|| এক ||
র বছর পর আফ্রিকা থেকে বাড়ি ফিরেছেন শ্যাম দাদা। প্রায় সারা জীবন বিদেশে কাটিয়েছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবী জুড়ে। অংশ নিয়েছেন হাজারো অভিযানে। বন্দুক হাতে আফ্রিকান সিংহের মুখোমুখি দাঁড়ানো থেকে আল্পস পর্বত চড়া, অনেক দুঃসাহসিক অভিযানের সাক্ষী থেকেছেন তিনি।
এবার দেশে তথা বাড়িতে ফিরেছেন সম্পূর্ণ অন্য এক উদ্দেশ্য নিয়ে। তার বাবার আমলের বিশেষ কিছু দুষ্প্রাপ্য কাগজ পত্র নাকি আছে তার বাড়িতে। সেগুলো প্রায় ধ্বংসের মুখে। সেই বিশেষ কাগজপত্রগুলোকে সংরক্ষণ করাই তার উদ্দেশ্য।
শ্যাম দাদা বাড়ি ফিরছেন শুনে পাড়ার ছেলে বুড়ো সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। কেবল বিদেশী চকোলেটের লোভ নয়, শ্যাম দাদার সঙ্গে সান্ধ্যকালীন বৈঠকি আড্ডা দেওয়াটাও এক বিশেষ আকর্ষণ প্রতিবেশীদের কাছে। কত অ্যাডভেঞ্চার, কত দুঃসাহসিক অভিযানের অভিজ্ঞতা যে তার ঝুলিতে আছে, সম্ভবত তিনি নিজেও এক কথায় বলতে পারবেন না।
সন্ধ্যা হতে না হতেই পাড়া ঝেঁটিয়ে লোকজন হাজির হয়েছে আমাদের বাড়ির ছাদে। আম, নিম, নারকেল, সুপারি গাছে ঘেরা আমাদের বাড়ি। মার্চ মাসের হালকা গরমের মধ্যে এলোমেলো বাতাস, মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আড্ডা মারা, গল্প গুজবের পক্ষে একেবারে আদর্শ। এসে গেছেন শ্যাম দাদা। হাতে একটা বেশ পুরানো ছেঁড়া খাতা। দেখে বোঝা যায় না শ্যাম দাদার বয়স ঠিক কত! পঁয়ষট্টি হতে পারে, সত্তর হতে পারে, পঁচাত্তরও হতে পারে। তবে চেহারাটা টেনিস খেলোয়াড়দের মত মেদহীন টানটান। সারা শরীর থেকে যেন এনার্জি চুইয়ে পড়ছে। সবার জন্য চা এসে গেছে। বাড়ির চা অবশ্য শ্যাম দাদার পছন্দ নয়। দিলীপের দোকানের চা চাই তার। তাও আবার কাচের বা কাগজের বা প্লাস্টিকের গ্লাসে নয়, মাটির ভাঁড়ে। বোঝা মুশকিল কোনটা তার বেশি পছন্দ, দিলিপের দোকানের চা নাকি মাটির ভাঁড়।
চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে শব্দহীন চুমুক দিতে দিতে তার হাতের ছেঁড়া খাতাটা দেখিয়ে বললেন, "পুরানো কাগজের স্তূপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই খাতাটা পেলাম। খাতায় এমন কিছু লেখা আছে সেটা কোনো ঘটনার বিবরণ নাকি নিছক গল্প বুঝতে পারছি না! খাতাটাতে যা কিছু লেখা সেটা আমার বাবার হাতের লেখা। খাতাটা পড়তে শুরু করার আগে আমার বাবার সম্বন্ধে দু চার কথা না বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। আমার বাবা রমন বোস যেমন বন্দুক চালাতে পারদর্শী ছিলেন, তেমনি ছিলেন সাহিত্য প্রেমী। অর্থাৎ যে হাতে বন্দুক চালাতেন সেই হাতে গল্প, কবিতা লিখতেন। সেইজন্য বুঝতে পারছি না এই খাতায় যা কিছু লেখা আছে সেটা কি কোনো সত্য ঘটনার বিবরণ, নাকি কোনো রোমহর্ষক গল্প! যাইহোক আমি পড়ছি, শেষটা তোমরা বিচার কোরো। খাতায় কোনো তারিখের উল্লেখ না থাকলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে খাতাটা অন্তত সত্তর বছরের পুরানো।"
|| দুই ||
রবিবারের অলস সকাল। সাতটা বাজতে না বাজতেই দরজায় টোকা। বাড়ির বাইরে থেকে কেউ ডাকছেন, "রমন বাবু বাড়ি আছেন?"
দরজা খুলে বাড়ির বাইরে এলেন রমন, "আমি রমন বোস "
- "নমস্কার। আমার নাম অসিত মিত্র। সোনার পুরে থাকি। ডাক্তার দীপক পাকড়াশীর কাছ থেকে আসছি। বিশেষ দরকারে উনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। কিছু কথা আছে আপনার সঙ্গে।"
- "ভেতরে আসুন।"
অসিত মিত্রকে ড্রয়িং রুমে এনে বসালেন রমন। অসিত বলতে লাগলেন, "আমি দীপকের প্রতিবেশী। বারুইপুর বাজারে আমাদের কাপড়ের এবং চালের পাইকারি ব্যবসা আছে। সম্প্রতি আমাদের কয়েকজন আত্মীয় এবং তাদের কিছু পরিচিত বিশেষ কাজে সুন্দরবনে যায়। কিন্তু আচমকা ঝড় ওঠায় তারা দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।"
- "বিশেষ কাজ! কি কাজ?"
- "সুন্দরবনের মৌলেদের সঙ্গে ওদের মধুর ব্যবসা আছে। তাছাড়া ...।" ইতস্তত করতে থাকেন অসিত।
- "তাছাড়া কি?"
নিচু স্বরে অসিত বললেন, "আমি ঠিক জানি না। তবে শুনেছি চোরাই কাঠের ব্যবসার সঙ্গে ওদের কেউ কেউ জড়িত। সেইজন্য গভীর জঙ্গলে গিয়েছিল। আচমকা ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ওরা দিক হারিয়ে ফেলে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওদের কয়েকজন ফিরে আসে। কয়েকজনকে মৌলেরা উদ্ধার করে। কিন্তু দুজন এখনো নিখোঁজ। ঐ দুজন আমার শ্যালক। ওরা কোথায় গেল? এখনো বেঁচে আছে কিনা কিছুই বুঝতে পারছি না! সেইজন্য দীপকের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। দীপকও আপনার মত একজন ট্রেন্ড গানার। শিকারের অভিজ্ঞতা আছে। আমরা ঠিক করেছি, ওদের খুঁজতে আমরা সুন্দরবনে যাবো। সমস্ত খরচ আমার। এখন আমার অনুরোধ যদি আপনি আমাদের সঙ্গে যান তাহলে খুব ভালো হয়। আরো কয়েকজন যাবেন বলে জানিয়েছেন। ক্যানিং থেকে আমাদের নৌকা ছাড়বে। বেশ কয়েকটা রাইফেল জোগাড় করা হয়েছে।"
- "সব ঠিক আছে। কিন্তু এতবড় জঙ্গলে দুজন মানুষকে খুঁজবেন কি করে?"
- "যারা ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে একজন যাবে আমাদের সঙ্গে। তার মুখে শুনলাম ওরা মাতলা নদী ধরে গোসাবা, সজনেখালি হয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে, দোবাঁকির জঙ্গলের কাছাকাছি গিয়ে একটা খাঁড়িতে ঢুকে কিছুটা গিয়ে, তারপর ডাঙায় উঠেছিল। জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরে ঢুকেছিল।"
- "তার মানে ওরা প্রায় কোর এরিয়ায় ঢুকে পড়েছিল! অর্থাৎ প্রায় জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল!"
- "আর বলবেন না। লোভ যে মানুষকে কত দুরে টেনে নিয়ে যায়!"
- "ঠিক আছে আমি যাবো। আপনারা কবে রওনা দিচ্ছেন?"
- "পরশু। আসলে বেশি সময়তো নষ্ট করা যাবে না। সকাল সাতটায় আমাদের নৌকা ক্যানিং থেকে ছাড়বে। আপনার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে কাল বিকালের মধ্যে আমাদের বাড়ি চলে আসুন। পরশু সকালে আমাদের গাড়িতে ক্যানিং যাবেন।"
- "আপনি কি নিজের গাড়িতে এসেছেন?"
- "হ্যাঁ।"
- "তাহলে আমার রাইফেলটা সঙ্গে নিয়ে যান। আমি কাল দুপুরের পর পৌঁছে যাবো। আপনার ঠিকানাটা এই কাগজটাতে লিখে দিন।"
- "আপনার রাইফেল?"
- "হ্যাঁ, লাইসেন্সড।"
অসিত বেরিয়ে যাওয়ার পর রমন অনেক বার চেষ্টা করার পর ডাক্তার দীপককে টেলিফোনে পেয়ে প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিলেন।
পরের দিন বিকালে রমন পৌঁছে গেলেন অসিতের বাড়ি। ডাক্তার দীপক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন আরো তিন জন অপরিচিত মুখ। অসিত রমনের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। রতন মাঝি, শ্যামল মন্ডল এবং রাম বারুই। প্রত্যেকেরই সুন্দরবন সম্বন্ধে কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা আছে। কয়েক দিন আগে শ্যামল মন্ডল সুন্দরবন থেকে প্রাণ হাতে করে ফিরে এসেছেন। উনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
রাতটা অসিতের বাড়ি কাটিয়ে ভোর হতে না হতেই সবাই রওনা দিল ক্যানিংয়ের উদ্দেশ্যে। চারজন মাঝি সমেত দশজনের দল নিয়ে ঠিক সকাল সাতটায় নৌকা ছাড়লো। সঙ্গে পাঁচটা রাইফেল, কার্তুজ, দা, ছুরি এবং বেশ কিছু আতসবাজি।
পেশিবহুল হাতে দাঁড় বাইছে মাঝিরা। তরতর করে এগিয়ে চলেছে নৌকা। বাতাসও সঙ্গ দিচ্ছে। নদীর দুদিকের সবুজ রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। বেশ কিছু দুর যাওয়ার পর বড় মাঝি মৈদুল বলে উঠলো, "দ্যাখেন বাবুরা মোদের নাও গোসাবা ছাড়ি যাতিছি। আর কিছুদূর যাওনের পর, মা বনবির থান পড়বিক। আমি ঝট করি বনবির পুজো দে আসমু। আপনারা নাও থেকি নামবেন নি।"
"সেকি মৈদুল আমাদের বন বিবির মন্দির দেখাবে না?" প্রশ্ন করেন ডাক্তার দীপক।
- " না বাবু। সময় বড় কম। বেশি সময় নষ্ট করা যাবে নি। আমি যামু আর আমু। আপনারা নাওতে থেকি বনবিরে পেন্নাম করি বলেন যে আমরা সফল কাম হই ফেরোনের পথে মা তোমার পুজো দিমু, দর্শন করমু।"
কিছু পরে নৌকা তীরে ভিড়লো। মৈদুল ছুটতে ছুটতে গিয়ে পুজো দিয়ে এলো। আবার নৌকা চলতে শুরু করলো। সজনে খালি ছাড়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে শ্যামল সেই বিশেষ খাঁড়িটা দেখালো, যেখান দিয়ে তাদের নৌকা একটা নদীতে ঢুকেছিল। মৈদুলরাও সেই নদী ধরে নৌকা চালাতে লাগলো। দাঁড় বাইতে বাইতে মৈদুল বলতে লাগলো, "মোরা খাঁড়িতে ঢুকি পড়িছি। কিন্তুক মাতলা ধরি সোজা আর এক দেড় মাইল যাতি পারলে দোবাঁকির জঙ্গল পড়বিক। দোবাঁকি! বড় ডরের জায়গা। পায়ে পায়ে মরণ জড়ায় আছে! ডাঙায় দক্ষিণ রায়, পাণিতে কালু রায়!"
রমন প্রশ্ন করলেন, "কালু রায় কে? তুমি কি কুমিরের কথা বলছো?"
- "পাণিতে থেকি ত্যানাদের নাম নেবেন নি বাবু। অনত্থ ঘটি যাবে! ত্যানারা ডাক শুনতি পান। যখন তখন আসি যেতি পারি!" স্পষ্টতই বিরক্ত মনে হল মৈদুলকে, "এটা বাদা বন। বড় কঠিন ঠাঁই। কত শত মাইনষি দক্ষিণ রায়ের প্যাটে চলি গিছে তার লিখা ঝুখা নাই! কালু রায় ন্যাজের ঝাপটিতে কত নাও যে উল্টাই দিছে, কত মাইনষি যে ত্যানার প্যাটে চলি গিছে তার কুনো হিসাব নাই! তবে বনবিরে স্মরণ ন্যান। তিনি সহায় থাকলি কেউ ক্ষেতি করতি পারবে নি।"
খাঁড়ি ধরে এগিয়ে চলেছে নৌকা। কিছু মানুষ নদীর তীরে মিন, কাঁকড়া ধরছে। অসিত কোনো দিন সুন্দরবনের ধারে কাছেও আসেন নি। তার সব কিছু নতুন লাগছে। তিনি মৈদুলকে প্রশ্ন করলেন, "এরা এরকম অদ্ভুত ভাবে মাথার পেছন দিকে মুখোশ পরে আছে কেন?"
- "বাদা বনের মাইনষিদের বড় জ্বালা গো বাবু! বড় জ্বালা! ঘরে দানাপাণি থাকে নি। তাই পরাণডারে হাতে করি চলি আসে মিন, কাঁকড়া ধরতি। যারা আসে সবাই কি আর ঘরে ফিরতি পারে? পারেনিগো বাবু, পারে নি! অনেকেই চলি যায় ত্যানাদের প্যাটে। ত্যানাদের হাত থেকি বাঁচতি এ এক চালাকিগো বাবু।"
মৈদুল থামতে ডাক্তার দীপক বললেন, "টাইগার ইউজ টু অ্যাটাকস ফ্রম বিহাইন্ড। সেইজন্য ওরা মাথার পেছন দিকে মুখোশ পরে আছে। বাঘকে বিভ্রান্ত করার একটা প্রয়াস। জাস্ট একটা ধোঁকা বাজি। তবে এতেও শেষ রক্ষা হয় না। অনেকেই জঙ্গলে প্রাণ হারায়।"
এগিয়ে চলেছে নৌকা। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর শ্যামল মন্ডল বলে উঠলেন, "নৌকা থামাও এখানে নামতে হবে। এখান থেকেই আমরা জঙ্গলে ঢুকে ছিলাম।"
নৌকা ভিড়লো। নামার জন্য লম্বা পাটাতন পাতা হল। একটা রাইফেল হাতে প্রথমে নামতে গেলেন রতন মাঝি। মৈদুল বলে উঠলো, "বাবুরা বনবির আশীর্বাদ সঙ্গে রাখেন। এই লাল সুতাগুলা হাতে বাঁধি ন্যান।" সবাইয়ের হাতে এক টুকরো করে লাল সুতো দিলেন মৈদুল। লাল সুতো হাতে বেঁধে পাটাতনে উঠলেন রতন মাঝি। আচমকা বেশ জোরে দুলে উঠলো নৌকা। মনে হল কে যেন খুব জোরে ধাক্কা দিল। কাদায় ছিটকে পড়লেন রতন। রাইফেলটা কিছু দুরে কাদায় পড়লো। আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনায় সবাই বেশ হতভম্ব হয়ে গেছেন। কাদা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন রতন। কিন্তু তার দুপা কাদায় আটকে গেছে।
ওদিকে ওটা কি? সবাই একরাশ উদ্বেগ আর বিস্ময় নিয়ে দেখছেন জল থেকে গুটি গুটি পায়ে উঠে আসছে এক বিশালাকার কুমির। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। কি করা যায়? কি করা উচিত? কেউ ভেবে পাচ্ছেন না। কুমিরটা রতনের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। এবারে কি হবে? কি করে বাঁচবেন রতন? রতনকে কি কুমিরটা এবার জলে টেনে নিয়ে যাবে? কিছুক্ষণ পরে নদীর জলটা কি রতনের রক্তে লাল হয়ে উঠবে? প্রথম দিনেই কি এতবড় অঘটন ঘটবে? সবাই বোধ বুদ্ধি হারিয়ে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে আছেন। বন্দুক তোলাতো দুরের কথা, ঈশ্বরকে ডাকতে পর্যন্ত ভুলে গেছেন সবাই! মৈদুল একটা ছুরি ছুঁড়ে মারলো কুমিরটাকে। ছুরিটা কুমিরের গায়ে লেগে ছিটকে এলো রতনের কাছে। হাত বাড়িয়ে ছুরিটা তুলে নিলেন রতন। এতবড় বিপদের সম্মুখীন হয়েও, মৃত্যুর এত কাছে দাঁড়িয়েও একটুও নার্ভাস হননি রতন। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে তৈরি তিনি। কিন্তু এত ছোটো একটা ছুরি কি রতনকে রক্ষা করতে পারবে? কুমিরের পুরু চামড়া ভেদ করে তাকে আহত করতে পারবে? একদম কাছে এসে গেছে কুমিরটা। কামড় বসাতে চলেছে রতনের পায়ে। কিন্তু তার আগেই রতন ছুরিটা বসিয়ে দিয়েছেন কুমিরটার বাঁ চোখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। একটা চোখ হারিয়ে, শিকার ছেড়ে কুমিরটা ফিরে গেল জলে। একটা বড় বিপদ কাটলো। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
কয়েক মুহুর্ত পরে জলের দিকে তাকিয়ে আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সবাই। তিন তিনটে কুমির ভেসে আসছে ডাঙার দিকে! এবারে ঘাবড়ে না গিয়ে হাতে রাইফেল তুলে নিয়েছেন কেউ কেউ। মৈদুল চিৎকার করছে, "এডা বন্ডুকের কাম নয়। বন্ডুক ছাড়ি পটকা ফাটান বাবুরা। যত পারেন পটকা ফাটান।" আতস বাজিতে আগুন লাগিয়ে সবাই ছুঁড়তে লাগলেন জলের দিকে। বাজির শব্দে ভেঙে খান খান হয়ে গেল জঙ্গলের নিস্তব্ধতা। বাজির শব্দে ভয় পেয়ে আবার জলে ফিরে গেল জলের শ্বাপদরা। অনান্যরা নৌকা থেকে নেমে এসে রতনকে তুলে নিয়ে গেলেন। নৌকার পাটাতন থেকে ছিটকে পড়ায় কিছুটা চোট লেগেছে রতনের পিঠে। খুব যন্ত্রণা করছে। ডাক্তার দীপক তার চিকিৎসা করলেন। বেদনা নাশক ওষুধ দিলেন। একটা দিন বিশ্রাম নিতে বললেন। রতন থেকে গেলেন নৌকায়। এই দলে আর কেউ রতনের মত এত ভালোভাবে সুন্দরবনকে চেনেন না। শ্যামল আশ্বাস দিলেন যে পুরো সুন্দরবনটাকে না চিনলেও, এই জায়গাটা তার ভালোভাবে চেনা। তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। মৈদুল বললো সেও যাবে, কারন সুন্দরবনের প্রকৃতি, চরিত্র তার অনেকটা জানা।
সবাই ডাঙায় উঠলেন। নৌকা থেকে রতন চিৎকার করে বললেন, "সাবধান। শুলো থেকে সাবধান।"
মৈদুল উত্তর দিলো, "চিন্তা করবেন নি বাবু। আমি আছি।" রতনকে আশ্বাস দেওয়ার পর মৈদুল অনান্যদের উদ্দেশ্যে বললো, "চরাতে সাবধানে হাঁটবেন বাবুরা। দ্যাখেন গাছের শেকড়গুলা কেমন মাটি ফুঁড়ে মাথা উঠাইছে। একটু অসাবধান হলি বড় বিপদ ঘটি যাবে।"
ডাক্তার দীপক যোগ করলেন, "লবণাক্ত মাটিতে বাতাস খুব কম থাকে। তাই প্রধানত ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের শেকড় মাটির উপরে উঠে থাকে শ্বাস নেওয়ার জন্য। একে শ্বাস মুল বলে। স্থানীয় ভাষায় 'শুলো' বলে। বাঘ সাধারণত নদীর চর থেকে মানুষ ধরে এই শুলোর ওপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায়। বারে বারে শুলোর আঘাতেই সে মারা যায়। সত্যি কি ভয়ঙ্কর এই সুন্দরবন!"
মৈদুল সমেত ছয় জনের দলটা শ্যামলের দেখানো পথ ধরে হাঁটতে থাকে। চারজনের হাতে রাইফেল। অসিত বন্দুক চালাতে পারেন না। তাই তিনি একটা মোটা লাঠি নিয়েছেন। কোমর বন্ধনীতে গুঁজে রেখেছেন একটা ধারালো দা। নৌকা থেকে নামার পর থেকেই মৈদুল বারে বারে মাটি পরীক্ষা করছে, দেখছে কোথাও বাঘের পায়ের ছাপ আছে কিনা। জঙ্গল খুব একটা ঘন নয়, তাই হাঁটতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। বড় কোনো বন্য প্রাণী দেখা না গেলেও মাঝে মাঝে পাখির ঝাঁক চোখে পড়ছে। হাজারো পাখির ডাক কানে আসছে।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর মৈদুল বললো, "বাবুরা আজ আর এগুনো যাবে নি। বেলা গইড়ে এসিছে। বিকেলের পর জঙ্গলের চেহারা চরিত্তির পাল্টি যায়। তাছাড়া আর কিছু দুরে হেঁতালের জঙ্গল। হেঁতালের জঙ্গলে ত্যানাদের আনাগোনা খুব বেশি হয়!"
ফেরার আগে ডাক্তার দীপক পকেট থেকে রুমাল বের করে একটা গাছের ডালে বেঁধে দিলেন। বললেন, "একটা চিহ্ন রাখলাম। কাল আবার এখান থেকে খোঁজা শুরু হবে।"
শ্যামল বললেন, "এখানে এসে আমরা ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। এই জায়গাটা আমার ভালোভাবে চেনা। তাই চিহ্ন না রাখলেও চলবে।"
নৌকায় ফিরে এলেন সবাই। প্রত্যেকেরই খুব খিদে পেয়েছে। মাঝিরা রান্না করে রেখেছিল। তাড়াতাড়ি খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লেন। সারা দিন অনেক ধকল গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখে ঘুম এসে গেল। নৌকায় থেকে যাওয়া তিন জন মাঝি আর রতনের চোখে ঘুম নেই। অমাবস্যার রাত। যেন অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেছে চরাচর। অবশ্য হাজারো জোনাকি মিটমিট করে জ্বলছে। অবিরাম ভাবে শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝিঁর ডাক। মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে বিভিন্ন প্রাণীর ডাক ভেসে আসছে। প্রায় মধ্য রাতে শোনা গেল সেই হাড়হিম করা গর্জন। কি ভয়ঙ্কর সেই গর্জন! একবার শুনলেই যেন হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসে! বাঘের ডাক শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন অসীম। রতন বললেন, "ভয় পাবেন না। এ ডাক অনেক দুর থেকে আসছে।"
মোটামুটি নির্বিঘ্নে কাটলো রাতটা। ভোর হতে না হতেই তোড়জোড় শুরু হল। আজ রতনও যাবেন। মৈদুল বললো, "আজ মোরা হেঁতালের জঙ্গলে যামু। বন্ডুক, টোটা সব ভালো করি দেখি ন্যান। সাথে কিছু বাজি, পটকা, লিয়ে লিবেন। কখন কি দরকার হইবো আগে থেকে বলা যাবেনি।" মৈদুলের কথা শুনে যে যার রাইফেল পরীক্ষা করে নিলেন। অসীম তার লাঠি, দা ছাড়াও একটা ছোটো ব্যাগে ভরে নিলেন আতস বাজি।
খুব তাড়াতাড়ি তারা পৌঁছে গেলেন গাছে বেঁধে রাখা ডাক্তার দীপকের রুমালের কাছে। আরো কিছুটা হাঁটার পর পড়লো হেঁতালের জঙ্গল। রতন বুঝিয়ে দিলেন এবার চূড়ান্ত সতর্কতা প্রয়োজন। বাঘ সাধারণত পেছন থেকে আক্রমণ করে তাই রাইফেল উঁচিয়ে সবাই সামনের দিকে মুখ করে হাঁটবেন। কিন্তু রতন হাঁটবেন পেছন দিকে মুখ করে হেঁতালের জঙ্গলে নজর রাখতে রাখতে। অসীমকে বললেন যে এখানে লাঠি খুব একটা কাজে লাগবে না। তাই লাঠিটাকে পিঠে বেঁধে তিনি যেন দুহাতে বাজি আর দেশলাই রেডি রাখেন। প্রয়োজন হলেই ফাটাতে হবে। কারন শব্দকে বাঘ খুব ভয় করে। মৈদুলও অসীমের হাত থেকে কিছু বাজি আর দেশলাই নিয়ে নিজের কাছে রাখলো। অতি সন্তর্পণে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চলতে লাগলো দলটা।
বেশ কিছুটা হাঁটার পর হেঁতালের জঙ্গল ছাড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। বোঝা যাচ্ছে বেশ কিছু গাছ এখান থেকে সম্প্রতি কাটা হয়েছে। মৈদুল বললো, "দ্যাখছেন বাবুরা, চোরা কাঠুরেরা জঙ্গলটারে একেবারে শ্যাষ করি দিছে"!
রতন অসীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, "না অসীম বাবু মনে হচ্ছে আর কোনো আশা নেই! জঙ্গল সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ কারো পক্ষে ঝড়ের সময়ে এই হেঁতালের জঙ্গল অতিক্রম করা অসম্ভব।"
আসে পাশে কিছু বন মোরগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বন মোরগ দেখে উত্তেজিত রাম বারুই বলে উঠলেন, "আজ রাতে বন মুরগির ঝোল খাবো। এ জিনিষ বারুইপুরে পাবো না!" কথা শেষ করেই রাম গুলি করলেন। গুলির শব্দ জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়লো।
'বাঁচাও বাঁচাও'। মনে হল কিছুদূর থেকে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো। কিন্তু পরিষ্কার ভাবে বোঝা গেল না আওয়াজটা কোন দিক থেকে এলো। মৈদুল একটা পটকা ফাটালো। আবার আওয়াজ! এবার শব্দটা স্পষ্ট ভাবে শোনা গেল। শব্দ শুনে সবাই এগোতে থাকলেন। আরো কিছুটা হাঁটার পর দেখা গেল দুজন মানুষ একটা গাছের ডালে বসে আছে।
অসিত তাদের দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন, "সুজয়, সুজিত তোমরা এখানে! নেমে এসো। নেমে এসো। তোমাদের খোঁজে আমরা এতজন এসেছি।"
গাছ থেকে দুজন অর্দ্ধ উলঙ্গ মানুষ নেমে এলো। সুজয় গাছ থেকে নেমে মাটিতে শুয়ে পড়ে। সুজিত জড়ানো গলায় বলতে থাকে, "আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না যে এতদিন আমরা বেঁচে আছি! ঝড়ের সময়ে আমরা যে যেদিকে পারলাম ছুটতে লাগলাম। আমরা দুভাই অনান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। সুন্দরবন যে কত ভয়ঙ্কর এই কদিনে আমরা চাক্ষুষ করেছি। অনেকক্ষণ ছোটার পর আমরা এই গাছটাতে উঠে পড়লাম। পরনের পোশাক দিয়ে আমরা নিজেদের গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে নিলাম। এই ভাবে এতদিন কাটালাম। খাবার নেই, জল নেই, এভাবে দিনের পর দিন কাটানো যে কি কঠিন ব্যাপার একমাত্র আমরাই জানি। গাছের ডালে বসে আমরা কত রকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেছি যে বলে শেষ করা যাবে না। গাছের নিচে দিয়ে বাঘকে যেতে দেখেছি মুখে তার বাচ্চাকে নিয়ে। আমার গায়ের ওপর দিয়ে চলে গেছে বিষাক্ত সাপ। ভয়ঙ্কর দাঁতালো বুনো শুয়োরের দলকে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ছুটতে দেখেছি। কত রকমের বন্য জন্তুর ডাক শুনে আমাদের পিলে চমকে গেছে। খিদেতে পেট টনটন করেছে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে। এভাবে সকাল হচ্ছে, রাত হচ্ছে। কিন্তু ভয়ে গাছ থেকে নামতে পারছি না। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন গাছে বসে থাকলেতো না খেতে পেয়ে মরে যাবো! আর নিচে নামলে বাঘে খাবে! দিনে রাতে যে কোনো সময়ে সাপের ছোবলে প্রাণ যেতে পারে! আর ভাবতে না পেরে নিজেদের ভগবানের ওপর ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম আয়ু থাকলে বাঁচবো, মরণ থাকলে মরবো।"
ডাক্তার দীপক তার সঙ্গে থাকা জলের বোতলটা এগিয়ে দিলেন সুজয়ের দিকে। অসিত আর একটা বোতল দিলেন সুজিতকে। সারা দিন ঘোরাঘুরি করতে হবে বলে সকলের জন্য কিছুটা মুড়ি এনেছিল মৈদুল। সেটা খেতে দেওয়া হল দুভাইকে। হঠাৎ একদল হরিণ দৌড়ে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলের দিকে চলে গেল। অভিজ্ঞ মৈদুল সকলকে সতর্ক করলো, "বাবুরা বন্ডুক রেডি রাখেন। চারিদিকে ভালো করি নজর দ্যান। এভাবে হরিণের ছুটি যাওয়া ভালো লক্ষণ লয়। ওগুলা লিচ্চয় তাড়া খাইসে। মনে লয় আশেপাশে ত্যানারা আছেন। আকাশটাও থম মেরি গিছে। ঝড় বৃষ্টি হতি পারি। আর এখানে থাকা যাবেনি। তাড়াতাড়ি চলেন, এখান থেকি চলি যাই।"
- "মৈদুল ঠিক বলেছে। আর এখানে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। লেটস মুভ, কুইক।" বললেন ডাক্তার দীপক।
|| তিন ||
অনেকক্ষণ খাতাটা পড়ে শোনানোর পর শ্যাম দাদা একটু থামলেন। তারপর খাতাটা বন্ধ করে আবার বলতে শুরু করলেন, "এর শেষাংশটা তোমাদের নিজেদের মত করে কল্পনা করে নিতে হবে। কারন এর পরের পাতাগুলো ছিঁড়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে। সেইজন্য বোঝা যাচ্ছে না যে ওরা সকলে ঐ ভয়ঙ্কর হেঁতালের জঙ্গল অতিক্রম করে নিরাপদে নৌকাতে ফিরতে পেরেছিলেন, নাকি আবার কোনো বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল? অথবা আরো একটা সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, সেটা হল, হয়তো পুরোটাই বাবার লেখা একটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক রোমাঞ্চকর গল্প। কোনো পত্রিকাতে পাঠাবেন বলে লিখেছিলেন। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে লেখাটা পাঠানো হয় নি। যদি অন্য কোনো খাতায় এ বিষয়ে কিছু লিখে রাখেন, সেই খাতা যদি খুঁজে পাওয়া যায় তবেই রহস্য উদ্ঘাটন হবে। না হলে রহস্যটা চিরকাল থেকে যাবে। সেই জন্যইতো ভেবে পাচ্ছি না এটা কি সেই রকম একটা ফ্যাক্ট যেটা ফিকশনের থেকে স্ট্রেঞ্জার? নাকি অন্য কোনো কাহিনী লুকিয়ে আছে এই ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখা কাহিনীর অন্তরালে!"
0 মন্তব্যসমূহ