ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

দ্বিতীয় পর্ব: অবিশ্বাস্য প্রাণীর খোঁজে - সোমনাথ দত্ত

দ্বিতীয় পর্ব: অবিশ্বাস্য প্রাণীর খোঁজে - সোমনাথ দত্ত


প্রাণীজগৎ! বিস্ময় আর বৈচিত্র্যের সমার্থক যেন মানবজাতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অধ্যবসায়ের ওপর ভর করে বিজ্ঞানজগতে উন্নতির লেখচিত্র ক্রমশ উর্ধ্বমুখী আজকের দিনে কিন্তু যতই অভাবনীয় উন্নতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকি না কেন, সুবিশাল জগৎসংসারের অনাবিষ্কৃত রহস্যের কাছে আমাদেরকে হার মানতে হয় বারবার ব্যাপ্তিতে অনন্য প্রাণীজগৎও তাই ব্যতিক্রম নয় অনাবিষ্কৃত অস্তিত্বের কথা না হয় বাদই দিলাম, এখনো পর্যন্ত যতটুকু  পরিচয় জানা গেছে প্রাণীকুলের, তাতেও কি বৈচিত্র্যের কমতি আছে? আকারে- প্রকারে, স্বভাবে- আচরণে একের পর এক সৃষ্টি তাই আমাদের মনে জাগায় অপার বিস্ময়বোধ, মনে জাগে অজস্র প্রশ্ন! তাদের সবাইকে নিয়ে এ আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে, এর শেষটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার কূলকিনারা খুঁজে পাওয়ার সাধ্যি নেই এই আনকোরা লেখকের
 
তাইতো বেছে বেছে মাত্র তিন- চারটে কিম্ভূতকিমাকার প্রাণীর সাথে পরিচয় করিয়ে শুরু করেছিলাম এই বিজ্ঞান-সিরিজের ধারাবাহিকতা কতটা বজায় থাকবে, উত্তরটা না হয় সময়ের কাছেই থাক ! আগামী সম্ভাবনার সমস্ত আশঙ্কাকে দূরে সরিয়ে রেখেই, এগিয়ে চলেছি এই ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্বের দিকে দেরি না করেশুরু করা যাক তবে……….


স্বচ্ছ শরীরে বিস্মিত করে গ্লাস ফ্রগ:

নামটা দেখে কিছু মনে হচ্ছে কি? না?-- বেশ! তবে ছবির দিকে একবার তাকানগ্লাস ফ্রগ

কি বুঝলেন? হ্যাঁ, হলদে সবুজ রঙের এই বিশেষ প্রজাতির ব্যাঙের ভেতরের আর নীচের ত্বক কাঁচের মতো স্বচ্ছ যার সৌজন্যে, এর দেহের প্রায় সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা যায় খালি চোখেই একইসাথে আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য এর সবুজ ত্বকের ওপর অজস্র কালো স্পট এই স্পটগুলো অভিনব উপায়ে  মিমিক্রি করে এর ডিমের, বিভ্রান্ত করে দেয় এর ব্যাঙাচির খাদকদের

কোথায় খুঁজে পাবেন?

গ্লাস ফ্রগ

গাছে বাস করে এই ব্যাঙ তাই বলে নিজের বাড়ির পাশের গাছে খুঁজতে যাবেন না যেনো, হা হাকোস্টারিকা নিবাসী এই অভিজাত গোছের ব্যাঙ দেখা যায় পানামা অঞ্চলে  বিশেষত, কোস্টারিকার টরটুগুয়েরো ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গেলে দর্শন পেয়ে যেতেই পারেন অনিন্দ্যসুন্দর এই গ্লাস ফ্রগের ফটিকস্বচ্ছ আভার জন্য এনারা সেখানে একপ্রকার বিখ্যাতই কিনা!
 কাঁচের মতো স্বচ্ছ দেহাংশের কথা উঠতেই মনে পড়ে গেল আরেক প্রাণীর কথা…….

মগজখানা দেখিয়ে বেড়ায় ব্যারেল আই (Barreleye)

ব্যারেল আই

একেবারে গভীর জলের মাছ! না না, উপহাস করে বলছি না আক্ষরিক অর্থেই গভীর সমুদ্রের প্রাণী এই ব্যারেল আই যিনি কিনা বিখ্যাত, এমন কেলাসের মতো স্বচ্ছ মাথা আর অদ্ভুতদর্শন মগজের জন্যে গ্লাস ফ্রগের মতোই এর শরীরের আভ্যন্তরীণ অংশ খালি চোখেই দেখা যায়, তবে শিরোভাগে তবে অবাক করে দেওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য কেবল এই একটিই নয়, গুণের যে অভাব নেই তেনাদের ইংরেজি 'Barrel' অর্থাৎ পিপের সাথে চোখের মিল দেখেই এই প্রাণীর এমন নামকরণ আসলে এর বিরাট, দূরবীনের মতো লম্বা চোখ যেন ঠিকরে বের হয়ে আসে মাথার স্বচ্ছ, নরম টিস্যু থেকে এই চোখদুটো কখনো চেয়ে থাকে ওপরের দিকে, কখনো বা সামনের দিকে লম্বা চোখ, মাথার স্বচ্ছতা সবটাই এই প্রাণীকে সাহায্য করে দূর দূরান্তের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে আসলে সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরতম অংশে বাস করার জন্যই এই মাছের এমন অভিযোজন তাই, দেখতে যত বিচিত্র আর অদ্ভুতদর্শন মনে হোক না কেন, আদতে কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যগুলোই ব্যারেল আইকে অবিরাম সাহায্য করে চলেছে জীবজগতে টিকে থাকতে
 
সামুদ্রিক অভিযোজনের প্রসঙ্গ উঠতেই আরো বহু প্রাণীর কথা মনে পড়ে যায় তাদের সবাইকে নিয়ে আলোচনায় গেলে এ আসর কখনো ফুরোবার নয় তাই দিতে চাই বিশেষ কারোর পরিচয়……

 

 প্যারোট ফিশ (Parrot Fish), ঠোঁট দিয়ে যায় চেনা

নাম শুনে কিছুই আন্দাজ করা যায়নি, এমনটা হয়েছে কখনও? এখানেও হবে না ভূমিকায় এই মাছের ঠোঁট


একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, টিয়াপাখির ঠোঁটের সাথে কতটা মিল! কেন? এখানেও যে সেই অভিযোজন

প্যারোট ফিশের বাসস্থল মূলত চরমভাবাপন্ন উষ্ণ পরিবেশে প্রবালদ্বীপ সংলগ্ন জলজ পরিবেশ, যেখানে অন্য যেকোনো প্রাণীর টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব, সেখানেই এদের আস্তানা টিয়ার ঠোঁটের মতো দেখতে এমন শক্ত দাঁত দিয়েই এরা পাথর, প্রবাল থেকে অ্যালগি বা শৈবালজাতীয় খাবার তুলে তুলে খায় আর এই খাবারই তাদের জীবনধারণের প্রধান রসদ

তবে প্যারোট ফিশের ব্যাপারে আরো চমকপ্রদ কিংবা বলা ভালো বেশ মজার তথ্য কি জানেন? এরা মল হিসেবে যা ত্যাগ করে, তা আসলে বালি সেকারণেই সফেদ সমুদ্রসৈকতে অনেক সময় যে বালির দানা পড়ে থাকতে দেখা যায়, তা আদতে এই বিচিত্র প্রাণীরই মল!
 
তা সে যাই হোক না কেন, এই প্যারোট ফিশ যে দেখতে ভারী সুন্দর সে বিষয়ে কারো সন্দেহ করার জো' নেই আর রঙ বেরঙের সৌন্দর্যের ভাণ্ডার যেখানে এই সুবিশাল জীবজগত সেখানে আরেকজনের কথা না জানালেই যে নয় ভারী অন্যায় হয়ে যায় তাহলে…..

সৌন্দর্যের অন্য রূপ এক, ম্যান্টিস শ্রিম্প (Mantis Shrimp)

সুন্দর, সুপ্রাচীন, উগ্রতায় পরিপূর্ণএর শরীরের অজস্র রঙের বাহার দেখে এর বিচার করতে যাবেন না যেন, রীতিমতো বোকা বনে যাবেন এককথায় ভয়ঙ্কর সুন্দর এই প্রাণী জীবজগতে যার আবির্ভাব প্রায় ৪০ কোটি বছর আগে! এত প্রাচীন আর কোনো শ্রিম্প এখন পৃথিবীতে টিকে নেই শরীরের অঙ্গগুলো এতটাই মোটা আর শক্তিশালী যে এদেরকে উপাঙ্গ না বলে রীতিমতো ক্লাব অর্থাৎ মুগুর বলে ডাকা হয় এই ক্লাবের আঘাতে এরা কাঁকড়ার খোলসও ভেঙে দিতে পারে

শুধু তাই নয়, এই ক্লাব দিয়ে এরা সেকেন্ডে ৫০০ বারেরও বেশি গতিতে আঘাত করতে পারে! এই আঘাত একেকটা কাচের গ্লাস ভেঙ্গে ফেলার জন্য যথেষ্ট একইসাথে এর অনবদ্য দৃষ্টিশক্তি একে বিন্দুমাত্র লক্ষ্যচ্যুত হতে দেয় না কাজেই এমন অভূতপূর্ব সৌন্দর্যময়কেও ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি

হদিশ পাই কোথায়?

তা সে যতই উগ্র হোক না কেন, রংবাহারি অপূর্ব সৌন্দর্যের জন্য ম্যান্টিস মশাইয়ের কদরও কিন্তু কোনো অংশে কম নয় প্রায় ৪০০ খানা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এই পিকক ম্যান্টিস শ্রিম্পের (ছবি) অনুরাগীই বোধ হয় সবচাইতে বেশি আর হবে নাই বা কেন, যার ওইটুকু শরীরে রঙের বাহার ময়ূরকেও হার মানায়, তাকে ঘিরে উন্মাদনা তো থাকবেই চাইলে আপনিও দেখা পেয়ে যেতে পারেন, যেকোনো সময়ে শুধু একটু সময় আর গাঁটের কড়ি খরচ করে যেতে হবে কোস্টারিকা কিংবা বালিতে, সেখানকার জলে ডুব দিয়ে মানে রীতিমতো ডাইভিং বুক করে বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করে আসতে পারবেন তেনাদের আসল রূপ
 
জলে তো অনেকক্ষণ থাকা হলো, এবার চলুন তো চট করে একবার স্থলভাগটাও ঘুরে আসি…..

  

অলসতা যার সফল জীবনশৈলী, শ্লথ (Sloth):

এমন একখানা নাম, যা রীতিমতো প্রবাদে গিয়ে ঠেকেছে শ্লথগতি বলতে যে ঠিক কি বোঝায়, তা বোধহয় আর খোলসা করে বলবার কোনো প্রয়োজন নেই বেশিকিছু নয়, ইউটিউবে একবার শ্লথের গতি বিষয়ে যেকোনো ভিডিও খুঁজে দেখুন, বিরক্তি আসতে বাধ্য এমন অলস প্রাণীর প্রতি চোখে বিষণ্ণতা, মুখে মুচকি হাসি, ছোট্ট কান, খাঁটো লেজজগতের যেকোনো প্রান্তে দেখে সহজেই চেনা যায় কুঁড়ের মহারাজ শ্লথবাবুকে! আচার আচরণে এরা এতটাই ধীর, যে খাওয়া, দাওয়া, ঝিমোনো কিংবা ঘুমোনো- এরা সারাদিন এক ডালে বসেই কাটিয়ে দেয় অলসতার উদাহরণ দিতে গেলে আরও বলতে হয়, দিনে মাত্র একবার মলত্যাগ করে এই আজব প্রাণী! ভাবা যায়!

গুণের কমতি নেই এনারও, মাথাটাকে সম্পূর্ণ ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরানোর ক্ষমতা কটা প্রাণীরই বা থাকে?

সবমিলিয়ে বলতে গেলে শ্লথ ভীষণ অলস, কিন্তু বিখ্যাত অলস! আর এর স্থবিরতাকে নিছক অলসতা ভেবে বসলে কিন্তু বেশ ভুল করা হবে আদতে এও একপর্যায়ের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এদের নড়ন চড়নের গতিতে, দূর থেকে কোনো শিকারী প্রাণী সনাক্তই করতে পারবে না এদের

ঠিকানা কোথায়?

দেখতে খুব মন চাইলে চলে যেতেই পারেন মধ্য কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে নিকারাগুয়া আর কোস্টারিকাতে বেশ ভালো সুযোগ পাবেন, কোনো সন্দেহ নেই

বৃক্ষনিবাসী এক প্রাণীর কথা না হয় হলো, এবারে আসি একেবারে চারপেয়ে, তৃণভোজী আরেক প্রাণীর কথায়…..

 

ওকাপি (Okapi), দেখবেন নাকি বিভ্রান্ত হবেন?

জেব্রা নাকি জিরাফজিরাফ নাকি জেব্রাছবিখানা দেখুন তো ভালো করে….

কি? চোমকে গেলেন তো একেবারে? ভাবছেন একই প্রাণীর মধ্যে জেব্রা আর জিরাফ দেখতে পাচ্ছি কি করে? তাহলে কি জেব্রা-জিরাফের সংকর কোনো প্রজাতি? না, একেবারেই নয় ওকাপি সম্পূর্ণ পৃথক, অনন্য এক প্রজাতির প্রাণী  বিবর্তনগত দিক থেকে জিরাফের জাতভাই, যার নিতম্ব আর চার পায়েই ডোরাকাটা, ঠিক জেব্রার মতো এর একটা ডাকনামও আছে কিন্তু, কী সেটা? -- ' জেব্রা-জিরাফ', আবার কি?

হদিশ জানাতে হয়.....

দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্যি যে, নিজের অস্তিত্বের লড়াই টিকইয়ে রাখতে প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত যুঝে চলেছে এই প্রজাতি এককথায়, বিপন্ন আর লুপ্তপ্রায় প্রজাতি এই ওকাপি  সংখ্যায় এরা এতটাই কম যে, এদের অস্তিত্বের হদিস ১৯০০ সালের আগে কখনও পাওয়াই যায়নি

আজকের দিনে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের উটুরি ফরেস্টে এদের নিবাস, নিরাপদ অভয়ারণ্যে সেখানে পর্যটকদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তবে বন্যপ্রাণ যারা ভালোবাসেন, তাদের মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই ফ্লোরিডার হোয়াইট ওক সংরক্ষণ কেন্দ্রে একবার ঢুঁ মেরে আসতেই পারেন তার জন্যে আগে থেকেই ট্যুর বুক করতে পারেন সংশ্লিষ্ট কোনো বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞের সহায়তায়

 

.......

গল্প হোক বা বিবরণ, আড্ডা হোক বা আলোচনা, দীর্ঘায়িত করাটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয় তাই এই পর্বের ইতিটা এখানেই টানতে হলোতাই বলে, আড্ডা কিন্তু ফুরোয়নি আমাদের ফুরোবার মতো আলোচনা শুরুই করিনি হয়তো, যেদিন শেষ হবে, সেদিনও হয়তো অসমাপ্তই রেখে যেতে হবে……যাকগে সে পরের কথা, সেসব নিয়ে এখন ভাবুক হয়ে লাভ কি বলুন? আমাদের এই কিছুটা তথ্যময় আবার কিছুটা রসময় আড্ডা কখনো না ফুরোক, এই আশাই রাখি তবে পাঠকবর্গের কেমন লাগছে, কিংবা তারা কিভাবে দেখতে চান এই সিরিজ কিংবা অন্য যেকোনো সিরিজের আসন্ন পর্বকে তা জানাটা সত্যিই ভীষণ জরুরি হাজার হোক, পাঠকেরাই তো যথার্থ মূল্যায়নের অধিকারীতাই আপনাদের ভালো লাগা না লাগাকে ঘিরে কৌতূহল থাকছেই…..অপেক্ষা রইল সকলের অভিমতের

একই সাথে জিইয়ে রাখলুম কিছু অনুসন্ধিৎসু পাঠকের নীরব অপেক্ষা….. এরপর উৎসহাজির হবে আরো অনেক মজার তথ্য নিয়ে, পরবর্তী পর্বে আশা রাখি, সকলের প্রতীক্ষা, অভিলাষা যোগ্য মর্যাদা পাবে আমাদের ছোট্ট গল্প আসরে




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ