো। এতই যখন প্র্যাক্‌টিক্যাল, তখন প্র্যাক্‌টিক্যালি ভাবলে তো ওদের কাছ থেকে একটা টাকাও ভাড়া নিচ্ছি না। কাউকে একটা ভাড়া দিতে পারলেই তো মাস কয়েকের মধ্যে এসির দাম উঠে যেত। তাহলে? আমার হক আমি ছাড়ব না। গরমে কষ্ট হয় তোমার আমি জানি। তেমন কিছু তো নয়, একটু ঠাণ্ডা হাওয়া চেয়েছি শুধু। সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে খেটে সেটুকুও কেন পাবো না বলতে পারো?”

পরেরদিন থেকে প্রায় প্রত্যেকদিনই একবার করে প্রসূন এসির কথা তুলতে লাগলেন। পরমও যেকোনো বাহানায় এড়িয়ে যায়। কখনও বলে টাকা নেই। কখনও বলে পরের মাসে একটা এরিয়ার পাওয়ার কথা আছে। কখনও বলে, এই তো বর্ষাকাল এল বলে। বাবার জোরাজুরিতে বিরক্ত হয় সে। ওদিকে দেখতে দেখতে বৌমার নতুন ওয়াশিং মেশিন চলে এল। হাই-ফাই টেকনোলজি। এসির চেয়ে বেশি দাম। তবু এসি এল না।

        প্রসূন এবার বৌমার কাছেও বলা শুরু করলেন। কথায় কথায় ঠেস দিয়ে ওয়াশিং মেশিনের কথা বলতেও ছাড়েন না। বৌমা সরাসরি মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। ভেতরে ভেতরে তড়পায়। ছেলে বাড়ি ফিরলে অশান্তি শুরু করে। ছেলে-বৌমাকে ইচ্ছে করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন প্রসূন। সবসময় ঘরে একটা অশান্তির বাতাবরণ। কিন্তু তিনি যে ঠিক করেছেন, এনাফ ইজ এনাফ। এবার আর কিছুতেই পিছু হঠবেন না। সমঝোতার ঠেকা কি শুধু তিনি নিয়ে রেখেছেন?

অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে একদিন শুনলেন বৌমা বলছে, “বাবার ঘরে যেদিনই এসি লাগাবে, সেদিনই আমি বাপের বাড়ি চলে যাব বলে দিলাম।” কষ্ট পেলেন না। তার বদলে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেল। প্রসন্নতার নয়, কতকটা যেন বিষাদের। আগের প্রসূন আর নেই। অনেক পাল্টে গেছেন এখন। দিনের পর দিন কেটে যায়। তাঁর ঘরের শুধু না, গোটা বাড়ির তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।

        কেমন একটা সর্বনেশে জেদ পেয়ে বসেছে তাঁকে। টেনশনে ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। একটু বেশি চলাফেরা করলেই হাঁফিয়ে ওঠেন। খাওয়াদাওয়াও ভালো করে করেন না। শরীর ভেঙে পড়ছে। ইচ্ছে করে ডাক্তার দেখান না। ঠেকেও উদাস হয়ে বসে থাকেন। ভাবতে থাকেন, সারা জীবনে করলেনটা কী? অশান্তি করতে করতে শেষমেশ একসময় হাঁফিয়ে পড়লেন। বুড়ো বয়সে আর কাঁহাতক…

একদিন রাতে কাতর গলায় অনুরোধ করলেন শিল্পা, “অনেক তো জেদ বজায় রাখলে। এবার থামো।”

“থামলেই কি সব সমস্যার সমাধান?”, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছুঁড়লেন প্রশ্ন। কাকে? কে জানে…

“সমাধান না হোক, সমস্যা তো আর বাড়বে না।”

কিছুক্ষণ চুপ। তারপর অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস সোনা গেল প্রসূনের। বললেন, “বেশ। থেমে যাব। তবে একটা শর্তে। তোমার সাথে নিয়ে চলো আমায়।”

শিল্পা তাঁর শর্ত পূরণ করেছিল। সেই রাতেই সত্যি সত্যি শিল্পার সাথে পাড়ি দিলেন তিনি। ছেলে একটুআধটু কষ্ট পেলেও খুব তাড়াতাড়িই সামলে নিল। বৌমা অবশ্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আর ‘এসি’, ‘এসি’ করে মাথা খারাপ করবে না বুড়ো। খবর দেওয়া হল আত্মীয়স্বজনকে। এমনকি ছেলের থেকেও বৌমা বেশি কাঁদছে দেখে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের বৌমা ভাগ্য নিয়ে আফসোস করতে লাগল।

        ছাদে উঠে নিরিবিলিতে শববাহী গাড়ির সেন্টারে ফোন করল পরমের বউ। কথাবার্তা চলল কিছুক্ষণ। রেট নিয়ে দরাদরি হল। শেষমেশ দুপক্ষই একটা সমঝোতায় এল। ফোন রাখার আগে ডুকরে কেঁদে উঠল বৌমা, “আমি কিন্তু এসি গাড়ির ভাড়া দিচ্ছি। ভুল করে যেন নন এসি গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন না আবার। গরমে বাবার খুব কষ্ট হত। এসি ছাড়া থাকতেই পারতেন না। আমরা এতদিন সাধ্যমত ওঁর খেয়াল রেখেছি। আজ শেষ যাত্রাতেও যেন উনি কষ্ট না পান, সেটা একটু দেখবেন। গাড়ি যেন একেবারে হিমশীতল থাকে…”


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ