ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বোধনদের বৃত্তান্ত -তুষার সরদার



সা
তবারের বার সবেদা গাছের একেবারে নীচু মোটা ডালটায় আর উঠতেই পারল না সাধন। বেশিটাই শারীরিক দুর্বলতায়, বাকিটা সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে পড়ার জন্য। সবেদা গাছটার গোড়ায় পৌঁছানোর আগেই স্যাঁতসেঁতে বাসি বোঁটকা গন্ধের লুঙ্গিটা কোনোমতে তুলে মাটির ওপর উবু হয়ে বসে পড়তে সে বাধ্য হল।

ঠিকমতো বসতে না বসতেই দুর্গন্ধযুক্ত ফ্যাকাশে তরল পিচকিরির মতো ঠেলে বেরিয়ে গেল তার প্রায় অসাড় পায়ুদ্বার থেকে। শক্ত মাটিতে পড়ে ছিটকে ওঠা সেই ঘোলাটে জলের মতো বিষ্ঠাতে তার দুই পায়ের পাতা, গোড়ালি আর একটু ওপর পর্যন্ত ভিজে গেল।

এসব ব্যাপার খুব আলগা ভাবে তার চেতনাকে সামান্য ছুঁয়ে গেল মাত্র। ততক্ষণে সে দু’হাত সামনের মাটিতে ঠেকনা দিয়ে শরীরের ভর রেখে অবসন্নতায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে ছিল। বেশ খানিক পরে যখন তার মনে হল এবার ওঠা যেতে পারে, তখন মাথাটা আস্তে আস্তে সোজা করল। মাথাটা সোজা করে সামনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অবাক, একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল সাধন।

গ্রীষ্মের গভীর রাত। পূর্ণিমা বা পূর্ণিমার খুব কাছের কোনো তিথি হবে আজ। ধোয়ামোছা আকাশের মাথায় চড়ে বসা দামড়া চাঁদটার আলো নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে চারদিকে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। এই জায়গাটা সাধনদের বসতবাড়ির লাগোয়া বাগান। 

বাগানের উত্তরে সুপারি গাছের সারি। আর পশ্চিমের কিনারা ঘেঁষে কয়েকটা জোয়ান সবেদা গাছ। তার ওপারে নীচু জলা। জমির ফুটখানেক উপর থেকে সবদিকেই মোটা মোটা ডাল ছেড়েছে তেজী সবেদা গাছগুলো। একেবারে নিরিবিলি জলার দিকের যে কোনো গাছের যে কোনো একটা নীচু মোটা ডালে বসে বড়োবাইরে করার খুব সুবিধা হয়।

বাগানের বাদবাকি জায়গায় মরসুমি আনাজের চাষ হয়। খানিক দূরে দূরে তিনটে কাঁচকলা আর দুটো কাঁঠালি কলার ঝাড় আছে। সবই হাতের তেলোর মতো সাধনের চেনা। মাথাটা উঁচু করতে পরিষ্কার দেখতে পেল সাধন, খানিকটা দূরে কাঁঠালি কলার নতুন ঝাড়টার কাছেই কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। একটু আবছা মতো, মিশকালো আর লম্বা, তবে স্পষ্ট মানুষের আদল! 

কে - কে ওটা? ভীষণ আতঙ্কে থর্‌থরিয়ে কেঁপে উঠল তার দুর্বল রুগ্ন শরীর। আস্তে আস্তে বিষ্ঠাতে ভিজে কাদা হওয়া মাটির ওপরেই থেবড়ে বসে পড়ল সে। একটা ভয়ার্ত চিৎকার গোঙানি হয়ে বেরিয়ে এল তার গলা থেকে - 
‘বোদ্না - বোদ্না রে…!’


কাল বিকেলে চৌকিতলার হাটে নিজেদের বাগানের সামান্য কিছু আনাজ বেচতে গিয়েছিল সাধন। সেসব বেচার শেষে সেই টাকা দিয়ে সংসারের কিছু খুচখাচ জিনিস কিনেছিল। বেচা ও কেনা সারতে সারতে সন্ধে হয়ে গেছিল। সন্ধের পর  হাট থেকে বেরোবার মুখে জগার অর্থাৎ জগন্নাথের ঘুঘনি আর আলু-কষার দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ লোভে পড়ে গেল সে। খিদের মুখ ছিল। আলু-কষা আর ঘুঘনি দুই-ই সাঁটিয়েছিল।

জগা-ব্যাটা মাল বানায় ভালো, তবে বাসি মাল বেচে বলে শোনা যায়। খাবার পর ফিরতি পথে আসার সময় ঘন ঘন ঢেঁকুর উঠছিল। তাতে বড্ড পচাটে দুর্গন্ধ ছিল। বাড়ি ফেরার পর থেকে পেটে খুব অস্বস্তি আর গড়গড়ানি শব্দ শুরু হয়ে গেল।

জ্বালানি বাঁচাতে তাদের বাড়িতে দুবেলা রান্না করা হয় না। দুপুরের রান্না করা পুঁইশাকের ঘন্ট, খেসারির ডাল আর জল দেওয়া ভাত আছে। কিন্তু তার খাবার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না। তবুও খেতে হয়েছিল। নাহলে ওই রান্না করা খাবারগুলো নষ্ট হবে।

সাধনের ভাদ্দোরবউ নয়নতারা বেশ গুণী মেয়ে। এদিকে মস্ত সুবিধা এই যে তার বাপ-ঠাকুরদা সব ডাকসাইটে ওঝা গুণিনের বংশ। বাপ-ঠাকুরদার কাছে শেখা বিদ্যেবলে এইসব পেটখারাপের হাবভাব নয়নতারা খুব ভালো বোঝে। সে ভাসুরকে বাতলে ছিল,
‘হাট বাজারের রাস্তা! রাতের বেলায় ফেরা, নিগ্ঘাত তোমার বদ-বাতাস লেগে গেছে। এটা পেটখারাপ নয়। দুকুরের জল দেওয়া ভাত খেলে পেট ঠাণ্ডা হবে। ওবেলার পুঁইশাক খেসারির ডাল সবই চলবে! দু’তিনটে শুকনো লংকা পশ্চিম-মুকো হয়ে পুইড়ে দিচ্ছি। মন্তর-পড়া তেঁতুলমাখা করে দিচ্ছি। সবকিছু জল-ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে নিও, পেটের দোষ কেটে যাবে।’

নয়নতারা সন্ধের একটু পরেই এক নিমন্ত্রণ বাড়িতে চলে গেছিল। তার একার নিমন্ত্রণ ছিল। রাতে খেয়েদেয়ে সে আর একা একা বাড়িতে ফিরতে পারবে না। পরদিন সকালেই ফিরে আসবে। ওদিকে সাধনের বউ বছর আটেকের মেয়েকে নিয়ে গতকালই বাপের বাড়িতে গেছে। দিন তিনেক পর আসবে। ফলে এখন বাড়িতে আছে শুধু দুই ভাই।
দুপুরের রাঁধা ভাত, তরকারি রাতের দিকে একটু পচাটে গন্ধ ছাড়লেও ফেলে দিয়ে নষ্ট তো করা যায় না। নয়নতারার পরামর্শ ও বিধান মতো অব্যর্থ মন্ত্রসিদ্ধ লংকাপোড়া আর তেঁতুলমাখা দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে ওরা দুইভাই যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।

রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ প্রচণ্ড এক আভ্যন্তরিক ঝাঁকুনিতে ঘুমন্ত সাধনের সব ঘুম আচমকা একেবারে নিঃশেষে মুছে গেল। তলপেটের ভেতর ভীষণ এক হ্যাঁচকা টানের প্রবল যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি নিয়ে হঠাৎ জেগে উঠেই সে ছুটল বাড়ির খিড়কি দরজার পথে। খিড়কি দরজার বাইরে খানিকটা উঁচু ডাঙা বাগান। বাগানের ওপাশে নীচু পতিত জলা। 

তার ধার ঘেঁষে কয়েকটা সবেদা গাছ। সেসব গাছের মোটা নীচু ডালে ঘন পাতার আবডালে বসে তাদের পরিবারের সবাই বড়োবাইরের কাজটা সারে। সাতবারের বার অবসন্ন সাধন আর পারেনি গাছের ডালে উঠে বসতে। দু’হাতে শরীরের ভর রেখে মাটিতেই উবু হয়ে মলত্যাগ করে ফেলেছিল। তার পর সামনের দিকে কালো ছায়ামূর্তিটা দেখে সেখানেই বসে থেকে দারুণ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছিল, 
‘বোদনা! বোদনা রে -!’


বোধন তার ঘরে শুয়েছিল, তবে তখনও জেগেই ছিল। নয়নতারা কাছে থাকলে রাত্তিরে তাড়াতাড়ি তার ঘুমটুম এসে যায়। আজকে একা একা তার ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল। দাদার বিকৃত স্বরের ডাকটা শুনে প্রথমটা ঘাবড়ে গেল সে। তারপরই ধড়মড় করে উঠে ছুটল। দাদার শরীর খারাপ - জোর পেট ছেড়েছে, জানে সে। দাদাকে সে খুব ভালোবাসে। পাল্লাবিহীন খিড়কি দরজার পথে ছুটে পেরিয়ে নির্ভুল আন্দাজে সবেদা গাছের কাছে পৌঁছে গেল বোধন। মাটিতে প্রায় হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় দাদাকে দেখতে পেল সে,
‘দাদা! কী হয়েছে দাদা?’
‘ওই দ্যাক্ বোদনা! ওই কলাগাছের কাছে কালো মতো কে একজন দেঁইড়ে আছে! কে ওটা?’
বোধন সেদিকে ঘোরে। ধোয়ামোছা আকাশ থেকে অনেকটা ঝুলে পড়া আস্ত গোল্লা চাঁদটার আলোয় চারদিক প্রায় দিনের মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বোধন খুঁটিয়ে কলাঝাড়ের চারপাশ দেখল। কিন্তু সেখানে কাউকেই সে দেখতে পেল না,
‘কই - কেউ তো কোথাও নেই ওকেনে!’
‘সে কী রে বোদনা! ওই তো শালা দেঁইড়ে আছে কালো ঝুলের মতন! ওই তো পষ্টো দেখা যাচ্ছে! তবু তুই দেখতে পাচ্ছিস না? আমি কি তোর সঙ্গে এখন মাজাকি কচ্চি নাকি!’
বোধন আবার ভালো করে সামনের দিকটা দেখে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। এবার তার একটু ভয় ভয় করতে থাকে। বিভ্রান্ত হয়ে ওই প্রসঙ্গটা পাশ কাটাবার চেষ্টা করে সে,
‘তোর হাগা হয়ে গেছে দাদা? এবার তাহলে পুকুর ঘাটে চল।’
‘ওই কালো ঢ্যাঙা লোকটা কোত্থেকে এল বল দেখি? ওই দ্যাখ, শালা এবার চলে গেল ওই জলার দিকে!’ - একটু চুপ করে থেকে খুব দুর্বল কাঁপা গলায় ভাইকে বলে সাধন - ‘এট্টু জল তুলে দিবি বোদ্না পুকুর থেকে? আমি তো নেবে আর ছোঁচাতে পারবুনি রে ভাই! শরীলটা আমার কেমন অসাড় হয়ে আসতেছে রে। আমার হাতটা ধরে এট্টু তোল দেকি। ওই শালা আবার ইদিকে ফিরে আসবে নাকি রে?’
নিরুত্তর থেকে দাদার হাত ধরে তুলে পুকুর ঘাটের দিকে নিয়ে যেতে যেতে মাথা নাড়ে বোধন। তার বউ নয়নতারা তাহলে তো ঠিকই ধরেছিল! দাদার খুব জোর বদ-বাতাস লেগে গেছে। জাত গুণিনের মেয়ে, - নাতনি সে। ভূত, শাঁকিনি, ডাকিনি, দানো, হাওয়া-বাতাস লাগা এসবের নানা সমস্যা, নানা লক্ষণ জানে বা চেনে নয়নতারা। 
নয়নতারার বাপ-ঠাকুরদা সেসব আপদের বিচিত্র সব সমাধান করত। সেসব বৃত্তান্ত শুনেছে বোধন নয়নতারার কাছে। তার কোমরে কালো ঘুনশিতে দুটো শেকড় আর দুটো মাদুলি বাঁধা আছে। নয়নতারাই বাপের বাড়ি থেকে সেসব এনে তিথি-ফিতি মিলিয়ে বোধনের বেঁধে দিয়েছে। ভূতপ্রেত কালো দানো তার কাছে আর সহজে ঘেঁষতেই পারবে না।

নয়নতারার কোমরেও কালো ঘুনশিতে শেকড়ের টুকরো আর ছোটো ছোটো মাদুলি বাঁধা আছে। সেবারে প্রথম যখন বিশাখার কোমরে ওসব বাঁধা আছে দেখেছিল, খুব অবাক হয়ে গেছিল বোধন। আজকে দাদা কালো দানো দেখলেও কোমরে বাঁধা ওই শেকড়-মাদুলির জোরে সে কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না! কী দারুণ শক্তি তাহলে এই শেকড় আর মাদুলির!

বাড়ির ভেতর থেকে একটা বালতি আর বেবিফুডের তোবড়ানো কৌটোটা নিয়ে এসে বোধন দেখল তার দাদা তখন আবার মাটির ওপর বসে পড়েছে। তীব্র বমির কঠিন ধাক্কায় তার সারা দেহ দুলে উঠছে। বমির উগ্র ঝাঁঝালো দুর্গন্ধে চারপাশ ডুবে গেছে। 

দাদাকে চোখের সামনে বমি করতে দেখে, বমির দুর্গন্ধে এবং বমিতে উঠে আসা জিনিসগুলো দেখে তারও গা বমিভাবে গুলিয়ে উঠল। কিন্তু সেজন্য দাদার কাছ থেকে সরবার কথা ভাবতেও পারল না সে।
তাড়াতাড়ি করে একটু ওপাশে যেখানে রোজ উনুনের ছাই ফেলা হয়, সেখান থেকে দু’হাতে আঁজলা করে ছাই এনে সেগুলো যথাসম্ভব চাপা দিল। তারপর বালতি করে পুকুর থেকে জল তুলে এনে দাদার কাছে গিয়ে দেখল বমি আর পায়খানাতে তার দাদার পা দুটো পুরো মাখামাখি হয়ে গেছে। সাধন নিজেও সেসব দেখে খুব দুর্বল অসহায় গলায় ভাইকে বলে,
‘হেগে - বমি করে কী কল্লোম বল দেখি! এখন কী হবে?’
বোধন আর দেরি কিংবা দ্বিধা করে না। বালতির জল তোবড়ানো কৌটোতে তুলে সযত্নে ধুইয়ে দিতে থাকে সাধনের বিবশ ঊরু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। কাদামাখা পিছন দিকটাও ধুয়ে দেয়। নোংরা লুঙ্গিটা খুলে ফেলে নিজের গামছাটা পরিয়ে দিয়ে দুহাতে ধরে তাকে নিয়ে চলল। যেতে যেতে দুর্বল গলায় ভাইকে অনুরোধ করে সাধন, 
‘জানিস বোদ্না, আমার ঘরে খাবার জল ফুইরে গেছে। অনেকক্ষণ হল জল খেতে পাইনি। তোর ঘরের থেকে আগে ভালো করে ঘটি দুই তিন জল দিস্ তো, আমি খাব। আমার গলা বুক সব যেন শুকনো কাঠ হয়ে গেছে।’ 

দাদার কথা শুনে একেবারে হাঁ - হাঁ করে ওঠে বোধন, 
‘খবদ্দার দাদা! এখন জল ছুঁবি না একদম! জল খেলিই তোর হাগা আরো পাতলা হয়ে যাবে। শুধু জল বেরোবে তখন। আর বেশি বেশি বমি পাবে। যত কষ্টই হোক জল একদম খাস্নি, তাহলে হাগা আর বমি দুই শালাই জব্দ হয়ে আসবে।’


ঘরে ঢুকে বিছানায় আর উঠতেই পারল না সাধন। বোধন কোনোরকমে ধরে তাকে বিছানায় তুলে দেয়। তাদের বাড়িতে কাঠের তৈরি তক্তাপোশ নেই। তক্তাপোশের মতো উঁচু করে বাঁশের তৈরি খুঁটির মাথায় মোটা বাখারি পেতে দিয়ে মাচা করা হয়েছে। তার উপরে কাদা মাটির প্রলেপ দিয়ে মোটামুটি সমতল করে তার উপর মাদুর-কাঁথা বিছানো। 

ময়লাটে সে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে শুয়ে থির থির কাঁপতে থাকে সাধন। হঠাৎ নিতান্ত অকারণে তার বড়ো কান্না পায় তার মেয়ে টুকির জন্য। ফিসফিসিয়ে কেঁদে ওঠে সে,
‘টুকি মা রে! - আর বুঝি তোর মুখটা একবার দেখা হবে নে রে -’ 
বোধন তখনও দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। দাদার কান্না জড়ানো কথা শুনে খুব চমকে ওঠে সে,  
‘একি কথা দাদা! টুকির সঙ্গে তোর দেখা হবে নে ক্যানো? আমি খবর পাটিয়ে কালই টুকি, আর টুকির মাকে আনাব। এখন আমি একটু ডাক্তারবাবুর কাছে যাই, ডেকে আনি। ওষুধ ইংজাশন পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আবার ওষুধ ইংজাশনের জন্যে টাকা-পায়সা খচ্চা করবি? অত টাকা পাবিই বা কোথায়? তাছাড়া বউমা যে বলল, এ হাগা কোনো অসুখের হাগা নয়, বদ-বাতাস লেগে হচ্ছে?  মস্ত বড়ো গুণিন বাড়ির মেয়ে সে! কত কিছু জানে -’
‘সে হোক গে। তবু ওষুধ খেতেই হবে এখন। অবস্থা তো ক্রেমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে - আমি যাই।’
‘যাসনি ভাই আমাকে একলা রেখে। জলার পাড়ে দেখা সেই হুমদো কেলে শালা আমায় একলা দেখে যদি আবার চলে আসে?’
‘এক্ষুনি তো ফিরে আসব। দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে শেকল তুলে দে’ যাচ্ছি। ভয় নেই তোর – মনে মনে হরির নাম কর্ এট্টু। আমি যাব আর আসব।’ 
আতঙ্ক আর করুণ নীরব অনুনয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে সাধন। সেই তাকিয়ে থাকা দেখে খুব মারাত্মক একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বোধন। একটু আগেই থেকে সেটা করবে কিনা ভাবছিল সে। দাদার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গভীর মমতায় বড়ো বিচলিত হয়ে পড়ে বোধনের ভ্রাতৃহৃদয়।
অবশেষে সব দ্বিধা ছুঁড়ে ফেলে বোধন। নিজের কোমর থেকে নিজের গভীর বিশ্বাসভরা, তার নিজের মহারক্ষাকবচ - ঘুনশিতে বাঁধা সেই মাদুলি-শেকড়, সবসুদ্ধ খুলে নেয়। নিজের জীবনের সম্ভাব্য সব বিপন্নতা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দাদার প্রাণ নিরাপদ পাহারায় রেখে যাবার জন্য দাদার কোমরে সেগুলো বেঁধে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দিতে থাকে,   
 ‘আর তোর কোনো ভয় নেই দাদা। আমার কোমরের এই মাদুলি-শেকড় খুলে তোর কোমরে বেঁধে দেলোম। আমার শউরোবাড়ির জিনিস এসব! আর কালো দানো বা অন্য কোনো কিছুই ঘেঁষতে পারবেই না তোর কাছে। তোর বউমা আমার কোমরে বেঁধে দেছিল।’
‘তবে তুই সেসব খুলে আমায় দিলি কেন ভাই? এত রাতে তুই বাইরে যাচ্ছিস। এখন তোর যদি কিছু বিপদ হয়?’
‘কিছু হবে না রে দাদা, - তুই শুয়ে থাক, আমি চট করে ঘুরে আসি।’


রাত তিনটে বাজে। হন্হনিয়ে হেঁটেও বোধনদের বাড়ি থেকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি যেতে প্রায় আধঘন্টার রাস্তা। সেখানে পৌঁছে বাইরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল গলায় ডাকাডাকি করতে লাগল বোধন। এত রাতে বাইরের দরজায় ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল ডাক্তারবাবুর। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে বেশ বিব্রত হলেন তিনি। 
গ্রামের একমাত্র ডাক্তার, পশার আছে অনেক, কিন্তু প্রাপ্তি খুব কম। দশ টাকা - পনেরো টাকা নিয়ে ওষুধ নিতে আসে বেশির ভাগ লোক। তারা জানে যে, টাকা যাই দেওয়া যাক না কেন, এই ডাক্তারবাবু কাছে ওষুধ পাওয়া যাবেই। 

কেউ কেউ আবার খালি হাতেই চলে আসে ওষুধ নিতে। ওষুধ নেওয়া হয়ে গেলে সবিনয়ে পরে এসে টাকা দোব’খন বলে চলে যায়। ওষুধ নিয়ে নেবার পর কিছু টাকা দিয়ে কেউ কেউ আবার পরামঈশ দেয়, 
‘জব্বর করে হালখাতা লাগিয়ে দ্যান্ তো ডাক্তারবাবু, - বছরে বার দুয়েক। সকলের জন্যে লুচি আর হালকা করে আলুর দম। শেষ পাতে চারটে করে জিলিপি। বাকি বকেয়া যা আছে সব ছেনে পুঁছে উঠে আসুক।’
 ডাক্তারবাবু মুখে ধমকে ওঠেন, - ‘দূর হ হতভাগা! এটা কী তুই দোকান পেয়েছিস নাকি? এর পর টাকা ঠিকমতো না আনলে কোনো ওষুধ আর দেবই না তোদের।’

কিন্তু এসব কথা তিনি মুখেই বলেন শুধু। অসুস্থ মানুষের জন্য ওষুধ দিয়ে তারপর পুরো টাকা না মেটালে আবার তা কেড়ে নেওয়া অথবা কোনো ওষুধ না দিয়ে একেবারে ফিরিয়ে দেওয়া তাঁর দ্বারা হবে না। বাইরের দরজা খুলে বোধনকে দেখে আবাক হলেন,
‘কী ব্যাপার বোধন? রাতে আমার ঘুমানোর দরকার নেই নাকি?’ 
হাত জোড় করে খুব কাতর হয় বোধন, 
‘আজ্ঞে, ডাক্তারবাবু, আমার দাদা সেই সন্ধেবেলা থেকে পাতলা হেগে যাচ্ছে।’
‘সন্ধেবেলা থেকে পাতলা পায়খানা হচ্ছে! আর তুই এলি এখন? এখন এই রাত সাড়ে তিনটের সময়!’ 
মাথা চুলকায় বোধন, ইতস্তত করে আসল কথাটা বলেই ফেলে,
‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার বউ বলেছেল দাদার বদ বাতাস লেগেছে, তাই এ্যামন হাগা হচ্ছে। আমার বউ আবার মস্তবড়ো গুণিন বংশের মেয়ে কিনা! আমার শউরো মশায়ের নাম হল গুণিন মহারাজ শ্রীযুক্ত ভৈরবকিঙ্কর -’
‘বোধন, আমি যেটা জিজ্ঞাসা করব শুধু সেটারই উত্তর দিবি। কাল রাতে কী খেয়েছিল সাধন?’
‘আজ্ঞে, দুকুরের ভাত, ওবেলার পুঁইশাগের ঘ্যাঁট, খেসারির ডাল, মন্তরপড়া তেঁতুল আর পশ্চিম-মুকো লংকাপোড়া -’
‘মন্তরপড়া তেঁতুল কথাটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু পশ্চিম মুখে লংকাপোড়াটা কী জিনিস? ওটা কীসের জন্য?’
‘দাদা বলেছিল বটে, হাটে জগা শালার দোকানের বাসি ঘুঘনি আর আলুকষা খেয়ে ওর পেট খুব ব্যথা হচ্ছে, পচা গন্ধের ঢেকুর উঠছে, পেটের মদ্দি গড়গড় শব্দ হচ্ছে। কিন্তু দাদার হাবভাব দেখে আমার বউ বলেছিল, পেট ঠিক আছে। প্রিকিত ঘটনা হচ্ছে বদ-বাতাস লেগে গেছে। তাই কাটাবার জন্য আমার বউ পশ্চিম-মুকো লংকাপোড়া -’
‘চুলোর যাক তোদের বদ-বাতাস! হাটের পচা ঘুগনি আর আলুর দম খেয়ে পেট খারাপের ওপর ওইসব ভয়ংকর পথ্য? এখনও পর্যন্ত পায়খানা কতবার করেছে? বমি কতবার হয়েছে?’
‘তা সাত-আটবার হেগেছে মনে হয়। বমি বার চারেক হয়েছে।’
‘ই-স-স্-স! এতবার? খুব বেশি বেশি করে জল খাচ্ছে তো?’
‘আজ্ঞে ওই ভুলটা আর করতে দিইনি। খুব করে জল খেতে চাচ্ছিল দাদা সেই কখন থেকে। একটা ফোঁটাও জল দাদাকে খেতে দিইনি, বারণ করিচি। হুঁ হুঁ বাবা - আমি জানি জল খেলেই জল হাগবে শুধু।’
‘হা ঈশ্বর!! তাহলে, - তাহলে পেশেন্ট, মানে সাধনের অবস্থা এখন কেমন?’
‘এমনি মনে হয় তো ঠিক আছে। তবে খুব নিঃসাড়া হয়ে এসেছে – শেষ বারে হাগতে গিয়ে কালো দানো দেখেছে।’
‘কালো দানো! সেটা আবার কী জিনিস?’
‘খানিক আগে হাগতে গিয়ে আমায় ডেকে বলছেল, বোদ্না ওই দ্যাক্ কলাগাছের পাশে কালো মতো কে যেন দেঁইড়ে আছে। আমার কোমরে শউরোবাড়ির মাদুলি-কবচ বাঁধা ছেল বলে আমি ওসব কিছু দেখতে পাইনি। শুধু দাদাই কালো – ’
‘হায় - হায়! কী সর্বনাশ! পেশেন্টের কাছে কে কে আছে এখন?’
‘কেউ নেই এখন। বউদি আর আমার বউ তো এখন -’
‘তার মানে!’ - প্রায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন ডাক্তারবাবু - ‘সাধনকে ওইরকম সাংঘাতিক অবস্থায় একা ফেলে রেখে চলে এসেছিস?’
‘হ্যাঁ - তবে আমার মাদুলি-কবচ খুলে দাদার কোমরে বেঁধে দিয়ে -’ 
খুব হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকান ডাক্তারবাবু, 
‘ভীষণ রকমের খারাপ কাজ করা হয়েছে রে বোধন। তবু তুই এক্ষুনি দৌড়ে বাড়ি চলে যা - দৌড়ে চলে যা দাদার কাছে!’
‘আপনি যদি একবার যেতেন ডাক্তারবাবু! আপনি গেলে - একটু দেখলে -’
‘আমি তো যাচ্ছি, - তুই দৌড়ে যা আগে। বেশি কিছু করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে - তবু যাব। কিন্তু তুই দৌড় লাগা বোধন।’


প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ, ইনিফিউশন সেট, স্যালাইন বোতল ইত্যাদি খুব বিষণ্ণ মনে গোছাতে লাগলেন ডাক্তারবাবু। এখানে তাঁর শত্রুর সংখ্যা অনেক – নানা রকম রোগব্যাধির সঙ্গে সঙ্গে আছে অশিক্ষা, কুসংস্কার, মন্ত্রতন্ত্র, স্বাস্থ্য উদাসীনতা। দিনের পর দিন এতগুলো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই দিতে দিতে তিনি পেরেও উঠছেন না আর। 
সাধনদের বাড়ির কাছাকাছি এসে বোধনের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। প্রচন্ড ক্ষোভে ডাক্তারবাবু চিৎকার করে উঠলেন,  
‘তুই এখনও পথেই ঘুরছিস আহাম্মক! বাড়িতে সাধনের কাছে যাসনি?’
নিরুত্তর বোধন এগিয়ে আসে। তারপর খুব বিভ্রান্তভাবে ফ্যাঁসফেঁসে অস্বাভাবিক তার গলা খুব কাঁপা কাঁপা হয়ে গেছে,
‘বাইরে থেকে দরজায় শেকল তোলা ঘরের মদ্দে দাদা ছেল। কিন্তু এখন শেকল খুলে ঘরে ঢুকে দেখি দাদা সেই ঘরের মদ্দে কোত্থাও নেই। সেই শালা কালো দানো এসে মনে হয় তাকে তুলে নিয়ে গেছে!’
ধাক্কা দিয়ে বোধনকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত পদে বাড়ির উঠানে পা দিলেন ডাক্তারবাবু। দাওয়াতে ব্যাগটা রেখে টর্চটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বোধনকে ডাকেন,
‘শিগ্গির এদিকে আয়। সাধন ঠিক কোথায় শুয়েছিল দেখা আমাকে।’
‘ওই যে ওখানে - ওই বিছানায়’ - কাঁপা গলায় বলে বোধন - ‘নড়ার ক্ষমতা ছেল নি দাদার। ধরে তুলে শুইয়ে দিতে হয়েছেল। তাহলে আমার দাদা কোথায় গেল? তবে কী কালো দানো সত্যিই দাদাকে নিয়ে চলে গেল? আচ্ছা - একবার পুকুর পাড়টা দেখে আসব? যদি ওই দাদাকে দিকে নিয়ে টিয়ে যায়?’
‘না। ওখানে সে নেই।‘’
শূন্য বিছানাটা আর মেঝে ভালো করে দেখে নিয়ে ডাক্তারবাবু টর্চ নিভিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন ।অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থ সাধনের পক্ষে কোথাও যাওয়া কী করে সম্ভব? পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বোধন ফিসফিসিয়ে কাঁপা গলায় বলে,
‘ডাক্তারবাবু, বলি কী চার পাশের গাছগুলো একবার ভালো করে দেখলে হয় না? অনেক সময় কালো দানো মানুষকে মেরে রক্ত খাবে গাছের ওপর তুলে নেয় বলে শুনিছি!’
‘না। ওসবের কোনো দরকার নেই। তুই আর একবার ভালো করে ভেবে বল, এখান থেকে যাবার আগে সাধনকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে তুই ঠিকমতো শিকল তুলে দিয়েছিলি? কোথাও তোর ভুল হয়নি তো?’
‘না না, ডাক্তারবাবু আমার পষ্টো মনে আছে দাদা এই ঘরের ভেতরে ওই বিছানায় পড়ে ছিল। আমি বাইরে থেকে নিজের হাতে শেকল তুলে আটকে দিয়ে তবেই গিছি।’
‘যদি তাই হয়’ - একটু থামলেন ডাক্তারবাবু। তারপর বললেন - ‘তাহলে, তোরই কথা অনুযায়ী, সাধন তাহলে বাইরে কোথাও যেতে পারেনি, নিশ্চয়ই এই ঘরের মধ্যেই কোথাও না কোথাও সে আছে।’


আবার ডাক্তারবাবুর টর্চ জ্বলে উঠল। এবার তাঁর টর্চের আলো ঘরের আনাচে কানাচে ধীরে ধীরে খুঁজতে খুঁজতে ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে টর্চের আলো ঘরের এক কোণে, যেখানে কয়েকটা বাক্স-প্যাঁটরা পরপর সাজিয়ে উঁচু করে রাখা ছিল, - সেখানে গিয়ে স্থির হল। সেখানেই সাধন রয়েছে!

সাধন সেই বাক্স প্যাঁটরাগুলোর উপর বসে আছে – পিছনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে। দুদিকে পা ছড়িয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বসে আছে। পরনের গামছাটা একপাশে ঝুলছে, তার চোখ দুটো বিস্ফারিত। জোরালো টর্চের আলোতে একটুও কাঁপল না সে চোখের পাতা।
‘ওই তো দাদা!’ - আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে বোধন - ‘ওই তো আমার দাদাটা বসে আছে! যাক বাবা, বাঁচা গেল! আচ্ছা দাদা, তুই
ওকেনে কী করতে গিছিস? তোর না শরীর কাঁপছেল? ডাক্তারবাবু, ওকে ধরে ধরে এনে আমি বিছানায় শোয়াচ্ছি। তারপর আপনি -’
ডাক্তারবাবু ততক্ষণে সাধনের একেবারে কাছে চলে গেছেন। স্থির বিস্ফারিত চোখে একই ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে সাধন। ডাক্তারবাবু ডান হাতে জ্বলন্ত টর্চ ধরে রেখে বাঁহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী অনেকটা ফাঁক করে সাধনের চোয়ালের নীচে গলায় দুপাশে চেপে ধরলেন।

গলায় ওইভাবে ধরতেও একটুও নড়ল না সাধন। ততক্ষণে ডাক্তারবাবুর শিক্ষিত অভিজ্ঞ আঙুল তাঁকে নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে সাধনের ক্যারোটিড আর্টারি সম্পূর্ণ স্তব্ধ, - উত্তাপ হারিয়ে ফেলে তার গলার খাঁজ এখন হিম শীতল!
 নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। তারপর সাধনের খোলা চোখের পাতা দুটো আঙুলে চেপে বন্ধ করে দিলেন ডাক্তারবাবু। তারপর বাইরের বারান্দায় এসে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠানে নামলেন। পিছন থেকে বিমূঢ় বোধন ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে ওঠে, 
‘চলে যাচ্ছেন ডাক্তারবাবু? দাদার চিকিচ্ছে? ওষুধ? ইংজাশন কিছু দেবেন না?’ 
বোধনের দিকে ঘুরে তার কাঁধে একটা হাত রাখেন ডাক্তারবাবু। খুব শান্ত বিষণ্ণ গলায় তাকে জানালেন,
‘মন শক্ত কর্ বোধন। তোর দাদা আর বেঁচে নেই। বেশ কিছুক্ষণ আগেই মারা গেছে। কয়েকজন লোক ডেকে এনে বডিটা ওখান থেকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা কর।’ 
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে থপ্ করে উঠানে বসে পড়ে বোধন। তার স্খলিত গলায় কান্নার ছায়া,
‘দাদা মরে গেছে? বেঁচে নেই!! কিন্তু - কিন্তু আমার দাদাকে মারল কে? দাদা বাগানে যাকে দেখেছেল সেই কালো দানো?’
‘কালো দানো বলে কিছু হয় না রে বোধন। সাধন তখন যা দেখেছিল তা ছিল মস্তিষ্কের সাংঘাতিক বিকার জনিত দৃষ্টিভ্রম। আসলে তখন তার টোটাল সি. এন. সিস্টেমের - যাক্ গে, এসব তুই বুঝবি না। এখন তোকে যা বললাম সেটা কর।’

‘দাদাকে ওখেনে বাস্‌কোর ওপর কে টেনে নে গেল ডাক্তারবাবু?’
‘সাধনকে ওখানে কেউ নিয়ে যায়নি রে। তোকে এখন এসব ব্যাপার কী করে বোঝাব? সাধন নিজের অজান্তেই নিজেই ওখানে চলে গেছে। এটা ঘটেছে এই ধরণের পেশেন্টের একটা অন্তিম অবচেতন বিক্ষেপের ফলেই। এই জন্যই এরকম পেশেন্টকে কখনও একলা রাখতে নেই। পেশেন্টের কাছে অবশ্যই কারো না কারো থাকা উচিত। মন খারাপ সামলাবার চেষ্টা কর। আর একটা কথা তোকে না বলেও পারছি না, তুই খুব মারাত্মক ভুল করেছিস বোধন তোর দাদাকে জল খেতে না দিয়ে। যদি প্রথম থেকেই তোর দাদাকে প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়াতে পারতিস তাহলে হয়তো তাকে বাঁচাবার অন্তত একটা চেষ্টা করার অনেকটা সম্ভাবনা থাকত। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এটা বলতেই হল।’

অস্পৃহ মৃত্যুর কঠিন পদচিহ্ন বহনকারী সেই অমারাত্রির অপসরণে ভোর এগিয়ে আসার সময় হয়েছে। কচি আলোর আগমনে আকাশের বাসি বুড়োটে কালি ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। শূন্যরক্ত বিবর্ণ আকাশের দেহে রক্তসঞ্চারের সূচনা হচ্ছে। প্রাক ঊষার ব্রাহ্মমুহূর্তের সেই নৈসর্গিক স্নিগ্ধ নীরবতাকে চিরে ফালা ফালা করে দিচ্ছিল বোধনের ভাঙা বিকৃত ভেদী কণ্ঠস্বরের একটাই শব্দ,
‘ওরে দাদারে - এ - এ ! ওরে দাদারে - এ - এ ! ওরে দাদা …’





'উৎস'তে প্রকাশিত লেখক তুষার সরদারের অন্যান্য লেখা (পড়তে লাল অক্ষরে ক্লিক করুন) -

ছোটগল্প

প্রবন্ধ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ