১)
সে প্রায় বছর বারো আগের কথা। ২০০৯ এর জুনের এক রোববারের পড়ন্ত বিকেল। তখনো ঠিক সন্ধ্যে হয়নি। হাসপাতাল চত্বরে বাইরের আলোগুলো তখনো জ্বলে নি। বছর তেইশ চব্বিশের জামাল একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ওয়ার্ডে ইতস্ততঃ ঘোরাঘুরি করছে। মাথার উপর চেপে আছে সদ্য পরিচিত কাসেম আলির কেসটা- বিরাট একটা বোঝা হয়ে। এর থেকে আদৌ মুক্তি মিলবে কিনা কে জানে? বহরমপুরের মাইল সাতেক ভেতরের গ্রাম থেকে নিজের আব্বাকে নিয়ে এখানে চিকিৎসা করাতে এসেছিল জামাল- দেশের অন্যতম সেরা দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত এই মিশন হাসপাতালে। আসার সময় আব্বাকে নিয়ে কত খারাপ সম্ভাবনাই না উঁকি দিয়েছিল। একটা চরম কিছু ঘটে যাওয়াও আশ্চর্যের হ’ত না। তবু জামাল চেয়েছিল রোগীর সঙ্গীসংখ্যা না বাড়িয়ে নিজের গরীব যৌথ পরিবারটির ব্যয় সাশ্রয় করতে। কোনভাবে বহরমপুর ব্যাঙ্কে নিজের একাউন্টটাতে লাখ খানেক টাকা জমা করে এটিএম কার্ডকে সম্বল করে সিরিয়াস রোগীকে একা আনার ঝুঁকি সত্বেও একাই নিয়ে এসেছিল সে। যাক, শেষটায় সবটাই সামাল দেয়া গেছে। আব্বা এখন সুস্থ হয়ে ছুটির অপেক্ষায়। তবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কোথাকার এক কাসেম আলির জন্যে নিজেদের উপর চেপে যাওয়া আটান্নব্বই হাজার টাকার এই উটকো বোঝাটা ছিল একেবারেই কল্পনাতীত।
বেশ কিছুদিন ধরেই আব্বার শরীরের সমস্ত নার্ভ ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে জীবনীশক্তি প্রায় হারাবার উপক্রম ঘটেছিল। প্রথমে বহরমপুর সরকারী হাসপাতাল, পরে কোলকাতার এসএসকেএম-এ দেখিয়েও কোন সুরাহা হয় নি। এখানে পৌঁছবার আগে প্রায় মুমূর্ষু রোগীর ঘেঁটে ঘালিয়ে যাওয়া অবস্থাটা কিন্তু বিগত এক মাসের চিকিৎসায় এখন মোটামুটি বিপদমুক্ত। জামাল যতটুকু জানতে পেরেছে, হাসপাতালের ডাক্তাররা কালই তার আব্বাকে ডিসচার্জ করে দিতে রাজী- তিন মাসের ওষুধ আর কিছু ব্যায়ামের বিধান দিয়ে। শুনেছে মাস চারেক পরে আবার চেক আপ করিয়ে নিতে বলা হবে। কিন্তু জামালের মন বলে না খুব সহজে এত খরচাপাতি করে ওরা আরো একবার এত দূরে আসতে পারবে। দেখাই যাক, শেষ অব্দি কি দাঁড়ায়। অন্ততঃ কাল তো রিলিজের একটা সম্ভাবনা আছেই ......।
“কিন্তু, কর্তৃপক্ষ যদি তৃতীয় ব্যক্তি ওই কাসেমের ব্যাপারটা নিয়ে কোন ঝামেলা বাঁধায়?” জামালের মনে আশার ক্ষীণ আলো উদয় হয়েও আবার মিলিয়ে যায়। বারবার ঘুরেফিরে একটা ভয়ই উঁকি দেয়- ঘটনাটা শেষ অব্দি আব্বার ডিসচার্জের সম্ভাবনাতে জল ঢেলে দেবে না তো? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে জামালরা নিজেরাই যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে শেষ অব্দি ফাঁস আটকে গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
২)
কিন্তু কে এই কাসেম আলি, যার জন্যে জামালকে আজ এই বিশ্রী অবস্থায় পড়তে হচ্ছে? এই হাসপাতালে আসার আগে কাসেমদেরকে তো ওরা চিনতই না। আব্বাকে ভর্তি করানো অব্দি দেখেছে তাদের নয় নম্বর ওয়ার্ডে সাত নম্বর বেডের পাশে ছয় নম্বর বেডে অল্পবয়সী একটা কংকালসার শরীর মৃত্যুর সাথে লড়ছে। একটা ভগ্ণস্বাস্থ্য কালোমত মধ্যবয়সী লোক মাঝে মাঝে রোগীর দেখাশোনা করতে আসে। বড্ড করুণ দিশেহারা তার চেহারা! জামাল নেহাৎই কথায় কথায় ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত সেই রোগীর নামটা জানতে পেরেছিল- কাসেম আলি বলে। আরো জেনেছে মধ্যবয়সী লোকটা কাসেম আলির আব্বা- নিয়ামত আলি। বাড়ী বাংলাদেশে। ঢাকার অদূরে নড়সিংদী অঞ্চলের শহরতলীতে বাপব্যাটা মিলে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চালাতো। হঠাৎই ছেলেকে নিয়ে এই বিপত্তি। ঢাকা সহ সেই দেশের নানা প্রান্তে নানা পদ্ধতির চিকিৎসা করিয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে মুমুর্ষু ছেলেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় এখানে চলে আসা।
ঢাকার সরকারী-হাসপাতালে করা কাসেমের আগের সমস্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখবার পরেও এখানকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবারও সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিজেরা করিয়ে নিয়েছেন– সঠিক অসুখ সনাক্ত করতে এটাই নাকি এদের নিয়ম। কিন্তু এই ‘ইন্ভেষ্টিগেশন’-এর স্তরেই ছেলেকে বাঁচাতে হতভাগ্য বাবার নিয়ে আসা সামান্য পুঁজিতে রীতিমত ভাঁটার টান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এও জানিয়েছে, ব্রেন অপারেশন না করলে ছেলেকে বাঁচানো যাবে না– আর তার জন্যে শুধু অপারেশন চার্জই দরকার অন্তত: পঞ্চাশ হাজার টাকা। অন্য আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। অপারেশনটাও খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হবে– নইলে যে কোন সময় চরম বিপদ ঘটে যেতে পারে। প্রৌঢ় অসহায় পিতা নিয়ামত ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ডাক্তারদেরকে অনুনয় বিনয় করে জানায়– পঞ্চাশ হাজার তো দূরের কথা, ওর কাছে ঝেড়ে মুছে হাজার বিশেক টাকা হতে পারে, তাও হোটেল খরচের জন্যে কিছু আলাদা করে রাখা ছিল বলে।
“অগর তুম লড়কাকো বাঁচানা চাহতে হো, তো অভি যাহাসে হো সাকে কম্ সে কম্ চালিশ হাজার জল্দি জমা করো, ডক্টরলোগ স্প্যাশেল কেস সমঝকে অপারেশন কর্ দেঙ্গে। লেকিন পুরা জিতনা বিল আয়েগা, বাদমে ইয়ানি ডিসচার্জকা টাইমপে পুরা দেনা হোগা”- ওয়ার্ডে মোটামুটি ভাল হিন্দী জানা একমাত্র তামিল পুরুষ নার্সটি নিয়ামত আলিকে পরিষ্কার করেই ডাক্তারদের হয়ে কথাটা জানিয়ে দেয়। নায়কোচিত ভঙ্গীতে এটাও বুঝিয়ে দেয় যে, এটা মিশন হাসপাতাল বলেই এমনটি সম্ভব হচ্ছে– অন্য কোথাও হ’লে যা হ’ত, তা কল্পনাতীত।
“লেকিন হামি কাহাসে ইতনা রুপেয়া দেগা সাব? য্যায়সে হো সাকে, হামারা বাচ্চাকা জান বাচালো, আল্লাহ্ তুমারা ভালা করেগা, হামে দয়া করো জী,”- এবার কেঁদেকেটে নার্সের পা-ই জাপটে ধরল নিয়ামত। নার্সটি তামিল ভাষায় বিড়বিড় করতে করতে জোর করে নিজের পা ছাড়িয়ে নেয়। নার্সের অঙ্গভঙ্গী দেখে পাশ থেকে জামালের বুঝতে অসুবিধে হ'ল না- এক্ষুণি কমপক্ষে চল্লিশ হাজার টাকা জমা না হলে কাসেমের অপারেশন কিছুতেই সম্ভব নয়। জামাল এও বুঝল যে, অপারেশন না হলে নিয়ামতকে অচিরেই নিজের ছেলের মরামুখ দেখতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাবে, কি আর করার আছে? গরীবদের ভাগ্যে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে বৈ কি। আর্থিক লাভ মিশন হাসপাতালের মিশন নয় বটে– কিন্তু কেউ তো আর ঢালাও দানছত্র খুলে বসে নি ! কাসেমদের জন্যে জামালের কষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাকে যে এটা মেনে নিতেই হবে। এদিকে তখনো সে জানত না- এবিষয়ে সামনে তার নিজের জন্যেই এক কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে।
৩)
ঠিক তার পরদিন। জামালের বাবা জলিলের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাদি তখনও শেষ হয়নি। রোগী নিজের বেডের উল্টোদিকের দেয়ালে সাঁটা যীশুর বাণীসম্বলিত ক্যালেন্ডারের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন সময় পাশের বেডে ছেলে কাসেমের শিয়রে দাঁড়ানো তার আব্বা নিয়ামত আলি হঠাৎই ভীষণভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কান্না যেন কিছুতেই থামতে চাইছে না। পুত্রের আসন্ন মৃত্যুর আশংকায় বিদেশের এক পিতাকে এমনভাবে ভেঙে পড়তে দেখে এদেশের মুমুর্ষু আরেক পিতা জলিলেরও মন চঞ্চল হয়ে পড়ল। বেডে শায়িত অর্ধমৃত সেই পিতার যে প্রতিক্রিয়া সবাই লক্ষ্য করল, চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যাকরণে বুঝি বা সেটার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা মেলা ভার। সত্তরোর্দ্ধ্ব বয়সী, অসার নার্ভের শায়িত রোগী জলিল মিঞা হঠাৎ ধপ করে উঠে সীটে বসে পড়ল; তারপর দুর্বল ইশারায় পুরুষ নার্সটিকে কাছে ডেকে কিছু বলতে চাইল যেন। সে কথায় একটু পরে আসছি।
জামালের আব্বা জলিল মিঞা হ'ল দেশভাগের কিছু আগে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদের জ্ঞাতিগুষ্টির গ্রামে চলে আসা এক মাঝারি কৃষক। আজ পাশের বেডের রেলিং ধরে দাঁড়ানো নিয়ামতের কান্না যেন তার প্রায় নিস্তেজ হয়ে যাওয়া নার্ভকে হঠাৎই সতেজ করে তুলেছে। এক যুগ আগের ছানিপড়া চোখে সে যেন দেখল পাশের বেডে কোন কাসেম নয়- যেন ওর ছেলে জামালই শুয়ে আছে; এবং এই মধ্যবয়সী পিতাটি যেন বহু বছর আগের সে নিজেই। আব্বার এই অদ্ভূত দিব্যদর্শনের ক্ষণটিতেই পুত্র জামালের জন্যে তৈরী হয়ে গেল আসন্ন পরীক্ষার কঠিন এক প্রশ্নপত্র।
জামাল মনোযোগ দিয়ে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করে। খুব নীচু স্বরে হিন্দী জানা পুরুষ নার্সটার সাথে তার আব্বার কি সব শলা-পরামর্শ হচ্ছে। মনে হচ্ছে টাকা পয়সার কোন হিসেব কষা হচ্ছে; কিন্তু ওদের নিজেদের বিষয়ে তো নয়– বারবার আঙুলের দিকনির্দেশ দেখে মনে হ’ল- বোধহয় কাসেমদের বিষয়ে। কাসেমের জন্যে নিজে কিছু একটা করবার প্রস্তাব দিচ্ছে জলিল, গোঁসা-গোঁসা-মুখ পুরুষ নার্সটার কাছে কাতরভাবে অনুমতিও চাইছে। পাশে দাঁড়ানো জামাল বেশ আন্দাজ করতে পারে- আজ বহুদিন পরে আবারও নিশ্চয় আব্বার ভেতরের সেই দয়াপরবশ বেহিসেবী মানুষটা জেগে উঠছে। তবে কি আজ আবারও তেমন অদ্ভূত একটা কিছুই ঘটাতে চলেছে আব্বা? নিজের হূঁশ হওয়া অব্দি আব্বার এমনধারা বিরল জেদী আচরণ জামাল বেশ কয়েকবারই দেখেছে। আর মনের এই বিশেষ অবস্থায় আব্বাকে নিবৃত্ত করার সাধ্যিও এখন অব্দি জামাল কারোর মধ্যে দেখতে পায়নি।
সেই ষাটের দশকে চালচুলোহীন দাদুর কালো মেয়ে, মানে তার আম্মাকে আব্বার হঠাৎ করেই ভালো লেগে যাওয়া, পরবর্তীতে তরুণ জলিলের উন্মাদ ভালোবাসার গল্প, শেষ অব্দি পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে সেই মেয়েকেই বিয়ে করবার ইতিহাস- এই সবই জামাল শুনেছে ওপারের একই গ্রাম থেকে এপারে চলে আসা বুড়োবুড়িদের কাছে। আর শুনেছে আব্বার কৈশোর বয়স থেকেই গ্রামবাসীদের যেকোন আপদ-বিপদে বিনা দ্বিধায় যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ার অবিশ্বাস্য সব কাহিনী। এবারও কি তাহলে সেরকমই কিছু ….? অপরিচিত চালচুলোহীন এক অনাত্মীয় পিতার মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দেবার নতুন কোন কাহিনীই কি রচিত হতে চলেছে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধরত সত্তর পেরুনো আরেক পিতা, মানে তার এই রুগ্ন আব্বার হঠাৎ উত্থিত ব্যতিক্রমী, উদার যৌবনের অদম্য শক্তিতে?
একটা অন্য প্রসঙ্গ তুলে তাড়াতাড়ি আব্বাকে নিরস্ত করবার শেষ কৌশল নিতে চেয়েছিল জামাল। কিন্তু মনের তীব্র আকাঙ্খার বিরুদ্ধে ছেলের তরফে সামান্য বাধা পড়ল কি পড়ল না, ওয়ার্ডভর্তি মানুষ অবাক হয়ে শুনল- বিছানায় মিশে যাওয়া দুর্বল জলিল মিঞা প্রায় চেঁচিয়ে ছেলেকে আদেশ করছে, “তুই যদি আমার ছাউয়াল হস্, সক্কলের কাছে কসম্ খা, তোর আব্বার জান কবুল, ওই বাপ্টার ছাওয়ালডারে আগে বাঁচাইতে হইব, নইলে জাইন্যা রাখ্, আমার জান অ বাঁচত না- কিছুতেই না”। ওয়ার্ড জুড়ে মানুষের স্তব্ধতা আর ইট-সিমেন্টের দেয়াল ভেদ করে সেই চীৎকার বুঝি বা হাসপাতাল চত্বরের মাঝখানে সুশোভিত বিরাট ক্যাথেড্রল অব্দিও পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়াবার এই আকুতি কি সেই ক্যাথেড্রলের কোনরকম আনুকূল্য, কোন করুণা পেয়েছিল? দেখাই যাক।
৪)
তারপর সে অনেক কথা- অনেক ঘটনা। অশিক্ষিত জলিল মিঞা তার সরল মানবিক ভাষায় এই সহজ কথাটা সবাইকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে পেরেছিল যে ওর নিজের জান বাঁচাতে হলে কাসেমকে বাঁচাতেই হবে। এর কোন বিকল্প ভাবা মানে একই সাথে দু’টি জান খতম করার দিকে এগুনো। তাই যত অবিশ্বাসের আর আশ্চর্যেরই শোনাক, এক আর্থিক টানাটানির সংসারের সদস্য জামাল উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একরূপ বাধ্য হয়েই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কাসেমের অপারেশন শুরুর ব্যাপারে নিজেদের পক্ষ থেকে কিছুটা আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব করে বসে। সেই সাথে কাসেমের চিকিৎসার জন্যে যথাসম্ভব ছাড়ের এবং দেয় অগ্রিম টাকার অংকের পুনর্বিবেচনার আবেদনও জানায়। কিছু কাজও হয়। জামালকে জানানো হয়, বিশেষ বিবেচনান্তে স্থির হল আপাততঃ ত্রিশ হাজার টাকা অগ্রিম জমা হলেই অপারেশন করে দেয়া যেতে পারে। বিশেষ বিবেচনায় অপারেশনের অগ্রিম খরচ মোট কুড়ি হাজার কমিয়ে এটা করা হ'ল। কিন্তু অন্যান্য খরচ জুড়ে রোগীর চূড়ান্ত বিলের ক্ষেত্রে মোট দেয় টাকায় কোন ছাড় সম্ভব হবে না। এদিকে নিয়ামতের থাকাখাওয়ার খরচা বাঁচিয়ে সে এখন সর্বোচ্চ পনেরো হাজারের বেশী দিতে অপারগ। অগত্যা জামাল আগ বাড়িয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেয়- কাসেম আলি নামের এই ছেলেটির প্রাণ বাঁচাতে তার আব্ব্বার একান্ত ইচ্ছায় শুধু অপারেশনের অগ্রিম জমা বাবদ বাকী পনেরো হাজার টাকার ভার এখন সে বইতে আগ্রহী- যদি তাতে এক্ষুণি অপারেশনে হাত দেবার ক্ষেত্রে অন্য কোন অসুবিধে না থাকে।
তারপর দেখতে দেখতে শুধু এই ওয়ার্ডেই নয়, রোগীর পার্টীদের মুখেমুখে সারা হাসপাতালে সবক’টা বিভাগে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে- চিকিৎসারত এক এদেশী ছাপোষা পিতার অলঙ্ঘ্য আদেশে নিরুপায় পুত্রের জমা দেয়া টাকায় ভিন্দেশী এক অচেনা ছেলের ব্রেন অপারেশন হয়েছে। মানবতাবাদী সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত দৃষ্টান্তমূলক এক প্রাচীন প্রতিষ্ঠান এই মিশন হাসপাতাল। এদেশের নানা প্রান্ত থেকে তো বটেই, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে ফিবছর কত রোগী নিয়ে পরিজনরা এখানে আসেন মানবিক স্পর্শযুক্ত সুচিকিৎসার আশায়। উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসক আর চিকিৎসাশাস্ত্রের ছোটবড় নানা শাখার সাথে যুক্ত অগণিত সেবকসেবিকাদের অভাবনীয় সমাবেশ এখানে। উপরন্তু, মিশনের ধর্মীয় আঙ্গিকে দেয়া নৈতিক আদর্শেও নাকি তারা বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত মানুষের পক্ষে ঈশ্বরকৃপার পরেও বোধহয় আসল প্রয়োজন হ'ল নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়ানো কোন রক্তমাংসের মানুষকেই পাশে পাওয়া। সাম্প্রতিক অতীতে নাকি এখানকার সেবাকর্মীরা এমন স্বত:স্ফূর্তভাবে কাউকে এতটা নি:স্বার্থভাবে কারো পাশে দাড়াঁতে দেখে নি, বিশেষ করে এক দুঃস্থ সিরিয়াস রোগীর জন্যে অন্য এক অতি সাধারণ স্তরের পেশেন্ট পার্টীর তরফে।
৫)
অন্যদিকে এই অকল্পিত পাওয়ার আকস্মিকতায় অসহায় নিয়ামত আলিও যেন হতভম্ব হয়ে গেল। বিদেশ-বিভূইয়ে দু’টি অচেনা মানুষের এই অযাচিত সহায়তাকে কিভাবে দেখবে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। বারবার জামালের জন্যে আল্লাহ্র দোয়া মেগে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “তুম্রার ঋণ ক্যাম্নে শোধ করুম বাপ্?” আবার পরক্ষণেই জামালকে ভরসাও দিয়েছিল- “তুমি আমারে শুধু দিন পাঁচ ছয়ের সময় দ্যাও, আমি দ্যাশে যাইয়া বাকী টাকার বন্দোবস্ত কইরা ফিরতাসি”। শেষে কিছুটা অবাক করেই সকলকে শুনিয়ে উঁচু গলায় বলেছিল, “দ্যাশে যাইয়া আমার বিয়াইত্যা অভিমানী মাইয়া, আর তার বড়লোক জামাইয়ের কাছে হাত পাতুম। আমাগো অমতে বিয়া করছে বইল্যা এতদিন বিয়াডাই স্বীকার যাই নাই, কিন্তু এইবার গিয়া আম্মুটারে কমু- এই হতভাগা আব্বাডারে মাপ কইরা দে, তর মরইন্যা ভাইডারে বাচা। আমি জানি, আম্মু আমার কথা ফিরাইত না। নির্যশ সাহায্য করব। ঠিক দেইখ্য জামাল আব্বু আমার, ফিরা আইয়া তুমার টাকা আর হাসপাতালেরও সব পাওনা মিটাইয়া দ্যামু, তুমি শুধু এই কয়ডা দিন আমার পুলাডারে দেইখ্যা রাখবা- জবান দ্যাও আমারে, আমার আল্লাহ্র পাঠাইন্যা দূত ছুডু আব্বাজান, জবান দ্যাও !”
হাসপাতালের একগাদা লোকের সামনে জামাল জবান দিয়েছিল, এবং পরে তার মর্যাদাও রেখেছিল। না রেখেই বা উপায় কি? সে যে বোকা বাপ জলিলেরই মুখ্যসুখ্য ছেলে ! দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার আর নার্সরা নির্লিপ্তভাবে কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। নিজেরা আগ বাড়িয়ে কোনরকম উৎসাহ দেয়নি বটে, কিন্তু জামালকে বাধাদান বা সাবধান - কোনটাই করে নি। তারপর? তারপর সীমান্তের ওপারে সেদেশে ঠিক কি ঘটল কারোরই জানা নেই। শুধু জানা আছে এপারে যা ঘটল।
অপারেশনের পর কাসেমকে দিন তিনেক আইসিইউ-তে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে এখন সেও মোটামুটি বিপদমুক্ত। নতুন জেনারেল ওয়ার্ড তিন নম্বরে নতুন বেড আটত্রিশে তাকে আনা হয়েছে দিন দশেক আগে। কিন্তু কাসেমের বাবার প্রতিশ্রুত পাঁচ ছয় দিনের সময়-সীমা শেষ হয়ে আজ দিন পনেরো হতে চলল– নিয়ামত আলির দেখা তো দূর্, কোন খবর পর্যন্ত নেই।
প্রথমে জমা করা পনেরো হাজার টাকা ছাড়াও কাসেমের অপারেশন-পরবর্তী দু'তিন দিনের ওষুধের রিকিউইজিশন ধরিয়ে দেওয়া হলে মানবতার খাতিরে জামাল নিজেই সেগুলো কিনে দিয়েছিল। কিন্তু পরে ওয়ার্ডে আনার পর আবার যখন আরো হাজার দশেক টাকা জামালের কাছ থেকেই চাওয়া হল- জামাল দিতে অস্বীকার করে। বিনত ভঙ্গীতে ডাক্তার আর নার্সদেরকে মনে করিয়ে দেয়- শুধুমাত্র তার অসুস্থ আব্বার বিশেষ ইচ্ছায়ই সে কাসেমের অপারেশনের জন্যে মাত্র তাৎক্ষণিক এবং এককালীন সাহায্য করবার কথা বলেছিল। এতদিনে তো কাসেমের আব্বার ফিরে এসে সব মেটাবার কথা- হাসপাতালের সবার সামনেই তো বুড়ো কথা দিয়ে গেছল!
এরপরেও জামালের উপর পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করা অব্যাহত থাকে। টাকার অংকটা অর্ধেক পরিমাণ কমিয়ে আরো পাঁচ হাজার টাকা দিতে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রায় বাধ্য করেছে। তারপর অবশ্যি মাঝখানে আর কোন টাকা সরাসরি চাওয়া হয় নি। কিন্তু ক্রমশ: বাড়তে থাকা কাসেমের বিলের খবর মাঝেমধ্যে এভাবে সেভাবে তার কানে পৌঁছানো হচ্ছে ঠিকই। জামাল বিষয়টাকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। ভেবেছিল, নিউরোওয়ার্ডের সাত নং বেডের জামাল-জলিল মিঞারা যে প্রথম দিকে পাশের ছয় নং বেডে থাকা রোগীর পার্টী কাসেম-নিয়ামত আলির কেউ নয় সেই বাস্তবটা তো কর্তৃপক্ষের গোচরেই আছে, যা ওরা অস্বীকার করতে পারবে না কখনো।
৬)
আজ ভোরের দিকে ওয়ার্ডের ভালোমানুষ বিল ক্লার্কটি যখন রাতের শিফট-ডিউটি সেরে চলে যাচ্ছিল, তখন তাকে বলে কয়ে কম্পিউটার থেকে ‘বেড নং সাত - জলিল মিঞা’-র নামে গতকাল শেষ হওয়া সপ্তাহ অব্দি তৈরী হয়ে যাওয়া তার আব্বার বিলটা জামাল আগাম এক পলক দেখে নিয়েছে। এর সাথে আজকের বিল না হওয়া হিসেবটাও মোটামুটি যোগ করে বুঝে নিয়েছে, ভর্তির সময়ে দেওয়া পঁচিশ হাজার অ্যাডভান্স বাদ দিয়ে আর মাত্র সাড়ে বত্রিশ হাজারের মত জমা দিলেই কাল তার আব্বার ডিসচার্জ হয়ে যেতে পারে। তাই তাড়াতাড়ি লজে ফিরে গিয়ে আজ সকালেই ট্র্যাভেল এজেন্ট মারফৎ প্রায় দেড়গুণ দাম দিয়ে আগামীকালের তৎকাল রেল রিজার্ভেশনটাও করিয়ে রেখেছে সে। রিলিজ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা কিছুটা থাকলেও অন্ততঃ ফিরতি-টিকিট না পাবার কোন ঝুঁকি সে নিতে চায় নি। কাল লজের বেডটা ছাড়ার আগে সেখানকার সামান্য কিছু বকেয়া এবং হাসপাতালের সব বিল মিটিয়েও জামালের একাউন্টে চলনসই ব্যালেন্স থেকে যাবার কথা। নিয়ামত আলির প্রতিশ্রুতি মতো ওদের থেকে নিজেরা খরচ করা মোট তেইশ হাজার টাকা ফেরৎ পাবার আশা সে মন থেকে ছেড়েই দিয়েছে। মোটের উপর আব্বাজানকে নিয়ে এখানকার পাট গোটাতে এই মুহূর্তে জামাল নিজের দিক থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু কাসেম সংক্রান্ত এই ঝামেলাটা থেকে ছুট্কারা মিলে গেলেই না সেটা সম্ভব হবে!
কিসের একটা ভয় এসে এখন জামালকে বারবার নঞর্থকই ভাবাচ্ছে। কাসেমের পুরো বিলটা শেষ অব্দি জামালকেই ধরিয়ে দেয়া হবে না তো? কাল একবার কানাঘুঁষো শোনা যাচ্ছিল- এমন সম্ভাবনা নাকি উড়িয়ে দেয়া যায় না। সাথে সাথেই এটেন্ডিং সিনিয়র ডাক্তার আর ওয়ার্ড-ইন্চার্জ এর সাথে কথা বলেছিল জামাল। মনে তো হয়েছিল সবাই ওর প্রতি সহানুভূতিশীলই; কারণ সবারই সান্ত্বনাবাক্য ছিল, "না, না, এটা আবার কি করে হয়?" কিন্তু পরে, বিশেষ করে আজ দুপুর থেকেই একটা থমথমে পরিবেশ- সবার মধ্যে কেমন যেন একটা রাখরাখ ঢাকঢাক ভাব, যেন ভেতরে ভেতরে জামালদের জড়িয়ে কি একটা ব্যবস্থাগ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। একটা অন্য বিপদের কথাও আকারে ইঙ্গিতে শোনা যাচ্ছে। কাসেমকে হাসপাতাল থেকে বুঝে ফেরৎ নেবার দায়িত্বও নাকি জামালকেই দেবার কথা উঠছে। জামাল মনস্থির করে- বিশেষ প্রয়োজনে সুপার বা আরো ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ অব্দি যাবে সে।
জামালের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, আব্বাকে কাগজে কলমে ডিসচার্জ দিলেও কর্তৃপক্ষ কাল আদৌ তাকে বাড়ী যাবার অনুমতি দেবে তো? নাকি কাল প্রথমদিকে ওয়ার্ডের বহু আধিকারিকদের তোলা যুক্তির মতো সেই একই অমানবিক অভিযোগ তুলবে- আগ বাড়িয়ে অন্য রোগীর বিষয়ে এত বড় দায়িত্ব নিতে কে বলেছিল জামালদেরকে? জামালের বুড়ো বাপ্টার নাহয় কিছুটা মেন্টাল ভীমরতি ধরেছিল, কিন্তু কমবয়সী জামাল নিজে তো পারত কায়দা করে পুরো ঝামেলাটা এড়িয়ে যেতে। ওরা যেন চাইলেও সরাসরি বলতে পারছে না- এই গ্রীষ্মঋতুর গুমট আবহাওয়ায় দক্ষিণের এই ছোট্ট শহরটিতে বহুদূরবর্তী সমুদ্র-তীর থেকে উদার হাওয়া কি শুধুমাত্র জলিল-জামালদের জন্যেই একটু বেশী খেলছিল? তা না হলে সুদূর উত্তরের ভিন্দেশী এক বিপদগ্রস্ত বাপব্যাটার জন্যে অন্য এক এদেশী বাপব্যাটার দরদ এতটা উথলে উঠল কি করে? স্রেফ স্বধর্মী বলেই কি?
জামাল কিন্তু এক একবার নিজেও ভাবে, কর্তৃপক্ষের খুব দোষ কি? ওদের কাছে রোগীকে ফেরত পাঠানোর রাস্তা তো খোলাই ছিল। মাঝখানে জামালরা নিজের থেকেই কান্ডটা না বাধালে এত দামী অপারেশন ওরা হয়তো করতই না, আর এইসব ঝামেলাও সহ্য করতে হ'ত না।
৭)
ঘটনাপ্রবাহ আর আশংকার দৃশ্যগুলো পরপর ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকা জামাল এখন ওয়ার্ডের বাইরে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসা বহুতল বাড়ীটার দূরতম প্রান্তে এক অদৃশ্য ছায়ায় অনেকটাই একা হয়ে গেছে। অপ্রত্যাশিতভাবেই কোত্থেকে এসে আকাশে মেঘও জমেছে প্রচুর। আর সন্ধ্যের এই আঁধারি মুহূর্তটা হঠাৎই ওর জন্যে বয়ে নিয়ে এল এযাবৎ কৃত সমস্ত মূর্খামির নিষ্ঠুরতম পরিণতির ফরমানটা। এবারও রঙ্গমঞ্চে হাজির সেদিনের সেই পুরুষ নার্সটিই, কিন্তু এবার নায়কোচিত নয় - একেবারে খলনায়কের ভঙ্গিমায়। জামালকে ইশারায় কাছে ডাকে সে। কম্পিউটর প্রিন্টের ‘ওয়ার্ড নং নয়ের বেড নং ছয়, আই সি ইউ, ও পরে ওয়ার্ড নং তিনের বেড নং আটত্রিশ - কাসেম আলি’ নামের লম্বা বিলটা ওর হাতে প্রায় জোর করেই গুঁজে দেয়। জামাল ভয়ে ভয়ে দেখে- মোট আটান্নব্বই হাজার টাকা নেট বকেয়া। নার্স গম্ভীরসে বলে, “তুমারে লিয়ে এক সন্দেস্ হ্যায়। অগর তুম কল্ অপনে পিতাজিকো লে জানা চাহতে হো, কাসেমকা পুরা বিল তুমহে হী ভরনা হোগা, ঔর তুমহে হী কাসেমকো সাথ্ কর্ হাসপাতালসে বাহার লে জানা হোগা”।
গছানো দায়িত্ব পালন করেই লোকটা নিমেষে উধাও। জামালের চকচকে কপালে দুঃশ্চিন্তার কালো ভাঁজের দিকে একবার তার নজরও পড়ল না। প্রেরকের পাঠানো ‘সন্দেশ’টি প্রাপকের জিভে মিষ্টি লাগল, কি পান্সা- তা জানতে তার যেন বয়েই গেছে। তথাকথিত উচ্চ আদর্শের অবাঞ্ছিত বদ্হজমী গুরুপাকে তার মানবতাবোধের যেন ঊর্ধগতি ঘটে গেছে, আর নির্দয় নিষ্ঠুরতার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই স্থবির ব’নে যাওয়া অস্তিত্বে চেনা গন্ডীর বাইরে ব্যতিক্রমী কোন হিন্দোলেই তার বুঝি কোন হেলদোল নেই।
ততক্ষণে একে একে হাসপাতাল-চত্বর জুড়ে আলোগুলো জ্বলতে শুরু করলেও জামালের সামনে কিন্তু এখনো পুরোপুরি নিরাশার অন্ধকার। হাঁটতে গিয়ে বারবার থমকে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবে- অসুস্থ আব্বার নির্দোষ ও নির্মল মহতী ইচ্ছাপূরণে পদ্ধতিগত কি ভুলটাই না করে বসেছে সে। আধোচেনা এই মানবিক দেয়ালের আড়ালে ঘেরা সম্পূর্ণ অচেনা এক অমানবিক চৌহুদ্দির ভেতরে একা একা কি কাঁচা কাজটাই না করে বসে আছে। তার কি উচিৎ ছিল না সরল বিশ্বাসের পথে না হেঁটে কাগজে কলমে লেখা সর্তে পরবর্তী কোন অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মূল দায়বদ্ধতা কর্তৃপক্ষের উপরেই রাখার যথাযথ ব্যবস্থা করা? কিন্তু এখন কোন্ পথে হাঁটবে সে? প্রথম কথা, বিশাল অংকের এই টাকা কোথায় পাবে? দ্বিতীয়ত: কাসেমদের বাড়ীর পুরো ঠিকানা পর্যন্ত ওর কাছে নেই। নিয়ামত আলিকে জামাল কখনো জিজ্ঞেসই করেনি বাঙলাদেশী এই বাপব্যাটার পাসপোর্ট-ভিসা জাতীয় কোন কাগজপত্র আছে কিনা, কিংবা চেয়ে রাখেনি অন্য কোন পরিচয়পত্রের কপিও। আসলে সত্যিকারের পাশে দাঁড়ানোর সময়ে এসব বাস্তব সাবধানতার কথা বোধহয় প্রকৃত দরদীদের মনেই আসে না।
কিন্তু এখন কি হবে? জামাল খেই খুঁজে পায় না। অনেক চেষ্টায় রুগ্ণ কাসেমের কাছ থেকে ওর আব্বার একটা মোবাইল নাম্বার পাওয়া গেল, কিন্তু তাতে ফোন করে জামাল নিয়ামতের কোন সাড়াই পেল না। ডাক্তারদের কাছে রিপোর্ট করলেও কাসেমদের প্রতি ‘বিশেষ দুর্বলতা’ আছে সন্দেহে ওরা জামালের উপর ভরসা হারায়। তাই তারা নিজেরাই সেই নাম্বারে বার কয়েক চেষ্টা করেন- কিন্তু ফল তথৈবচ। উল্টোদিক থেকে শুধুই শোনা যায়- "গ্রাহক এখন পরিষেবা সীমার বাইরে, পরে আবার চেষ্টা করুন …" ইত্যাদি।
৮)
নিয়ামতের ফিরে আসা নিয়ে আগে কিন্তু কারো মনে কোন সংশয় কখনোই দানা বাঁধেনি। সবাই ভেবেছিল, পিতৃত্বের মস্ত টানে নিয়ামতকে যে আসতেই হবে। বড়জোর ছেলেকে নিতে এসে জবান দেয়া সময়টা পেরিয়ে যাবার জন্যে সত্যিমিথ্যে কোন সাফাই গাইবে, আর কর্তৃপক্ষের কাছে কান্নাকাটি করে টাকা আরো কমানোর বায়না ধরবে। কর্তৃপক্ষ হয়তো তা মেনেও নিত। নইলে কোথাকার ছা-পোষা জলিল-জামালদের মানবিক কাণ্ডকীর্তিই কি খুব বেশী প্রাধান্য পেয়ে যেত না? এই মিশন হাসপাতালের সাথে দীর্ঘদিনের জুড়ে যাওয়া ‘চ্যারিটি’র গ্ল্যামার অন্যদের চোখে অনেকটাই ফিঁকে হয়ে যেত না কি?
অন্যদিকে গ্রাম্য, আবেগপ্রবণ আব্বার বোকা ছেলে জামালের সরল বিশ্বাস যেকোন পরোপকারের মতোই এক্ষেত্রেও তাকে একটা নিশ্চিন্ত ভরসার জায়গা জুটিয়ে যাচ্ছিল। ছোটবেলা থেকে আব্বার কাছে পাওয়া সত্যের সহজ পাঠ বরাবরই তার সত্তার অনেক গভীরে কোথাও তাকে মনের জোর জুগিয়েছে। তার দৃঢ় আস্থা ছিল, এবারও শেষ পর্যন্ত তাদেরই জয় হবে, কারণ পুরো ঘটনাটায় তার আব্বা এবং সে নিস্বার্থভাবে স্রেফ মানবতার পক্ষেই কাজ করেছে। তাছাড়া হাসপাতালের সর্বত্র সদাজাগ্রত যীশুও তো সবই একেবারে সামনাসামনি দেখেছেন। তাই ভয় করবার কিছু ছিল বলে তার মনে হয়নি।
কিন্তু এখন চতুর্দিকের এই আলোকজ্জ্বল সন্ধ্যায়ও কম্পিউটরের নিকষ কালো প্রিন্টের বিল ধরানো জামালের সমগ্র অন্ধকার সত্তা জুড়ে শুধু একটাই ভাবনা- কি করে এই দায় থেকে তারা রেহাই পেতে পারে। এটা তো সত্যি যে তারা যেচে দায়িত্ব নিয়েছিল- যদিও সেটা শুধুমাত্র অপারেশনটা তাড়াতাড়ি শুরু করাবার জন্যেই। কিন্তু সেটা তো এখন নেপথ্যে। ধরেই নেয়া হচ্ছে যেন সব দায়িত্ব তারাই নিয়ে ফেলেছিল। মুখের কথার ভুল ফায়দা তোলা হচ্ছে। অবশ্যি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ফরমানটাও এখনো মৌখিক, কিন্তু তা খুবই স্পষ্ট ও শক্তিধর, কারণ বিরাট এই সংস্থার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্রেন থেকে তা উদ্ভূত। আসন্ন বিপদ থেকে ছুট্কারা পেতে এবার তো শেষ চেষ্টা কিছু একটা করতেই হয়। কিন্তু ঠিক কার কাছে যেতে হবে বুঝতে পারে না জামাল। হঠাৎ দূর থেকে ক্যাথেড্রলের বাইরে সেট করা স্পীকারে বাজা গানগুলি তার কানে আসে। এই যা, আজ রোববার মিশনের ক্যাথেড্রলে জমজমাট প্রার্থনার দিন ছিল না? আশ্চর্য, সে এতক্ষণ এত আন্মনা ছিল? প্রার্থনা তো প্রায় শেষ হবার সময় এসে গেল। একবার বিশপ-ফাদারের কাছে গেলে হয় না? উনি অন্তত: বাস্তব অবস্থাটা বুঝবেন নিশ্চয়ই। বুঝবেন মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সাধ্যিমত কাসেমের বাবার পাশে দাঁড়িয়ে জামালরা কোন অপরাধ তো করেইনি; বরং, ঈশ্বরের দূত মারফত আবহমানকাল শুনে আসা নির্দেশ পালন করেছে মাত্র।
জামাল আশান্বিত হয়। সময় নষ্ট না করে ক্যাথেড্রলের দিকে দ্রুতপায়ে রওয়ানা দেয়। করিডোরে প্রচুর লোকের ভীড়। এইমাত্র প্রার্থনা শেষ হয়ে গিয়েছে। ভক্তরা কতকটা বেমানানভাবে হুড়োহুড়ি করে ফিরে আসছে। তাদেরই দুই একজনকে জামাল বিশপ-ফাদারের কথা জিজ্ঞেস করে। “ফাদার তো নেই, মানে আসেন নি”। আসলে উনি নিজে ব্যস্ততার কারণে প্রার্থনাসভায় খুব কমই উপস্থিত থাকেন। তাঁর আসনটাই সম্মান দিয়ে রাখা আছে শুধু। প্রায়দিনের মতোই আজও যিনি কার্যত: সভা পরিচালনা করছেন, তিনি মিশনের অনেক নীচের স্তরের সামান্য একজন বেতনভোগী কর্মী। এইসব টাকাকড়ি সংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে তার তো মতামত থাকার কোন কথা নয়।
জামাল তবুও খালি হলঘরের দিকে এগিয়ে যায়। একরাশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ নিয়ে ঠিক মাঝখানটায় পৌঁছয় সে। চারদিক নিথর শূন্যতায় ভরা। মূল বেদীর নীচে যীশুর প্রতীকী মূর্তি ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। রেলিং ঘেঁষে যতটা সম্ভব যীশুর পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। তারপর কি ভেবে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। না, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন নালিশ জানাতে নয়। যীশুর উদ্দেশ্যে তার জিজ্ঞাসা- হে প্রভু ! আল্লাহ্র সাথে একাত্ম হয়ে দুই দেশের দুই বাপকে সমান সন্তানস্নেহ দিয়েছ নিশ্চয়ই; তবুও কেন এক বাপ পরের ছেলের জন্যে নিজেকে উজাড় করে দেয়, আর অন্য বাপ নিজের মরতে বসা ছেলের জন্যে আরেকজনের উজাড় করা সহানুভূতি পাবার পরেও সব প্রতিশ্রুতি, এমনকি ছেলেকেও এভাবে ভুলে যায় ! আধোচেনা এই পৃথিবীর এক করুণতম পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের প্রাথমিক বিচারে দুই পিতৃত্বের এই ফারাককেই দায়ী করে জামাল। ফলে এই মুহূর্তে কাছে পাওয়া স্রষ্টার দূত যীশুকেই বুঝি কাঠগড়ায় দাঁড় করায় সে।
পরক্ষণেই আবারও এক নিখাদ সহানুভূতি আর আশংকা জেগে উঠে জামালের মনে- কাসেমের আব্বার জন্যে। আদৌ বেঁচে আছে তো বেচারা নিয়ামত আলি? নাকি বড়লোক মেয়ের কাছে আশাহত হয়ে আত্মযন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে ...? জামালের মন কু-ডাকে। দরিদ্রতম পিতার সম্ভাব্য স্বপ্নভঙ্গের আর অজানা পরিণতির কথা ভেবে মানুষের চরম দারিদ্র্যের স্রষ্টা হিসেবে আবারও যীশুকেই অভিযুক্ত করে সে। আরো কিছু নীরব মুহূর্ত কেটে গেলে অনন্য গেঁয়ো সরলতায় ওর মনে হয়, সদ্য ধরিয়ে দেয়া অপরাধবোধে স্বয়ং যীশু নিশ্চয়ই এবার ভীষণ অনুতপ্ত। তাই তার আব্বার পবিত্রতম অনুভূতির ছোঁয়াজাত, নিজের গলায় পরানো এই মানবতার ফাঁস থেকে তাকে মুক্ত করার জোরদার আর্জিও এবার সে এই যীশুর কাছেই জানায়- আদায় করবার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।
৯)
অজানা ঘোরে অনেকক্ষণ কেটে গেছে জামালের। পর্দার বেহিসেবী উঠানামায় জীবননাটকের কোন্ দৃশ্যান্তরে দর্শক হয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সে। মাত্র একটু আগে ক্যাথেড্রল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। না, আকাশের নীরবতা ভঙ্গ করে কোন দৈববাণীর লেশমাত্র শুনতে পেল না কোথাও। শুধু ঝিক্কা-উ করে বাজতে শোনা গেল শহরের প্রান্তীয় রেল জংশনটি থেকে এইমাত্র ছাড়া হাওড়াগামী আজকের ট্রেনের সিগন্যাল-হর্ণটা। কাল এই ট্রেনেই তো তাদের টিকিট কাটা ! জলছলছল ঝাঁপসা চোখে ক্যাথেড্রলের বাইরে নিয়ন-আলোর বিক্ষিপ্ত প্রতিসরণে ক্ষণজন্মা দূরবীণে জামাল যেন আগামীকালের এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য অগ্রিম দেখতে পেল। দেখল, কাল সন্ধ্যের এই ট্রেনটা ফাঁসে আটকানো জলিল-জামালদেরকে পেছনে ফেলে রেখে, ওদের বোকা বোকা দরদী দু’জোড়া চোখকে ব্যঙ্গ করতে করতে, স্বীয় গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে ওদের অনেক আগে। জীবন নিয়ে আব্বার কাছ থেকে শেখা জামালের সব হিসেব-নিকেশ কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। সে অপেক্ষায় থাকে- নিয়নের আলোর ভীড়েও একদল মানুষের স্বার্থপরতার গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানবিক আলোর রশ্মি যদি কোথাও আবার নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায়।
0 মন্তব্যসমূহ