এই গল্পটি জুন ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
রবিবারের দুপুর। বাচ্চাটা আবারো ভীষণ জোরে চীৎকার করছে। অরুণিমা কিছুতেই তাকে
শান্ত করতে পারছে না। কাল আশ্রম থেকে বোধিসত্বের ঘরে নিয়ে আসা অব্দি এই নিয়ে পরপর
বেশ ক’বার এমনটি হয়ে গেল।
--- বেচারা! ছোট্ট মানুষের চেহারা নিয়ে জন্মানো আজব এক জীব! কি দরকার ছিল তোর এই
সমস্যা-সংকুল পৃথিবীতে আসার? বাবা কে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই, মা জন্ম দিয়েই গভীর রাতে এক নিরিবিলি বাসষ্টপে ছেড়ে দিয়ে খালাস! ভোরে কারা যেন
কুড়িয়ে নিয়ে আশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিল। আরে সেখানেই যদি গেলি, শেষ অব্দি আমারই ঘরে চলে আসার দরকারটা কি ছিল তোর? একি শুধুই ভবিতব্য? নাকি তোরও তীব্র
আকাঙ্ক্ষা- জোর করে সম্পর্কের অধিকার ফলাবার? ঠিক আমার বাচ্চা-পাগল বৌটারই মতো?
বোধিসত্ব মনে মনে বাচ্চাটার উপর তার সব ঝাল ঝাড়ছিল। ঐটুকুতেই শেষ নয়, নির্বিচারে আরো
স্বগতোক্তি করে যাচ্ছিল সে-
--- কিন্তু তোর এই প্রাপ্তিটা তো পুরো নয় বাছা। স্রেফ আদ্ধেকটা অধিকার পেতে
বারেবারে এত জায়গা বদল? কি, বুঝতে পারছিস না কিছু? এখানে তো শুধু পাতানো
মা পাচ্ছিস। কিন্তু বাবা?
উহু, কিছুতেই নয়। বিয়ের এত
বছর বাদে তোর মত কোন পরের বাচ্চার বাবা হওয়ার এতটুকুও সখ নেই আমার!
শুরু থেকেই বৌকে স্পষ্ট করে দেয়া নিজের অবস্থানটাকে বোধিসত্ব আবারো নিজের ভেতর
পোক্ত করে নেয়।
বাচ্চাটার চীৎকার ক্রমে চরমে পৌঁছুচ্ছে। অরুণিমা অসহায়ের মত বোধিসত্বের দিকে
তাকিয়ে আছে, কিন্তু কিছু বলার সাহস
পাচ্ছে না। বোধিসত্বও ভাবছে- চুলোয় যাক সব। কাঁদছে তো কাঁদছে! বোধিসত্বের তাতে কি
এসে যায়? সাধ করে পরের ছেলের মা
হওয়া অরুণিমা পারলে সামলাবে, না পারলে নয়! সে তো বরাবরই বৌকে বলে এসেছে, “পরপর তিনবার তোমার পেটের বাচ্চা কেড়ে নিয়েছেন যিনি, বুঝতে হবে সেই ঈশ্বরই
চান না আমাদের ঘরে কোন সন্তান আসুক। এই সত্যিটাকেই মেনে নাও। বেশ তো আছি- তুমি আর
আমি। মাঝখানে কেউ আর নাই বা এল! এই সন্তানহীন দীর্ঘ ছয় বছরে একটি দিনের জন্যেও
তোমাকে ভালবাসায় আমার কোন খামতি দেখেছ কখনো?”
সত্যিই বোধিসত্বের ভালবাসা নিয়ে অরুণিমার কোন অভিযোগ নেই। স্বামী-স্ত্রীতে
সুখের সংসার। প্রতিবার বাচ্চা নষ্ট হবার সময়টায়ও বৌকে অনেক খরচাপাতি করে চিকিৎসা
করিয়েছে স্ত্রী-বৎসল দায়িত্বশীল এই স্বামীটি। নিজের হাতে সেবা করেছে। রোগা-পটকা
বৌকে যত্ন করে ওষুধ-পথ্যাদি খাইয়ে বারবার সুস্থ করে তুলেছে।
অল্প বয়সে বিয়ের ক’বছর আগেই কেন্দ্রীয়
সরকারী দপ্তরে কেরাণীর চাকরীটা জুটে যাওয়ায় খেয়ে পরে চলতে দুজনের সংসারে তেমন
কোন অসুবিধে তাদের কোনদিনই হয় নি। শুধু গ্রামের ক্ষেত-খামার-গাছগাছড়া-পুকুর ভর্তি
নিজেদের বাড়ী ছেড়ে এই শহরের এক প্রান্তে এই দুই কোঠার টিনের ছাউনি আর এক চিলতে
বারান্দার বাড়ীভাড়ার বাড়তি খরচটা বোধিসত্বকে একটু পীড়া দেয়, এই যা। তাছাড়া
মাঝেমধ্যে মা-বাবার জন্যে কিছু অতিরিক্ত খরচাদি গ্রামের বাড়ীতে পাঠাতে হয় বৈ কি।
তখন যে কিছু টানাটানি হয়না তা নয়, তবে তাকে ঠিক অভাব-অনটনের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
সেদিন অব্দিও রোজ দুবেলা তার ‘অরু’র স্বাস্থ্যের খবরাখবর
নেওয়ায় কোন ত্রুটি রাখে নি বোধিসত্ব। এখন অবশ্যি ঘরে বাড়তি একটা প্রাণী এসেছে।
অরুর নিয়ে আসা বাচ্চাটার জন্যে এখন থেকে খরচ কিছু বাড়বে বটে, কিন্তু সেসবের জন্যে
মোটেই কোন চাপ নিচ্ছে না বোধিসত্ব। তার আদরের অরুর জন্যে এইটুকু সে করতেই পারে।
পরের বাচ্চার মা হয়ে খুশি থাকতে পারলে তাই থাক না অরু। তাকে সে সুখে বঞ্চিত করতে
চায় না বোধিসত্ব। শুধু নিজের জীবনে ওই উটকো বাচ্চাটাকে সে কোন সম্পর্কে জড়াতে দিতে
রাজী নয়।
বত্রিশ পেরুনো অরুণিমা এখনো যথেষ্ট রূপবতী। সুযোগ পেলেই তার নরম শরীরটা আদরে
আদরে ভরিয়ে দেবার দুর্বার আকর্ষণ এখনো বোধিসত্ব নিজের রক্তমাংসে আর মজ্জায়
পুরোমাত্রায় অনুভব করে। অরুণিমাও কি চায়নি উজাড় করে এই পূর্ণাঙ্গ পুরুষটিকে পূর্ণ
নারীত্ব দিয়ে ভরিয়ে দিতে?
কিন্তু হায়, সম্পুর্ণ নারী হয়ে উঠা
তার আর হ'ল কই? মা হতে না পারার এক
যন্ত্রণা তাকে ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে খেত। বুকের ভেতরটায় কোথায় যেন এক বিরাট শূন্যতা।
সেখানে পুরুষের শরীরী স্পর্শের হাজারো সুখ ছিল, কিন্তু ছিল না মুখ গুঁজে সব পাওয়ার আনন্দে মায়ের সত্তায় নিজেকে সঁপে দেওয়া কোন
নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। ছিল না ফুলের মত নিষ্পাপ কোন কচি শিশুর তুলতুল দেহে মায়ের
শরীরের উষ্ণতা বিলোবার অধিকার। বিয়ের দীর্ঘ ছ’বছর পরেও বোধিসত্বকে বাবা হবার তৃপ্তি এনে দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সে।
সম্প্রতি ডাক্তারের শেষ রিপোর্টের কথাটাও বোধিসত্বের কাছ থেকে পরিবারের সবাই
জেনে গেছে। ফলে শেষ আশাটুকুও ছেড়ে দেওয়া শশুরবাড়ীতে একসময়ের রূপেগুণে ‘নজরকাড়া’ বৌয়ের আদর আজ প্রায়
শূন্যের কোঠায়। এখন গ্রামের বাড়ীতে যাবার কথা উঠলে রীতিমত আতঙ্কিত হয় অরুণিমা। আর
কখনো যেতে বাধ্য হলে সংকোচ আর অপরাধবোধ থেকে সবসময় ভয়ে কুঁকড়ে থাকে।
শহরের বাড়ীতে বাচ্চা পাবার আধুনিক সব পদ্ধতির খবর অরুণিমা যে পায় নি এমন নয়।
কিন্তু ‘আই.ভি.এফ’ কিংবা ‘সেরগেশন’ ইত্যাদি বিপুল
ব্যয়বহুল সেসব পদ্ধতি যে একেবারেই তাদের সাধ্যের বাইরে তা বুঝতে সে এতটুকুও ভুল
করে নি। তাই একটিবারের জন্যেও এসব প্রস্তাবের কোন উত্থাপনই সে বোধিসত্বের কাছে করে
নি। শুধু আবদার করে বহুবার একটা কথাই বলত, “চলনা গো আমরা একটা বাচ্চা এডপ্ট করি, আজকাল তো ......”
কথা শেষ হবার আগেই প্রত্যেকবার কড়া ধমক খেয়েছে সে। “না, না, ওসব এডপ্ট ফেডপ্ট
করবার আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। বাচ্চা হয়নি, ব্যস্। ঈশ্বরের বিধান বলেই কিন্তু আমি এটাকে মেনে নিয়েছি। তোমাকেও তো কতবার
বলেছি, এই তো বেশ আছি। কত
লোকেরই তো সন্তান নেই, তারা সব্বাই কি এডপ্ট
করে?”
হ্যাঁ, এটাই ছিল বোধিসত্বের
বরাবরের জবাব। অরুণিমার মাতৃত্বের বিকল্প ইচ্ছেটা চরিতার্থ হবার পথে পতিদেবতার এই
বিরুদ্ধ অবস্থান একটা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও বাড়ীর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে
যে বেসরকারী অনাথ আশ্রমটি রয়েছে, মাসদুয়েক আগে সেখানে অরুণিমা খোঁজ নিয়েছিল। জানতে পেরেছিল তাদের হাতে একটা
পাঁছ-ছয় মাসের ছেলে-বাচ্চা আছে বটে, কিন্তু দত্তক দিতে হলে আশ্রমের তরফে সরকারের অনুমতি নিতে হবে এবং কিছু নিয়ম
কানুন মানতে হবে। তাই কমপক্ষে মাসখানেক সময় চাই। অরুণিমা কথা আদায় করে এসেছিল
সময়মতো ওরা তাকে খবর দেবে।
দু'দিন আগে আশ্রম থেকে
ফোন পেয়েছে অরুণিমা। দত্তক নিতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বামী-স্ত্রী মিলে
লিখিত আবেদন ও অঙ্গীকারপত্র সহ সেখানে হাজির হতে হবে। তাই সেই রাতের শেষেই যখন
ভোরের বিছানায় বরের আদরে হারিয়ে যাবার মুহূর্ত প্রায় উপস্থিত, ঠিক তখনই নিটোল
ভালবাসার নিখুঁত ভঙ্গীর সাথে তোষামোদের ক্রিম মিশিয়ে অরুণিমা বোধিসত্বের কানে অনেক
সতর্কতার সাথে সেই পুরনো কথাটা পাড়ল, “আমি জানি তুমি এভাবে বাবা হতে চাও না, কিন্তু দেখো, কতজনই তো বাচ্চা এডপ্ট
করে কত ভাল রয়েছে। তাদের মতোই রাজী হয়ে যাও না, লক্ষ্মীটি!”
--- আরে দূর সেসবের কোন
প্রশ্নই উঠে না।
--- কিন্তু কেন প্রশ্ন উঠে
না বলবে তো!
--- না, না, আমি ওসব পতিতা
ফতিতাদের বাচ্চার বাবা হতে পারব না।
--- তোমাকে কে বলল ওরা
সবাই পতিতাদেরই বাচ্চা হয়?
--- কাউকে বলতে হয় না, সেটা নিজেই জানার
বিষয়।
--- কি? কি জানো তুমি? হ্যাঁ গো, মনে কত কষ্ট আর দু:খ
নিয়ে কোন জন্মদাত্রী মা তার বাচ্চাকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় তা বোঝ? মায়ের মনের ব্যথাটাকে
অনুধাবন করতে পারো না কখনো?
--- কি? কি বলতে চাও তুমি? তোমার জন্যে আমাকে শেষ
অব্দি নষ্ট মেয়ের বাচ্চার বাবা হতে হবে? তোমাকে ভালবাসি বলে কি .....
--- নষ্ট মেয়ে, নষ্ট মেয়ে- কথাটা
দেখছি তোমার শিরায় মিশে গিয়ে তোমাকে একেবারে গ্রাস করে বসে আছে! বলি, আর কোন কথা শোনার বা
বিচার করার মত কিছুই কি বাকী রাখ নি?
--- ও মাই গড! পরের
বাচ্চার মা হবার তীব্র আকুতিতে আজকাল বেশ বড় বড় কথা বলাও শিখে গেছ দেখতে পাচ্ছি।
শেষ অব্দি আমাকেও জ্ঞান দেয়া হচ্ছে!
--- ছি, রাগ করো না লক্ষ্মীটি।
তোমাকে আমি কখনো শেখাতে পারি? তোমার জীবনে আসার পর থেকে তোমার কাছ থেকে কি না পেয়েছি? ভরসা, বিশ্বাস, প্রেম-ভালবাসা, সহানুভূতি, সংসারের জটিল
মুহূর্তগুলিকে সরল করে চলবার মূল্যবান পরামর্শ আর সহায়তা! কার ভাগ্যে এতসব জুটে গো, বলতে পারো?
ভোরের রাগে-অনুরাগে গড়ানো এই সময়ের দু'টি বিপরীত ভাবনার ব্যবধানটা বোধিসত্ব আর অরুণিমাকে একসময় দু'জনের অজান্তেই
পরস্পরের শরীর থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। এবার অরুণিমা আবারো নতুন করে বরকে ঘনিষ্ট হয়ে
জড়িয়ে ধরে। মুখের একেবারে কাছে মুখ নিয়ে বলে, “প্লীজ, রাজী হয়ে যাও না গো,
শুধু আমার জন্যে, প্লীজ!”
বোধিসত্ব বহুদিন মনে মনে চেয়েছে অরু নিজে থেকে তাকে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমু খাক, কিন্তু আজ অব্দি
কোনদিন একবারের জন্যেও তা আদায় করতে পারে নি; বোধিসত্ব নিজে তা করতে চাইলে অরুণিমা তাতে সাড়া দিয়েছে শুধু। বোধিসত্বের কেন
মনে হল আজ বোধহয় তার বহুদিনের সেই ইচ্ছে সফল হতে পারে। সে ইশারায় তা চেয়েও বসল।
কিন্তু আশ্চর্য, অন্য অনেক দিনগুলোর
মতই অরুণিমা আজো সে পথে গেলই না। বোধিসত্ব বেশ বুঝতে পারে, তার অরু মা হতে চাইছে ঠিকই, কিন্তু এখনো না আসা সেই সন্তানকেও শুধু একটা চুমুর দামের মত সস্তা বানাতে দিতে
রাজী নয় সে। মনে মনে স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে যায় বোধিসত্বের। কিন্তু
বাইরে সেই দুর্বলতা দেখাবার মত উদারতা এই পুরুষশাসিত সমাজ যে তাকে এখনো শেখায় নি!
তাই তার নির্লিপ্ত জবাব-
--- ঠিক আছে, তোমার যখন এত ইচ্ছে, পরের ছেলের মা তুমি
খুব হও গে যাও। যাও, কালই নিয়ে এস আশ্রমের
সেই অনাথ ছেলেটিকে, যার কথা গত ক'দিন ধরে শুনতে শুনতে
আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। সই ফই যা কিছু করতে হয় তা করে দেব। কিন্তু স্পষ্ট
জেনে রাখ, আমি কিন্তু কারো বাবা
ফাবা হতে পারব না, এই বলে রাখলাম, হ্যাঁ।
--- ও মা, সে কি কথা? তেমন আবার হয় নাকি? আমি মা হব, আর তুমি বাবা হবে না?
--- এসব বাচ্চাদের শুধু মা-ই থাকে, বাবা থাকে না, মানে বাবার কোন ঠিক
থাকে না আর কি।
--- লক্ষ্ণীটি, এসব উল্টোপাল্টা কথা
না বলে সরাসরি রাজী হয়ে যাও, প্লীজ্!
অরুণিমার সুন্দর দু’টো ডাগর চোখ সেই
মুহূর্তে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। বোধিসত্বের বহুদিনের চেনা অরুণিমার
তারুণ্যোচ্ছল সমর্পণের এই ভঙ্গীতে তার পক্ষে অটলব্রতী নির্বিকার পুরুষ সেজে থাকাটা
সত্যিই ছিল খুব কষ্টের। অথচ পুরুষোচিত জিদ বজায় রেখে সে আবারো যান্ত্রিক অনুমতি
দেবার মতো বলে বসে, “বললাম তো কালই নিয়ে
এসো, কিন্তু সব ঝামেলা তুমি
নিজে সামলাবে। শুধু খরচাপাতি ছাড়া পরের বাচ্চার আর কোন ভালমন্দয় আমাকে আশা করো না।”
অরুণিমা জানত এসব হ'ল স্রেফ বোধিসত্বের
জিদের কথা। তাই একথার পর বসে থেকে সময় নষ্ট করার ভুল সে আর করে নি। ঠিক পরদিনই
ছুটীর দিন শনিবারে অর্থাৎ গতকাল বোধিসত্বকে নিয়ে চলে গেল সোজা অনাথ আশ্রমে। একগাদা
কাগজে অরুণিমার সইয়ের পাশে বোধিসত্বও সই করল। তার সাফ কথা- শুধু বৌকে ভালবেসেই
এইসব করছে সে। কিন্তু কারো বাবা ফাবা সে হতে পারবে না, তার এই ফয়সালার কিছুতেই কোন পরিবর্তন সম্ভব নয়।
অরুণিমার জন্যে আশ্রম আগে থেকেই কাজ অনেকটা এগিয়ে রেখেছিল। তাই সেদিন বিকেলেই
ওদের হাতে বাচ্চাটাকে তুলে দেয়া হয়। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে তার নতুন মা বিরাট
তৃপ্তি নিয়ে বাসায় ঢুকে। কিন্তু একটা মাত্র দিন না যেতেই আজ এ কোন্ পরিস্থিতি
তৈরী হ'ল? ক্রমাগত কেঁদে যাওয়া
বাচ্চাটা ক্লান্ত হয়ে মাঝে একটু চুপ হয়েছিল, কিন্তু আবার তার বিকট চীৎকারে চারদিকে একেবারে হৈ হৈ কাণ্ড! এমন কান্না সে এই
ক'মাসের জীবনটায় আর
কখনো কাঁদে নি বুঝি! আনাড়ি মা নানা ভঙ্গীতে ছেলেকে থামাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু
মুখে গুঁজে দেয়া দুধের বোতলের নিপল বারবার অস্বীকার করছে ছেলে।
মাঝে মাঝে অরুণিমা তার নির্দুধ স্তনের বোঁটায় ছেলের ঠোঁটের স্পর্শ লাগিয়ে
শান্ত করবার চেষ্টা করলে সে আরো দ্বিগুণ ক্ষেপে যাচ্ছে। কি করবে ভেবে পায় না
অরুণিমা। সে জানে চোখের সামনেই পাশের ঘর থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করা নির্বিকার
বোধিসত্বকে বলেও কোন লাভ নেই। এদিকে বাচ্চাটার উপর প্রচণ্ড রাগ হয় বোধিসত্বের। তার
মনে হয়- বাচ্চাটা নতুন মায়ের যাবতীয় দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে না তো? অরুর জন্যে তার নতুন
করে খুব মায়া হয়। কি দরকার ছিল এসব ঝামেলা বাঁধাবার? না জানা বাপের কোন্ বেজন্মা বাচ্চা, আসল বাপ-মায়ের উপর ক্ষোভের ঝালই কি সে আজ তার অরুর উপর ঝাড়ছে?
পড়শীদের কাউকে বলে কয়ে আজই একটা কম বয়সী বৌকে বাড়ীতে ডেকে এনে কিছু কাজ
করাচ্ছিল অরুণিমা। বোধিসত্ব শুনেছে তার একটি দুধের শিশুও রয়েছে। পাশের বাড়ীর
মালিকানীর অনুমতি নিয়ে তাদের বড় উঠোনে কিছু কাঁথা সেলাইয়ের কাজে তাকে বসিয়ে
দিয়েছিল অরুণিমা। চীৎকারের চরম মুহূর্তটায় বাচ্চাটাকে বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে
শুইয়ে দিয়ে বৌটিকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেল সে- বোধহয় বৌটির সদ্য পাওয়া নির্ভেজাল
মাতৃত্বের সাহায্যের প্রত্যাশায়।
সদ্য মা হওয়া বৌটির পরিপূর্ণ স্তনের দিকে যে কারো, বিশেষতঃ কোন পুরুষের চোখ পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। বোধিসত্বেরও পড়েনি তা
নয়। “সর্বনাশ! এই বাচ্চাটাকে
ঐ বৌটির বুকের দুধ ফুধ কিছু খাওয়াবার আবেদন করবে না তো অরু?” বোধিসত্ব আতঙ্কিত হয়।
কিন্তু সেটা সে মেনে নেবে কি করে? বাচ্চাটা বোধিসত্বের কেউ নয় বটে, কিন্তু সে তো এখন তার অরুরই ছেলে- অনেক আশা নিয়ে যে অরু তার যথার্থ মা হতে
চাইছে। না, না, অন্য কাউকে দিয়ে তাকে
বুকের দুধ খাওয়ানো ...?
কিছুতেই নয়!
বোধিসত্বের ভাবনা আর গড়িয়ে যাবার সুযোগ পায় না। অরুণিমা চলে যেতেই বাচ্চাটা
কাঁদতে কাঁদতে হামাগুড়ি দিয়ে বোধিসত্বের রুমটার খুব কাছে চলে আসে। বোধিসত্ব ঘর
ছেড়ে চলে যেতে চায়, কিন্তু পেরে উঠে না।
পার্টিশনের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে আবার বাধাগ্রস্ত হয়। বাচ্চাটা আদ্ধেক দরজা ছাড়িয়ে
এসে প্রায় ওর ঘরেই ঢুকে যাচ্ছে। পিঠে হাত দিয়ে বাচ্চাকে সরাতে যাবে এমন সময় এক
অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। বাচ্চাটা ছোট্ট দুটি হাতে বোধিসত্বের পা দুটিকে জড়িয়ে ধরে তার
গায়ে জোরে সেঁটে থাকে। বোধিসত্ব নিশ্চল হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে। বাচ্চাটার
ছলছল চোখ দুটিতে চিকচিক করছে বড় মায়াময় এক হাসির ঝলক! সমস্ত কান্না তার কোথায় যেন
উধাও!
কাণ্ডের এখানেই শেষ নয়। এবার বাচ্চাটি বোধিসত্বের পা দুটিকে খুঁটীর মত
ব্যবহার করে ছোট্ট দুটি হাতের মুঠো উপর দিকে তুলে ধরতে চাইছে। বোধিসত্ব বেশ বুঝতে
পারে বাচ্চাটা তার হাত ধরতে চাইছে। সে কি দুর্নিবার সংগ্রাম সেই ক্ষুদে সৈনিকটির!
বোধিসত্বের হাতের নাগাল না পাওয়ায় তার পায়ের মাংসপেশীতে বাচ্চাটার ধারালো নখের
আঁচড় লেগে যাচ্ছে। হয়ত আর কিছুক্ষণ এমন চললে পরনের লুঙিটাতেই টান পড়বে। বোধিসত্ব
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয়। লুঙিটা ঠিক করতে উদ্যত হতেই বাচ্চাটা তার পায়ের থেকে
আলতো হয়ে গিয়ে দুম্ করে মেঝেতে পড়ে যায়, আর অসহায়ভাবে আবারো কেঁদে উঠে। বোধিসত্ব ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়।
--- আ:! খুব লাগল, তাই না? কাঁদে না, কাঁদে না, এই তো তুই, এক্কেবারে আমার কোলে।
নতুন মা-টা ভীষণ দুষ্টু,
তাই না? তোকে ফেলে কোথায় চলে
গেছে ! কাঁদে না সোনা, একদম কাঁদে না। নতুন
মা এলে ভীষণ ভীষণ বকে দেবো খ’ন!
বাচ্চাটা আবার ছলছল চোখের হাসিতে বোধিসত্বের সমস্ত সত্তায় এক অনির্বচনীয়
আনন্দের শিহরণ জাগিয়ে দেয়। নিজের অজান্তে কখন যে বাচ্চাটাকে তার ‘সোনা’ বানিয়ে ফেলেছে
বোধিসত্ব!
ঠিক সেই সময় অরুণিমা কাজের বৌটিকে সাথে করে ফিরে আসে। বোধিসত্বের কোলে তার
শান্ত ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে অরুণিমার কোথায় আশ্চর্য হবার কথা, কিন্তু সে শুধু এক পলক
সেদিকে তাকিয়ে থেকে নির্বিকারভাবে বৌটিকে বলল, “যা তো, তুই গিয়ে বারান্দায় রাখা পুরনো দোলনা থেকে আজে বাজে জিনিসগুলো সরিয়ে ওটা খালি
কর্ গে। আমাদের সোনামণি এখন তার বাবার হাতে দোলনা চড়বে”।
বোধিসত্বের মনে পড়ে যায় প্রথমবার প্র্যাগনেন্সির সময় প্রায় তিন মাস নির্বিঘ্নে
পেরিয়ে যাওয়ার পরে সে আগেভাগেই একটা দোলনার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। পরে পরপর বেশ ক'বার 'অ্যাবরশন'- এর দুর্ঘটনাগুলি ঘটে
যাওয়ায় বারান্দায় রাখা দোলনাটা দীর্ঘদিন ধরে আজেবাজে জিনিসপত্র রাখার একটা বাক্সের
মতো ব্যবহৃত হচ্ছিল।
এইমাত্র অরুণিমার মুখে নির্দ্বিধায় উচ্চারিত ‘বাবা’ শব্দটা বোধিসত্ব স্পষ্ট শুনল বটে, কিন্তু সেটা কাকে উদ্দেশ্যে করে বলা তা নিয়ে জেরা করার আর কোন প্রয়োজন সে অনুভব করল না। শুধু গররাজী হয়ে ঘরে তোলা পরের ছেলেকে কোলে নিয়ে সে নিজেই বাইরে দোলনার খোঁজে এগিয়ে গেল। তার মনে হল, ঘরের দমবন্ধ আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আজ যেন বহুদিন পরে সে এক মুক্ত বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছে। তবে কি আজ সে আসলে নিজের ছেলেরই বাবা হয়ে উঠল? এও কি সম্ভব? কুসংস্কারে বিশ্বাসী বোধিসত্ব বাইরে কোন টিকটিকির ‘টিক টিক’ শব্দ শুনতে পেল না বটে, কিন্তু নিজের বুকের ভেতরে সেটার খুব কাছাকাছি স্পন্দনধ্বনির একটা আশ্বাসবাণী শুনতে তার কোন অসুবিধে হল না।
0 মন্তব্যসমূহ