ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

কুমোরটুলি — মূর্তি তৈরির কারিগরখানা - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

শরতের আকাশ আর শুভ্র কাশফুল জানান দেয় মা দুর্গার আগমন বার্তা। কলকাতা শহর এই সময় নতুন প্রাণে জেগে ওঠে। মহাষষ্ঠীতে বোধন থেকে শুরু করে দশমীতে বিসর্জন অবধি- চারদিন উৎসবমুখর থাকে কলকাতা শহর। আসন্ন দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্নে আজ সেই শিল্পীদের কথা বলব যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও অসাধারণ সৃষ্টিশীলতায় দেবী মূর্তি আমাদের মণ্ডপ আলোকিত করেন।

সাবর্ণ-চৌধুরী বাড়ির পুজোকে সূচনা ধরলে শহর কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস বড় জোর চারশো বছরের। প্রথম দুর্গা পূজা শুরু হয়েছিল ১৬০৬ সালে। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গা পূজার প্রচলন করেন।

এরপর ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব কলকাতায় দুর্গা পূজা শুরু করেন। তখনকার দিনে কুমোররা জানতেন না যে সিংহ কি রকম দেখতে হয় তাই রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ির দুর্গা প্রতিমায় সিংহের জায়গায় ঘোড়ার রূপ দেওয়া হয়। সেটির প্রচলন আজ অব্দি অব্যাহত।

বাণিজ্যিক কারণে মুঘল বাদশাহ ঔরাঙ্গজেবের আমন্ত্রণে ১৭ শতকের একেবারে শেষ দিকে, ১৬৯০ সালের আগস্ট মাসে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠিয়াল জোব চার্নক সুতানুটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে কয়েক বছরের মধ্যেই সুতানুটির পাশের গ্রাম কলকাতাতে স্থাপিত হল কোম্পানির প্রধান বাণিজ্যকুঠি। তখনও কিন্তু কলকাতা গ্রাম। এই শহরের প্রকৃত নগরায়ণ আরম্ভ হয় পলাশির যুদ্ধের পরে। কোম্পানির কুঠির টানে, কাজের আশায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ তখন ধীরে ধীরে কলকাতায় ভীড় করছে। আবহমান কাল থেকেই বংশপরম্পরায় বাংলার কুমোররা হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি বানিয়ে আসছেন কুমোরটুলিতে। কুমোরটুলির ইতিহাস শুরু হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন কৃষ্ণনগর থেকে পুতুল তৈরির পটুয়ারা উন্নতি সাধনের জন্য হুগলীর বর্ধিষ্ণু গ্রাম গোবিন্দপুরে স্থানান্তরিত হন। গঙ্গার পাড়ে এই সমৃদ্ধিশালী গ্রামে তাঁদের উপার্জনের পথই ছিল মাটির হাঁড়ি কলসি, খেলনা পুতুল প্রভৃতি বানানো। পরে তাঁরা সুতানটিতে নতুন বসতি স্থাপন করে যা আজ কলকাতার "কুমোরটুলি" নামে পরিচিত।

পলাশির যুদ্ধের পরে বাংলার মূল শাসন ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ায় সমগ্র পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে গোবিন্দপুর গ্রামে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপন করে। ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্য করে বা তাদের ব্যবসা-সহায়ক হয়ে এক শ্রেণীর মানুষের হাতে জমে উঠতে থাকে প্রভূত ধনসম্পত্তি। আর সে যুগে যেহেতু বিত্ত ভোগ করার প্রচুর আয়োজন বিশেষ ছিল না তাই দুর্গাপুজো ক্রমশ হয়ে ওঠে বিত্তবান শ্রেণীর বৈভব প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম। কলকাতায় যত ধনীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্গাপুজোর সংখ্যাও বাড়ে। ওই ঈসব ধনী বাবু-বাড়িতে প্রতিমা তৈরির কাজে ডাক পড়তে লাগলো কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পীদের। এ ভাবেই কেটে গেল গোটা আঠারো ও উনিশ শতক।


ই দীর্ঘ সময়ে পুজোর সংখ্যা বাড়লেও, চাল ও সিংহের আকৃতি বাদ দিয়ে, প্রতিমার অন্যান্য রূপবৈচিত্র্যের খুব একটা হেরফের ঘটেনি। তার কারণ ওইসব পুজোগুলি সবই ছিল একক পারিবারিক উদ্যোগের বাড়ির পুজো। বিভিন্ন পুরাণগ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের দেওয়া ব্যাখা অনুসারেই প্রতিমা তৈরি করতেন সে যুগের শিল্পীরা। একটি বেদী ও তার উপরে লম্বালম্বি দাঁড় করানো একটি অর্ধগোলাকৃতি চাল বা চালার মধ্যে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, মহিষাসুর ও সিংহ— এই সাতটি প্রতিমা। একটি চালার মধ্যে সব প্রতিমাগুলি থাকায় এর নাম একচালা প্রতিমা।

বিশ শতকের প্রথম চারটি দশক পর্যন্ত কিন্তু চালের বিন্যাস ও সিংহ ছাড়া আর বিশেষ কোনও পরিবর্তন কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পে ঘটেনি। পরিবর্তনটা এল কৃষ্ণনগর-ঘুর্ণীর গোপেশ্বর পালের হাত ধরে। ঘুর্ণীর যদুনাথ পালের বৈশিষ্ট্য ছিল এক তাল মাটি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কোনও মানুষের মুখের অবয়ব তৈরি করায়। সেই পরিবারের ছেলে গোপেশ্বরও ছোটোবেলা থেকে ওই বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। পরিণত বয়সে গোপেশ্বর আসেন কুমোরটুলিতে। এত কাল একটি চালের ভিতরেই সপরিবার দুর্গাকে নিয়ে তৈরি হত প্রতিমা। আর প্রতিমার মুখের আদলও ছিল পান পাতার মত, সঙ্গে প্রায় কান পর্যন্ত টানা চোখ। একে বলা হয় বাংলা রীতির মুখ। ১৯৪০-এ কুমোরটুলি সর্বজনীনের প্রতিমা গড়তে গিয়ে গোপেশ্বরই প্রথম সাবেক প্রথা ভেঙে একচালার ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশকে আলাদা করে ফেললেন। কথিত আছে, ১৯৩১ সালে শুরু হয় কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গাপূজা। কুমোরটুলির শিল্পীরা মিলে এই পুজো শুরু করবেন মনঃস্থির করেন। এই পুজোর সভাপতি হতে চান হরিশংকর পাল। নেতাজীর কাছে প্রস্তাব যায় এই পুজোর সভাপতি হবার জন্য, কিন্তু যেখানে ইংরেজ আছে সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। কিন্তু তরুণ বাহিনী ছিল নাছোড়বান্দা।  তখন হরিশংকর নিজেই সরে দাঁড়ান আর ১৯৩৮ সালে নেতাজী হ’লেন কুমোরটুলির সর্বজনীন পুজোর প্রথম সভাপতি। এই বিষয়ে বহু সদস্যই আপত্তি করেছিলেন, কারণ কেউই ব্রিটিশদের বিরাগভাজন হতে চাইছিলেন না। অতঃপর সব বাধা অতিক্রম করে নেতাজীই সভাপতি হলেন।


দেখতে দেখতে পুজোর দিন চলে এল। পঞ্চমীর দিন ঘটে গেল মহাবিপত্তি। মন্ডপে একচালার দেবীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। হঠাৎ আগুন লেগে গেল, প্রতিমা পুড়ে ছাই। কিন্তু পরের দিন যে বোধন! তবে কি পুজো বন্ধ হয়ে যাবে? হাল ছাড়তে রাজী নয় তরুণরা। পাড়াতেই থাকতেন শিল্পী গোপেশ্বর পাল। এগিয়ে এলেন, নিজে গড়লেন প্রতিমা। একচালা ভেঙ্গে তৈরী হল পাঁচচালা। তৈরি করলেন অপরূপ মাতৃমূর্তি। যা সম্ভব হল শিল্পী গোপেশ্বর পালের জন্যই। এভাবেই পাঁচচালা মুর্তিপুজোর প্রচলন শুরু হল।

তারপর বাংলা রীতির মুখ বদলে প্রতিমার মুখে গোপেশ্বর আনলেন মানবিক রূপ। পরিবর্তন এল গায়ের রঙেও। সাবেকি তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা দুর্গার সেই হলুদের সঙ্গে এবার মিশলো একটু গোলাপি, মানুষের গায়ের রঙের কাছাকাছি। ‘স্বর্গের দেবী’ যেন এবার ‘মানবী’-র রূপ পেলেন গোপেশ্বরের হাতে।

কুমোরটুলির অবস্থান

সাবেক কুমোরটুলি ঠিক কোথায় ছিল আজ তা বলা কঠিন। হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাবেক কুমোরটুলিও তার অবস্থান পাল্টেছে বারে বারে। আজকের কুমোরটুলির অবস্থান হল বাগবাজারের ঠিক পাশেই। মূল কুমোরটুলি অংশটি রয়েছে বনমালী সরকার স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে— উত্তরে কুমোরটুলি স্ট্রিট, দক্ষিণে অভয় মিত্র লেন, পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড আর পূর্বে রবীন্দ্র সরণির মধ্যবর্তী জায়গায়। অবশ্য এর বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও অনেকটা জায়গাই এখন মৃৎশিল্পীদের দখলে চলে গিয়েছে। আদিতে ওই সব জায়গাগুলির মালিকানা ছিল গোবিন্দরাম মিত্র, গোকুলচন্দ্র মিত্র, বনমালী সরকার, নন্দরাম সেন প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের। পরে ভাগ্যকুলের রায় পরিবারের কলকাতার বসতবাড়িও তৈরি হয়েছিল ওই অঞ্চলে। তাদের জমির কিছু অংশও এখন কুমোরটুলির অন্তর্গত। ওই সব ব্যক্তিরা কেউই কিন্তু মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন সে যুগের এক এক জন স্বনামধন্য মানুষ।

প্রথমে আসা যাক গোবিন্দরাম মিত্রের কথায়। সে যুগে লোকে তাঁকে বলত ‘ব্ল্যাক জমিনদার’। অসম্ভব দাপুটে ওই জমিদার দুর্নীতিপরায়ণও ছিলেন। ১৭৩০ সালে তিনি চিৎপুর রোডের উপরেই প্রতিষ্ঠা করেন এক বিশাল পঞ্চরত্ন মন্দির ও তাকে ঘিরে তিনটি দো’চালা ও দু’টি নবরত্ন মন্দির-সহ এক ‘মন্দির কমপ্লেক্স’। সাহেবরা ওই বিশাল পঞ্চরত্ন মন্দিরকে বলত ‘প্যাগোডা’। প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মধ্যে ১৭৩৭-এর ঝড়ে ভেঙে পড়ে মন্দিরের চূড়া। আরও পরে আস্তে আস্তে পুরো মন্দিরটিই ভেঙে যায়। পুরনো কলকাতার কয়েকটি ছবিতে গোবিন্দরাম মিত্রের ওই প্যাগোডার উল্লেখ রয়েছে

এর পাশেই মদনমোহনতলা। ওখানকার মদনমোহন ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র মিত্রর আদি বাড়ি ছিল বালিতে। তিনি বর্গি হামলার সময়ে কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। লবণ-ব্যবসায়ী গোকুলচন্দ্র খুব অল্প সময়ে প্রচুর টাকা রোজগার করেন। ওদিকে ওই বর্গিদের হামলাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ জমিদারি রক্ষা করতে এক বিশাল অঙ্কের টাকা ধার নেন গোকুলচন্দ্রের কাছ থেকে। পরিবর্তে বন্ধক রাখেন কুলদেবতা মদনমোহনকে।


বিষ্ণুপুরের মদনমোহন

বিষ্ণুপুর মল্ল রাজবংশের রাজা দুর্জন সিংহ ১৬৯৪ সালে বিষ্ণুপুরে মদনমোহন বিগ্রহ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ওই বিগ্রহ ছিল রাজবংশের সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই অবস্থার ফেরে বন্ধক দিলেও, চৈতন্য সিংহ টাকা শোধ দিয়ে কুলদেবতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন।

 

এদিকে ঘটনাচক্রে মদনমোহন ঘরে আসার পর থেকে গোকুলচন্দ্রের অবস্থারও উন্নতি হতে থাকে। ধর্মীয় সংস্কার বশে তিনি বিগ্রহ ফেরত দিতে রাজি হলেন না। ঘটনা গড়াল আদালত পর্যন্ত। ইতিমধ্যে চতুর গোকুলচন্দ্র আরও একটি বিগ্রহ তৈরি করিয়ে রাখেন এবং বিচারের সময়ে চৈতন্য সিংহকে আসল মদনমোহন বিগ্রহ চিনে নিতে বলা হল। হুবহু এক রকম দেখতে দু’টি বিগ্রহের মধ্যে থেকে একটি বেছে বিষ্ণুপুরে নিয়ে গেলেন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। আর অন্যটি রইল গোকুল মিত্রের কাছে, মিত্র পরিবারের কুলদেবতা হয়ে।

গোকুলচন্দ্র তাঁর এক বিঘেরও বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি বাড়ির দোতলায় নতুন কুলদেবতার জন্য মন্দির তৈরি করলেন। একতলায় তৈরি হল ঠাকুরদালান, বাড়ির পাশে আলাদা রাসমঞ্চ, দোল, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস প্রভৃতি উৎসব-অনুষ্ঠানে মদনমোহন ও রাধিকার বিগ্রহ ওই দালান-রাসমঞ্চে এনে বসানোর জন্য। গোকুলচন্দ্র মিত্রের সেই ঠাকুরদালান আজও আছে। দোল-রাস উৎসবও হয় সেখানে। পাশাপাশি এই দালানও এখন ছোটখাট এক কুমোরটুলি। পুরো দালান আর উঠোন জুড়ে তৈরি হয় নানা রকমের প্রতিমা।


কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পের নবযুগের শুরু করেছিলেন গোপেশ্বর পাল, তা আরও পরিশিলীত, পরিমার্জিত হল ওপার বাংলা থেকে আসা রুদ্রপাল কুমোরদের হাতে। সাতচল্লিশের দেশভাগ আর তার অব্যবহিত পরের দাঙ্গায় সব খুইয়ে আরও লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর সঙ্গে এদেশে এসেছিলেন ফরিদপুরের ধনঞ্জয় রুদ্রপাল কিংবা বিক্রমপুরের রাখালচন্দ্র রুদ্রপালের মতো প্রতিমা শিল্পীরা। এখন যেখানে কুমোরটুলি, সেই জায়গার খানিকটা ছিল ভাগ্যকুলের রায়দের জমি। সেখানে কথা ছিল হাসপাতাল হওয়ার, কিন্তু নানা ঝঞ্ঝাটে তা আর হয়ে ওঠেনি। পরিত্যক্ত সেই জমিতেই তাঁরা গড়লেন তাঁদের মূর্তি তৈরির কারখানা।

কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পের নবযুগের শুরু করেছিলেন গোপেশ্বর পাল, তা আরও পরিশিলীত, পরিমার্জিত হল ওপার বাংলা থেকে আসা রুদ্রপাল কুমোরদের হাতে। সাতচল্লিশের দেশভাগ আর তার অব্যবহিত পরের দাঙ্গায় সব খুইয়ে আরও লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর সঙ্গে এদেশে এসেছিলেন ফরিদপুরের ধনঞ্জয় রুদ্রপাল কিংবা বিক্রমপুরের রাখালচন্দ্র রুদ্রপালের মতো প্রতিমা শিল্পীরা। এখন যেখানে কুমোরটুলি, সেই জায়গার খানিকটা ছিল ভাগ্যকুলের রায়দের জমি। সেখানে কথা ছিল হাসপাতাল হওয়ার, কিন্তু নানা ঝঞ্ঝাটে তা আর হয়ে ওঠেনি। পরিত্যক্ত সেই জমিতেই তাঁরা গড়লেন তাঁদের মূর্তি তৈরির কারখানা।


সাতচল্লিশে ঢাকা-বিক্রমপুর থেকে এসেছিলেন রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল। সঙ্গে এসেছিলেন হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল, মোহনবাঁশি—চার ভাই। মানিকগঞ্জের যোগেন্দ্র পাল কিংবা গোরাচাঁদ পাল এবং আরও অনেকে। সেই এঁদের কিছু আগে সরকারি চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে পড়তে আসা ফরিদপুরের রমেশচন্দ্র পাল— সব মিলিয়ে পঞ্চাশের দশক থেকেই কুমোরটুলিতে ওপার বাংলার মৃৎশিল্পীদেরই যুগ। তবে কুমোরটুলির এখনকার ঘরানা তৈরিতে গোপেশ্বরের অবদানের কথা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন ওপারের শিল্পীরা। হরিবল্লভের ছেলে গৌরাঙ্গ রুদ্রপাল বলেন,

‘‘নতুন যুগের শুরুটা কিন্তু জি. পালই (গোপেশ্বর পাল এই নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন) করে গিয়েছেন। আমাদের বাবা-কাকাদের হাতে তা উন্নত হয়েছে মাত্র। তাঁকে বাদ দিয়ে কুমোরটুলির ইতিহাস হবে না।’’



দুর্গাপুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় অনমনীয় পরিশ্রমী আর নিঃশর্ত আত্মোৎসর্গকারী কুমোরদের সর্বশ্রেষ্ঠ নৈপুণ্যের প্রদর্শন- দুর্গাপ্রতিমার নির্মাণের জন্য। হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমা বানানোর ব্যাপারটা বেশ জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমার জন্য কাদামাটি সংগ্রহ থেকে সাজসজ্জা প্রতিটা কাজই হয় প্রথা মেনে। বর্ষার প্রথম অক্ষয় তৃতীয়ায় যেদিন রথযাত্রা হয়, সেদিন গণেশ এবং লক্ষ্মী পুজো দিয়েই গাঁরাল কাঠামো পুজো শুরু হয়। নদীর পাড় থেকে কাদামাটি সংগ্রহ হয়। এর আগে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে একটা কাঠামো বানানো হয় যার সঙ্গে শন বা খড় পাটের দড়ি বেঁধে প্রতিমার একটা অবয়ব আনা হয়। এই অবয়বের সঙ্গে নদী থেকে আনা এঁটেল মাটি দিয়ে নিখুঁত প্রতিমা বানানো হয়। প্রতিমা বানাতে প্রধানত দু’রকমের মাটির ব্যবহার করা হয়- এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। এঁটেল মাটি দিয়ে মূর্তি গড়া হয় এবং তারপরে বেলে মাটি দিয়ে সেই মূর্তিগুলোকে পলিশ করা হয়। গঙ্গা থেকেই প্রধানত মাটি আনা হয় তবুও উলুবেড়িয়া থেকে মাটি আনাই পছন্দ করেন কুমোরটুলির কুমোররা। মহালয়ার পুণ্যলগ্নে দেবীর চক্ষুদান করা হয়।

মাটির তৈরি প্রতিমা থেকে শুরু করে বর্তমানে ফাইবার, শোলা প্রভৃতি দিয়েও মূর্তি তৈরি হচ্ছে। মূর্তি বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় মূর্তি তৈরি শিল্পে নব জাগরণ ঘটেছে। ২০০৬ সালে কুমারটুলি থেকে ১২,৩০০টি দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯৩টি রাষ্ট্রে কলকাতার এই পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা প্রেরণ করা হয়ে থাকে।


সাধারণত পুরুষেরাই প্রতিমা তৈরি করেন কিন্তু ১৯৯০ থেকে মালা পাল ও চায়না পাল এই দুই মহিলা শুরু করেন দুর্গা প্রতিমা গড়া। এমনকি মালা পালকে “ন্যাশনাল হ্যান্ডিক্রাফটস এন্ড হ্যান্ডলুম মিউজিয়াম", নিউ দেল্লী থেকেও এক্সিবিশনের সময় ডাকা হয়। তাঁর প্রতিমা জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, ইউএসএ সব জায়গাতেই রপ্তানি করা হয়।


মালা ও তাঁর মা মায়ারানী পাল দুজনেই সমান দক্ষতার প্রতিমা শিল্পীরূপে সুখ্যাতি লাভ করেছেন, যদিও মালা পালের ভাই গোবিন্দ পাল মনে করেন, “কামাখ্যাবালা দেবী ছিলেন কুমোরটুলির প্রথম মহিলা মৃৎশিল্পী।“ কয়েক বছর আগে তিনি মারা গিয়েছেন। কামাখ্যাবালার পরবর্তী প্রজন্মে কাকলি পাল, তৃপ্তি পাল, নমিতা পাল, মিনতি পাল, সোমা পাল, কাঞ্চী পাল ও চম্পারাণী পাল প্রমুখ আরও বহু মহিলা প্রতিমাশিল্পী কুমোরটুলিতে মূর্তি তৈরিতে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে পুরুষপ্রধান কাজে মেয়েদের আসা নিয়ে প্রবল সামাজিক বিরোধিতা দেখা দিলেও ধীরে ধীরে এঁদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পারিবারিক ও আর্থিক দৈন্যের থেকে মুক্তি পেতে বাধ্য হয়ে এই পেশায় মহিলারা আসতে শুরু করলেও, বর্তমানে বহু মহিলা নিজেদের শখেও এই পেশা বেছে নিতে শুরু করেছেন। পুরুষদের পাশাপাশি কুমারটুলিতে প্রায় তিরিশ জন মহিলা প্রতিমাশিল্পী রয়েছেন।

 যুগ বদলের সাথে সাথে প্রতিমার রূপ বদলও ঘটেছে। বদল ঘটেছে অঙ্গসজ্জার কারিগরি শিল্পেরও উপাদান ও উপস্থাপনার। কিন্তু কুমোরটুলির গুরুত্ব এখনও একই ভাবে বহমান। ভবিষ্যতেও বঙ্গজীবনে বিভিন্ন উৎসবের সাথে তাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকবে কুমোরটুলি ও এখানের মৃৎশিল্পীরা।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ