ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

আরশি - সোমনাথ চক্রবর্তী


হালদার পুকুরে সেদিন মাছ ধরা হচ্ছিলো। একটা জ্যান্ত রুইমাছ এনেছে আজ ভোলা। দেড় কিলো সাইজ। আমার বাবা ছিলেন এল.এম.এফ ডাক্তার। সব অসুখের পেটেন্ট ওষুধ ছিলো শিশি, মোড়া আর বড়ি। শিশির গায়ে কাগজ কেটে মার্কা দেওয়া। দু-দাগেই একদম ফিট। আমাদের গ্রামে বাবাকে সবাই খুব ভালোবাসতো। ভোলা আমার বাবার কম্পাউন্ডার। শিশির গায়ে মার্কা লাগায়। পুরিয়া তৈরি করে। সেদিন  উঠোনে বসে সে মাছ কাটছিলো। বাবা বললে, তেলটুকু আরশির জন্যে রাখো। আমরা মাছের তেলে মাছ ভাজতে পারি নে। ইলিশ হলেও নাহয় হতো। কিন্তু ইলিশ এখন পাবো কোথায়? আমার তখন সাত বছর বয়েস। ইলিশ মাছের জন্যে আমার বুক কনকন করে উঠলো। মা বুঝতে পেরে বললো, সামনের শনিবার তো তোমার ডিসপেন্সারি বন্ধ। কুলতলির হাট থেকে একটা চকচকে ইলিশ মাছ এনো। মেয়েটা বড্ডো ভালোবাসে। বাবা বললে, আচ্ছা। আজ ওই তেলটুকু তাহলে আরশির জন্যে রাখো।


আরশি আমাদের বাড়ির পুষি ক্যাট। ঠাকুমার বড়ো আদরের। তবে ইদানিং দাদাভাই মারা যাবার পর থেকে ঠাকুমার দিকে মোটেও ঘেঁসে না। শনিবারে বাবা হাট থেকে বড়ো ইলিশমাছের দাগা কাটিয়ে আনলো। মুড়োটা আড়াআড়ি চেলা করে হবে পুঁইশাক চচ্চড়ি। দুপুরে আমি তখন ইস্কুলে আর বাবা ডিস্পেনসারিতে মা কাঁচালঙ্কা দিয়ে সোনারঙের মাছের ঝাল রেঁধে চাপাচুপি দিয়ে রেখে সবে চানে ঢুকেছে। এমন সময় আরশি মুখ দেখালো আর খপাখপ দুটো দাগা তুলে নিয়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল।



বিকেলবেলায় তুলকালাম। আরশিকে পাকড়াও করে চটের ব্যাগে পুরে বাবা চললো চোরের সমুচিত শাস্তি দিতে। সন্ধ্যের অন্ধকারে বাজার পেরিয়ে কুমোরপাড়ায় হলো তার নির্বাসন। আমার অজান্তে। আমি স্কুল থেকে ফিরে দেখি আরশি নেই। মাকে বললাম, ঠাকুমাকে বললাম। ওরা কেউ কিছু জানে না। অদ্ভুত কান্ড। রাতে খেলাম না। আরশি আমার একমাত্র বন্ধু। খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার।

সারারাত্তির চোখের জলে বালিশ ভিজলো। জলজ্যান্ত একটা প্রাণী কি উড়ে গেল নাকি? কেউ 

কিচ্ছুটি জানে না ! স্কুল যাবার সময় ভালো করে খেলাম না। আড়চোখে দেখলাম মাছের কাঁটাপোঁটা গুলো দুর করে ফেলে দিলো মা। বাবা হেঁটমুখে ডিসপেন্সারিতে বসে। আমার ক্লাসে মন বসলো না। পড়া ভুল করলাম। হোমটাস্ক করিনি। থার্ড পিরিয়ডে নিলডাউন। হাঁটু দুটো খুব জ্বালা করছিলো।



রাতে ঠাকুমা একলা মেঝেতে বসে সিরিয়াল দেখছে। আমি কাছে গিয়ে বসলাম। বুড়ির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমায় আদর করে গল্প বলে ভোলাতে চাইলেই হবে? তোমরা কেউ কিচ্ছু জানো না, না ? জলখাবারের মুড়িমাখা বাটি ঠেলে সরিয়ে দিলাম। বাটি উল্টে সারা ঘরে তখন মুড়ি, গাজর, গাঠিয়া বাদাম নারকেল কুচি আর চানাচুর থৈথৈ করছে। রাতেও সেদিন আমার নো মিল।



একটু বেশি রাতে আমার কানে এলো বন্ধুর আকুল কান্না। ম্যাও-ও-ও। পাঁচিলের ওপর বসে অঝোরে কাঁদছে আরশি। আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে সোজা বিছানায়। ঠাকুমাও তাড়াতাড়ি একবাটি গরম দুধ নিয়ে হাজির। 



এখন আমি সুগৃহিনী। বয়েস ত্রিশ ছুঁইছুঁই। ফ্ল্যাটে থাকি। আমার সাতবছরের মেয়ে তুলি স্কুল থেকে ফিরে ডোরেমন দেখে একা একা। ডোরেমন এক প্রাণহীন কানকাটা এনিমেশন বেড়াল। তুলির কোনো বন্ধু নেই। ওর বুকের নির্জন পেলব জমিতে ভালোবাসার ফুলদল আপনি ফোটে। মাটি পায় না। জল পায় না। আদর পায় না। আপনি ঝরে যায়। তুলির হাতে মুঠোফোন তুলে দিয়ে আমরাও পরম নিশ্চিন্তে দুজন দুদিকে হাসিমুখে অফিস চলে যাই। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে টিভি দেখি। তুলির মাস্টার আসে। চা বানাই। রাতে হোম ডেলিভারি এসে ডোরবেল দেয়। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ