
এবং কপিল ও আভারানি
স
কালের দিক। ঘড়িতে সাতটা পনেরো কুড়ি হবে। বাঘাযতীন আর গড়িয়ার মাঝখানে রেল
লাইনের পাশের সারি সারি বস্তির ছিঁড়ে ফেটে যাওয়া ঘুমের ছোটো বড়ো টুকরোগুলোর
বেশিটাই তখনও ঝুলছে, দুলছে। টুকরোগুলোর কিছু কিছু ঝরলেও পুরো ঝরে পড়েনি।
কারও দরজা একেবারে বন্ধ। কারও বা আধখোলা। পেচ্ছাপ-টেচ্ছাপ সেরে ফের আরেক দফা
খুচরো ঘুমের তোড়জোড়। কোনো কোনো দরজার বাইরে তোলা উনুন ধোঁয়া ওগরাচ্ছে। যাদের
সকালে রান্না করে খেয়েদেয়ে বেরোনোর সময়ে টান আছে, তারা চানটান আর রেডিমেড খাওয়া
সেরে এখন কাজকর্মে বেরিয়ে পড়ার মুখে।
কপিল আর আভারানি বেরোবার জন্য প্রায় তৈরি। তবে আভারানির তৈরি হতে যত সময় লাগে
তার চেয়ে কপিলের একটু বেশি দেরি হয়, কেননা সে অন্ধ। অন্যদিকে, যদিও আভারানির
একটা হাত পোলিওতে প্রায় নুলো। সে হাতে তেমন জোর পায় না, তবুও কপিলকে সে সাহায্য
করে কিছুটা। বাকিটা কপিল নিজের অভ্যাসের হাত ধরে তৈরি হয়ে যায় বেরোবার
জন্য।
দুজনেই লঙ্কা পিঁয়াজ দিয়ে মাখা বাসি আলুসেদ্ধ আর পান্তাভাত খেয়ে নিয়েছে। কপিল
হল পুরুষমানুষ, তাই বাড়তি হিসাবে একটা ডিমসেদ্ধ তার খাওয়া উচিত বলে মনে করে -
খেয়েও ছিল। আভারানি অবশ্য সেদ্ধ করার সময় দুটো ডিম নিয়ে সেদ্ধ করে রেখেছিল। খুব
চুপি চুপি একটা সেঁটেও দিয়েছিল। কিন্তু কপিল কীভাবে যেন শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা
ঠিক টের পেয়ে গেছিল। বিরক্ত হয়েছিল বেশ -
‘তুই তো দেখছি খেয়ে খেয়েই আমাকে ফতুর করে দিবি। ঘরের মেয়েছেলের এত বেশি নোলা
থাকা একদম ভালো নয়। তাতে লক্ষ্মীছাড়া দশা ধরে সংসারে। তার ওপর আপন স্বামীকে
লুইকে খাওয়া! - ছিঃ!’
অন্য সময় ‘তুমি’ বললেও রেগে গেলে কপিল আভারানিকে ‘তুই’ করে বলে। কিন্তু
পুরুষমানুষের সব কথায় সব সময় কান দিলে চলে না। তার উপর কপিল অন্ধ। এরা এমনিতেই
একটু রাগী ধরনের হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রায়ই এভাবে আভারানি খুচখাচ গোপন খাওয়া খায়।
না খেয়ে পারে না সে। তার একটু বেশি বেশি খিদে পায়।
ডিমের ঝুড়িটা নিচে নামানোই থেকে গিয়েছিল। তাড়াহুড়োতে ঝুড়িটা উপরের তাকে আর
তুলে রাখা হয়নি। হাতের কাছে ঝুড়িটা পেয়ে মনে হয় হাতড়ে হাতড়ে ডিমের হিসেব করেছে।
না হলে মিনসের সাধ্যি কী যে এসব টের পায়? কপিলের বাজে কথাগুলো একদম খেল না
আভারানি। বরং ভেজা ভেজা গলায় তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল -
‘আচ্ছা গো আচ্ছা। এবার থেকে আর তোমাকে লুইকে কখনও খাব না গো, - দেখে নিও। এখন
চলো না গো আমরা বেরিয়ে পড়ি। বেশি দেরি হয়ে গেলে কারখানার গেট তো বন্ধ হয়ে
যাবে।’
শান্ত হয় কপিল। আভারানির এই ঢলানিটুকু মন্দ লাগে না তার। আগের বউটা চুরি করে
খেত না বলে তার মনে হয়, তবে বড্ড কাঠ কাঠ স্বভাবের ছিল বউটা। গায়ে গতরেও তাই,
একখানা চ্যালা কাঠের মতো। সেদিক দিয়ে ধরলে আভারানির শরীর উঁচুনীচু আছে আর
স্বভাবটাও বেশ নরমসরম। তাছাড়া আগেরটা ধরা বউ ছিল। কিন্তু আভারানি তার বিয়ে করা
একেবারে পাকাপোক্ত নিজের বউ।
কাজের মধ্যে
বস্তির আস্তানা থেকে বেরিয়ে ওরা ট্রেন ধরে প্রথমে শিয়ালদহ স্টেশনে যায়। সেখান
থেকে বিভিন্ন লোকাল ট্রেনের যে কোনো একটা ধরে চলে যায় মেন লাইনে বা বনগাঁ
লাইনে। কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, গেদে, বনগাঁ বা হাসনাবাদ লোকালে ওরা ভিক্ষে করে
সারাদিন। সাউথ সেকশনের দিকে বড়ো একটা যায় না ওরা। কারণ ওদিকের প্যাসেঞ্জাররা
বেশ কেপ্পন হয়, তেমন পয়সা ছাড়ে না।
কপিলরা ভিক্ষে করে জীবন চালালেও ঘরে বাইরে বা নিজেদের মধ্যে বা একই বৃত্তির
অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওরা কখনও ভিক্ষা করা কথাটা ব্যবহার করেই না।
তার বদলে ওরা আজকাল বলে - ‘কাজ করা’।
বস্তির প্রতিবেশিদের প্রায়ই শুনিয়ে আসে যে তারা দুজনেই একটা কারখানায় কাজ করে।
সেটা যদিও গোটাগুটি মিথ্যা, তবে এই মিথ্যা বলাতে কোনো দোষ নেই। সম্মান বাঁচাবার
জন্যই এসব বলা, অন্যকিছু কারণে তো নয়। তবু তো ওই বস্তির শিবেনকে গত সপ্তাহে
শনিবার শেষ রাতে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবার আগে কেউ জানতেই পারেনি যে সে আসলে
ট্রেনে ছিনতাই করে বেড়ায়, অথচ মুখে বলত কোন এক ঠিকাদারের কাছে নাকি সে
লেবার-মেটের কাজ করে।
যাই হোক ভিক্ষা করলেও নিজেদের ঠিক ভিখারি বলেও ওরা আজকাল ভাবে না। ভিক্ষা নয়,
ওরা ভাবে, ওরা অন্যের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকে। ওরা তাই লোকজনের কাছে ভিক্ষা
চাওয়ার বদলে সাহায্য করতে বলে। তবে তাদের মধ্যে অল্প কিছু খুব নীচুজাতের ভিখারি
আছে যারা এখনও নাকি সাহায্য না চেয়ে পাবলিকের কাছে ভিক্ষা চেয়ে বসে। এরা তাদের
খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এবং অতিশয় বাজে ধরনের করুণার চোখে দেখে।
ট্রেনে খুব গুঁতোগুঁতির ভিড়ের মধ্যে কাজ করা অসুবিধাজনক। প্যাসেঞ্জার বড্ড
বিরক্ত হয়। সেজন্য সকালের দিকটা কলকাতা অভিমুখী ট্রেন ওরা এড়িয়ে চলে। তেমনি
আবার বিকেলের পর থেকে শহরতলির অভিমুখে যাওয়া ট্রেনগুলোতে কাজ করে না। রোজগারটা
সকালের দিকে একটু বেশিমতো হয়। কারণ সকালের দিকেই মানুষের পুণ্যলাভ করার প্রবণতা
বেশি থাকে। বিকেলের দিকে রোজগারটা একটু পড়তির দিকেই যায়।
সেদিন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে ভেবেচিন্তে সকালের আপ শান্তিপুর লোকালে উঠে পড়ল
কপিলরা। কপিল কখনও খুব বেসুরো গলায় গান গায়, কখনও গান থামিয়ে তার মতো দুর্ভাগা
অসহায় অন্ধজনকে সাহায্য করতে বলে। আভারানি তার হাত ধরে ধরে নিয়ে ঘোরায় আর পয়সা
সংগ্রহ করে। গান গাইতে গাইতে কপিল তার দুই কান উঁচিয়ে কীরকম পয়সা পড়ছে সেটা
যথাসম্ভব আন্দাজ করার চেষ্টা করে।
কপিলের নির্দিষ্ট করে দেওয়া নিয়মমতো কোনো কামরা থেকে নামার আগে আভারানিকে সেই
কামরায় সংগৃহীত পয়সা কপিলের হাতে তুলে দিতে হয়। প্রত্যেকবারই আভারানি অল্প কিছু
সরিয়ে বাকি সব পয়সা তুলে দেয় কপিলের হাতে। দু’হাতের আঙুল বুলিয়ে কপিল
নিখুঁতভাবে পয়সাগুলো গুণে কোমরে বাঁধা থলিতে রেখে প্রত্যেকবারই আভারানিকে
সন্দেহ করে - মাগি কিছু সরায়নি তো?
আপ শান্তিপুর লোকালে কাজ করা শেষ হলে ওইটাতেই অর্থাৎ ডাউন শান্তিপুর লোকালে
ওরা আবার কাজ করতে করতে আসবে। তারপর সুবিধাজনক কোনো স্টেশনে নেমে সেখানে
দুপুরের আহার ও বিশ্রাম করে ওরা। বিশ্রামের পর অন্য লাইনে বা অনেক সময় একই
লাইনে আবার দু’তিনটে ট্রেনে কাজ করতে থাকে যতক্ষণ না সন্ধ্যা উঁকিঝুঁকি দিতে
থাকে।
সন্ধ্যার মুখে ওরা বাড়ি ফিরে আসে। সন্ধ্যায় ট্রেনে খুব ভিড় বেড়ে যায়। সেজন্য
রোজগারটা বড্ড ঝুলে যায়। তাছাড়া ওই সময়টাতে প্যাসেঞ্জারের মেজাজ মর্জি বেশ
খারাপ থাকে। সারাদিন কাজকর্ম করে ডেলি প্যাসেঞ্জারির ধকল সয়ে ফেরে কিনা, তাই
-’
কিন্তু কপিলও তো সারাদিন ভিড় ঠেলে ঠেলে কাজ করেছে। তারও তো ধকল হয়। তাও আবার
সে অন্ধ। কই তার তো প্যাসেঞ্জারের মতো মেজাজ খারাপ হয় না! সে সময় সাহায্য চাইলে
প্যাসেঞ্জার হারামজাদাদের মুখে লেগেই আছে -
‘মাপ কর। ওদিকে দেখ।’
‘চোপ্ শালা কেপ্পনের বাচ্চা!’ - মনে মনে গর্জে ওঠে কপিল - ‘দিবি না তো দিবি
না! আবার বলে মাপ কর! কক্ষনো তোকে মাপ করবই না শালা বান্চোত! কী করবি আমার? আর
ওদিকে দেখব কী কোন্ দিকে দেখব সেটা বলে দেবার তুই কে? আমার যেদিকে ইচ্ছা সে
দিকে যাব, তাতে তোর বাপের কী?...’
শালারা সব ফোতো কাপ্তান! বেশি ন্যাকড়াবাজি না করে দুটো পাঁচটা টাকা বার
করে কপিলকে দিয়ে দিলেই তো অন্ধকে দান করার পুণ্যিটা পেয়ে যাস। সেসব না করে কেবল
-’
গেনো বিশু
‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে -এ -এ -এ... শ্যামা মা কি আমার কালো
ও-ও-ও...’
নাঃ! সুরটা ঠিক মতো লাগলই না। বিশুর মনটা খুব খচখচ করতে থাকে। গান থামায় সে।
ভিক্ষের জন্য গান গাইলেও তার কানে সুর আছে। মনে লয় আছে, তাল আছে। আগে তার একটা
একতারা ছিল। শাদা লাউয়ের খোলের তৈরি খাঁটি একতারা।
একতারাতে সুরের গমকের সঙ্গে সঙ্গে লয় ও তালের একটা স্পষ্ট বাঁধন পাওয়া যেত।
গান বেসুরো বেতালা হত না। কিন্তু তার কপাল দোষে একদিন ট্রেনের ভিড়ের ধাক্কায়
গেল একতারাটা ভেঙ্গে। তারপর আর নতুন একতারা জোগাড় করাই গেল না। সবাই বলে ওসব
নাকি আর এখন চলে না।
তার উপর তার গলাটা কোনো কারণে, হয়তো অনাহারে অপুষ্টিতে খানিকটা বসে গেল।
তাছাড়া একতারার অভাবে আস্তে আস্তে তার গলাটা এখন ছাড়া পাওয়া ছাগলের মতো বড্ড
এদিক ওদিক করতে থাকে। তাতেও কাজ করাটা কোনোরকমে চলে যায় হয়তো। কিন্তু বিশুর মন
একটুও ভরে না, বড়ো খুঁতোয়।
কোনো গান বেসুরো বেতালা হলে স্পষ্ট বুঝতে পারে বিশু। কিন্তু উপায় নেই, পেটের
দায়। মাত্র একটা পা একটুখানি খোঁড়া বলে প্যাসেঞ্জারের সাড়াও কম পায় সে। তবু
শুধু গান গেয়ে ভিক্ষা করার জন্য গেনো বিশু নামটা তার থেকেই গেল। গেনো বিশু শুধু
গান গাওয়া ছাড়া ভিক্ষা চাওয়ার অন্য কোনো উপায়, যেমন অন্য কোনো হাত বা পা মিথ্যে
করে বেশি নুলো দেখানো বা অন্ধ সাজার কথা কখনও ভাবতে পারে না। যদিও তাতে
প্যাসেঞ্জারের বেশি দয়া হতে পারে, বেশি পয়সাও দিতে পারে। তবুও গেনো বিশু তা
কখনও করবে না।
মদনপুর স্টেশনে নেমে ট্রেনের বগি পালটায় বিশু। শান্তিপুর লোকালের পরের কামরাতে
উঠে ফের ওই শ্যামাসংগীতটাই জুত করে ধরে ছিল। এবারে পারতেই হবে এমন ভাব নিয়ে
স্থায়ীতে সামান্য এগিয়ে গিয়ে উদারার উপর দিকে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় তার গলাটা
হঠাৎ ঘ্যাঁস করে মুখ থুবড়ে পড়ে একেবারে থেমেই গেল, - এবারের কারণটা অবশ্য
আভারানি।
সকালের আপ শান্তিপুর লোকাল। ভিড় একটু পাতলার দিকে। মোটামুটি তাকানো যায় এমাথা
ওমাথা। চেষ্টা করলে দাঁড়ানো লোকজন দেখা যায়। ওরা সবাই জানে কাজ করার
পক্ষে এইরকম ভিড়ই সবচেয়ে সুবিধাজনক। বিশু উঠেছে কামরাটার একধারে। আভারানির নুলো
হাতটা ধরে তার পিছনে পিছনে কপিল সেই কামরার অন্যধারে উঠে তার খাঁদা বেসুরো
বেতালা গলায় সবে ধরেছিল গানটা -
‘আঁমায় এঁকটুঁ জ্যাঁয়গাঁ দ্যাঁও, মাঁয়ের মোঁন্দিরেঁ -এঁ-এঁ...’ হঠাৎ সে থেমে
গিয়ে বলল - ‘ওদিকে কোথাও বিশে শালার গলা পেলুম না? ফের তোর পেছনে ফেউ লাগতে
এল!’
আভারানির বুকের সব রক্ত তখন ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ে উতল। খুব চেষ্টা করে কোনোরকমে গলা
স্বাভাবিক রেখে সে বলে -
‘না না, এটা গেনো বিশু নয়। এই মালটা উটকো মাল মনে হচ্ছে। এলাইনে ওকে কখনও
দেখিনি।’
‘আমি তো এই কামরায় আগে উঠিছি! তা দেখেও কাজ করার নিয়মের বাইরে গিয়ে একই কামরায়
কাজ করতে উঠল ওই শালা উটকো মাল? ওর কাছে এক্ষুনি নিয়ে চলো তো! বান্চোতের
দেখাচ্ছি মজা! আমাদের বাঁধা লাইনে উটকো মাল ঢুকবেই বা কেন?’
‘আহা ছাড়ো না গো। সে তো তোমাকে দেখেই গান থামিয়ে দিয়ে কাজ করা বন্ধ করেছে।
একদম ওদিকের গেটের ধারে চলে গেছে। পরের স্টেশনেই নেমে উলটো দিকে চলে যাবে মনে
হচ্ছে।’
‘শালা সকালের দিকে আমার প্যাসেঞ্জারগুলো ঘেঁটে দিল। আজ কি আর ভালো কাজ করা
যাবে!’
গজ গজ করতেই থাকে কপিল। সকালের দিকের কাজটাই ভালো হয়। ওদিক থেকে দোনামোনা করে
নীরব বিশু এগিয়ে এসেছে এদিকে। কতদিন পরে আজ আভারানিকে সে দেখতে পেল। বিশুর দিকে
গাঢ় ইঙ্গিতে তাকিয়ে তাকে চুপ থাকতে বলে আভারানি।
আভারানির দিকে বিশু তাকিয়েই থাকে। আভারানির চোখে কত বিদ্যুৎ আছে ... কত গোলাপ
ফোটে আভারানির দৃষ্টিতে, কপিল তা জানে না - জানবেও না কোনো দিন। শুধু বিশু সেসব
জানে, ভালোমতে জানে। যেন নতুন করে জানল আবারও সে আজ। চুপ করে সে দাঁড়িয়ে পড়ে
আভারানির ইঙ্গিত মতো। তেতো গলায় কপিল আবার আগের গানটা হাতড়ায় -
‘আঁমায়ঁ এঁকটুঁ জ্যাঁয়গাঁ দ্যাঁও ...’
পয়সা তুলতে তুলতে দাঁড়িয়ে থাকা বিশুকে পেরিয়ে যাবার সময় ভিড়ের ছলে বিশুর গায়ে
তার ব্যাকুল বুক চেপে ধরে একটু দাঁড়িয়ে থেকে তারপর এগোয় আভারানি। বিদ্যুতায়িত
সে স্পর্শে মথিত বক্ষে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিশু। আভারানির সেই একান্ত
ঘনিষ্ট সপ্রেম আমর্শ দু’তিন মুহূর্তের জন্য হলেও সেই আকুল কোমল স্পর্শনে কত না
গোপন অশেষ কথা নিহিত আছে। কিছু বোঝা গেল। অনেক কিছুই না-বোঝা রয়ে গেল...
আভারানির নুলো হাতটার আঙুল ধরে থাকা অবস্থায় কপিল গান গাইতে গাইতে বিশুকে
পেরিয়ে যায়। বোকার মতো খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বোকার মতোই গুটি গুটি পায়ে ওদের পিছন
পিছন এগোয় বিশু। ঠিক কেন সে ওভাবে তাদের পিছনে যাচ্ছে তা বিশু নিজেই ঠিকমতো
জানে না। হয়তো যতক্ষণ পারবে আভারানিকে সে অবিরাম তার দুটো চোখে নিবিড়ভাবে মেখে
নিতে চায় বলে। আবার কবে যে আভারানির সঙ্গে তার দেখা হবে তার তো কোনো ঠিক
নেই।
আভারানি কপিলকে ছেড়ে দিয়ে তার কাছে আসবে না তা জানে বিশু। কেনই বা আসবে!
কপিলের বিয়ে করা বউ আভারানি। কপিল অন্ধ বলে রোজগারটাও তার ডবল হবে। গেনো বিশু
একাই থাকে তবু কখনও বউ জোগাড়ের চেষ্টা করেনি। মনের গহনে এখনও আভারানির আশা
ছাড়তে পারেনি সে।
অনেকদিন হয়ে গেল আভারানি কপিলের ঘরে চলে গেছে। তবুও কেন যে আভারানিকে দেখলেই
তার বুকে এভাবে হঠাৎ গমকল চালু হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ওঠে, জানে না সে।
কেন যে ট্রেনে উঠে প্রথমেই আভারানি উঠেছে কিনা, অন্ধ কপিলের খোঁনা কর্কশ গলার
গান শুনতে পায় কিনা সেটা দেখার বা শোনার সাগ্রহ চেষ্টাটা করতেই হয় তাকে, সেটা
ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি সে এখনও। হয়তো পারবেই না বুঝতে কোনোদিন। নিজের হৃদয়ের
অতলে যে কথা নিহিত থাকে সেকথার সবটাই কি বোঝা যায়!
দুপুরের বিরাম
তিন-চারখানা গাড়িতে কাজ করতে করতেই দুপুর গড়াতে থাকে বিকেলের দিকে। খিদেটাও
তেড়ে চাগাড় দিতে থাকে কপিলের। যাহোক কিছু এবার পেটে ভরে না নিলে আর কাজে তার মন
লাগে না। কপিল আর আভারানি এবার নেমে পড়বে কোনো একটা সুবিধাজনক স্টেশনে। কোথায়
কোন কোন স্টেশনের কাছে সস্তায় ভাত বা রুটি তরকারি পাওয়া যায় সেগুলো সব ওদের
মুখস্থ।
দুপুরের বা সন্ধ্যার খাওয়া-দাওয়ার ধরনটা নির্ভর করে সেদিনকার রোজগারের
পরিমাণের উপর। কপিল খুবই হিসেবি মানুষ। খুব সোজাসাপটা ধারণা নিয়ে চলে সে। যেদিন
ভালো রোজগার হবে সেদিন দুপুরে মাছ-ভাত খাওয়া হবে। যেদিন রোজগার কম থাকে সেদিন
ডাল-ভাত বা রুটি-তরকারি বা ছাতু-পিঁয়াজ খেয়ে চালানো হয়। সেদিন কপিলদের রোজগার
মোটের উপর খারাপ হয়নি। তাই সেদিন দুপুরে মাছ-ভাত খেয়ে নেবার জন্য পরের স্টেশনে
নেমে গেল তারা।
চাকদা স্টেশনের কাছে আনন্দময়ী হিন্দু হোটেলে খুব খিদে পেলেও দুপুরের খাওয়াটা
মোটেই শান্তির হল না আভারানির। খেতে বসে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিল সে। বিশুর
সঙ্গে প্রায় পঁচিশ দিন পরে আজ দেখা হল। শান্তিপুর লোকালে হঠাৎ বিশুর গলা পেয়ে
আজকেও তার বুকের সব রক্ত চমকে উঠে এধার থেকে ওধার পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে ভীষণ
দৌড়াদৌড়ি করছিল।
হোটেলের বেঞ্চিতে ইচ্ছে করে কপিলের থেকে একটু দূরে বসেছিল আভারানি। ক্ষুধার্ত
কপিল যথারীতি গপ্গপিয়ে খেয়ে যাচ্ছিল। আভারানি প্রায় হাত গুটিয়ে বসেছিল। অন্ধ
কপিল সেসব কিছু বুঝতে পারছিল না। দৃশ্যমানতার ব্যক্তিগত নিজস্ব স্বাধীন
জগৎটুকুর মধ্যে বসে আভারানি সামনে খাবারের থালা অষ্পৃষ্ট রেখে দিয়ে কেবলই
পুরোনো কথা ঘাঁটাঘাঁটি করছিল।
বড়ো সুন্দর ভরাট আর সুরেলা গলা ছিল বিশুর। একটু কালোর উপর মাঝারি চেহারা। ডান
পা-টা খোঁড়া। চমৎকার সুরেলা গলায় গান ধরলে কালোবরণ বিশুকে তখন বড়ো সুন্দর লাগত।
অন্ধ মায়ের হাত ধরে তখন ট্রেনে ভিক্ষে করত বাড়ন্ত কিশোরী আভারানি। ট্রেনে বিশুর
গান শুনে আর বিশুকে দেখে আভারানির চোখে ঘোর লেগে গিয়েছিল। তার খুব ভালো লেগেছিল
বিশুকে আর বিশুর গানকে। আস্তে আস্তে গানের থেকে গায়কই বেশি করে তার কিশোরী মনের
দখল নিয়ে ফেলেছিল।
আভারানির মা কালীদাসীর চোখ ছিল না। তাই তার জীবনে কাউকে দেখে চোখে ঘোর লাগার
কোনো ব্যাপারই ছিল না। আভারানির একচোখওলা বাপকে সে রোজগার দেখে বিয়ে করেছিল।
তাছাড়া সে আবেগহীনও ছিল বটে। কিন্তু তার বুদ্ধি ছিল যথেষ্টই। তাই অন্ধ হলে কী
হবে ঠিক টের পেয়ে গেছিল মেয়ের হেলন-দোলন। কিন্তু বিশুকে পাত্র হিসেবে মোটেই
পছন্দ নয় তার।
কারণ গেনো বিশু একপায়ে খোঁড়া। ক্রাচ দূরে থাক চলাফেরা করতে গিয়ে একটা লাঠি
পর্যন্ত লাগে না তার। ওকে দেখে পাবলিক তো পয়সা ফেলবেই না তেমন। ভালোমতো দু-পায়ে
খোঁড়া হলে নাহয় বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখা যেত। তাছাড়া ভালো গাইয়ে হলেও এ লাইনে
আরও ঝামেলা। কোনো কারণে বা এমনি গাইতে গাইতে গানের গলা নষ্ট হয়ে গেলেই রোজগার
একেবারে তলানিতে চলে যাবে।
অন্যদিকে কপিল পুরো অন্ধ। আগে অবশ্য একটা ধরা বউ ছিল তার। বেশ কিছুদিন হল সেটা
একেবারে কেটে গেছে। অবশ্য কপিলের বয়স আভারানির থেকে অনেক বেশি। সে হোকগে, অত
দেখলে চলে না। ট্রেনের কামরায় হাত ধরে ঘোরানো আর সংসার চালানোর জন্য একটা
চোখওলা বউয়ের খুব দরকার কপিলের। কয়েকজনের মাধ্যমে আভারানির কথা শুনে কপিল তাকে
বিয়ে করার জন্য লাইনের অন্য ভিখারীদের মাধ্যমে কালিদাসীর কাছে কথা চালাচালি
করছিল।
কালীদাসী নিজে অন্ধ। সে জানে অন্ধকে অনেক সময় লোকে ডেকে পয়সা দেয় বেশি পুণ্যি
কেনার জন্য। সুতরাং অন্ধ কপিলের হাত ধরে ঘোরানোর লোক থাকলে তার রোজগার কতটা হতে
পারে সে বিষয়ে কালিদাসীর স্পষ্ট আন্দাজ ছিল। তাছাড়া ওদিকে বিশু আবার পুরো
চোখওলা। পোলিওতে বাঁ হাত নুলো হয়ে যাওয়া আভারানিকে কতদিন তার দেখতে ভালো লাগবে
সে বিষয়েও কালিদাসী ঘোর সন্দিহান ছিল।
এই সব ব্যাপারে মেয়ের যথাসম্ভব মগজ ধোলাই করে, প্রায় জোর করে কপিলের সঙ্গেই
তার বিয়ে দিয়েছিল কালিদাসী। কিন্তু এবার তার নিজের হাত ধরে ঘোরানোর লোকের অভাব
হয়ে গেল। রোজগারের কিছু বখরা পেলে একাজ করার লোক মিলে যায়। কালিদাসী সেই চেষ্টা
করছিল। কিন্তু পছন্দমতো লোক পাবার আগেই মেয়ের বিয়ের মাসচারেক পরে কালিদাসী
একদিনের হঠাৎ জ্বরে মারা গেল। এদিকে আভারানি হয়তো খুব অভাবে পড়ল না, কিন্তু ঠিক
সুখী হতেও পারল না। কারণ বিশু তার অনেকটা জুড়ে থেকে গেল অনেকটা দূরে
থেকেও।
খাওয়া সারা হলে ঘন্টাখানেকের জন্য বিশ্রাম নেয় কপিল। তা নাহলে পেটের ভাতটাত
কিছুতেই হজমের গর্তে বসে না, পেটের মধ্যে চরে বেড়ায়। ভাত চরে বেড়ালে বদহজম,
গ্যাস, অম্বল - এসব হবেই হবে। এসব ব্যাপার কপিল ভালোভাবে জানে বলে মোটেই
হেলাফেলা করে না। পেটের ভাত যাতে চরে না বেড়িয়ে পেটে হজমের গর্তে ঠিকমতো বসে
যায় সেজন্য খাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় সে।
যে স্টেশনে খাওয়া দাওয়া হয় তার কাছাকাছি কোনো গাছের তলার ছায়ায় বা মন্দিরের
চাতালে ওরা বিশ্রাম নেয়। বেশির ভাগ সময় কপিল ভিক্ষালব্ধ মুদ্রাগুলো তখন সাবধানে
গোনে। একবার গুনে সন্তুষ্ট না হলে দুবার গোনে। কতটাকা খরচ হল সে হিসাবও করে।
আয়ের পরিমাণ কম মনে হলে বিড় বিড় করে গালিগালাজও করে প্যাসেঞ্জারদের। এভাবেই তার
বিশ্রামের সময়টা কাটিয়ে দেয় সে।
আভারানি সে সময়টা খানিক তফাতে বসে বসে বা কোনোকিছুতে হেলান দিয়ে ঝিমোয়। আর
মাঝে মাঝে প্যাসেঞ্জারদের গালিগালাজ করতে থাকা কপিলকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
একফাঁকে খুব সাবধানে যাতে শব্দের বাষ্পটুকুও না ওঠে সেভাবে সরিয়ে রাখা পয়সাগুলো
সেও গুনে নিয়ে পেটকোঁচড়ের ভিতরে ঢোকায়।
সেদিন প্রায় অভুক্ত আভারানি ঝিমোলো না। কপিলের কানের আড়ালে সরানো মুদ্রাগুলোও
গুনলো না। উদাস চোখে খানিক দূরের একটা সজনে গাছের ডালে বসা একজোড়া বুলবুলি
পাখির দিকে অন্যমনস্ক চোখে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ ধরে।
গেনো বিশু বেশ রোগা হয়েছে। কী হয়েছে তার? কোনো অসুখ বিসুখ? খাওয়া দাওয়ার খুব
অভাব? বিয়ে তো করলই না তার জন্য! কে রান্না করে দেয় কে জানে? কেউ দেয় না হয়তো।
রাতে খায় তো? শুকনো মুড়ি বা চিঁড়ে হয়তো খায়। খাওয়ার জন্য কেউ তো জোর করবার নেই!
না খেয়েই হয়তো রাতে শুয়ে পড়ল! ...আভারানি বড়ো বিক্ষত হতে থাকে।
রাত যেমন আসে
সন্ধে নামলে আর ওদের কাউকে কাজ করতে দেখা যায় না। সারাদিনের শ্রম, ক্লান্তি আর
সেই সঙ্গে কাজ করার নানা অসুবিধার জন্য ওরা ফিরে আসে যে যার আস্তানায়। গেনো
বিশুর মতো একা একা অথবা কপিল-আভারানির মতো দুজনে - যাই হোক না কেন।
আভারানি ফিরে এসে হাতমুখ ধোয়। শাড়ি ছেড়ে একটা নাইটি পরে নিয়ে রোজকার মতো
রান্নায় বসে। আজ রাতে ভাত আর আলু-পটলের ডালনা। কপিল হাতড়ে হাতড়ে খানিকটা আনাজ
কুটে দেয়। আভারানি দেড়-খানা হাতে অবশ্য অনেক কাজই করতে পারে।
কপিলের চোখ নেই বলে স্বাভাবিক কারণে অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো কিছুটা বেশি
সক্রিয়। সব অন্ধদের অনুভব ক্ষমতা তাই বেশি হয়ে থাকে। কপিল অনুভব করেছিল আভারানি
আজ একটু চুপচাপ হয়ে গেছে। এর আগে কথাটা জিজ্ঞেস করবে বলে করা হয়ে ওঠেনি। এখন
জিজ্ঞাসা করে। মন ভালো থাকলে কপিল আভারানিকে ‘তুমি’ করে বলে -
‘কি গো, তোমার শরীল গতিক ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ। ক্যানো?’
‘না, মানে ক্যামন এট্টু ঝিইমে আছ বলে মনে হচ্ছে।’
‘ঠাণ্ডা লেগে গলায় বড্ড ব্যথা হয়েছে - কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘অ-অ।’
কপিল চুপ করে যায়। হতে পারে গলায় ব্যথা। আবার বিশে শালার সঙ্গে হয়তো দেখা
হয়েছে, সেজন্যও মন খারাপ হতে পারে। যাকগে এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা ভালো নয়।
দরকারই বা কী? আভারানি তার বিয়ে করা একদম পাকাপাকি বউ। আগের মতো ধরা বউ নয়।
বিশুর সাথে কোনো রকম ফষ্টিনষ্টিও করে না। তাহলে শুধুই যদি মন খারাপ করে তো করুক
না। এই নিয়ে বেশি কচলালে যদি আভারানি তাকে ছেড়ে চলে যায় - এ ভয়টাও যথেষ্ট আছে
কপিলের।
বিশুর ওপর আভারানির একটা চাপা গভীর অভিমান আছে। আভারানি যে বিশুকে খুব পছন্দ
করে – তাকেই চায়, এটা কিন্তু বিশু জানত। অথচ একবারও সে আগ বাড়িয়ে কোনোদিন
আভারানিকে চায়নি বিয়ে করতে। বিশুর চোখের সামনেই কপিলের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল।
অথচ বিশু একবারও একটা কথাও বলল না, - না আভারানিকে, না তার মা কালিদাসীকে।
কালিদাসী অবশ্য বেশ মুখরা ছিল, তবু একবারটি মুখ ফুটে তাকে বলতে কী দোষ ছিল?
তারপর তো আভারানি যা করার সে তো করত। অন্তত করার সুযোগ পেত।
কালিদাসী অবশ্য মেয়ের মনে ভালোমতে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে তার নুলো হাত নিয়ে
অন্ধ কপিলের কোনো মাথাব্যাথা থাকবে না। কিন্তু চোখওলা বিশু নুলো হাতওলা বউ এর
সঙ্গে কিছুতেই বেশি দিন ঘর করবে না। তাছাড়া কপিল সচ্ছল, কিন্তু বিশু
অভাবী।
মায়ের সেসব কথা সেদিন সব যে পুরো বিশ্বাস করেছিল আভারানি তা নয়। আজও যে করে
তাও নয়। তবুও এখন কী কারণে সে অন্ধ কপিলকে হঠাৎ করে ছেড়ে বিশুর কাছে চলে যাবে,
- বিশেষ করে বিশু তাকে না ডাকতেও? অন্ধ মানুষটা এমনিতে তো মন্দ নয়। তাকে মারধর
বা গালিগালাজ কখনও তো করে না? তবে...?
শতধা বিক্ষত আভারানি তবুও ভাবে, বিশু যদিও তাকে বিয়ে করতে এগিয়ে আসেনি - না
এলেও, বিশু যদি কোনোদিন এসে তাকে চায় তাহলে সে তার সবটুকু উজাড় করে বিশুকে দিয়ে
দিতে পারবে একটুও দ্বিধা না করে। কেন যে সে এটা করতে পারবে না জানে না আভারানি।
তবে সেটা সে পারবে -পারবেই।
রাত ঘষটে ঘষটে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একসময় বিমনা আভারানি বিছানায় আসে। কপিল
আগেই শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে এখনও ঘুমোয়নি। আজকের শান্তিপুর লোকালে যে ব্যাটা
গান ধরেছিল সে হারামিটা মনে হয় গেনো বিশুই হবে। নাহলে তার পর থেকেই আভারানি অমন
ঝিম মেরে গেল কেন?
মাঝে মাঝে অকারণেই কপিলের মনে হয় গেনো বিশুর সঙ্গে আভারানির খুব গহন গোপন কিছু
একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু সেটা যে কী হতে পারে তা কপিল অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে
পারেনি। বুঝতে পারে না বলে তার রাগমতো হয়। গেনো বিশুর কোনো কথাই কোনোদিন
আভারানি কখনও তোলেনি। তবুও অজানা এক কারণে গেনো বিশুর উপর তার একটা দুর্বোধ্য
আক্রোশ আছে।
যাই হোক, বিশে শালাই যদি আজ আভারানির মন খারাপের কারণ হয়েই থাকে তবে সেটা
কপিলের কাছে একটু ভয়ের কথা আর অনেকটা রাগের কথা। বিশুর উপর সেই রাগের শোধ এখন
তুলতে হবে। নাহলে তার একটুও শান্তি হবে না।
গেনো বিশুকে তো সে এখন পাবেই না। তাই খুব গোপনে অন্যভাবে একটা শোধ সে
নেবে। আভারানির উপরেই শোধটা নেবে কপিল - আজকেই নেবে। তাতে শোধ নেবার সঙ্গে
সঙ্গে আভারানির শরীরেরর উপর তার নিজের একচ্ছত্র অধিকার আর কর্তৃত্বটাও ভালোমতে
ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। নিশ্চিন্ত হওয়াও যাবে।
আভারানি বিছানায় আসতেই সামান্য ত্বরিত ভূমিকা কোনোমতে সেরে আভারানির শরীরের
কাছাকাছি ঘেঁষে যায় আক্রুষ্ট কপিল। গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে পরুষ কামসিক্ত
স্পর্শে সজোরে হাতড়াতে থাকে আভারানির নিতান্ত অনিচ্ছুক শরীরটা। প্রেমহীন কর্কশ
সে জান্তব পীড়নে বড়ো কষ্ট হতে থাকে আভারানির।
আভারানি তখন শরীর ছেড়ে দেয়। মন নিয়ে অন্ধকার ঝুপড়ির ভ্যাপসা মলিন ক্লিষ্ট
বিছানা থেকে সে উঠে যায় উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রদ্যুতিত অনন্ত চন্দ্রাতপের নীচে।
সেখানে শিশিরসিক্ত কোমল ঘাসের স্নিগ্ধ নির্মল শয্যায় বিশুকে সে সাগ্রহে নিজের
সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে আবাহন করে তার শত হস্ত বাড়িয়ে।
ট্রেনের স্বল্পক্ষণের অতৃপ্ত স্পর্শ নয়, বিশুর সর্বশরীরে একটু একটু করে তার
সর্বশরীর গভীর প্রেমে মেলাতে থাকে আভারানি ... ধীরে ধীরে বিশুর সঙ্গে ডুব দিতে
থাকে এক দীর্ঘ গহন আনন্দময় অবগাহে। ততক্ষণে অন্ধ কপিল তার নিজস্ব অতি সংক্ষিপ্ত
প্রয়োজন সেরে ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছে ঝুপড়ির ক্লিন্ন বিছানার এক ধারে।
0 মন্তব্যসমূহ