ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বর্ষমহরৎ@১৪৩০. কম -সুপ্রিয়া গঙ্গোপাধ্যায়


চৈতে গিমা তিতা, বৈশাখে নালিতা মিঠা,

জ্যৈষ্ঠে অমৃতফল আষাঢ়ে খৈ, শায়নে দৈ।

ভাদরে তালের পিঠা, আশ্বিনে শশা মিঠা,

কার্তিকে খৈলসার ঝোল, অগ্রাণে ওল।

পৌষে কাঞ্ছি, মাঘে তেল, ফাল্গুনে পাকা বেল।।

                                               - খনার বচন


শ্র

দ্ধেয়া খনা দেবীর স্বাস্থ্যকর বচনটি আপামর বাঙালির প্রাচীন বাঙালিয়ানাকে পুষ্ট করে শিহরিত করে আজও। যৎসামান্য শিক্ষা প্রাপ্ত অথবা গ্রামীণ রমণীর মুখে মুখে অতি চর্চিত এই বাণী সহ প্রবেশ করি নববর্ষের বাসরে।


উৎস-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিতব্য বাঙলা সাহিত্য চর্চায় মনের আনাচে কানাচে উঁকি মারে বাংলা বর্ষবিদায়, বর্ষবরণ ও হালখাতারূপ ত্রিধারা। বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একটি বর্ষ বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষিত হয় পরবর্তী নতুন বর্ষের বরণ বার্তা। প্রাসঙ্গিক এই এপ্রিলেরই ১৫ তারিখে ১ লা বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দের সূচনা।


বাংলা পঞ্জিকায় ১২ টি মাসের উপস্থিতি সত্ত্বেও বিশাখা নক্ষত্র প্রসূত বৈশাখ মাস দিয়েই বর্ষ- সূচনা হবার বিষয়টি আমার ন্যায় অনেক বন্ধুকেই ভাবায়,জানি। এতদ্ভিন্ন ১৪৩০ সংখ্যাটিই বা এল কোথা হতে! 


পূর্বোক্ত একজোড়া প্রশ্নের সমাধান কল্পে একটু পিছিয়ে যাই মুঘল আমলে। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। সে সময়ে মুঘল রাজত্বে কাজকর্ম চলত হিজরী সন অনুযায়ী; যেটির গণনা ছিল চান্দ্রমাস ভিত্তিক। ফলে বৎসরান্তরে ঋতুর হিসেব মিলত না। ভিন্ন ভিন্ন বৎসরের ঋতু পরিবর্তন ঘটত ভিন্ন তারিখ ও মাসে।


যেহেতু প্রধানতঃ ফসল বিক্রীর অর্থ দ্বারাই প্রজারা রাজস্ব, কর বা খাজনা প্রদান করতেন, তাই বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে সেটি আদায় করতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল।


কিন্তু ঐ সময়ে বাংলায় সূর্য-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৌর মাসভিত্তিক বর্ষ পঞ্জিকা চালু ছিল, যেখানে বৎসরান্তরে মাস ও ঋতুর অমিল ঘটত না।


সম্রাট আকবর একটি নতুন নিয়ম চালু করলেন। তাঁর রাজ্যাভিষেকের বছর অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকে তিনি চান্দ্রমাস অনুযায়ী হিজরী মতে গণনা করালেন, যেটি দাঁড়াল হিজরী ৯৬৩ সন।


এর ঠিক পর থেকেই বৈশাখ মাসের ১ তারিখে তিনি সৌরমাস অনুযায়ী বর্ষগণনা শুরু করালেন। সেই হিসেবে প্রথমেই ৯৬৩ যুক্ত হয়ে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ লা বৈশাখের পর থেকে ক্রমান্বয়ে সৌরমাস অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে বঙ্গাব্দ।


সেই মোতাবেক এই বৎসরে ২০২৩ থেকে ১৫৫৬ বিয়োগ করলে দাড়ায় ৪৬৭ এবং সঙ্গে ৯৬৩ যুক্ত হলে প্রাপ্ত হয় ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।


 প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই বাংলার সঙ্গে পঞ্জাব, আসাম, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যেও একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় বর্ষবরণ।


ইতিহাস বলে, লাঙ্গলের ব্যবহার শিখবার পর মানুষ স্থায়ী বসবাস শুরু করে। কৃষিজাত দ্রব্য বিনিময়ের প্রথার সূত্রপাত ঠিক তখন থেকেই। এই লাঙ্গল বা হালের মাধ্যমে চাষের ফলে উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী বিনিময়ের হিসেব একটি খাতায় লিপিবদ্ধ হত। সেই খাতার নাম ছিল 'হালখাতা '।


সংস্কৃতে 'হল' বা 'হাল' কথার অর্থ  'লাঙ্গল' এবং ফারসি ভাষায়  'হাল' শব্দের অর্থ  'নতুন' ।দুটি অর্থই অবশ্য হালখাতায় প্রযোজ্য। প্রাচীনকালের 'হালখাতা' নবাবী আমলে নাম পাল্টে হয় 'পুণ্যাহ'। কিন্তু পরবর্তীতে  'হালখাতা' নামটিই প্রচলিত হয়ে পড়ে সর্বাধিক জনপ্রিয়তার সঙ্গে।


চিত্রা নক্ষত্র প্রসূত চৈত্র মাসের শেষে রাজস্ব পরিশোধ করবার রীতি ছিল সেই আমলে। সে অর্থে 'হালখাতা' রাজস্ব আদায়ের নামান্তর বললে অত্যুক্তি হ'ত না, অবশ্যই। সেই রীতির অনুসরণে আধুনিক বাংলার প্রতিটি সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানের মালিকপক্ষ সম্বৎসরের  লাভপ্রদ কারবার কামনায় পূজা করেন সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বৈভবের দেবী মাতা লক্ষ্মীর। দেবতার পূজার্চনান্তে তাঁর পায়ে ছোঁয়ানো সিঁদুর দ্বারা স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কিত ও চন্দন চর্চিত  লাল মলাট যুক্ত খাতায় নতুন বছরের হিসেব নিকেশের শুভ মহরৎ হয় হালখাতায়-পয়লা বৈশাখে।


তবে বঙ্গাব্দের সূচনাকালে নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে হালখাতার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে নববর্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে ঐতিহ্যপূর্ণ হালখাতা লেখার উৎসব।


এদিন ক্রেতাদের আনন্দদান কল্পে ও অগ্রিম ব্যবসার লক্ষ্যে  মিষ্টির বাক্স, ঠাণ্ডা পানীয়, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি সহযোগে    আপ্যায়নের বন্দোবস্ত  রাখেন ব্যবসায়ীরা। অনেক কারবারী এই সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি ১ লা বৈশাখের পরিবর্তে অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতেই সাঙ্গ করে থাকেন।


এই হালখাতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রেতা- বিক্রেতার মাঝে নির্মিত হয় এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের শক্তপোক্ত বুনিয়াদ। 

আমবাঙালি এদিন নিজেকে আর নিজের ঘরকে সাজায় নতুন ভাবে, নতুন আঙ্গিকে; আর রকমারি মনপসন্দ পদ রন্ধন দ্বারা পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে আহ্বান জানায়  আর সাদরে বরণ করে নেয় নতুন বর্ষটিকে।মাসের নাম অনুসারে অনুষ্ঠানটি  'বৈশাখী' নামেও সমধিক প্রসিদ্ধ সাহিত্যচর্চার আসরে।


বলাবাহুল্য হলেও বলি, ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, চার হাজার বছর পূর্বেও প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার বেবেলিয়নরা 'আকিতু' নামক নববর্ষ অনুষ্ঠান পালন করে সুখী, শান্তিপূর্ণ, শুভময় ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা জানাতেন দেবতার দুয়ারে।  

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ- এর সূত্রপাত বা শুভ মহরৎ  ঘটে এই হালখাতার মধ্য দিয়েই। বারোমাস পার করে আবার পালিত হয় পুণ্যাহ বা হালখাতা। এভাবে কালচক্রে আবর্তিত হতে থাকে বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষা, গতিময়তা আর কর্মযজ্ঞের প্রবাহ।


এই নতুনকে পাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে অবশ্যই কুর্নিশ জানাতে হবে প্রাচীন বর্ষটিকে। কারণ সে- ই বাঙ্গালীর হাতে প্রতি বছর অর্পণ করে নববর্ষের নবতরু আশালতার ইঙ্গিত। লর্ড টেনিসনের উক্তিটি অতি প্রাসঙ্গিক এক্ষেত্রে:

 The old order changeth, yielding place to new..


১৪৩০- এর প্রারম্ভিক লগ্নে লেখিকার তরফে ক্ষুদ্র অথচ বিশেষ উপহার: ঊনবিংশ শতকের কলকাতায় ভ্রমণের সুবর্ণ সুযোগ _ অবশ্যই মসি মারফৎ। তৎকালীন বর্ষশেষের  খন্ডচিত্র আমরা পাই কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত  'হুতোম পেঁচার নকশা' নামক প্রহসনটিতে। বাবু- কালচারের কপটতা ও ভন্ডামির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ শাণিত এক অসাধারণ দলিল এই প্রহসনটির প্রথম ভাগটি প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে।


চৈত্র মাসের চড়ক বা গাজন পার্বণ দিয়েই সাঙ্গ হয় বাংলার বর্ষ। প্রহসনটির প্রথম ভাগের একটি অধ্যায়  'কলিকাতায় চড়ক পার্বণ'। তার নির্ধারিত কিয়দাংশ:

 আজ চড়ক.....................................

গীর্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গেল। শহরে কান পাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারিদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধোঁ, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলোকি সুতো, শোন, সাপ, ছিপ, বাঁশ ফুঁড়ে একেবারে মরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালীঘাট থেকে আসচে।


অনেকে চড়ক বাণ ফোঁড়া, তলোয়ার ফোঁড়া দেখতে ভালোবাসেন। অনেকে বুড়ো- মিনসে হয়েও হীরে বসানো টুপী, বুকে জরির কর্ম করা কাবা ও গলায় মুক্তার মালা, হীরের কণ্ঠি, দু হাতে দশটা আংটি পরে খোকা সেজে বেরুতে লজ্জিত হন না, হয়তো তার প্রথম পক্ষের ছেলের বয়স ষাট বৎসর! 


ক্রমে দিন ঘুনিয়ে এল, আজ বৈকালে কাঁটা ঝাঁপ। বৈঠকখানায় মেকারী ক্লাকে ট্যাং ট্যাং ট্যাং করে পাঁচটা বাঁজল। সূর্যের উত্তাপ হ্রাস হয়ে আসতে লাগল। শহরের বাবুরা ফেটিং, সেল্ফ ড্রাইভিং, বগি ও ব্রাউহ্যামে করে অবস্থাগত ফ্রেন্ড, ভদ্রলোক বা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরোলেন, কেউ বাগানে চললেন।


এদিকে বাবুদের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠল, ঢাক বাজতে লাগল, ... গাজনতলায় বিশ আটি বিচালী বিছানো ছিল, কাঁটার ডালগুলো তার উপর রেখে বেতের বারি ঠ্যাঙানো হল, কাঁটাগুলি ক্রমে সব মুখে মুখে বসে গেলে পর পুরুত তার উপর গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিলেন, দুইজন সন্ন্যাসী ডবল গামছা বেঁধে তার দুদিকে টানা ধরলে __ সন্ন্যাসীরা ক্রমান্বয়ে তার উপর  ঝাঁপ খেয়ে পড়তে লাগল, শহরে সন্ধ্যাসূচক কাসর ঘণ্টার শব্দ থামল। সকল পথের সমুদয় আলো জ্বালা হয়েচে। 'বেলফুল' 'বরফ' 'মালাই' চিৎকার  শুনা যাচচে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েচে, অথচ খদ্দের ফিচ্চে না।


আজ বৎসরের শেষ দিন। যুবত্বকালের এক বৎসর গেল দেখে যুবক যুবতীরা বিষণ্ণ হলেন। হতভাগ্য কয়েদীর নির্দিষ্ট কালের এক বৎসর কেটে গেল। দেখে আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। আজ বুড়োটি বিদায় নিলেন, কাল যুবোটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন। বুড়ো বৎসরের অধীনে আমরা যে সব কষ্ট ভোগ করেচি _ আগামীর মুখ চেয়ে আশার মন্ত্রণায় আমরা সে সব মন থেকে তারই সঙ্গে বিসর্জন দিলেম। ভূতকাল যেন আমাদের ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে চলে গেলেন _ বর্তমান বৎসর স্কুল মাস্টারের মত গম্ভীরভাবে এসে বসলেন __ আমরা ভয়ে, হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত!!


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, চলুন ফিরে আসি আজকের নেট দুনিয়ায়। সকল শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি রইল ১৪৩০ ডট কমের শুভ মহরৎ বার্তা:

সম্ভাবনাময় আলোকিত উজ্জ্বল নববর্ষ

বন্ধুদের জীবনে আনুক সাফল্য, শান্তি, হর্ষ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ