![]() | |
“পারফেক্ট ইমপারফেকশন” বিলি বন্ডের তৈরি প্রতিকৃতি |
সাধারণত যখন কোনও বস্তু ভেঙ্গে যায় আমরা তা বাতিল করে দেওয়াই শ্রেয় মনে করে থাকি।কিন্তু জাপানের এক বিশেষ শিল্পকলা – “কিন্তসুগি” পদ্ধতিতে যে কোনও ভাঙ্গা বস্তুকে অসাধারন এক পদ্ধতিতে জুড়ে দেওয়া হয়।
![]() | |
আশিকা ইওশিমাসার প্রতিকৃতি, ১৫ শতকে (ছবিসুত্রঃ Wikimedia Commons ) |
◉ ইতিহাসঃ প্রায় ১৫ শতকে জাপানের এক বিখ্যাত শোওগান বা সেনাপতি আশিকাগা ইওশিমাসা চীনে একটি চীনামাটির ভাঙ্গা চায়ের পাত্র (Tea Bowl) পাঠান জোড়া দিয়ে ঠিক করে দেওয়ার জন্য।পাত্রটিকে ধাতব তার দিয়ে মুড়ে জোড়া দিয়ে জাপানে ফেরত পাঠানো হয়।জোড়াকৃত পাত্রটির কুৎসিত চেহারা দেখে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং আদেশ দেন সেটিকে যেন সুন্দর করে জুড়ে দেওয়া হয়। জাপানী কারিগররা জুটে যান ভাঙ্গা পাত্রটিকে সুন্দর করে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টায়।তাঁরা সোনার ব্যবহার করেন ফাটল মেরামত করার জন্য ও এক অপূর্ব সুন্দর রূপ দান করেন।এই চেষ্টার ফল স্বরূপ এক নতুন শিল্প কলার সৃষ্টি হয়।
নাম কিন্তসুগি বা কিংসুকোরই। কিন্তসুগি কথার অর্থ হল সোনালী জোড়াকারী ("golden joinery") এবং কিংসুকোরই কথার অর্থ হল সোনালী সারাই (“golden repair”)। এই পদ্ধতিতে ভাঙ্গা বস্তু জুড়তে সোনা, রুপা ও প্ল্যাটিনামের মত দামী ধাতুর ব্যবহার করা হয়।এর ফলে আসল বস্তুটির থেকে জোড়া দেওয়া ভাঙ্গা বস্তুটির অর্থমুল্য বেশী হয়।সাধারণত পোর্সেলিন বা চীনামাটির ভাঙ্গা বাসন-পত্র জোড়ার কাজে এই পদ্ধতি বহুল প্রচলিত। পরবর্তীকালে ইওশিমাসা শাসনভার গ্রহন করলে ‘জেন’ বৌদ্ধ মতালম্বী হিগাশিয়ামা বাঙ্কা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সুচনা হয় (Higashiyama bunka cultural movement)। এর ফলে জাপানে ঐতিহ্যময় চা-অনুষ্ঠান (Sado - the Way of Tea) এবং ইকেবানা (Kado - way of flowers) পালনের প্রচলন হয়। “সাদো” -তে কিন্তসুগি পদ্ধতিতে তৈরি চায়ের সরঞ্জামই ব্যবহার করার রীতি পালন হয়। এর ফলে কিন্তসুগি পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
১৭ শতক থেকে কিন্তসুগি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই সময়ের সৈন্যরা চায়ের বিভিন্ন ভাঙ্গা পাত্র জোগাড় করে এই পদ্ধতিতে জুড়ে বেশী মুল্যে তা বিক্রয় করে মুনাফা লাভ করত। কথিত আছে সংগ্রাহকরা এক সময় দামী মূর্তি বা ঐতিহাসিক বাসন – পত্র ইচ্ছা করে ভেঙ্গে এই পদ্ধতিতে জুড়ে বস্তুটির দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি করতেন। যদিও পরবর্তীকালে তা নিন্দনীয় কাজ হিসাবে সমালোচিত হয় এবং কঠোর নিয়ম করে বন্ধ করা হয়। যদিও এই শিল্পকলার জন্ম জাপানে কিন্তু বর্তমানে চীন, ভিয়েতনাম ও কোরিয়াতে এর বহুল প্রচলন দেখা যায়।
![]() | |
জীবনকে জুড়ে দেওয়ার কথা বলে |
◉ দর্শনঃ জাপানের প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যশালী শিল্পকলা কিন্তসুগির নেপথ্যে এক সুন্দর জাপানী জীবন দর্শন কাজ করে। “অসম্পূর্ণের মধ্যে সম্পূর্ণতা দর্শন” । অর্থাৎ যদি কোনো কিছু অসম্পূর্ণ হয় বা নষ্ট হয়ে যায় তা বাতিল না করে নতুনভাবে চেষ্টা করে তাকে সুন্দর ও সম্পূর্ণ রূপ দিয়ে গ্রহন করা উচিত। এটি রূপকের মাধ্যমে মনুষ্য জীবনে অন্য আঙ্গিকে ব্যবহার করার কথা বলা হয়।মানুষের ভাঙ্গা সম্পর্কও হয়ত এই ভাবে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা যায়। জাপানীদের মধ্যে এই জীবন দর্শন পরবর্তীকালে প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই সারিয়ে তোলার পদ্ধতিটি জাপানী দর্শন মোত্তানাই অর্থাৎ কিছু নষ্ট হলে দুঃখিত হওয়া এবং মুশিন অর্থাৎ পরিবর্তন গ্রহনীয় – এই দুই জীবন বোধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
◉ উপাদান সামগ্রীঃ কিন্তসুগিতে ব্যবহৃত সামগ্রী সমুহ হলঃ
• ‘এপক্সি’ রজন বা চীনামাটির জিনিস জুড়তে ব্যবহৃত আঠা।
• সোনা ও মাইকার গুঁড়ো।
• পাতলা সরু আঁকার তুলি।
• ভাঙ্গা চীনামাটির পাত্রের টুকরো।
• স্ক্র্যাপ পেপার
• মাস্কিং টেপ
• হাতুড়ি
• গ্লাভস
◉ পদ্ধতিঃ এই বিশেষ শিল্পকলায় প্রধানত তিন প্রকারের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
► ক্র্যাকঃ সর্বাধিক ব্যবহৃত এই পদ্ধতিতে হাল্কা ফাটল আকৃতিতে ভাঙ্গা পাত্রকে জুড়ে দেওয়া হয়। শিরার আকারের এই ফাটলগুলোতে সোনালী রঙের ঔজ্জ্বল্য ফুটে ওঠে।এতে উপাদানের ব্যবহার খুব সীমিত হয়।
► পিস মেথডঃ যখন কোনো পাত্রের ভাঙ্গা টুকরো হারিয়ে যায় বা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় তখন সেই ফাঁকা স্থানটি সোনা বা অন্য ধাতু দিয়ে পূর্ণ করে পাত্রটি জুড়ে দেওয়া হয়।এতে ধাতুর ব্যবহারে পরিমান তুলনামূলক বেশী হয়। তাই এই পদ্ধতিতে তৈরি পাত্রের দাম বেশী হয়।
► জয়েন্ট কলঃ এই পদ্ধতিতে একাধিক ভিন্ন ধরনের ভাঙ্গা টুকরো ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ আলাদা আলাদা পাত্রের টুকরো জুড়ে নতুন রূপ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য টুকরোগুলোর আকৃতি এক হওয়া দরকার হয়।
কিন্তসুগি পদ্ধতিতে কোনো বস্তুর অসম্পূর্ণতা, হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং খুঁতকে দূরে সরিয়ে তাকে নতুন রূপে সজ্জিত করাকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কোনো বস্তুই বাতিল হতে পারেনা, ভাঙ্গা বস্তুরও আলাদা মুল্যায়ন করা যায় -- এই ভাবাদর্শকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।জাপানী এই শিল্পকলা আমাদের জীবনকে উন্নত করার এক অন্য জীবন দর্শনের অনুভব করায়।
এই শিল্পের প্রতিফলন বর্তমানে অন্যান্য শিল্পেও দেখতে পাওয়া যায়। সেই রকম কিছু উদাহরন দিলাম।
0 মন্তব্যসমূহ