ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

রক্ষক -প্রীতম বিশ্বাস

"এল ওরো  হা  লিগাডো  কাওটেন ... " 

ক্যাম্পিচির অদূরে স্পেনের বিশাল সৈন্য শিবিরের মাঝে অপেক্ষাকৃত জাঁকজমকপূর্ণ তাঁবুতে প্রবেশ করে সেনাপতি  মার্টিন অ্যারিজমেন্ডিকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বললেন একজন প্রহরী , যার অর্থ - 

 " সোনা পৌঁছে গিয়েছে ক্যাপ্টেন। " 


তাঁবুর এককোণে রক্তাক্ত অবস্থায় খুঁটির সাথে বাঁধা সুবিশাল মায়া সভ্যতার সর্বাধিপতি। আমার তরবারি তার গলার সাথে ঠেকানো। আর তার সামনে নিথর হয়ে পড়ে আছেন তার নাকম অর্থাৎ সেনাপ্রধান।


রাজবন্দীর মুখ দিয়ে কাতর কণ্ঠে ভয় মিশ্রিত আদেশের সুরে মায়ান ভাষায় যে  কথাগুলো বেরিয়ে এলো তার অর্থ হলো, " আমি তোমাদের কথামতো একটা ঘর সম্পূর্ণ পূর্ণ করা যাবে তত সোনা আনিয়ে দিয়েছি। এবার আমাকে মুক্ত করো।" 


কথাটা শেষ হতেই অ্যারিজমেন্ডি আমাকে চোখের ইশারায় নির্দেশ দিলেন এবং আমার তলোয়ারের আঘাতে মায়া অধিপতি জগতের মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।


কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন অ্যারিজমেন্ডি।

- "খবর আছে কর্টেস।  কয়েকজন আদিবাসী কিছু দুর্মূল্য গোল্ডেন আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে ইয়াকাটানের পশ্চিম সীমানার দিকে পালিয়েছে। এখুনি তুমি তিনশো সৈন্য নিয়ে এইদিকে যাত্রা করো। তারা জীবিত থাকুক বা মৃত ঐ আর্টিফ্যাক্ট গুলো আমি তোমার হেফাজতে দেখতে চাই।" সাথে সাথে আমি ,  উইলিয়াম কর্টেস,  স্প্যানিশ আর্মিতে সেনাপ্রধান মার্টিন অ্যারিজমেন্ডির  মায়া অভিযানের একটি বিশেষ ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক আমার তিনশো সৈন্যের বিশেষ ইউনিট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অস্তাচলের অভিমুখে।


মাঝে একটা পুরো দিন গিয়েছে। অমাবস্যার রাত। তাই পাহাড়ি জঙ্গলে পথচলা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে একদিনেই আমাদের দলের তেত্রিশজন সদস্য নিরুদ্দেশ। তাই কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে আমরা একটা পাহাড়ি ঝিলের ধারের অপেক্ষাকৃত সমতল জমিতে আজ রাতের জন্য ঘাঁটি গাড়তে বাধ্য হয়েছি। এতজনের এত কম সময়ের মধ্যে নিরুদ্দেশের ঘটনায় আমার দলের মধ্যে একপ্রকার ভয়ের প্রবেশ ঘটেছে। তাছাড়াও এই অঞ্চলে পুমা অর্থাৎ পাহাড়ি সিংহ এবং জাগুয়ারের উৎপাত খুব বেশি। যত্রতত্র আগুনের ব্যবস্থা করা হয়েছে জংলি জানোয়ারদের দূরে রাখতে। খাওয়া সেরে নৈশপ্রহরী নিয়োগ করে  আমি আমার তাঁবুতে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই নাকে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ এসে লাগল। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো।



 চোখ খুলতেই চোখে সূর্যের আলো এসে লাগলো। ঘোর কাটতেই চক্ষু চড়কগাছ। আমার সাথে আমার দলের পাঁচজন স্পেনীয় সৈনিক একটা বাঁশের খাঁচায় বন্দী আর আমাদের খাঁচাটাকে পালকির ন্যায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছে একদল মায়ান আদিবাসী। মানসিক অবস্থা আশা করি বলার প্রয়োজন নেই। কিছুক্ষণ পরে আমাদের খাঁচাটাকে একটা পাথরের মন্দিরের সামনে আরেকটা খাঁচার পাশে নামানো হলো। খেয়াল করে দেখলাম এই খাঁচাতে আমাদেরই দলের আরও সাতজন সদস্য। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কয়েক মুহূর্ত পরে আমাদেরকে খাঁচা থেকে বার করে পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো। আর আমাদের পিছনে তীর - ধনুক, বল্লম হাতে ইয়াকাটানের আদিবাসী যোদ্ধার দল। 

   

   আমাদের সামনে কালো পাথরে খোদাই করা একটি মূর্তি , যার নীচের চোয়াল অপেক্ষাকৃত বেশিই বড়ো।  ইক-চিওহা , যুদ্ধ ও ভ্রমণের দেবতা। হঠাৎ মন্দিরের থেকে বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধ মায়ান আদিবাসী , তার এক হাতে সবুজ অবসিডিয়ানের একটা ছুরি আর অন্য হাতে একটা মানুষের মাথা। বুঝলাম উনি পুরোহিত। ভালো ভাবে তার হাতের মাথাটা লক্ষ করতেই যেন আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। মাথাটা আমার দলেরই একজন সৈনিকের । অর্থাৎ বাকিরাও এদেরই শিকার। মন্দির থেকে এসে লোকটা ইক-চিওহা এর সামনে প্রার্থনা করতে লাগলো।  বুঝলাম তারা আমাদের অন্যত্র নিয়ে যেতে চলেছে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে আর সেই যাত্রাপথে যাতে কোনো বাধা না আসে তার জন্যই এই প্রার্থনা। হঠাৎই আমার তিনজন সঙ্গীকে ইক-চিওহা এর সামনে হাঁটু গেড়ে বসানো হলো এবং তাদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে অর্পণ করে তাদের কাটা মাথাগুলি একটার ওপর একটা সাজিয়ে রাখা হলো। আমরা নিরুপায় হয়ে হতভম্বের মতো চেয়ে রইলাম। ইক-চিওহা এর উদ্দেশ্যে তিনটি পাথর একটার ওপর একটা সাজিয়ে প্রার্থনা করা হয় শুনেছিলাম, কিন্তু সেই প্রথার এই রূপ দেখতে হবে, ভাবিনি কোনোদিন । 


এরপর আমাদের হাঁটতে নির্দেশ দেওয়া হলো। আমাদের দশ জন নিরস্ত্র , ভীত সন্ত্রস্ত স্পেনীয় সৈনিককে দাসের ন্যায় নিয়ে যেতে লাগলো তারা। আমাদের পা থামলেই তাদের চাবুক চলতে থাকে। কিছু পথ যাওয়ার পর আমরা পাহাড়ি পথে চড়াই উঠতে লাগলাম। কয়েকশো ফুট ওঠার পর আমাদের কয়েকজনের মাথা ধরা ও বমি শুরু হলো। অধিক উচ্চতায় বায়ুর অভাবের ফল। একজন আদিবাসী আমাদের দিকে কতগুলো পাতা এগিয়ে দিয়ে মুখে পুরো চিবোতে নির্দেশ করলো। অনিচ্ছা ও অশ্রদ্ধা সত্ত্বেও তার কথা মতো পাতাগুলো মুখে নিয়ে বুঝতে পারলাম,  ওগুলো কোকোর পাতা এবং কিছুক্ষণ পর যথেষ্ট সুস্থ বোধ করতে লাগলাম এবং এতদিনে এদের জ্ঞানহীনতা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেছিলাম তা অনেকাংশে বিলীন হলো  আর ভাবলাম , ভাগ্যের কী অসীম পরিহাস দুইদিন আগেও যারা সহস্র আদিবাসীদের হত্যা করে , সহস্রাধিককে দাসে পরিণত করে , নির্বিচারে  ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড চালিয়েছে ; তারা আজ মাত্র একশত মায়া আদিবাসীর হাতে বন্দী ও মৃত্যুর নির্দেশ পালনেও বাধ্য।


সূর্য যখন মাথার ওপর , তখন আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছালাম। পাহাড়ের ঢালে সমতল ফাঁকা জায়গার মাঝে মায়ানদের শিকার ও বন্য প্রাণীর দেবতা ইয়ুম-কাক্স এর মূর্তি। আর তার সামনে রাখা আছে অনেক গুলো তীর ও ধনুক। পুরোহিত মূর্তির সামনে আসলেন। সশস্ত্র আদিবাসীরা আমাদের দশজনকে পাঁচ জোড়ায় ভাগ করে দাড় করিয়ে  সকলে ওই সমতল ভূমিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। এরপর পুরোহিত আমাদের এক সদস্য টমসনের হাতে তীর ও ধনুক দিয়ে অপর সদস্য দ্যানিয়েলের ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।  অনিচ্ছা  সত্ত্বেও  তীরন্দাজ ও লক্ষ্যবস্তুর জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হলো তারা। টমসন তীর নিক্ষেপ করেছে ঠিকই কিন্তু আমাদেরকে অবাক করে তা নিক্ষেপ করেছে  তার সঙ্গীর দিকে নয় , বরং পুরোহিতের দিকে। কিন্তু আমাদের সবাইকে আরও অবাক করে সেই তীর নিজের অভিমুখ পরিবর্তন করে প্রথমে টমসন ও তারপর দ্যানিয়েল দুজনকেই বিদ্ধ করলো। তারা দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। হঠাৎই আমার মনে পড়ে গেল ইয়ুম-কাক্স এর বিশেষ ক্ষমতার কথা। তিনি অস্ত্রের আঘাত পুনরায় শিকারির ওপর ফিরিয়ে দিতে পারেন।


 আমরা বুঝতে পেরেছিলাম মৃত্যু সকলের নিকটে এসে উপস্থিত, কিছু সময়ের ব্যবধানে সকলকে মরতে হবে। তাই পরের ছয়জন জোড়ায় জোড়ায় নির্দেশ পালনের জন্যে নির্দিষ্ট স্থানের প্রতি এগিয়ে গেল এবং প্রতিবারই ইয়ুম-কাক্স এর ক্রোধ শিকার ও শিকারী উভয়কেই গ্রাস করতে থাকলো। 


অবশেষে আমার স্হান হলো লক্ষ্যবস্তুর স্হানে  এবং তীর চালাতে হবে লুইসকে। আমি চোখ বুঁজে মায়ানদের প্রতি নিজের অত্যাচারের জন্য শেষ মুহূর্তে প্রথমবারের জন্যে মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। কিছুক্ষণ পরে হাততালির আওয়াজে চোখ খুলে দেখি আমার শেষ সঙ্গী লুইস মাটিতে লুটিয়ে পরে আছে আর আমি সম্পূর্ণ অক্ষত। 



আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরোহিত আমার কাছে এসে আমাকে জানালেন যে তাদের ভগবানেরা আমাকে নির্বাচন করেছেন। এইটুকু বলে তিনি ইয়ুম - কাক্সের বিশাল পাথরের মূর্তির পিছনের দিকে গেলেন এবং আমাকেও অন্যরা সেইদিকে নিয়ে গেলেন।  গিয়ে দেখলাম ইয়ুম-কাক্সের মূর্তির পিছনে আরও একটা মূর্তি । এটা একটা দেবীমূর্তি। মূর্তিটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠলো। তাঁর চোখ বুজে আছে আর আধপচা দেহটার গলায় একটা দড়ি দিয়ে গাছ থেকে ঝুলে আছে। ইনি ইক্স্টাব , আত্মহত্যার দেবী । আমি একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ নিজের অজান্তেই হাঁটা শুরু করলাম পাশের জঙ্গলের দিকে। শরীর - মন সব যেন হালকা লাগতে লাগলো । কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে  ঘোরটা কেটে গেল আর নিজেকে আবিষ্কার করলাম  একটা গভীর গর্তের একেবারে ধারে। ভিতরে তাকিয়ে দেখি গভীর গর্তের তলদেশ সোনার তৈরী জিনিসে পরিপূর্ণ। সেই সোনা, যার সন্ধানে আমি এসেছিলাম। যার সন্ধানে এসে আমি আমার তিন শত সঙ্গীকে হারিয়েছি। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নিজেকে শূন্যে অনুভব করলাম আর তার ঠিক পরমুহূর্তেই কানের দুই ইঞ্চি নীচে কট করে একটা আওয়াজ ও কিছু মুহূর্তের যন্ত্রণা। 

    ****

আমি অ্যারিজমেন্ডির আদেশ পালন করেছি। তার আদেশমতো সেই সোনা , সেই বহুমূল্য আর্টিফ্যাক্ট গত চারশো বছর ধরে আমারই হেফাজতে এবং তা অনন্তকাল পর্যন্ত থাকবে। আমি মায়ান দেব দেবীদের দ্বারা নির্বাচিত ইয়াকাটান পেনিনসুলার অদ্বিতীয় সম্পদের রক্ষক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ