ব জায়গাতেই এখন জায়গার বড়ো অভাব। জায়গার স্থায়ী দখল নিয়ে কড়া টানাটানি আর তীক্ষ্ণ রেষারেষি চলে, পেশির নগ্ন প্রদর্শন চলে সবখানেই। যে পেশির স্ফীতি যত বেশি সেই পেশির বিজয় ঘটে যায় জায়গা দখলের লড়াইয়ে।
নিতান্তই অসম সেসব প্রতিযোগিতায় জায়গা না পেয়ে বাজারের খানিক কাছাকাছি রাস্তার ধারে সন্ধ্যার সময় বসেছে এক যুবতী মা। সারা দুপুর ধরে খুঁজে-খুঁটে তোলা কিছু শাকপাতার তুচ্ছ পসরা তার সামনে। পাশেই রাস্তার ধারেই বসে আছে তার হামাগুড়ি দিতে শেখা শিশু। তার কচি কচি হাত দুটো রাস্তার ধুলোতে মাখামাখি। সেই হাত মাঝে মাঝে মুখে পুরে ফেলছে সে।
একটু আলোর আবডালে বসেছে মেয়েটি। সেটা দরকার। পরণের শাড়িটা এখানে ওখানে ছেঁড়া। সেসব জায়গায় ছায়া আর আবছা আঁধারের সাময়িক তালি না লাগিয়ে উপায় নেই। এখানে অনেক লোকের যাতায়াত। শাড়ির ভাঁজ বদলে বদলে সব ছেঁড়া ঢাকা দেওয়া যায় না। আলোর মতই ছায়া বা আঁধারও কত না দরকারি হয়ে ওঠে কোনো মানুষের কাছে।
তার রুখু-শুখু চুল নড়ছে বাতাসে। যৌবনের অদাব লাবণ্য সত্ত্বেও শুকনো উপোসী মুখ। সকালের খানিক জল-ভাতের ‘টিফিনে’র মধ্যে মিলিয়ে গেছে আজ দুপুরের খাওয়াটা। শাকপাতা সংগ্রহ করে আনার পর নিভন্ত বিকেলের আহার ছিল মিয়ানো মুড়ির কয়েক মুঠোর অবশেষ আর দু’গ্লাস জল।
যৌবন বড়ো অবিবেচক। বিশেষত নারীদেহে কুসুমিত হতে গিয়ে সে কখনও কোনোরকম যৌক্তিক বাছবিচার করে না। কোথায় কত বেশি বা কম পাপড়ি সে কখন কী ভাবে মেলবে তারও কোনো ঠিক থাকে না। যেমন দুর্ভাগ্যপীড়িত এই অনশনক্লিষ্ট নারীর শরীরে যৌবন বড়ো প্রগলভ।
সহায়শূন্য সেই দেহের এখানে-ওখানে কতখানে যৌবন তার অবিবেচক সোচ্চার ঘোষণা ছড়িয়ে রেখেছে। ভারী উরু আর পেটের ফাঁক দিয়ে মাথা গুঁতিয়ে ভিতরে ঢুকছে তার ক্ষুধার্ত শিশু। পৌঁছে গেল স্তনবৃন্তে। ক্ষুধাক্রান্ত প্রায় অক্ষম উৎস থেকে সাদা রক্ত টেনে টেনে খেতে লাগল।
আসমা গরিব ঘরের মেয়ে, গরিব ঘরের বউ। তবুও শাকপাতা খুঁটে নিয়ে রাস্তার ধারে তার বেচতে বসার কথা নয়। সংসারে অভাব ছিল, তবে অনাহার ছিল না। দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত মোটামুটি জুটে যেত। শাদির আগে বাপের বাড়িতে বা শাদির পরে স্বামীর ঘরেও খাওয়া-পরার টানাটানি তেমন ছিল না আসমার।
নানা উৎসব বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে মন্ডপ বাঁধার কাজ করত আসমার বর সাজিদ। যদিও মরসুমি ঝোঁকের সঙ্গে সঙ্গে এসব কাজের সুযোগ কমে বাড়ে, তবুও সারাবছর মিলিয়ে চলনসই রোজগার বটে।
ছোটোবেলায় বাপ-মা হারা হয়ে চাচাদের কাছে বড়ো হওয়া লম্বা-চওড়া সাজিদের মনটাও ছিল একই রকম বড়ো আর দরাজ। পাঁচজনের মুখে শুনে, নিজে দেখে, ভেবেচিন্তে আসমার আব্বু নিশ্চিন্ত মনে সাজিদের সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ে আসমার শাদির ব্যবস্থা করেছিল।
সে শাদিতে আসমারও পুরো খুশির সায় ছিল। সরাসরি আলাপ পরিচয় না থাকলেও সাজিদকে চিনত সে। সাজিদের নিজেরও এই সম্বন্ধটা বেশ পছন্দ ছিল। পরে দেখা গেল এই শাদির ব্যাপারে আসমার আব্বু, আসমা, সাজিদ কারও কোনো ভুলচুক সত্যিই হয়নি। আসমা-সাজিদ বড়ো সুখী দম্পতি হয়েছিল।
বিয়ের দু’বছরের মাথায় আসমার কোল জুড়ে এল - ফুটফুটে বাচ্চু। আর বাচ্চুর জন্মের তিন মাস আঠাশ দিনের মাথায় মন্ডপ বাঁধার কাজে ব্যস্ত সাজিদ প্রায় ত্রিশ ফুট উপর থেকে পা ফসকে নীচে পড়ে গেল, আর উঠতে পারল না। রক্তের ছোটোখাটো পুকুর তৈরি করতে করতে আল্লাহ্র নাম নেবার বদলে দু’বার কোনোমতে আসমাকে ডেকে উঠে তারপর একেবারে থেমে গিয়েছিল সাজিদ।
দস্তুরমত খরচাপাতি করে কোনোরকমে চুপে-চাপে পুলিশ-কেস নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে সেদিনের রোজের মজু্রির সঙ্গে আরো কিছু বেশি টাকা ধরে দিয়ে একেবারে হাত ধুয়ে ফেলেছিল ঠিকাদার। অসহায় আসমার হয়ে এই ব্যাপারে কিছু করার বা বলার জন্য কাউকেই তেমনভাবে পাওয়া গেল না।
সাজিদের মৃত্যুর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের জন্য বেশি কিছু বলে কাজ হারাবার ভয়ে ঠিকাদারকে কেউ চটাতে চাইল না। তবুও যারা একটু আধটু মুখ ফাঁক করেছিল, ঠিকাদার টাকার টুকরো ছুঁড়ে সেসব দুর্বল ফাঁক দ্রুত বন্ধ করে দিয়েছিল।
দাফনে চলে যাবার সময় সাজিদ খুব চুপি চুপি আসমার পাঁজর থেকে ক’খানা হাড় খুলে, লুকিয়ে নিয়ে গেছিল কাফন-বস্ত্রের আড়ালে। টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল আসমা। অবোধ বাচ্চুটা তখন কিছু বোঝেনি। অনেক পরে সে-ই কিন্তু তার নিজের অজান্তে একসময় তার ভাঙ্গা আম্মুকে আস্তে আস্তে কোনোমতে জুড়ে দিতে পারল।
দাফনের খরচ-টরচ হয়ে যাবার পর ঠিকাদারের দায়সারা ভাবে দেওয়া টাকার বাকিটা শেষ হতে বেশিদিন দেরি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। প্রতিবেশী আর পাড়ার লোকের সাহায্যে কিছুদিন গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল। আসমার আব্বুও অবস্থার ফেরে এখন আরও গরিব হয়ে পড়েছে। সেখান থেকেও সাহায্য অতি সামান্যই পাওয়া গিয়েছিল। অন্যের সাহায্য নিয়ে কারো সংসার কিছুদিন চলে - বেশিদিন নয়।
অতএব বেচার মতো সামান্য যা কিছু ছিল সেগুলো একে একে বিক্রি হতে থাকল। বাস্তুজমি বাদে সাজিদের ভাগের পৌনে চারকাঠা জমি দু’দফায় হলেও বেচে দিতে হল। তারপর বেচতে হল আসমার আব্বুর দেওয়া ক’গাছা রূপোর চুড়ি আর একটা রূপোর গোট চেন। আসমার সব থেকে বেশি নিরুপায় কষ্ট হয়েছিল সাজিদের করে দেওয়া সোনার তৈরি ছোটো ছোটো দুটি কানের টপ বেচার সময়।
তারপর আসমার সব বেচার জিনিস একসময় শেষ হয়ে গেল। বাঁচার তাগিদে এবার শুরু হল এবাড়ি ওবাড়ি কিছু বাসনমাজা ঘরমোছার ঠিকা কাজ করা। ফাঁকে ফাঁকে শাকপাতা তুলে বাজারের কানাচে বসে বেচা। তার বাচ্চুকে বড়ো করে তুলতেই হবে। লেখাপড়া শেখাবে, যত দূর পারবে। তার জন্য যত কষ্ট করতে হয় তা করবে আসমা।
বাজারে আসা এইসব শাকপাতার খদ্দেররা কিন্তু তেমন গরিব-টরিব হয় না। বদহজম, গ্যাসের সমস্যা, রক্তে শর্করা এবং অথবা উচ্চচাপ, অনিদ্রা, এসব বালাই ডাক্তারি ওষুধের সঙ্গে বিশেষ বিশেষ শাকপাতা খেয়ে আরো কমানোর আশায় তারা আসে। তাদের প্রায় সকলের দেহের কেতায় সচ্ছলতার রসকলি আঁকা। পেটফোলা বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরতি পথে সে সব খদ্দেরদের কেউ কেউ আসমাকে দেখে দাঁড়ায়। তাদের বেশির ভাগই মাঝবয়সি অথবা প্রৌঢ় অথবা বৃদ্ধ। শাকপাতার সঙ্গে আসমাকে নজর করে তারা, - ইল্লি-ই-ই-!!
ওরা এগিয়ে আসে কাছে। তারপর শাকপাতার পশরা দেখার ছলে পশারিনিকেই দেখে বার বার। দেহের খাঁজে-খোঁজে লোভের দৃষ্টি গুঁজে দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকে। তারপর শাকের দাম করাকরি, নাম জানাজানির আড়ালে ধর্মাধর্ম, শিক্ষা আর রুচি অনুযায়ী তাদের ভিতরের আবর্জনা গোপনে অসংবৃত হতে থাকে...
...মাই গড্! এরকম হাইলি ল্যসিভিয়াস্ লুকের একপিস্ দুর্দ্দান্ত ফিগার অযত্নে অবহেলায় এখানে এভাবে ওয়েস্টেজ হয়ে যাচ্ছে! হোয়্যাট আ গ্রিভ্যাস ডিসিপেশ্যন! অথচ আমরা কিছুই ...
...জয় শ্রীরাধে! আহা, মেয়েমানুষটা তো দারুণ ডবগা গো! কিন্তু হাবেভাবে যে মোছলমান বলে মনে হচ্ছে। কোলে ছানা রয়েছে, কিন্তু শাঁখা সিঁদুর কই? হোকগে মোছলমান, তেল সাবানে পোষ্কার হয়ে নিলে তো আর অর মধ্যে রাধিকা-ভাব আনাতে অসুবিধে কিছু নেই...
...ইয়া আল্লাহ্! এইরকম একটা আগুনের খাপরা আওরতের বোরখা ছাড়া বাইরে ঘোরা বেশক না-জায়েজ। এর কি দোজখের ভয় নেই? অবশ্য এই আওরত যদি মুসলমান হয় সেক্ষেত্রে একদম একে একা আলাদাভাবে নসিহত শোনানোর খাস দায়িত্ব নিতে তিনি রাজি আছেন। তবে ওকে খুশবুদার সাবানে গোসল করে যেতে হবে। আতরও লাগবে। আচ্ছা,- সাবান আর আতরের দামটা না হয় তিনিই...
...আরিব্বাস! রাস্তার ধারে কী চোখা একটা মাল ঝুলে আছে মাইরি! গাঙ্গুলী স্যারকে খবরটা দিতেই হয় এক্ষুনি! হ্যা – হ্যা, বলা যায় না, পরে হয়ত তার ভাগ্যেও...
ঘোরাঘুরি করে তারা চলে যায়। শাকপাতা বিশেষ বিকোয় না। এই ধরণের শাকপাতার খদ্দেরদের বেশির ভাগই বাজারের ভিতর থেকে ওসব কিনেটিনে বেরোয়। তাছাড়া আসমার জোগাড় করা শাকপাতাগুলো তার মতোই বেওয়ারিশ আর ম্লান।
নিয়মিত জল, রাসায়নিক সার আর কীটনাশক দেওয়া শাকপাতার মতো সতেজ আর সবুজ নয়। দূর মাঠে মাঠে প্রায় শুকনো জলার ধার থেকে খুঁজে পেতে আনা সেসব ক্ষুধার্ত শাকপাতা শাঁসওয়ালা খদ্দেরদের নজরে ধরে না।
দামড়া সরীসৃপের মতো আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝকঝকে ইন্ডিগো সিএস গাড়ি আসমার থেকে খানিকটা দূরে এসে থেমে পড়ে। সামনের দরজা খুলে নেমে আসে একজন। লোকটা খানিক আগে আসমাকে দেখে গিয়েছিল। একটু অলস পায়ে একদম কাছে আসে। চোখ দিয়ে হালকা চেটে নিয়ে গলায় হাওয়াই মিঠাই ঢেলে সে শুধোয় আসমাকে –
‘ও মেয়ে, তোমার এই শাকপাতাগুলো সব নিয়ে নেবে আমার মালিক। কত দাম নেবে গো?’
‘দু-টাকা করে আঁটি।’ সবগুলো নিয়ে নেবে! ব্যস্ত হয় আসমা - ‘গুণে তো দেখিনি বাবু। এই যে গুণে দেখে বলি –’
ব্রাক্ষ্মী, থানকুনি, শুষনি, কলমি, হিঞ্চে মিলিয়ে মোট আঠারো আঁটি, ছত্রিশ টাকা দাম। একসঙ্গে নিচ্ছে যখন পঁয়ত্রিশ টাকা,- আচ্ছা নাহয় তিরিশ টাকা দিলেও আসমা এগুলো দিয়ে দেবে।
আসমার কথা শুনে ভীষণ দয়ার একটা নরমগরম হাসি হাসে লোকটা। বুক-পকেট থেকে একখানা ঝকঝকে পাঁচশ’ টাকার নোট বার করে, দু’আঙুলে ঘষে ভাঁজ খুলে তার দিকে এগিয়ে দেয়। দেখে মাথা নাড়ে আসমা।
অতবড়ো নোটের খুচরো সে কোথায় পাবে? নোটটা সেইভাবে বাড়িয়ে রেখে লোকটা আরও ঘনিয়ে আসে। মহাত্মা গান্ধী আসমার দিকে ঈশ্বরের মতো হাসিমুখে তাকিয়ে থাকেন। আঁধারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলা আরো নেমে যায় লোকটার -
‘এটা নাও গো, খুচরো-টুচরো কিচ্ছু ফেরত দিতে লাগবে না। সবটাই তোমার গো। শোন বোনটি, একটা কাজ করবে? এই শাকপাতাগুলো আর, আচ্ছা আমি নাহয় শাকপাতাগুলো নিচ্ছি, তুমি বাচ্চাটাকে নিয়ে আমার সঙ্গে ওই গাড়িতে চল। মাছ-মাংস-ডিমের পাশাপাশি আমার মালিক এসব খেতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু কপালের ফের, ঘরে রান্না করার লোক নেই। তুমি বোনটি মালিকের বাড়িতে গিয়ে এগুলো বেছে কুটে রান্না করে দিয়ে একেবারে তুমি, তোমার বাচ্চাসুদ্ধু খাওয়া-দাওয়া করেই আসবে। তখন আরো পাঁচশ’ টাকা নিয়ে আসবে,’ - একটু থামে লোকটা। তার গলাটা আরও সরু হয়ে যায় - ‘অবশ্য ইচ্ছা হলে রাতে থেকে যেতেও পারো। তাতে আরও অনেক বাড়তি টাকা তো পাবেই, তোমার নতুন শাড়ি-বেলাউজ, তোমার এই বাচ্চাটার জামা-প্যান্ট সবই পেয়ে যাবে। আমার মালিকের বড়ো দয়ার শরীর। উনি সেজন্যই আর কী এত....’
নির্মম ক্ষুধার সঙ্গে পা মিলিয়ে আঁধারও ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে আসমার অস্তিত্বে। জায়গাটা একটু আলো-আঁধারি হলেও নজর চলে। স্পষ্ট দেখা গেল মাথা নাড়ছে বিষণ্ণ, ক্লিষ্ট আসমা। শুধু শাকপাতা ছাড়া আর অন্য কিছু সে বেচবে না।
'উৎস'তে প্রকাশিত লেখক তুষার সরদারের অন্যান্য লেখা (পড়তে লাল অক্ষরে ক্লিক করুন) -
ছোটগল্প
- সমাধান (প্রকাশকাল- জুলাই ২০২৩)
- বোধনদের বৃত্তান্ত (প্রকাশকাল- সেপ্টেম্বর ২০২৩)
প্রবন্ধ
- সত্য-মিথ্যার আলোছায়া (প্রকাশকাল- আগস্ট ২০২৩)
0 মন্তব্যসমূহ