আ
জ পর্যন্ত জগতে যত ধর্মগুরু আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধই নিজেকে কখনও ঈশ্বর, ঈশ্বর প্রেরিত দূত কিম্বা অবতার, এমনকি গুরুও বলেননি। তিনি নিজেকে একজন মানুষ বলেই পরিচয় দিতেন, এবং বলতেন যে, কোনও ব্যক্তিগত গুরু বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর না করেই কেবল নিজের ঐকান্তিক চেষ্টা ও অধ্যবসায়ে পরমসত্য লাভ করা সম্ভব, তিনিও যে বোধি লাভ করে বুদ্ধ হয়েছেন, আন্তরিক চেষ্টা দ্বারা যে কোন ব্যক্তিই সেই বুদ্ধত্ব লাভ করে ‘বুদ্ধ’ হয়ে উঠতে পারে। আশি বছরের দীর্ঘ জীবনের প্রায় অর্ধেকের বেশি সময় (৪৫ বছর) ধরে তিনি ধর্মপ্রচার করেছেন। শত-সহস্র মানুষ তাঁর জীবন ও উপদেশ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ, নিন্দিত পেশার এবং ঘৃণ্য অপরাধী ও খুনী থেকে আরম্ভ করে সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেণীর বিদ্বান ও ধনী মানুষ ও বহু রাজা-রাজরা পর্যন্ত তাঁর অনুগামীতে পরিণত হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মতোই সাধনার নানা পথ তিনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সাধন প্রণালী অবলম্বন করেও তিনি শান্তি পাননি। শেষে অন্তরে জ্ঞানের আলো পাওয়ার জন্য নিজেই তীব্র তপস্যায় রত হলেন, প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘আমার ত্বক-অস্থি-মাংস ক্ষয়ে ধূলায় পরিণত হয়ে গেলেও বোধি লাভ না করা পর্যন্ত তপস্যা থেকে বিরত হবো না!’ একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে তিনি সাধনায় বসেছিলেন, একটানা উনপঞ্চাশ দিন আসন ত্যাগ করেননি। অবশেষে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলেন, জ্ঞানের আলো বা ‘বোধি’ লাভ করে গৌতম হলেন বুদ্ধ। তাই সাধন পথের নানা খুঁটিনাটি ছিল তাঁর নখদর্পণে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন অতিরিক্ত দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য যেমন সাধনের অনুকূল নয়, ঠিক সেভাবেই অতিরিক্ত দৈহিক কৃচ্ছ্রতাও ফলদায়ী হয় না। তাই তিনি মধ্যম পন্থার উপদেশ দিতেন। মানুষের মনে বুদ্ধের প্রতি জন্মেছিল সুগভীর শ্রদ্ধা। মুনি ঋষি রাজা পণ্ডিত ও দেবতারাও বুদ্ধের উপদেশের শরণ নিতেন। জগতের সকল জীবের হিতসাধন কিসে হয়, এই বিষয়ে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে চিন্তাভাবনা চলছিল মানবজাতির শুভচিন্তকদের মধ্যে। কেউ তা স্থির করতে পারছিলেন না। অবশেষে তাঁরা বুদ্ধের শরণ নিলেন। এক দেবপুরুষ বুদ্ধকে অনুরোধ জানালেন, “কিসে মানুষের হিত ও সুখ দুইই হয়, সেইপ্রকার মঙ্গলের বিধান আপনি বলুন!” তখন সকলের কল্যাণার্থে বুদ্ধ আটত্রিশটি ‘সুত্ত’ (সূত্র) বলেছিলেন, সরল ভাষায় তারই সারসংক্ষেপ বলব।
(১) অজ্ঞানী ব্যক্তির সেবা ও তোষণে মঙ্গল নেই, জ্ঞানী ও পূজনীয় চরিত্রের ব্যক্তিদের সেবাতেই উত্তম মঙ্গল।
(২) ধর্ম (ন্যায়) জীবন যাপন করবার মতো উপযোগী পরিবেশেই বাস করা মঙ্গল। নিজের আগে করা ভালো কাজগুলো মনে রেখে সেই পরম্পরা রক্ষা করে সর্বদা সৎ কর্মে নিযুক্ত থাকাই মঙ্গল।
(৩) বহু শাস্ত্র বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা, নানা শিল্প শেখা, বিনয়ী, সুশিক্ষিত ও মধুরভাষী হওয়া মঙ্গলের।
(৪) বাবা-মায়ের সেবা করা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণ করা, অনৈতিক নয়, এমন কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা খুবই মঙ্গলজনক।
(৫) দান করা, কায়মনোবাক্যে ধর্মাচরণ করা, আত্মীয়স্বজনের যথাসাধ্য ভরণ-পোষণ ও সুপরামর্শ দিয়ে তাদের উপকার করার চেষ্টা করা, নির্দোষ কর্ম সম্পাদন করা—এগুলো হল উত্তম মঙ্গল।
(৬) কায়িক ও মানসিক পাপে অনিচ্ছা, বাচিক পাপে বিরত থাকা, মদ্যপানে সংযম এবং যখন যে পুণ্য কর্ম করা দরকার, ভুলে না গিয়ে অবিচলভাবে সেগুলো করে যাওয়া—এসমস্তই উত্তম মঙ্গল।
বুদ্ধ আটত্রিশটি সূত্র বলেছেন। উল্লিখিত সূত্রগুলি তারই সারাংশ। একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যেই তিনি ‘মঙ্গল সূত্র’ দেশনা করেছেন। চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এর কোনটাই মেনে চলা অসম্ভব নয়, বাধা কেবল নিজের মনের ও ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতায়। বর্তমানে সমাজে সর্বত্র নীতিহীনতা ও আদর্শের অভাব। সমাজের সর্বস্তরে থাবা বসিয়েছে দুর্নীতি। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আত্মীয়-স্বজন তো দূরের কথা, নিজের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরও খেয়াল রাখে না। ক্ষণিকের সুখ খুঁজতে গিয়ে মানুষ নিজের অজান্তেই জীবনযাপনের সারল্যকে জটিল করে তুলছে ও হারিয়ে ফেলছে তার মানসিক সুখ ও শান্তি। বুদ্ধ ঈশ্বরের কথা বলেননি। তিনি কর্মবাদের উপর জোর দিয়েছেন। সৎ কর্ম কর, নৈতিক জীবনযাপন কর, লোভ ও ঈর্ষা দমন কর, শান্তি তোমার করতলে। এটাই ছিল গৃহীর উদ্দেশ্যে তাঁর উপদেশের মূল কথা। আজকের পৃথিবীতে ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ধর্মমত। শ্রীরামকৃষ্ণ যাকে ‘মতুয়ার বুদ্ধি’ বলতেন, অর্থাৎ ‘আমার ধর্মই ঠিক, তোমার ধর্ম ভুল’। ধর্মের নামে হানাহানির এই অশান্ত বিশ্বে আজ বুদ্ধের বাণী ও জীবনদর্শনের চর্চা ও অনুশীলন খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রিয় শিষ্য আনন্দ যখন বুদ্ধের শেষ শয্যার পাশে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন, বুদ্ধের অন্তিম বাণী ছিল, ‘আত্মদীপো ভব। আমি কেউ নই, গুরু কেউ নয়, আমি নিজের চেষ্টায় বুদ্ধত্ব লাভ করেছি। তোমরাও এবং অন্য যে কেউ ঐকান্তিক ধৈর্যশীল ও যত্নশীল অধ্যবসায়ে বুদ্ধত্ব লাভের প্রয়াসী হলে, বুদ্ধ হতে পারবে। বুদ্ধ কোন ব্যক্তি নন। বুদ্ধত্ব একটি অবস্থা। আর যে কেউ তা লাভ করতে পারে। বাইরে থেকে কোন সাহায্যের প্রত্যাশা রেখো না, নিজের অন্তরে জ্ঞানের দীপ জ্বালো ও সেই আলোয় পথ দেখে চলো।’ এটাই ছিল শিষ্যদের প্রতি বুদ্ধের উপদেশ। আজ আড়াই হাজার বছর পরেও তাঁর এই বাণী আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। সমাজ গড়ে তোলা কোনও একক প্রচেষ্টায় সাধ্য নয়, কিন্তু নিজেকে গড়ে তোলা সম্ভব, ‘আত্মদীপ’ হয়ে ওঠা যায়। আর দীপ যদি জ্বলে ওঠে, কেউ চাইলেও সে আলো ঢেকে রাখতে পারে না। সে আলোয় পথ দেখে চলে আরও অনেক মানুষ, শত সহস্র দীপ জ্বলে ওঠে ঐ একটি জ্বলন্ত শিখা থেকে। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায়—“একজন আগুন করে, অনেকে সে আগুন পোহায়।” বুদ্ধের জীবন ও বাণী অনুপ্রাণিত করেছিল স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। বুদ্ধের ‘আত্মদীপো ভব’-র কাব্যিক অনুবাদে তিনি লিখলেন—
আপনারে দীপ করি জ্বালো।
আপনার যাত্রাপথে
আপনিই দিতে হবে আলো।
0 মন্তব্যসমূহ