আল বায়াত স্টেডিয়ামে উদ্বোধনের দিন। সারাবিশ্বের চোখ তখন কাতারের আকাশের দিকে। আকাশজুড়ে কেবল আলোর রোশনাই। রঙ বেরঙের আলোর ছটা! যেন জীবনের শত সহস্র অনুভূতির রংকে আলোর মোড়কে সাজিয়ে হাজির করা হল। আসরের জমকালো আলোকচ্ছটা যখন ম্রিয়মাণ করে দিচ্ছিল অবশিষ্ট পৃথিবীর সমস্ত রূপ জৌলুস, তখন কি ভাগ্যদেবতাও সবার অলক্ষ্যে থেকে হাসছিলেন না?
আগামী প্রায় একমাস ধরে চলতে থাকা আশা-নিরাশার দোলাচল যে এত রঙ বদলাবে ক্ষণে ক্ষণে, এমনটা কেই বা বুঝতে পেরেছে? যত রঙ বেরঙের আলোর পসরা দেখেছে আয়োজক এ দেশ তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, সময় যত এগিয়েছে তার চেয়েও বর্ণময় একের পর এক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে; মানতে বাধ্য হয়েছেন ঘোর সমালোচকেরাও, এত অনিশ্চয়তা, এত বিতর্ক, এত সুখ দুঃখ বিষাদের আবেগঘন মুহূর্ত, এত জৌলুস, এত তারকার সমাহার বিশ্বের আর কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতাকে ঘিরে তৈরি হয়নি এর আগে।
দেখতে দেখতে এ মহোৎসবেরও প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এলাম আমরা, বিদায়ঘন্টা এই বাজলো বলে। কিন্তু কি করার? আমরা বরাবরই নস্টালজিয়ায় বাঁচতে ভালোবাসি। স্মৃতি রোমন্থন করেই বারবার ফিরে পেতে চাই চিরচেনা, প্রিয় মুহূর্তগুলো। বিশ্বকাপের বিশেষ এই সংখ্যায় আপনাদের প্রিয় 'উৎস'র মাথাতেও তাই ভাবনা এলো, কেন না আবার ফিরে দেখা যাক, স্মরণীয় সেই মুহূর্তগুলোর দিকে, করেই ফেলি অনুভূতির স্মৃতিচারণ, খানিকটা সত্যি আর অনেকটা আবেগ মিশিয়ে, ঠিক নিজেদের মতন করে। যেই ভাবা সেই কাজ, চলুন তাহলে, চেপে বসাই যাক টাইম মেশিনে। পেছন ফিরে দেখে নিই, কেন এই বিশ্বকাপ এতটা বর্ণময়, ঠিক কী কী ছিল এবারের আসরের বিশেষত্ব!
কিংবদন্তির বিশ্বকাপ
যদি বলি আজ থেকে বিশ বছর পর দাঁড়িয়েও আপনি আপনার মানসচক্ষে দেখতে পাবেন এই আসরের একের পর ছবি......এই খেলার প্রসঙ্গ উঠতেই নতুন প্রজন্মকে বারবার মনে করাবেন, আমাদের সময়েও কাতারে কোনো বিশ্বকাপ হয়েছিল.... স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে সেমিফাইনাল ম্যাচে ৩৫ বছরের দুরন্ত কিশোর মেসির বল পায়ে কি অনবদ্য ড্রিবলিং, ঐশ্বরিক সব দক্ষতায় বল কাটিয়ে, সমস্ত প্রতিপক্ষকে ঘোল খাইয়ে বল এন্ডলাইনের কাছে নিয়ে আসা, তারপর সতীর্থ আলভারেজের পায়ে আলতো ঠেলে, সোজা গোলের ঠিকানায় গোলককে পৌঁছে দেওয়া!.... মনে থাকবে আগের ব্রাজিল ম্যাচেই ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষকের কি অনবদ্য সব সেভ....মনে থাকবে রোনাল্ডো, নেইমার, সুয়ারেজের কান্না.... মনে থাকবে ক্ষয়ে যাওয়া জার্মানি থেকেও উঠে আসছে জামাল মুসিয়ালা, নিকলাস ফুল্ক্রাগের মতো তারকা.....মনে থাকবে আরও অনেক অনেক কিছু...রূপকথার ধাঁচে, কিংবদন্তি হয়ে।
তার কারণও আছে অবশ্য, শুধু কাহিনিসুলভ কিংবদন্তি রচিত হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু এ বিশ্বকাপ রীতিমতো কিংবদন্তিদের নিয়ে আয়োজিত বিশ্বকাপ, তাঁদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত বিশ্বকাপ। বিশ্বজোড়া একখানা শব্দ আজকাল খুব প্রচলিত ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে....GOAT, গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম! লিওনেল মেসি না ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, কে এই অভিধা'র যোগ্য দাবিদার, তা নিয়ে অনুরাগীদের মধ্যে কম বাক-বিতন্ডা হয়নি, আগামীতেও হবে, কেননা এ বিতর্কের কোনো অবসান নেই। কিন্তু ফুটবল বিশ্বের দুই কিংবদন্তির ভাগ্য কোথাও যেন একসূত্রে বাঁধা.... হ্যাঁ, দুজনেরই হয়তো এটা শেষ বিশ্বকাপ। জীবনে অগুনতি ট্রফি, সম্মাননা, মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার পর প্রাপ্তির ভাঁড়ার প্রায় পূর্ণই করে ফেলেছেন দুজনে। আক্ষেপ শুধু একটাই, বিশ্বকাপ জিততে না পারার.....বাকিটা আমরা সবাই জানি।
সারা পৃথিবী আবার দ্বৈরথে নামলো, মাপতে শুরু করলো দুই শতাব্দীশ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে। জয়-পরাজয়ের মহাসাগর সাঁতরে এসে মেসি-রোনাল্ডো এখন ঋষির মতো প্রাজ্ঞ, মগ্ন আপন ধ্যানে। কোনো সমালোচনা, বিতর্ক, ঘৃণা, অবজ্ঞা তাদেরকে ছুঁতে পারে না মোটেই। বরং নিন্দুকদের এত বাক্যব্যয়ের পরও প্রগাঢ় হয়েছে তাঁদের বন্ধুত্ব। জীবনের শেষ মহামিলন, দেশের হয়ে লড়ে যাওয়ার মতো শেষ দ্বৈরথ.... সুযোগ যখন এলোই এই মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখার, কেউই হাতছাড়া করলেন না। বসে পড়লেন প্রতীকী যুদ্ধে, ৬৪ বর্গের সাদা-কালো মগজ-ময়দানের দু-প্রান্তে। সে দুর্লভ দৃশ্য দুজনের সামাজিক মাধ্যম থেকে একযোগে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে, জনপ্রিয় হতে সময় লাগলো না। কেউ কেউ খুঁজেও বের করলেন, ওদের স্নায়ুযুদ্ধে দাবার দুনিয়ার দুই মহারথী হিকারু নাকামুরা আর ম্যাগনাস কার্লসেনের ছায়া।
বিশ্বকাপের শেষ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাঠের বাইরে দুই সর্বসেরা'র এমন মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারা জানান দেয় আমরা কতটা ভাগ্যবান। পাতায় পাতায়, ছবিতে কালিতে রচিত হয় ইতিহাস, আগামীতে রোমন্থন করার মতো স্মৃতিময় ইতিহাস। যে স্মৃতির কৃতিত্ব দিতে হয় এই বিশ্বকাপ আসরকেই।
তবে শুধু মেসি, রোনাল্ডোর প্রসঙ্গে আটকে গেলেই ভারি ভুল করা হবে। এ বিশ্বকাপ আরও বহু কিংবদন্তির বিশ্বকাপ। বহু বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের শেষ বিশ্বকাপ। ভাবতেও কষ্ট হয়, আর কোনো বিশ্বকাপে আমরা দেখতে পাবো না নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেশকে চূড়ান্ত সাফল্য এনে দেওয়া লুকা মডরিচ'কে, আর দেখতে পাবো না সুয়ারেজের সেই বন্য আগ্রাসন। শৈশব থেকে ভালোবেসে আসা ন্যয়েরের অপার্থিব একেকটা সেভ, অমানুষিক রিফ্লেক্স মিস করবো। আর চোটের গেড়োয় আটকে করিম বেনজেমা'র খেলা তো এবারও উপভোগ করা হল না, আর কোনো বিশ্বকাপে দেখাও হবে না....ভাবতেই মন কেমন করছে। দেখা হবে না আর ডি মারিয়া, লেওয়ানডস্কি, ডি সিলভা, মুলারের মতো কিংবদন্তির ভুবন ভোলানো পারফরম্যান্স।
সত্যি বলতে এত তারকার সমারোহ আর রত্নখচিত বিশ্বকাপ সচরাচর দেখাও যায় না; এরপর আর কত মরসুম পেরিয়ে যে অপেক্ষা করতে হবে এমন একখানা বিশ্বকাপের, উত্তর জানেন না বোধ হয় কেউ।
প্রতিবাদের বিশ্বকাপ
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়তেই চাইছিল না কাতারের। বিশ্বকাপের শুরুর অনেক আগে থেকেই। স্টেডিয়াম তৈরির কাজে নিয়োজিত একের পর এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু সারা বিশ্বের সচেতন মানুষের মনকে নাড়া দেয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো একের পর এক অভিযোগ দাগাতে শুরু করে আয়োজক দেশের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদের বন্যা ভেসে আসতে লাগলো। সেসবের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই কাতার আয়োজন চালাতে থাকে নিজের ছন্দে।
বিতর্কের এখানেই শেষ নয়, হওয়ার কথাও ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সংস্কৃতি যে অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপন্থী নয়, সে নিয়ে নতুন কিরে বলার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রেও বাধ সাধলো তাই। সমকামিতা, মদ্যপান, পোশাক-পরিচ্ছদের মতো বহুবিষয়ে বিধিনিষেধ ফিফাকে কার্যত অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। আয়োজক দেশের আইন কানুন আর স্পনসরদের দাবিদাওয়ার দোটানায়, ফিফার কার্যকলাপও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল না। ফুটবল অনুরাগী আর দর্শকদেরও প্রসন্নবোধ করার খুব একটা কারণ ছিল না।
তবে এত কিছুর মধ্যেও আয়োজকদেরকে দমানো যায়নি, একবিন্দু টলতে দেখা যায়নি তাদের সিদ্ধান্ত থেকে। আর একবার আয়োজন শুরু পর তো সবটাই বদলে যেতে লাগলো। ম্যাচ দেখার টিকিটের এত দাম বাড়ার পরও দর্শকদের উৎসাহের কমতি দেখা গেলো না উৎসবকে ঘিরে। অশ্বমেধের ঘোড়া ছাড় পেলো, বিশ্বকাপ আবার শুরু হল, তার চিরাচরিত গতিতে।
তবে প্রতিবাদের সময়, সুযোগ বা কারণ কোনোটাই যে এখনো ফুরোয়নি, কাতার তারও সাক্ষী থাকলো। সাক্ষী থাকলাম আমরা সবাই। কেউ হলাম মুগ্ধ, কেউ হতবিহ্বল, কেউবা তিতিবিরক্ত।
২১ শে নভেম্বরের দোহা। ইরানের সাথে ইংল্যান্ডের প্রথম ম্যাচ। ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীতের সময়.... ঠোঁটটা সেকেন্ডের জন্যে সামান্য খুলতে গিয়েও কিছু মনে পড়ে গেল এক ইরানি ফুটবলারের, থেমে গেলেন। সবাই মুখ বন্ধ করে রেখেছেন তখন, জাতীয় সংগীতে গলা মেলালেন না ইরান দলের একজনও। তাদের প্রতিবাদ নিজেদের দেশের সরকারের বিরুদ্ধেই। কারণটা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে খানিকটা অতীতে।
সেপ্টেম্বর মাসে। ২২ বছরের তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যু হয় পু্লিশি হেপাজতে। কি দোষ ছিল ওর? হিজাব পরতে চায়নি বলে সে অপরাধে তেহরান থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে তিনদিন ধরে অকথ্য নির্যাতন চালায় মাহশা'র ওপর। প্রতিবাদে জ্বলছে ইরান তারপর থেকেই। কত নিষ্পাপ তরুণ, তরুণী, নাবালককে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে, অত্যাচারে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে স্বেচ্ছাচারী সরকার, কেড়ে নিতে চাইছে ওদের স্বাধিকার, স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আর আত্মমর্যাদা-- এ প্রতিবাদ সেই ফ্যাসিবাদী সরকার আর তার গোঁড়া আইনের বিরুদ্ধে। যে প্রতিবাদের আঁচ এসে পড়লো লড়াইয়ের ময়দানেও।
মাহশার মতো নিষ্পাপ আরো বহু ইরানীর পাশে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতে গলা মেলালেন না মিলাদ মহম্মদিরা। সারা পৃথিবী তখন শুধু স্তম্ভিত হয়ে দেখছে, দেখছে আর ভাবছে, মেরুদণ্ড কতটা ঋজু হলে, প্রতিবাদের ভাষা কতটা তীব্র হলে এমন আন্তর্জাতিক মঞ্চ তাকে নতুন করে চিনিয়ে দেয় পুরো পৃথিবীর কাছে; মাঠে যখন এহসান হাজি সাফিরা মুখ বুজে, তখন গ্যালারিতেও সেই প্রতিবাদেরই খণ্ডচিত্র। "Woman Life Freedom" লেখা ইরানি পতাকা সাথে নিয়ে ওরা জানান দিচ্ছিল, এ প্রতিবাদ ওদের সবার। মাঠে উপস্থিত ইরানি মেয়েদের চোখ তখন কান্নায় ভিজে আসছে....এ দৃশ্য যাকে ভাবায় না এক মুহূর্তের জন্য, করে না আবেগে আপ্লুত , তার কি মন বলে আদৌ কিছু আছে? ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে খাতায় কলমে তারা হেরে গিয়েছিল ঠিক, তবে জয় করে নিয়েছিল কোটি কোটি মানুষের হৃদয়, যারা মানবতায় বিশ্বাসী, মানবতার যুদ্ধজয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
প্রতিবাদের আরেক রূপ বিশ্বকাপ দেখলো জার্মানি- জাপান ম্যাচে। সমকামিতা নিয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে আয়োজক দেশের এমন কড়া নিয়ম কানুনকে ধিক্কার জানাতে এককাট্টা হয়ে যায় মুসিয়ালাদের পুরো দল। সবাই একসাথে মুখ ঢেকে মাঠে দাঁড়ায়। পরে জাপানের কাছে হারের পর এই নিয়েও অবশ্য বিতর্ক কম হয়নি। অনেক প্রাক্তন জার্মান ফুটবলারই বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখেননি, প্রতিবাদের বদলে মন দিতে বলেছেন খেলায়। কিন্তু যে যাই বলুক না কেন, দলের বুকের পাটা যে এখনও শক্ত এই ঘটনা তার প্রমাণ। তা না হলে এত ঢাকঢোল পিটিয়েও হলুদ কার্ডের ভয়ে কেন ওয়ান লাভ আর্মব্যাণ্ড পড়তে পারলো না টিম ইংল্যাণ্ড? নিঃসন্দেহে ফিফা বিশ্বকাপ -২০২২ এর তাই অন্যতম স্মরণীয় ফ্রেম হয়ে থাকবে জার্মানির এই প্রতিবাদের ছবি।
নায়কের কান্নার বিশ্বকাপ
২০১০ এ গোলবারের সামনে হাত দিয়ে ঘানার গোলমুখী বল আটকে লাল কার্ড দেখেন লুই সুয়ারেজ। পেনাল্টিতে ঘানা গোল করতে পারেনি, নয়তো নিশ্চিত পরাজয় ছিল উরুগুয়ের ভাগ্যে সেদিন! সুয়ারেজ সেদিন যা করেছিলেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্কে জড়িয়েছেন। প্রশ্ন তোলা হয়েছে তার স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়েও, কিন্তু মানতে হবে, নিখাদ দেশপ্রেম না থাকলে মানুষ একটা ম্যাচে এতটা সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত নেয় না মাঠের মধ্যে।
এরপর আগ্রাসী ফুটবলে কখনো মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের, কখনো বিপক্ষকে কামড়ে কুড়িয়েছেন নিন্দা, কটাক্ষ। সব মিলিয়ে তিনি এমনিতেই বর্ণময় চরিত্র।
কিন্তু এবারে, জীবনের শেষ বিশ্বকাপে, আর বেশিদূর এগোনো গেল না। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতেও গোলের ব্যবধানে ছিটকে গেলেন গ্রুপপর্ব থেকেই। ডাগআউটে বসে সুয়ারেজের সেই হাউমাউ করে কান্না- সুয়ারেজের ভক্ত হন আর নাই হন, এ দৃশ্য বেদনায় আর্দ্র করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুর্লভ।
পরের দৃশ্যগুলো হয়তো আরো কঠিন।
কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি ব্রাজিল, এই বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার। তাদের রিজার্ভ বেঞ্চেই এত নামজাদা সব খেলোয়াড়, বাকি দলগুলোর মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। এহেন ব্রাজিলকে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হট ফেভারিট মানা হবে এমনটাই দস্তুর। খাতায় কলমে অনেক এগিয়ে ব্রাজিল তখনো।
কিন্তু খেলা শুরু হতেই যে দৃশ্যপট এতটা বদলাতে শুরু করবে ধীরে ধীরে, কে জানতো? ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণ বরাবরই ভালো, কিন্তু ত্রাতা হয়ে এলেন গোলরক্ষক লিভাকোভিচ! ব্রাজিলের সামনে শক্ত দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে সেভ করতে লাগলেন একের পর এক দানবিক শট.... বিপক্ষ যত গোলাবারুদ ছুঁড়ে চলেছে, তিনি যেন ততই দৈত্যের মতো সর্বগ্রাসী হয়ে রুখে চলেছেন.... অতিরিক্ত সময়ে নেইমার দুর্ধর্ষ একটা গোল দিলেন বটে, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ক্রোয়েশিয়া সমতা ফেরাল। টাইব্রেকার পেনাল্টিতে গিয়ে জয় ছিনিয়েও নিল লুকা মডরিচের দল।
অবিশ্বাস্য সেই ম্যাচ শেষে স্বপ্নের নায়ক নেইমার জুনিয়রের কান্না যেন চোখে দেখা যাচ্ছিল না। সাথে বিমর্ষ সতীর্থরাও, কাঁদছে বিশ্বের কোটি কোটি ব্রাজিল সমর্থক।
তবে সব শেষে মনে রাখার মতো ছবি এটাই। ক্রোয়েশিয়া দলের ইভান পেরিসিকের ছোট্ট ছেলে দৌঁড়ে আসে তার প্রিয় খেলোয়াড় নেইমারের দিকে। হেরে যাওয়ায় সমবেদনা জানায়, নেইমার জড়িয়ে ধরে খুদে ফ্যানকে। কান্না-হাসির দোলাচলে একরাশ হাসি আর রোমাঞ্চ উপহার দিয়ে যায় ওই একরত্তি শিশুটি। বুঝিয়ে দেয়, কেন এত কিছুর পরেও ফুটবল এতটা সুন্দর।
শেষ ছবিটা বোধহয় সত্যিই সহ্যশক্তির পরীক্ষা। পর্তুগাল - মরক্কোর কোয়ার্টার ফাইনাল। ক'জন ভেবেছিলেন ফলাফল এদিকে যাবে?
সিংহভাগ জনতা শুধুমাত্র একটি মানুষের জন্য ম্যাচের মুখে তাকিয়ে। গোট, সর্বকালের সেরা, সিআরসেভেন। সারাটা জীবন যাঁর এই খেলার প্রতি উৎসর্গীকৃত, যে মানুষটা তাঁর দেশ ক্লাবকে এনে দিয়েছেন বিশ্ব ফুটবলের প্রায় সমস্ত সম্মান, তিনি কি পারবেন আজ প্রত্যাশার মর্যাদা রাখতে?
দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ারও বেশ কিছু সময় পরে নামানো হল তাকে মাঠে। কিন্তু হায়, পারলেন না, পারলেন না সেই পুরোনো চিরচেনা রোনাল্ডোর মতো রূদ্ধশ্বাস গতিতে ম্যাচকে দিশা দেখাতে। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও রয়ে গেলেন সেই রোনাল্ডোর ছায়া হয়েই, মিইয়ে গেলেন....নাকি ফুরিয়ে গেলেন? এ কি বয়সের বিষকামড় নাকি ভাগ্যের চোরাটান.... জানা নেই।
তবে সব ইচ্ছে পূরণ হয়না, সত্যি হয়না সব স্বপ্নও। মরক্কো যেন অঘটন ঘটাতে মাঠে নেমেছে এদিন। একদিকে অপ্রত্যাশিত জয়ের অকৃত্রিম উল্লাস, অন্যদিকে আশৈশব ভালোবাসার নায়কের অকস্মাৎ বিদায় এ মঞ্চ থেকে, চিরতরে.... বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ারই কথা।
মুখ ঢেকে বসে পড়লেন সুপারহিরো, অথচ লজ্জাজনক কোনো কাজ তো করেননি তিনি। মুখ ঢাকলেন হতাশায়, মুখ ঢাকলেন যন্ত্রণায়! সত্যিই তো! আর কি করলে পাওয়া যেত সে স্বর্ণস্তম্ভ? আর কত তপস্যায় মোহভঙ্গ হত দেবতার? আর কত?
টানেল দিয়ে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথে ক্রিশ্চিয়ানোর সেই বুকফাটা কান্না, আগে কোনোদিন কেউ দেখেনি। কতটা ভেঙে পড়লে মানুষ এমনটা করে?
ফুটবল, এক স্বপ্নের নাম। অথচ এ খেলা মাঝেমাঝে এতটা নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, ভাবতেও অবাক লাগে!
মাতৃত্বের জয়ের বিশ্বকাপ
দেশটার নাম মরক্কো! নেই কোনো নামজাদা খেলোয়াড়, নেই কোনো কিংবদন্তি! তাহলে কি আছে ওদের কাছে?
⁃ "মেরে পাস মা হ্যায়" (আমার কাছে মা আছে)
এটাই কি মরক্কোর রিংটোন এখন?
মরক্কো দলের অধিনায়ক আশরাফ হাকিমি'র জীবন সংগ্রামের সবচেয়ে বড় সাথী তাঁর মা সাইদা মু, সংসার চালিয়েছেন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। অন্যদিকে বাবা হাসান হাকিমি স্পেনের রাস্তায় করতেন ফেরি।
আজ যখন ছেলে বিশ্বতারকা, তখন গ্যালারিতে বসে ছেলের খেলা দেখতে দেখতে গর্বে বুক ফুলে ওঠে হাকিমির মায়ের। অবহেলিত, জীবনসংগ্রাম থেকে উঠে আসা এক মায়ের এর চেয়ে বড় জয় হতে পারত না। গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচ জিতে মায়ের কাছে গিয়ে কপালে চুম্বনরত হাকিমি-- হয়তো বিশ্বকাপের কোলাজে অন্যতম সেরা ফ্রেম হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে কোয়ার্টার ফাইনালে ঐতিহাসিক জয়ের পর সোফিয়ান বউফাল যখন মা'কে সাথে নিয়েই আনন্দ নৃত্য শুরু করেন মাঠের মধ্যে.... এক কথায় যেন আমাদের সবার চোখের কোণ খানিকটা হলেও ভিজে যায়। এ অশ্রু আনন্দাশ্রু।
আর কিছু না থাকলেও মরক্কোর কাছে মায়ের আশীর্বাদ আছে। পৃথিবীতে মাতৃত্বের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু হতে পারে না। মরক্কোর জয়, তাই যেন মাতৃত্বের জয়েরই সমর্থক হয়ে উঠছে কাতারের স্টেডিয়ামে।
হাজার রঙে রঙিন, বাহারি এই বিশ্বকাপে, আবেগ, অনুভূতি, দুঃখ, আনন্দ, সম্মানের সাথে আশীর্বাদ ভালোবাসার এ অপূর্ব মেলবন্ধন অন্য মাত্রা দিয়েছে কাতার বিশ্বকাপের আসরকে। এ ঐতিহাসিক আসর তাই চিরকাল থাকবে মনের মণিকোঠায়, কিংবদন্তি হয়ে, ভবিষ্যৎ আলোচনার প্রসঙ্গ হয়ে।
0 মন্তব্যসমূহ