সম্পাদক হিসাবে বুদ্ধদেব বহুবর্ণিল সাফল্যের পরিচয় দিলেও বর্তমান প্রবন্ধে আলোকপাত করা হচ্ছে সিকি শতাব্দী ধরে তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকাটি। ছাত্রাবস্থায় ‘পতাকা’ ও ‘প্রগতি’ নামে দুটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকা সম্পাদনায় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন শুধু কবিতাকেন্দ্রিক একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করতে। ‘পরিচয়’ সাহিত্যপত্রের এক আড্ডায় অন্নদাশংকর রায়ের হাতে ইংরেজি ‘পোয়েট্টি’ পত্রিকাটি দেখে তিনি উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন ‘কবিতা’ প্রকাশ করতে। তাঁর ভাষায়- ‘আমি কখনও কখনও এমন পত্রিকার স্বপ্ন দেখতাম যেটার শুধুই রূপ ঐ মার্কিনি নমুনাটিতে দেখতে পেয়ে আমি একটি দুঃসাহসিক কথা চিন্তা করে ফেললাম : এরকম একটা বের করা যায় না বাংলায়? তা হ’লে তো কবিতা এবং কবিরা পদপ্রান্তিক অবমাননা থেকে বেঁচে যান।'' শুধু কবিতার জন্য একটি সাহিত্যপত্রের আবির্ভাবে সেদিন কবিতার কৌলীন্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। কবিতা অর্জন করেছিল স্বতন্ত্র মর্যাদা এবং যোগ্য কবির জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল ‘কবিতা’। সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর স্বকীয় দর্শন ও স্বপ্নের বীজ অংকুরিত হয়েছিল ‘কবিতা’ পত্রিকায়। প্রথম সংখ্যাতেই নিজের লক্ষ্য স্পষ্ট করে তুললেন- ‘কবিতা’ হবে ‘এমন কোনো পত্রিকা’ ‘যার মধ্য দিয়ে কবিতা হতে পারে বিশেষভাবে প্রকাশিত, প্রচারিত ও রসজ্ঞজনের দৃষ্টিগোচর’। রবীন্দ্রবলয় অতিক্রম প্রয়াসী আধুনিক কবিদের প্রধান পীঠস্থান ‘কবিতা’ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সসম্ভ্রম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি নিয়মিত কবিতা পাঠিয়েছেন এ পত্রিকার জন্য। রসজ্ঞজনের দৃষ্টিগোচর করার পাশাপাশি ‘কবিতা’কে ভালো কবির বিকাশ ও লালনভূমি হিসাবেও প্রতিষ্ঠা করেছেন বুদ্ধদেব বসু। একজন সৎ সম্পাদকের এর চেয়ে উপযুক্ত কাজ আর কী হতে পারে? রবীন্দ্র পরবর্তী শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে স্বীকৃত জীবনানন্দ দাশের আবিষ্কারক সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু পাকা জহুরির মতো আধুনিক বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড় রত্ন জীবনানন্দকে চিনতে পেরেছিলেন। আবির্ভাব লগ্নে জীবনানন্দ যখন উপেক্ষিত তখন বুদ্ধদেবই তাঁকে লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে বের করে আনেন। তাঁর পত্রিকায় ‘প্রকৃতির কবি’ শিরোনামে জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করে তাঁকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। ‘কবিতা’র পাতায় জীবনানন্দের কবিতা এবং তাঁর কবিতা সম্পর্কে আলোচনাই যে তাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার কেন্দ্রীয় পুরুষে পরিণত করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু জীবনানন্দই নয়, আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম স্রষ্টা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আবিষ্কারকও বুদ্ধদেব। ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়। তার প্রতি বুদ্ধদেবের সীমাহীন উচ্ছ্বাসের প্রমাণ তাঁরই উদ্যোগে নিজের প্রকাশনা ‘কবিতা ভবন’ থেকে প্রকাশিত হয় সুভাষের কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’। বাংলা কবিতার নতুন সম্ভাবনা এভাবেই সম্পাদক বুদ্ধদেবের পরিচর্যায় বিকশিত হতে থাকে। নবীন কবি হিসেবে বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র , সমর সেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, অজিত কুমার দত্ত ‘কবিতা’- য় ঠাঁই পেয়েছেন। সচেতন পাঠকের সঙ্গে নবাগত কবিদের উপযুক্ত সেতুবন্ধন বুদ্ধদেব নির্মাণ করেছিলেন তাঁদের কবিতা ও কবিতার আলোচনা প্রকাশের মাধ্যমে। এ কথা বিস্মৃত হওয়ার কোনো কারণ নেই যে, বুদ্ধদেব নিজেও ছিলেন একজন কবি।
প্রতিভা ও শ্রমের সমবায়ে যেমন ভালো কবি নির্মিত হন, একই নিষ্ঠা প্রয়োজন সমঝদার পাঠক হওয়ার জন্যও। বুদ্ধদেবের উপলব্ধি- ‘‘কবি হয়ে জন্মাতে হয়, কবিতার পাঠক হয়েও জন্মাতেই হয়।” কবিতার উপযুক্ত পাঠক তৈরির জন্য তিনি শুধু ভালো কবিতাই ছাপেননি ‘কবিতা’র পাতায়, কবিতা বিষয়ক নিবন্ধ, আলোচনাও প্রকাশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর সবচেয়ে বড় সহযোগী গদ্যশিল্পী বুদ্ধদেব। অসম্ভব মেধা ও মনীষার অধিকারী বুদ্ধদেবের সুবিস্তৃত অধ্যয়ন জগতে পাশ্চাত্য সাহিত্যের গভীর প্রভাব পড়েছিল। ইউরোপ-আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবি লেখক, সাহিত্যান্দোলনের খবর- কোনোকিছুই তাঁর অজানা ছিল না। অগাধ সাহিত্যজ্ঞান তাঁর সম্পাদনা প্রতিভাকে সর্বত্রগামী করেছিল। ‘কবিতা’ পত্রিকা তাই হয়ে উঠেছিল সাহিত্যের বিশ্বায়নের প্রতীক। কিপলিং, ইয়েটস, ভার্জিনিয়া উলফ, র্যাবো, এইচজি ওয়েলস রাইনার, মারিয়া রিলকে, গ্যোটে, বোদলেয়ার, হাইনে- বিশ্বসাহিত্যের সব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নেমে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় সাহিত্যপত্র ‘কবিতা’র উর্বর ভূমিতে। নিজে অনুবাদ করেছেন, অন্যকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছেন- এভাবেই বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছিল বাঙালি লেখক ও পাঠকের। বুদ্ধদেবের যোগ্যতম সম্পাদনা ছাড়া এটি সম্ভব ছিল না। বুদ্ধদেব বসু প্রমাণ করেছেন সম্পাদকের অন্যতম গুণ বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পূর্ণ অনাসক্ত ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বাছাই করেছেন ভালো কবিতা, স্বীকৃতি দিয়েছেন যোগ্য কবিকে। ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা ছাপা হওয়া মানেই কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ- বাংলা সাহিত্যে এমন গৌরব আর কোনো সাহিত্যপত্র অর্জন করতে পারেনি।
মাত্র ছাব্বিশ বছরের আয়ু ‘কবিতা' যেন ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে দ্রুত নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে অন্তর্হিত হল। বিরোধ আর বৈপরীত্যের মধ্যে বিরল সমন্বয়ের কৃতিত্ব সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর। আধ্যাত্মিকতার পাশে রাজনৈতিক দর্শন, নাগরিক বিচ্ছিন্নতা ও নৈঃসঙ্গের মাঝে প্রকৃতি তন্ময়তা, পদ্যছন্দের পাশে গদ্যছন্দ, রোমান্সনির্ভর কবিতার পাশে বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন, অতিন্দ্রীয় চেতনার পাশে ইন্দ্রিয়ঘন উচ্ছ্বাস- সবকিছুই প্রশ্রয় পেয়েছে ‘কবিতা’- র পাতায়। সব্যসাচী বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনা আদর্শ বাংলা সাহিত্যে শীর্ষতম স্থানের দাবিদার।
0 মন্তব্যসমূহ