ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

‘হোটেল স্যালভেশন’ চলচ্চিত্র এবং পিতা-পুত্র সম্পর্কের সমীকরণ: একটি আলোচনা -অভিজিৎ চক্রবর্তী


সি
নেমা এমন একটি মাধ্যম যে মাধ্যমে লোকরঞ্জন হয় সবথেকে বেশী। কারণ বিশ্বব্যাপী বিরাট সংখ্যার মানুষের কাছে সিনেমা গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যম। কেউ সেটিকে শিক্ষনীয় উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন, কেউ বা শুধুই অবসর যাপনের সঙ্গী হিসেবে। গোটা বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ সিনেমা রিলিজ হয় তার সংখ্যা হাতে গুণে শেষ করা যায় না। হলিউড বা দক্ষিণ কোরিয়া বাদ দিলে এশিয়ার মধ্যে ভারতও সিনেমা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিগণিত। শোনা যায়, বছরে প্রায় হাজারখানেক  সিনেমা তৈরী ও রিলিজ করে ভারতের বুকে। এদের মধ্যে বহু সিনেমা দর্শকমননে প্রভাব ফেলে, বহু সিনেমা আবহমানের জন্য জনপ্রিয় হয়ে যায়, আবার বহু সিনেমা এমনিই কোন চোরাস্রোতে অতর্কিতে হারিয়ে যায়। সিনেমা হলে দর্শক পৌঁছোবার আগেই সিনেমাটি সেই হল থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় এমন বহু সিনেমার নজির আছে এই ভারতে। তখন ইন্টারনেটের পাইরেটেড উপায়ে সিনেমা ডাউনলোড করা ছাড়া অপর কোন উপায় থাকে না। আর যদি ভাগ্য ভালো থাকে, তাহলে ইউটিউবে  দেখা যেতে পারে (যদি প্রোডিওশিং হাউস পূর্বেই আপলোড করে থাকে, তবেই সম্ভব)। 

তিনবছর আগে রহস্যজনক ভাবে মারা যান অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত। তাঁর এই মৃত্যু যেন ‘বলিউড’ এর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে প্রকট করে দেয় নতুন করে। ‘চিরাচরিত বাণিজ্যিক’ বনাম ‘সমান্তরাল’- এই দুই ঘরানার মধ্যে রেষারেষি চলে আসছে বহু বছর ধরে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাণিজ্যিক ছবি তাদের অর্থ, প্রভাব, বিক্রির বাজারের দাপটে খুব সহজেই সমান্তরাল ছবি গুলিকে কিস্তিমাৎ দিচ্ছে, এবং পূর্বোক্তদের প্রভাবের জন্য শেষোক্তগণ চোরাস্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে। 

এতখানি গৌরচন্দ্রিকা করবার একটাই উদ্দেশ্য:  তা হল ভারতের সিনেমা সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে পাঠককে জানিয়ে রাখা। ধীরে ধীরে আমি আমার প্রবন্ধের বিষয়ে প্রবেশ করব। তবে লেখা শুরুর আগে এ কথা জানিয়ে দেওয়া দরকার যে আমি সিনেমা বিশেষজ্ঞ নই, সিনেমাপ্রেমী বা আরো ভালো করে বলতে গেলে “সিনেমার পাঠক”। সিনেমার মধ্যে বাস্তবকে যেভাবে যেরূপে দেখতে পাই, ঠিক তেমনটাই লিখে থাকি। বিশেষজ্ঞ না হওয়ার ফলে আমার লেখায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং অনুমানের উপস্থাপনা অধিক পরিমাণে থাকবে। অনুরোধ করব: পাঠক যেন সচেতনভাবে আমার এ লেখা পড়েন। 

উইকিপিডিয়ার সূত্র ধরেই বলছি, ২০১৬ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একটি হিন্দি ছবি রিলিজ করে, নাম “হোটেল স্যালভেশন”। ছবিটি ভারতের বাজারে রিলিজ করে ২০১৭ সালে। সেসময়ে ভারতের সংবাদপত্রে ভীষণরকম প্রশংসাবাক্য লেখা হয়েছিল এই ছবিটি নিয়ে। ছবিটি বাণিজ্যসফল হয় নি; ফ্লপ করেছিল। যথারীতি কিছুদিন পরে ছবিটি হারিয়েও যায়; এমনকি টেলিভিশনেও সিনেমাটির কোন সম্প্রচার হয়নি এবং ইউটিউবেও নেই। 

কিন্তু কী ছিল সে ছবিতে? কেনই বা ছবিটির এত গুরুত্ব দিচ্ছি? আসলে সিনেমা কিছু না কিছু হলেও সত্যকে প্রকট করে। এই সিনেমাটিও তাই। ভারতবর্ষে মধ্যবিত্ত পরিবারে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক কেমন, তার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য মেলে এই সিনেমার মাধ্যমে। সিনেমার গল্পটি আর পাঁচটি সিনেমার গল্প থেকে একটু আলাদা; অথচ খুবই বাস্তব-নির্ভর। গল্পে দেখা যায়: দয়া, এক বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক, সংসারের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেনারস চলে যেতে চান, সেখানে গিয়েই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে চান। তাঁর পরিবার বলতে পুত্র: রাজীব, পুত্রবধূ: লতা এবং বিবাহযোগ্যা নাতনি: সুনীতা। রাজীব অফিসে চাকরি করে, অফিসের কাজে ছুটি নিয়ে বাবাকে নিয়ে বেনারস যেতে ইচ্ছে করে না; আবার বৃদ্ধ বাবাকে একলা ছাড়তেও ইচ্ছে করে না। এদিকে বাবার জেদ— বেনারস তিনি যাবেনই, প্রয়োজনে একলাই যাবেন। অগত্যা রাজীবকে অফিসের কাজ সামাল দিয়ে বেনারস বেরিয়ে পড়তে হয় তাঁর বাবাকে নিয়ে। বেনারস পৌঁছে তাঁরা একটি ধর্মশালায় আশ্রয় নেন, সেটির নাম “মুক্তি ভবন”। সেখানে নিজেদেরই রান্নাবান্না করে খেতে হয় পিতাপুত্রকে। সচরাচর এই “মুক্তি ভবনে” তাঁরাই আসেন যারা ইহজীবন থেকে মুক্তি পেতে চান। ফলে দয়া তাঁর সমবয়সী অনেককেই পেয়ে যান, যারা মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণছে এবং একপ্রকার স্বেচ্ছাবসরে এই ধর্মশালায় দিন কাটাচ্ছেন। সেরকমই এক বৃদ্ধা হলেন বিমলা, তিনি বহু বছর যাবৎ সেখানে আছেন। দয়া-রাজীবের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় এবং ধীরে ধীরে দয়া’র সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। দয়া ধর্মশালার পরিবেশে মিশে যান, কিন্তু রাজীবের অফিস থেকে চাপ আসতে থাকে। কিন্তু তার সমস্যা হল, সে বাবাকে ফেলে কোথাও যেতে পারে না; আবার বাবা সম্মানীয়, বয়োজ্যেষ্ঠ – এইসব ভেবে বাবার কথা অমান্যও করতে পারে না। উভয়ের মধ্যেই সে যেন জেরবার হয়ে যেতে থাকে। বেশ কিছুদিন এইভাবে কাটানোর পর দেখা যায় একদিন বিমলা মারা গেছে। বার্ধক্যে এরকম পর্যায়ে একজন বন্ধুসম ব্যক্তিকে হারিয়ে দয়া খুব ভেঙ্গে পড়ে। মুষড়ে পড়ে। রাজীব আবার তার বাবাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চায়, তিনি ফেরেন না। বরং, রাজীবকেই ঘরে ফিরতে হয় সাংসারিক প্রয়োজনে। ঘরে ফিরে যথারীতি সে আবার অফিস, সংসারে মনোনিবেশ করে। এরকমই একদিন খবর আসে যে তার বাবা আর ইহজগতে নেই। তারপর পুত্রের কাঁধে চড়ে পিতার শেষযাত্রার মধ্যে দিয়েই সিনেমা শেষ হয়। 
সিনেমাটি আদ্যোপান্ত দেখলে এক দায়িত্বশীল সন্তানের দিকটি আমাদের চোখে পড়ে, যে সন্তান তার পিতার ওপর শ্রদ্ধাশীল। পিতার কোন দাবির ওপর “না” বলতে পারে না। তারমানে এই নয় যে, পিতার সব দাবি দাওয়াকে মন থেকে মেনে নেয়। কিন্তু পিতার প্রতি সম্ভ্রম এবং ভয় মেশানো শ্রদ্ধার বশে সে কাজগুলি করে। এই পিতা পুত্রের সম্পর্কের সমীকরণটিকে একটি প্রতিভূ রূপে বর্ণনা করা যায়। ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখতে পাওয়া এই পিতা-পুত্র সমীকরণ আজকের নয়। আজও এই সমীকরণ চলে আসছে অবলীলায়। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক (বহু রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত) পরিবারেই বাঁধনযুক্ত। এই বাঁধন হল সংস্কারের এবং বয়সের। সচরাচর পিতা/বাবা মানেই একপ্রকার গুরুগম্ভীর প্রকৃতির মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে, যিনি হাসেন কম; পুত্রের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন কম --- ইত্যাদি। যদিও হাল আমলে এই চিরায়িত “পিতৃসম” চিত্রটা পাল্টাচ্ছে এবং আরও পালটাবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাবা মানে যে গাম্ভীর্যের প্রতীক সেটার চল বহু পরিবারেই আছে। অন্তত যেসব সন্তান তাদের “বাবা”দের এরূপ গুরুগম্ভীর বাবা হিসেবে দেখেছেন, তারা নিজেরাও যখন বাবা হয়েছেন; তখনও সেই চিরায়িত ধারাই বজায় রেখে এসেছেন। কারণ, খুব স্বভাবতই তাদের মনে হয়েছে “বাবা”দের এই গুরুগম্ভীর চিত্রই হল আদর্শ বাবাসুলভ ব্যবহার।

এতো কথা বলবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল এই কারণে, এইবার আমরা ধীরে ধীরে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের আলোচনায় ঢুকব। উপর্যুক্ত কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ সন্তানের মনে ভীতির সঞ্চার করে; ফলে স্বভাবতই সে তার জীবনের সকল দোষ-গুণ, সকল খারাপ-ভালো, বাবার কাছে স্বীকার করতে পারে না অবলীলায়। ফলে তারা তাদের মা’কেই আঁকড়ে ধরতে চায়, মা’র সমর্থন পেতে চায় জীবনের সকল কাজে। প্রায়শই এরকম উদাহরণ দেখা যায় যে, সন্তানের দৈনন্দিন জীবনের সব কাজেরই ওয়াকিবহাল রয়েছেন মা; এবং প্রয়োজনবুঝে সন্তানের কিছু খবর গৃহকর্তাকে গোপন পর্যন্ত করেন। অর্থাৎ, খুবই স্পষ্ট সংসারে বাবাকে সকলেই সমীহ করে চলে। একথাও যেমন সত্যি যে সন্তানকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে অনেকসময় “বাবা”রা কর্তৃত্বপূর্ণ হয়ে থাকেন সন্তানের শৈশবকাল থেকেই। আবার এর উল্টোদিকটিও সত্যি- এই কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণের প্রকাশে খুব অল্পবয়স থেকেই একজন শিশু তার বাবাকে “দূরের মানুষ” বলে জ্ঞান করে, ফলে তার কাছে সহজে সহজ হওয়া যায় না। আজীবন শিথিলতার কষ্ট বয়ে চলতে হয়। হয়ত কখনো বাবাও চান সহজ হয়ে উঠতে, কিন্তু সন্তান তখন আর মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। সন্তানও নিজের কৈশোর, যৌবনে বাবাকে সহজ করে পেতে চেয়েছিল; তখন বাবাও পাশে থাকেন নি। ফলে মানসিকতার দ্বন্দ্ব চলে অবিরত। 

ছেলেবেলায় রাজীব কবিতা লিখত, কিন্তু দয়া তা পছন্দ করতেন না --- অকারণ মারধর করতেন। ফলে রাজীবকে কবিতা লেখা থেকে সরে আসতে হয় নিজের ইচ্ছে না থাকলেও। শুধু তার বাবার ইচ্ছেতেই সব মেনে নিতে হয়। তেমনি ভাবেই দেখতে পাই, রাজীবও তার মেয়ে সুনীতার বিয়ে স্থির করেন। কিন্তু সুনীতার কোন ইচ্ছে ছিলনা সেই বিয়েতে। নেহাৎ বাবার মুখের ওপর না করতে পারে না, তাই মেনে নিতে হয়েছিল। ফলে বুঝতে পারি, আগের প্রজন্মগুলি থেকে পাওয়া ‘বাবাসুলভ কঠোরতা’ই পরের প্রজন্মগুলিতে সন্তানদের ওপর চাপানো হয়েছে। যতক্ষণ না মানুষ বুঝতে পারে যে সে অন্যের ওপর অন্যায়ভাবে কোন কিছু দিনের পর দিন চাপিয়ে এসেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার কাজ বহাল রাখে। সিনেমায় দাদু নাতনীর সম্পর্ক ভালো, তাই নাতনী কিছু প্রকাশ না করলেও দাদু বুঝে যান যে বিয়ে দেওয়া নিয়ে জোর করা হচ্ছে, তাই পুত্র রাজীবকে বলে বিয়ে দেওয়া থেকে তাকে নিবৃত্ত থাকতে বলেন। পরে দয়াও বুঝতে পেরেছিলেন, যে তিনি রাজীবের সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে দিয়েছেন, তাই রাজীবকে আবার কবিতা লেখা শুরু করতেও বলেন দয়া। তবে কিছু জিনিস আছে, যার অভ্যাস জীবন থেকে একবার মুছে গেলে আবার ফিরে আসতে চায় না, বা ফেরে না। 

এইবার আসি সিনেমাটির জীবনদর্শনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে। অব্যক্ত- অস্ফুটস্বরে যেন প্রাচীন ভারতের আর্য সংস্কৃতির জীবনচেতনা যেন ফুটতে দেখি। প্রাচীন আর্যযুগে সমাজ চতুরাশ্রমে বিভক্ত ছিল: ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস। বাণপ্রস্থের যেমন প্রৌঢ় পিতা মাতা স্বেচ্ছাবসরে চলে যেতেন, এখানে দয়া-ও তেমনি সেইরূপ স্বেচ্ছাবসরে চলে যেতে চেয়েছেন। সনাতনী যুগ থেকেই বার্ধক্যের কালে অধিকাংশ বুড়ো-বুড়িদের আশ্রয় ছিল বারাণসী। তাই দয়া-ও সেখানে গিয়েই জীবনের শেষক’টা দিন অতিবাহিত করতে চেয়েছেন। যদিও সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হিন্দুসংস্কারের উপস্থিতি দেখা যায়; তবে সাম্প্রতিক কালে বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার আভাস সেখানে নেই। শুধুমাত্র সহজ সাবলীল ভঙ্গীতে পিতা-পুত্র রসায়ন উপস্থিত করা হয়েছে এই ছবিতে। সমাজ মনস্তত্বের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে পিতা পুত্রের সম্পর্ক, বারাণসীতে তাদের একঘেয়ে জীবন কাটানো, দ্বন্দ্ব-ভালোবাসা সবকিছুরই মিশ্রণ। এসবকিছুই সম্পর্কের সূক্ষতাকে একটু একটু করে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। তবে বারবার একটি সূক্ষ কথাই আমাদের বুঝিয়ে দিতে থাকে এই সিনেমা: সহজ হওয়াটা কী ভীষণই কঠিন, সেটা সন্তান বা পিতা উভয়ের তরফ থেকেই কঠিন। কারণ সন্তান বা পিতা উভয়েই যখন উভয়ের কাঠিন্যের দিকটিতে ধাতস্থ হয়ে যায় বা নিজের মধ্যেকার কাঠিন্যে একাত্ম হয়ে যায়; তখন সেই কাঠিন্যের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে নিজের যেমন অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়, তেমনি যার জন্যে এই খোলসত্যাগ, তার চোখেও অস্বাচ্ছন্দ্য দেখতে পেলে স্বভাবতই নিজেকে সামলানো যায় না। তাই এই নীরব মানসিক দ্বন্দ্বে জেরবার হওয়ার থেকে ‘খোলসত্যাগের ফাঁদে পা না দিলে’ অনেক শান্তিময় আটপৌরে জীবন কাটানো যাবে বলেই বহু পিতা বা পক্ষান্তরে সন্তানদেরও ধারণা। যদিও এই কথা সত্যি: গৃহ থেকে দূরত্বে অবস্থান আমাদের কাছে এনে দেয়। এই সিনেমায় দয়া ও রাজীব বাড়ি থেকে বেনারস বেড়াতে আসার ফলেই উপলব্ধি করেছিল তারা পরস্পরের মনের কাছাকাছি এসেছে। হয়ত একথা ঠিক যে বাড়ি থেকে দূরে গেলে পারিবারিক, সামাজিক বেশ কিছু চিন্তা দূরে সরে যায়, মন তখন অন্যরকম চিন্তা ভাবনা করতে পারে। তাই হয়ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দয়াও পরিবার, সামাজিকতার দায় থেকে নিজেকে বেনারসে সরিয়ে নিয়ে রাজীবের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের সমীকরণ বুঝতে পেরেছেন, আবার হয়ত তেমনি ভাবেই দয়ার মৃত্যুর পরে “মুক্তি ভবনে” দয়ার ঘরে বসেই রাজীব এবং সুনীতার সম্পর্ক সহজ হয়। সুনীতা তার বাবা রাজীবের লেখা কবিতার একটি ডায়রি খুঁজে পায় এবং রাজীবের সামনেই সেই কবিতা পাঠ করে। রাজীবের লেখা সেই কবিতার মূলভাব ছিল: “মনের কথা শোনো, সেই অনুযায়ী কাজ ক’রো”। কিন্তু রাজীব নিজে সেই কাজ করতে পারেনি, দয়া-র ভয়ে নিজের কবিতা লেখা চালিয়ে যেতে পারেনি। আবার, সুনীতা চেয়েছিল নিজের পায়ে দাঁড়াতে, স্বাবলম্বী হতে--- সেকারণে রাজীব যখন তার বিয়ে ঠিক করে, সে না করে দেয়। এই বিষয় নিয়ে বহুদিন পিতা-পুত্রী দ্বন্দ্ব ছিল, সেই দ্বন্দ্ব মেটে মুক্তি ভবনে এসে, দয়া-র অন্ত্যেষ্টিতে।

আসলে পিতা ও সন্তানের এই সম্পর্কের সমীকরণের শক্ত খোলসটির মধ্যে নরম কুসুমসম একটি সত্তা হয়ত লুকিয়ে থাকে। অধিকাংশ সময়েই এই কুসুমকোমল অন্তরের সন্ধান আমরা সহজে পাই না। তাই, স্বভাবতই ধরে নিই যে বহিরাবরণের শক্ত খোলসটিই প্রকৃত সত্তা। ফলে সারাজীবনই কর্তৃত্বকঠোর, গুরুগম্ভীর, তথাকথিত পিতাসুলভ এক ব্যক্তির সামনে নত হয়েই থেকে যেতে হয়। আবার যদি সেই কোমল হৃদয়ের সন্ধান পাওয়া যায়, সম্পর্কে যুক্ত হয় ভিন্ন মাত্রা, আটপৌরে জীবনেও আসে লাগে নতুন বাতাস। “হোটেল স্যালভেশন” সেই বাতাসের সন্ধানই দিতে চেষ্টা করেছে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ