ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

চোর - শুভম ঘোষ

 


এই গল্পটি জুন ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। 

(১)

ন্ধ্যা হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক, যেটা দিল্লি-আগ্ৰা হয়ে কলকাতা চলে গেছে, সেই রাস্তায় আমাদের গল্পের সূত্রপাত।

  লকডাউন- এর জেরে রাস্তার চরম ব্যস্ত রূপটা মোটেই নেই। কেবল কয়েকটা মোটরসাইকেল, সাইকেল ও মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। আর আছে পরিযায়ী শ্রমিকের দল। হ্যাঁ, পরিযায়ী শ্রমিক, ওরা ঘরে ফেরার তাগিদে কোন উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত একজোড়া পায়ের উপর ভরসা রেখে 'জয় মা' বলে বেরিয়ে পরেছে।

এদের দলে ইয়াকুবও চলেছে, আর পিছনে চলেছে ওর ১২-১৪ বছরের ছেলে সরিফুল। 

  "আব্বা আর হাঁটতে পারছি না, পা'টা টনটন করছে ", ছেলের ডাকে পিছনে তাকায় ইয়াকুব। হাঁটতে হাঁটতে সে বলল,"আরেকটু পা চালা বাপ। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে আসবে। তার আগে এই জায়গাটা পার হতে হবে, অন্তত একটা লোকালয়ে পৌঁছতে হবে। চল চল, পা চালা।"

  "আব্বা, আমরা তো ট্রাকে করে যেতে পারি।ওই যে কতজন যাচ্ছে।"

 কথাটা নেহাৎ মন্দ বলেনি সরিফুল। ওদের মতো অনেকই ট্রাকে ঠাসাঠাসি করে যাচ্ছেও।

  সত্যি বলতে কি, ইয়াকুবের যে একবারও এই ইচ্ছাটা হয়নি তা নয়। সে কয়েকবার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু ওই অমানুষিক ঠাসাঠাসি তার ওপর সাথে একটা ছোট ছেলে.... তাছাড়া ব্যাপারটায় খানিকটা ঝুঁকিও আছে। ইয়াকুব ছেলের কথায় কান না দিয়ে হাঁটতে থাকে।

  ওঃ একটা সাইকেলও যদি থাকতো........

কথাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইয়াকুবের মুখ থেকে। একটা সাইকেল কেনার কথা তার মনে হয়েছিল। লকডাউনের আগে শেষ কটা দিন মজুরি খেটে যে কটা টাকা পেয়েছে তা দিয়ে একটা সাইকেল অনায়াসেই হয়ে যেত। কিন্তু কিনবে কোথা থেকে, সব দোকানই তো বন্ধ। আর তাছাড়া কবে বাড়ি পৌঁছতে পারবে তার তো কোন  ঠিক নেই, হাতে কিছু টাকা রাখা ভালো। কখন কি বিপদ আপদ হয় তা তো বলা যায় না।

  এরই মধ্যে অন্ধকারটা বেশ ঘনিয়ে এসেছে।ইয়াকুব আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো একটা লোকালয়ের মধ্যে চলে এসেছে। রাস্তার দুপাশে বেশ কয়েকটা বাড়ি।

  হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ইয়াকুবের মাথায় একটা ফন্দি আসে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সে।

ছেলেকে কাছে টেনে ওর কানে কানে কী যেন বলে।

  "মনে থাকবে তো যা বললাম?"ছেলেকে প্রশ্ন করে ইয়াকুব।

 "হ্যাঁ আব্বা, খুব থাকবে"

                          

(২)

  ঠক ঠক ঠক ঠক......

  একটু বিরক্ত হয়েই দরজার দিকে তাকান অর্জুন শ্রীবাস্তব। এত রাতে আবার কে এল রে বাবা। তিনি গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন- "কৌন হ্যাঁয় রে ইতনি রাত কো?"

  দরজার ওপাশে একটা অস্পষ্ট গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন অর্জুন শ্রীবাস্তব। তিনি দরজা‌ খুলে দেখলেন একটা বছর তেরোর ছেলে, পড়নে জীর্ণ ময়লা জামা-প্যান্ট। তিনি গলার স্বরটা একটু নরম করে বললেন,"ক্যা চাহিয়ে বেটা?কৌন হো তুম?"

  ছেলেটি বলল,"আমার নাম সরিফুল"

 অর্জুন শ্রীবাস্তব বাংলা খানিক বোঝেন। তিনি বললেন,"তুম বাংগালি হো"

 ইয়াকুব এতক্ষণ বাড়িটার ভিতরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে নজর রাখছিল। 'কী ‌জানি ছেলেটা যদি কোনো গোলমাল করে ফ্যালে, যদি শেখানো কথা ভুলে যায়' এই ছিল তার সন্দেহ। হাজার হোক ছেলেমানুষ তো। কিন্তু ইয়াকুব যখন দেখল ছেলে তার সব কথা ঠিক ঠিক বলে যাচ্ছে তখন  নিশ্চিন্ত মনে পরিকল্পনা মাফিক নিজের কাজ করতে চলে যায় সে।

 অর্জুন শ্রীবাস্তব সরিফুলকে বলে,"ক্যা চাহিয়ে?"

 সরিফুল একটু আমতা আমতা করে শেখানো কথাটা আউরে দেয়,"খুব খিদে পেয়েছে, যদি কিছু খাবার হয়......"

 অর্জুন শ্রীবাস্তব একটু বিরক্ত হন। রাত্রিবেলা যতসব ঝক্কি, যত্তসব! মুখে কিছু না বলে সরিফুল কে দাঁড়াতে বলে বাড়ির ভিতরে চলে

গেলেন। এই অবসরে সরিফুল চট করে একবার আশেপাশে তাকিয়ে নেয়, তার আব্বাকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারেনা। কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে সে।

ঠিক তখনই ওপাশের অন্ধকার থেকে খুট করে একটা শব্দ আসতে সেদিক ঘুরে তাকায় সরিফুল। সে দেখল তার আব্বা একটা সাইকেল নিয়ে বাড়ির গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় অবশ্য তার সঙ্গে একবার চোখাচোখি করে নিল। সরিফুল বুঝলো তাদের প্ল্যান কাজে দিয়েছে।

বাড়ির ভিতরের দিক থেকে পায়ের আওয়াজ শুনে সে দিকে ফিরে তাকায় সরিফুল। অর্জুন শ্রীবাস্তব ফিরে আসছেন, হাতে একটা পলিথিনের প্যাকেট। মুখে কিছু না বলে তিনি প্যাকেটটা সরিফুলের হাতে দিয়ে দিলেন।

সরিফুল ধন্যবাদ জানিয়ে এক দৌড়ে রাস্তায় চলে এল। কিন্তু তার আব্বা কোথায়? দেখতে পাচ্ছে না কেন? সে আরও খানিকটা এগিয়ে যায়। এবার দেখতে পায়। ওই তো রাস্তার ধারে বসে আছে তার আব্বা, সাইকেলটা এক পাশে দাঁড় করানো। সরিফুল কাছে যেতেই ইয়াকুব হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে,"দিয়েছে খাবার?"

"হ্যাঁ আব্বা, অনেক"

"তোর কি খিদে পেয়েছে, খাবি এখন?"জানতে চায় ইয়াকুব।

সরিফুল সরলভাবে জবাব দেয়,"না আব্বা, সকালে খুব খিদে পায় তখন খাব।"

"আচ্ছা" বলে সাইকেলে উঠে বসে ইয়াকুব। হঠাৎ কি মনে হতেই সে সরিফুলকে বলে,"হ্যাঁ রে, চিঠিটা রেখে এসেছিলি তো?"

সরিফুল জিভ কেটে বলে,"এই যাঃ ভুলে গেছি আব্বা"

"যা, দৌড়ে যা, গিয়ে রেখে আয় চিঠিটা"ছেলেকে হুকুম করে ইয়াকুব।

                        

(৩)

  পরদিন সকালে বাড়িতে একটা চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙ্গে অর্জুন শ্রীবাস্তবের। বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন তিনি। ব্যাপারটা আর কিছুই না তার ছেলের নতুন সাইকেলটা কাল রাতে চুরি হয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। মনে মনে বললেন,"শালা ভিখারী, হামারে ঘর চোরি কর গয়া"

  গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে রাস্তার দিকে আসার সময় চিঠিটা চোখে পড়ে অর্জুন শ্রীবাস্তবের। খানিকটা অবাক হলেন তিনি। সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে খুলতেই ভেতরের লেখাটা দেখতে পেলেন তিনি---

          "বাবু, আমরা চোর নই। বাড়ি যাওয়াটা খুবই দরকার। তাই বাধ্য হয়েই আপনার সাইকেলটা নিলাম। কিছু মনে করবেন না। আর খাবারের জন্য ধন্যবাদ।"

          চিঠিটা পড়ে অর্জুন শ্রীবাস্তব একেবারে থ মেরে গেলেন।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ