করোনার প্রভাব কিছুটা কমায় ইদানীং কলকাতার সিনেমাহলগুলি আবার ঊর্ধে 75% দর্শকের অনুমতি দিয়ে খুলে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এবিষয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ খুব একটা অবশিষ্ট নেই, কারণ খুবই অল্প খরচায় টিভি, কম্পিউটার বা মোবাইলে বেশ ভাল ভাল ছবি দেখার যে অভ্যেস বর্তমানে তৈরী হয়ে গেছে, এখন আর এত দাম দিয়ে টিকিট কেটে হলে গিয়ে সিনেমা দেখাটা ঠিক পোষাবে না। তবে জীবন সায়াহ্নের এই ব্যতিক্রমী ভয়াবহ অধ্যায়টুকু পেরোতে পেরোতে সিনেমাকে কেন্দ্র করে আমাদের ছেলেবেলার বহু নির্ঝঞ্ঝাট ঘটনা সম্প্রতি ভীষণভাবে মনে পড়ে যায়। আজকালের শিশু-কিশোরদের কাছে সেগুলি হয়তো অনেকটা রূপকথার কাহিনীর মতোই শোনাবে।
ছোটবেলায় আমাদের ছোট শহর আগরতলায় (পাহাড়ী রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী) আমরা কিন্তু খোলা আকাশের নীচেই সাদা পর্দায় চলমান ছবি দেখতাম। তাকে বায়োস্কোপ বলা হ’ত। সরকারী ব্যবস্থায় তথ্য ও প্রযুক্তি দপ্তর থেকে সন্ধ্যের পর উপযুক্ত কোন মাঠ বা বড় উঠোনে লোহার স্ট্যান্ডে পর্দা টাঙিয়ে দূরে টেবিলের উপর বসানো প্রোজেক্টর থেকে রীল ঘুরিয়ে পর্দায় আলোর বীম ফোকাস করে সেগুলি দেখানো হ’ত। মূলতঃ সেগুলি ছিল ‘ডকুমেন্টরী’ বা তথ্যমূলক ছবি, যাতে শিক্ষামূলক নানা বিষয় থাকত। ১৯৬২-র চীনযুদ্ধের উপর দেখানো তেমন একটা ডকুমেন্টরী এখনো আমার স্মৃতিতে একেবারে গেঁথে আছে। ভিড় বেশী হয়ে গেলে আমরা কখনো কখনো পর্দার পেছন দিকটায় দাঁড়িয়েও ছবি দেখতাম। তখন পর্দার মানুষগুলির ডানহাতকে বামহাত এবং সংশ্লিষ্ট সবকিছুকেই উল্টো মনে হ’ত- অনেকটা আয়নায় নিজেকে দেখার মতো। ডকুমেন্টরী ছাড়াও তখনকার সময়ের ছোটদের উপযোগী কিছু ফিচার-ফিল্মও খুব দেখানো হ’ত, যেমন ‘দেড়শ খোকার কাণ্ড’, ‘লালুভুলু’, ‘দো আঁখে বারো হাত’, ‘রবিনহুড’, ‘হম পঞ্ছি এক ডালকে’, ‘ঢুলি’ ইত্যাদি। বিশেষ করে স্কুলগুলিতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পরটাতেই শহরের প্রভাবশালী কিছু লোকজন প্রস্তাবিত কোন জায়গায় বায়োস্কোপ দেখাবার জন্যে সরকারী কর্তৃপক্ষকে লিখিত বা মৌখিক অনুরোধ জানাতেন, এবং সাধারণতঃ সেই অনুরোধে সাড়া দেয়া হ’ত। প্রায় সন্ধ্যেতেই এই বিনে পয়সার বায়োস্কোপ দেখতে আমরা ছোট্ট শহরটার এদিকে সেদিকে বেশ বড় অঞ্চল জুড়ে ছুটে বেড়াতাম- শুধু কোনভাবে খবরটা পেয়ে যাওয়া যেকোন একটি বন্ধুর মারফতে সেটা আমাদের সবার কাছে পৌঁছে গেলেই হ’ল, ব্যস্!
হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সাথেও আমার কৈশোর ভীষণভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ষাটের দশকে আগরতলায় মাত্র তিনটি সিনেমা হল ছিল- রূপছায়া, চিত্রকথা ও সূর্যঘর। সবগুলিতেই টিকিটের পাঁচরকমের শ্রেণীবিভাগ থাকত- গ্রাউণ্ড ফ্লোরে ফার্ষ্ট, সেকেণ্ড ও থার্ড ক্লাশ, বক্স, এবং দোতলায় বেলকনি। তাদের অর্থমূল্য ছিল যথাক্রমে এক টাকা, বারো আনা, সাড়ে সাত আনা, পাঁচ টাকা এবং পাঁচ সিকি (তখন টাকা আনা পয়সার চল ছিল- ষোল আনায় এক টাকা আর চার পয়সায় এক আনা হ’ত; চার আনাকে এক সিকি এবং আট আনাকে আধুলি বলা হ’ত)। যাই হোক, আসলে বেলকনি ও বক্সের প্রতিটি চেয়ারের দাম একই ছিল; কিন্তু শুধু একসাথে চারটি টিকিট কাটলেই বক্স পাওয়া যেত। প্রাইভেসি বজায় রেখে গ্রুপে বসার জন্যেই ছিল পৃথক খোপের ভেতর চার সিট বিশিষ্ট ঐ বক্স-ব্যবস্থা। থার্ড ক্লাশের বরাদ্দে ছিল হলঘরের একেবারে সামনে পাতা কয়েক সারি ঠেসহীন বেঞ্চ, সেকেণ্ড ক্লাশ মানে মাঝামাঝি পাতা আকাঠি কিছু সারিবদ্ধ কাঠের চেয়ার, এবং ফার্ষ্ট ক্লাশ মানে হলের পেছন দিকটায় মোটামুটি ভদ্রস্থ গদি আঁটা চেয়ারের সারি। বক্স ও বেলকনির চেয়ার কিন্তু ছিল বেশ বনেদী গোছের। দশ-বারো বছর বয়সে মা-বাবার সাথে সে সময়ের নামকরা কিছু ছবি দেখেছি। তখন হয় বক্স বা বেলকনিতে, কিংবা নিদেনপক্ষে ফার্ষ্ট ক্লাশেই বসা হত। কিন্তু শুধু ভাইবোনেরা মিলে দেখলে সেকেণ্ড ক্লাশই বরাদ্দ ছিল। আর বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে দেখলে তো থার্ড ক্লাশই সই! থার্ড ক্লাশে খুব কাছে থাকা পর্দায় উপরের দিকে তাকিয়ে ঘাড় উঁচু করে ছবি দেখতে হ’ত। একবার সেখানে বসে সুদীর্ঘ সুপার ফাইটিং ছবি ‘হাতিম তাই’ দেখে বেরিয়ে এসে সবার ঘাড়ে সেকী ব্যথা! বলতে দ্বিধা নেই, সিনেমার চরিত্রগুলি রাতে স্বপ্নে এসে ভিড় করত, এবং প্রায়ই ভয়ে কিংবা রোমাঞ্চে ঘুম ভেঙে যেত।
সিনেমার সাথে জড়িয়ে থাকা আরেকটা আকর্ষণ ছিল তার ভ্রাম্যমান বিজ্ঞাপন। সাইকেল রিক্সার সামনে মাইক লাগিয়ে রিক্সায় বসা কোন স্বপ্নলোকের মানুষ যেন সমানে রাস্তার দু’ধারে ভাষার ফোয়ারা ছুটিয়ে যেত (তখনো টেপ-রেকর্ডার প্রচলিত তথা সহজলভ্য হয়নি)। সেই উদাত্ত সুকন্ঠে শোনা যেত- “এসে গেছে এসে গেছে, আজ থেকে শহরের সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ চিত্রকথায়- আপনাদের বহুপ্রতীক্ষিত অজয় কর পরিচালিত সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত দুষ্টু-মিষ্টি প্রেমের বাংলা ছবি ‘সপ্তপদী’। সঙ্গীতে কন্ঠ দিয়েছেন হেমন্তকুমার এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়; সঙ্গীত পরিচালনায় হেমন্তকুমার। অভিনয়ে আরো যারা রয়েছেন, তারা হলেন- ছবি বিশ্বাস, ছায়া দেবী, উৎপল দত্ত প্রমুখ …”। কিংবা অন্য কোনদিন আরেকজনের কন্ঠে হয়তো শোনা যেত- “আজ থেকে আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ রূপছায়ায় মহা সমারোহে শুভমুক্তি লাভ করতে চলেছে দেবানন্দ-আশা পারেখ ও প্রাণ অভিনীত, নাসির হোসেন পরিচালিত, নাচে গানে জমজমাট সুপার হিট হিন্দী ছবি ‘জব প্যায়ার কিসিসে হোতা হ্যায়’। ছবিটিতে কন্ঠ দিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর এবং মহম্মদ রফি; সঙ্গীত পরিচালনায় শঙ্কর জয়কিষান …” ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই শব্দব্রক্ষ্মের মূর্ছনার পাশাপাশি এক চিলতে কাগজের লিফলেটও চারদিকের মানুষদের মধ্যে বিলানো হ’ত, যার চলতি নাম ছিল ‘প্রোগ্রাম’। আমরা চলমান রিক্সার সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দৌড়ুতাম যতক্ষণ না একটা প্রোগ্রাম হস্তগত হয়। আমাদের পাড়ার একটা দাদাও একটি হলের হয়ে প্রোগ্রাম বিলাতো। সে কিন্তু রাস্তায় আমাদের কাউকে দেখলে প্রয়োজনে রিক্সা থামিয়ে এক একজনকে দু’টো তিনটে করে প্রোগ্রাম দিয়ে দিত, আর আমাদের মনে হ’ত যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছি। আজ সেসব ভাবলে যেমন হাসিও পায়, আবার মনে হয় কি যেন এক অনাবিল আনন্দ হারিয়ে বসে আছি। আসলে স্মৃতি বোধহয় সততই বড় মধুর।
একটা মজার ঘটনা বলি। আমাদের রাজ্যের আদিবাসী ভাইবোনেরা, যারা শহর থেকে দূরে পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করেন, তারা দুর্গাপূজোর সময়ে সমতলে নেমে এসে দিনরাত ঘুরে পূজো দেখার প্রোগ্রাম করতেন। সিনেমাহলগুলিও তখন সারা রাতব্যাপী শো’য়ের আয়োজন রাখত। হল-মালিকেরা রাতের শো’গুলির জন্যে পৌরাণিক ছবি আনার চেষ্টা করতেন। তেমনি একবার পূজোর সময়ে একটি হলে মহীপাল-অনীতা গুহ অভিনীত সুদীর্ঘ হিন্দী ছবি ‘সম্পূর্ণ রামায়ণ’ চলছিল। কোন একটি আদিবাসী গ্রাম থেকে সহজ সরল মনের কিছু মানুষ দল বেঁধে রাত তিনটের শো’তে ছবিটা দেখতে এসেছিলেন। আর্থিক অবস্থা ততটা ভাল না হলেও বছরের একটা বিশেষ দিনে আনন্দ করতে এসে তারা বেশ দামী, মানে ফার্ষ্ট ক্লাশের টিকিটই কিনলেন। দলের সর্দার তাদের সবাইকে সাথে করে সিনেমাহলের একেবারে সামনের দিকের দরজা দিয়ে ঢোকাতে নিয়ে এলেন। কিন্তু টিকিট-চেকার তাদের হাতে ফার্ষ্ট ক্লাশের টিকিট দেখে তাদেরকে বলল একেবারে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সেখানে গিয়ে বসতে। শোনা যায় সর্দার নাকি তখন ভীষণ রেগে গিয়ে জানিয়েছিলেন- এত দামী টিকিট কেটে পেছনে বসতে তারা কিছুতেই রাজী ন’ন; তাদেরকে সামনেই বসতে দিতে হবে। পরে একজন সাব্যস্তের দর্শকের হস্তক্ষেপে বিষয়টি তাদের কাছে পরিষ্কার হয় এবং পেছনের গদি আঁটা চেয়ারে বসে নির্বিঘ্নে ও আরামে তারা রামলীলা উপভোগ করেন। বর্তমান সময়ে কিন্তু ত্রিপুরার আদিবাসী ভাইবোনেরা শিক্ষালাভের গুণে দুনিয়ার সর্বত্র সাফল্যের সাথে ছড়িয়ে পড়েছেন- তাই এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাটা মজার হলেও এ’নিয়ে তাদেরকে তাচ্ছিল্য করার কোন ভুল যেন কেউ না করেন।
ষাটের দশকের প্রায় শেষদিকে কিন্তু আগরতলা শহরে আরো একটি সিনেমাহল তৈরী হয়। সেই সময়ে প্রাপ্য বহু আধুনিক সুবিধাযুক্ত মনোরম ঐ হলটির নাম রাখা হয় ‘রূপসী’। হলটির নির্মাণ অবস্থায় আমরা ছাত্ররা কৈতূহল বশতঃ মাঝে মাঝে সেটা দেখতে যেতাম। হলের মালিক আমাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাতেন। মনে পড়ে হলের দেয়ালকে ‘ইকোপ্রুফ’ বানাবার টেকনোলজি উনি আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। হলটি উদ্বোধনের পরে বেশ কয়েক বছর অব্দি তার মালিক চেষ্টা রেখেছিলেন যাতে শুধু ‘কোয়ালিটি ফিল্ম’-ই হলটিতে দেখানো হয়। হলটিতে বেশ কয়েকবার ভারত তথা পৃথিবী খ্যাত বেশ কিছু ছবি নিয়ে ‘ফিল্ম ফেষ্টিভেল’ও আয়োজিত হয়েছিল। একবার সৌভাগ্য হয়েছিল বিখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনাগলের ঠিক পেছনের চেয়ারে বসে তাঁরই ছবি 'আরোহণ' দেখেছিলাম। তাঁর পাশে ছিলেন হলমালিক স্বয়ং। নিজের ভেতরে তখন সেকী উত্তেজনা! পরে অবশ্যি গতানুগতিকতার কাছে নতি স্বীকার করে সব ধরণের ছবিই হলটিতে দেখানো হ’ত।
সত্তর দশক ছাড়িয়ে জীবনের পেছনে ফেলে আসা পরবর্তী ষাট বছর ধরে এই দুনিয়ায় বহু পরিবর্তন তথা বিবর্তন দেখেছি। সিনেমা জগতও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ ডিজিটেল দুনিয়ায় সর্বত্র হলের ছবি ভীষণ মার খেয়ে যাচ্ছে- সে সাধারণ এসি হলেই হোক, বা মাল্টিপ্লেক্স হলেই হোক। আমার আগের সেই শহরটিতে তো প্রাচীনতম তিনটি হলই এই শতাব্দীর প্রথম দিকেই অস্তিত্ব হারিয়েছিল। আর চতুর্থ হল 'রূপসী'-কে হঠিয়ে তার জায়গা দখল করেছে বর্তমান 'M LPlaza'. আর পরবর্তীকালে তৈরী হওয়া গোটা কয়েক মাল্টিপ্লেক্স হলও আজ ডিজিটেল মিডিয়ার সাথে প্রতিযোগিতায় রীতিমত কোণঠাসা।
0 মন্তব্যসমূহ