"দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ".... কার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল এ অভিধা? সময়ের দূরবীনে উল্টোদিকে চোখ রেখে যদি উত্তর খুঁজি .... তর্কসাপেক্ষে যে নাম উঠে আসবে, তা এককালে সুপ্রাচীন গ্রিসের পাহাড়ি উপত্যকায় জন্ম নেওয়া কোনো মহাযজ্ঞের। অজস্র ক্রীড়া আর বিশ্বমানের ক্রীড়াবিদদের নিয়ে সেই ক্ষণস্থায়ী অথচ চিরন্তন, মহার্ঘ মিলন-উৎসবের নাম 'অলিম্পিক'; এত শতাব্দী পেরিয়েও যিনি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান বিশ্বজনীন। তবে আজকের গল্পের নায়ক তিনি নন, অন্য কেউ। অনেকেই ভাবছেন, গল্প কেন।সত্যিই তো গল্প বলতে তো আসিনি এখানে। কিন্তু রূপকথার চেয়েও অসম্ভবপ্রায় কল্পনা আর জমকালো দ্যুতির সমন্বয়ে যে বাস্তব, যাকে কল্পকাহিনীতেই সবচেয়ে বেশি মানায়, সেই চোখ ঝলসানো, রঙিন মহোৎসবকে বাস্তবের মাটিতে ভাবতে চাওয়াটাও যেন চরম ধৃষ্টতা।
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালে মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে চার অঙ্কের সংখ্যাটা। ২০২২। খ্রিস্টের জন্ম থেকে বিশ্ব পেরিয়ে এসেছে দু'খানা সহস্রাব্দ, সাথে আরও দুটি দশক। এ গ্রহ ঠিক কত পরিবর্তন দেখেছে এই সুদীর্ঘ সময়কালে, তার হিসেব কষতে বসা আমাদের সাধ্যের অতীত। এত বস্তু, এত ধারণা, এত বিচার, আদর্শের রঙবদলের ভিড়ে বদলে গেছে কত বিশেষণ। এ যেন এমন কোনো বিশেষণের ভোলবদলের গল্প; গল্প, নাকি বাস্তবের রূপকথা!
"দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ".....ধারে, ভারে, আভিজাত্যে, আয়োজনে আর সমারোহে এই সহস্রাব্দে দাঁড়িয়ে বোধহয় একটিমাত্র উৎসবের কথাই মাথায় আসবে যেকোনো ক্রীড়াপ্রেমীর। না, অলিম্পিক নয়, আর যখনই হোক, এই ২০২২ এ দাঁড়িয়ে তো একেবারেই নয়। কেননা যে উৎসবের আনন্দে রাতের পর রাত জেগে মাতোয়ারা হয়েছে বিশ্ববাসী, আট থেকে আশি সবাই সবকিছু ফেলে মগ্ন হয়ে আছে নিজেদের প্রিয় দলকে সমর্থন করতে, সব্বাই আক্রান্ত এক অনির্ণেয়, অদ্ভুত জ্বরে-- সে উৎসবকে গ্রেটেস্ট বলবো না তো বলবো কাকে? হ্যাঁ, অনুমান করার জন্যে বিশেষ কোনো পুরস্কার নেই। হচ্ছে আপনার, আমার সব্বার ঘুম কেড়ে নেওয়া, গোল-গোলকের মহাযুদ্ধ ফুটবল বিশ্বকাপের কথা। আরো জোর খাটিয়ে বললে এ গল্পের নায়ক ২০২২ এর মহাযজ্ঞ, কাতার বিশ্বকাপ!
২০ শে নভেম্বর, ২০২২.... গ্রিনিচের ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২:০০....সুদূর দিগন্ত বিস্তৃত ধূসর মরুর মাঝে ছোট্ট কোনো দেশ প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে এক আনন্দময় মহাযজ্ঞের আয়োজনের... এ সময় সেই প্রস্তুতিরই চূড়ান্ত প্রদর্শনের, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এক অগ্নিপরীক্ষার। কাতারের আল বায়াত স্টেডিয়াম, ৬০,০০০ এর ধারণক্ষমতা নিয়ে তখন কানায় কানায় পূর্ণ। বিশ্বের বাকি সমস্ত মানুষের চোখ তখব স্যাটেলাইটের পর্দার দিকে। অবশেষে ঢাকে পড়ল কাঠি। হল শুভ সূচনা, আগামী ২৯ দিন ধরে বিশ্ববাসীকে এক অদ্ভুত নেশায় বুঁদ করে রাখার মতো মহাযুদ্ধের।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিমছাম হবে, এমনটা আন্দাজ করা যাচ্ছিলই। কেননা হাজার হোক, কাতারের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়াটাও তো এই বিশ্বকাপের অন্যতম প্রাপ্তি। তবে আয়োজন যে এতটা জমকালো আর বর্ণময় হবে, এমনটা কল্পনারও অতীত ছিল। হলিউডের স্বনামধন্য অভিনেতা মর্গ্যান ফ্রিম্যান মূলমঞ্চে তখন। উদাত্ত কন্ঠে ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছেন, আহ্বান জানাচ্ছেন সমগ্র বিশ্বকে একত্রিত হতে এই মরুর বুকে... চিনিয়ে দিচ্ছেন উৎসবের ঠিকানা...কখনো আরব্য গল্প বলার ঢঙে, কখনো এ দিগন্তবিস্তৃত বালুকাময় উদ্যানের ইতিহাস, কৃষ্টিরম প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে। গল্পের ছলেই এক এক করে এ আনন্দ আসরে যোগ দিতে থাকেন একের পর এক শিল্পী, উদযাপক আর আনন্দপ্রেমীর দল। পারফরম্যান্সের অছিলায় এক মঞ্চে একত্রিত হন কত আরবীয় আর আন্তর্জাতিক তারকারা... এ যেন আক্ষরিক অর্থেই তারার মেলা।সম্মিলিত হতে থাকেন পূর্ববর্তী বিশ্বকাপ আসরের শিল্পী তারকারাও। চোখ জুড়িয়ে, প্রাণ কেড়ে নিয়ে বাজতে থাকে সেই চিরচেনা শ্রুতিমধুর একেকটি গান....চার বছর ধরে যাদের স্মৃতি রোমন্থন করেই বেঁচে আছে আপামর ফুটবলপ্রেমী জনতা।
মহামিলনের কর্মযজ্ঞে, আনন্দ অনুষ্ঠান আরও বর্ণময় হয়ে ওঠে আরেক মহাতারকার আগমনে। বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড বিটিএসের নাম কোনো ভূমিকার মুখাপেক্ষী নয়, আজকের দিনে। এই ব্যান্ডেরই সর্বকনিষ্ঠ সদস্য জং কুক, ছিলেন সেদিন মঞ্চের মধ্যমণি হয়ে। স্বপ্নের মতো মনে হলেও এ যেন সেদিন স্বপ্নের চেয়েও অসম্ভব, অথচ বাস্তব, সত্যি। যারা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন, স্বপ্ন দেখার সাহস রেখেছেন যারা, এ মুহূর্ত যেন শুধু তাদের জন্যেই। তাই কাতারের খ্যাতিমান গায়ক ফাহাদ আর কুবাইসির পাশে দাঁড়িয়ে যখন 'ড্রিমার্স' গাইলেন জং কুক....তখন তিনি শুধু একা নন, এ গানের ছন্দে, লয়ে, সুরে আন্দোলিত করলেন শতকোটি স্বপ্নপ্রেমীদের হৃদয়কে আক্ষরিক অর্থেই। স্বপ্ন দেখলেন, দেখালেন... সহজ কথায় তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন।
স্টেডিয়ামের মূলমঞ্চে তখন কাতার আর বিশ্বসংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। সারা বিশ্ব পরিচিত হয় ধূ ধূ মরুভূমির বুকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা লোকসংস্কৃতির সাথে। কাতারের ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য আরধার প্রদর্শন মন জয় করে নেয় বিশ্ববাসী, এ যেন তাদের কঠিন জীবন সংগ্রামের প্রতীক। আলো ছায়ার খেলায় মঞ্চে ফুটে ওঠে বিশ্বমানচিত্র আর তার ওপর মরুভূমি আর মহাসাগরের আবহ।
দৃষ্টিনন্দন এ অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ৩২ টি দেশের জার্সি। শুধুমাত্র প্রদর্শনেই নয়, অভিনবত্ব দেখা যায় আয়োজকদের চিন্তন আর মননেও। হ্যাঁ, অনুষ্ঠানের ধারা বিবরণে নিজের দরাজ কন্ঠ আর নিখাদ ব্যারিটোনে আমাদেরকে মুগ্ধ করে রাখছিলেন অভিনেতা মর্গ্যান ফ্রিম্যান। তবে খুব শিগগিরই তাঁর সাথে যোগ ২০ বছর বয়েসী ঘানেম আল মুফতাহ। ঘানেম, কাতারের স্বনামধন্য ইউটিউবার, জন্ম থেকেই এক বিরল রোগের শিকার, জন্ম থেকেই যার শরীরে কোমরের নিচের অংশ অনুপস্থিত। তিনি যে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে জাতি-ধর্ম-মত বয়েস নির্বিশেষে কত মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। তাঁকে নিয়ে বলতে গেলে শুধুমাত্র তাঁকে নিয়েই বলতে হয়, এই একখানা প্রতিবেদন তাঁর জন্যে যথেষ্ট নয়। ফ্রিম্যান আর মুফতাহ, দু'জনের বক্তব্যের মধ্য দিয়েই যে বিশ্ব ঐক্য আর সাম্যের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তা এক কথায় সমীহ আদায় করে নেয়।
এককথায়, আল বায়াত স্টেডিয়ামে এই দিনেই বহু গানে, বহু ভাষায়, বহু তারার সম্মেলনে এক সুরে যেন গাঁথা হয়ে গেল আগামী একমাসব্যাপী চলতে থাকা উৎসবের আবহ। এ সুর স্বপ্নজয়ের, এ সুর সৌভ্রাতৃত্বের, এ সুর বিশ্বজয়ের। মরুময় পৃথিবীর বুকেও ফলানো যায় স্বপ্নের ফসল, কোনো এক গোলককে কেন্দ্র করে স্বপ্নের লড়াই, পরাবাস্তব যুদ্ধজয়ের গৌরবকে অভীষ্ট করে সারা পৃথিবীব্যাপী যে ছড়ানো যায় উৎসব আর আনন্দের রোশনাই, তার এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কিইবা হতে পারতো।
এভাবেই উদ্বোধন শুধু অনুষ্ঠানের নয়, উদ্বোধন হল এক যুদ্ধের, গোল-গোলকের বিশ্বযুদ্ধের, খেলোয়াড়দের দেশপ্রম, পেশাদারিত্ব আর মর্যাদা রক্ষার মহাযুদ্ধের। এ যুদ্ধ কত কিংবদন্তির কথা স্মরণ করাবে, জন্ম দেবে আরো কত কিংবদন্তির! তাই তো সেই স্বর্ণনির্মিত বিশ্বকাপ আর চামড়ার গোলকের পরই এ মহাযুদ্ধের প্রধান চরিত্র এর যোদ্ধারা, নিজেদের জীবনপণ করে লড়তে আসা সেই সমস্ত বিশ্বনন্দিত খেলোয়াড়রা, যাঁরা সবকিছু উজাড় করে দিতে এসেছেন দেশের জন্যে, সবকিছু ছাপিয়ে এ প্রতিযোগিতায় দেশকে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করতে চান বলে।
আয়োজকেরাও তাই উদ্যোগ নিয়েছেন এই আসরের বিশ্বকাপ যাত্রাকে উৎসর্গ করতে, এই খেলোয়াড়দের প্রতি। যার প্রতীকীস্বরূপ আগমন ঘটল এই বিশ্বকাপ আসরের ম্যাসকট লা-ইবের.... আরবী ভাষায় 'লা-ইব' কথার অর্থ খেলোয়াড় বা দক্ষ খেলোয়াড়.... আরব্য বেদুইনের মত মস্তকাবৃত, বিশালাকৃতির উড়ন্ত জিন লা-ইবকে ঘুড়ির মতন অনায়াসে বাতাসে ভাসতে দেখে মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠেনি, এমন ফুটবলপ্রেমী কোথায়? এ যেন উৎসবের সেই মুক্ত আত্মা যা অনবরত আন্দোলিত হচ্ছিল আমাদের সকলের প্রাণে, শুধু অপেক্ষা ছিল কোনো অবয়বের! এদিন সে অপূর্ণতাও আর রইল না।
শুরু হল উৎসবের, শুরু হল মহাযজ্ঞের, শুরু হল মহাযুদ্ধের! কত বিতর্ক, কত বাধা, কত বিপত্তি পেরিয়ে কাতার সফল হল, সফল হল বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে, এশিয়াও জানে, এশিয়াও পারে! তারাও পারে পশ্চিমি দেশগুলোর মতোই, কিংবা তার চাইতেও জমকালো আয়োজনে বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিতে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম বিশ্বকাপ বলে কথা, এ বিশ্বকাপ স্মরণীয় না হলে হয়? তাইতো আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেনি মধ্যপ্রাচ্যের এ আমীর অধ্যুষিত রাষ্ট্র।
"দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ" - হ্যাঁ, আবারও বলছি, এত কিছুর পরেও যারা এই আপ্তবাক্য মেনে নিতে নারাজ, তাদের জন্যে খানিকটা অঙ্কের হিসেব.... গত রাশিয়া বিশ্বকাপের আয়োজনে যেখানে সর্বসাকুল্যে খরচ হয়েছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে কাতার এই খরচার অঙ্ককে টেনে নিয়ে গেছে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে! টানা চার বছর ধরে তারা গড়ে তুলেছে একের পর এক বিশ্বমানের স্টেডিয়াম, গড়ে তুলেছে সড়ক, অট্টালিকা, শপিংমল, চিকিৎসা আর যোগাযোগব্যবস্থা। ঢালাও সাজানো হয়েছে পুরো দেশকে। উদ্দেশ্য, এই উৎসবকে সামনে রেখে পুরো দেশকে প্রস্তুত করা, ভবিষ্যতের পর্যটনশিল্পের অভিলক্ষ্যে। আর কোন খেলায়, আর কোন উৎসবে, আর কোন আয়োজনে এমনটা সম্ভব? অধুনা বিশ্বের রাজসূয় যজ্ঞ তো একেই বলতে হয়।
সত্যি বলতে ফুটবল দেবতাও যেন চাইছিলেন, এ বিশ্বকাপকে অন্য সমস্ত বছরের চেয়ে ব্যতিক্রমী আর অনন্য করে রাখতে। তা না হলে, উৎসবের আগমনের গন্ধে কে-ই বা অনুমান করতে পেরেছিল, এই ২০২২ এর কাতার বিশ্বকাপকে সারা পৃথিবী মনে রাখবে 'অঘটনের বিশ্বকাপ' নামে! সত্যিই এ বিশ্বকাপ অজস্র অঘটনের, সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের উত্থানের। এ বিশ্বকাপ পরম প্রাপ্তি এশিয়া আর আফ্রিকার মতো ফুটবলে তথাকথিত 'আনাড়ি' মহাদেশের জন্যে, যাদেরকে হ্যাঁটা করতে কোনোদিন কার্পণ্য করেনি ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর বহু সমালোচক আর ধারাভাষ্যকার।
এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা। দেখা যাক, কার হাতে ওঠে এ বহুকাঙ্ক্ষিত স্বর্ণস্তম্ভ। মরুবিজয়ের কেতন শূণ্যে উড়িয়ে, সমস্ত আশা নিরাশার দোলাচলকে তুচ্ছ প্রমাণিত করে বালুকাময় তরঙ্গভূমিতে চিরতরে প্রোথিত হয় কার বিজয় নিশান! তবে যাই হোক না কেন, স্বর্গের পরীদের জৌলুসে আবিষ্ট, রূপকথাময় সেই আরব্য রজনী যে কয়েক যুগ ধরে ভুলতে পারবে না বিশ্ববাসী, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
0 মন্তব্যসমূহ