মেদিনীপুর, ঊনিশশো ত্রিশ -
শীতের রাত। কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে মফঃস্বল। রাস্তার কুকুরগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, যতটা তাপ নিজেদের কাছে রাখা যায় আর কী! দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল। বাতাসে কীসের যেন ফিসফিস, এদিক ওদিক দু-চারজোড়া চাপা পদধ্বনি। গোটা দেশের যুবকেরা উত্তাল হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। বেশ কিছু বিপ্লবী দলের মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স ওরফে বিভি, যে দল গান্ধীজীর অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। সশস্ত্র লড়াই করে আপন মাতৃভূমিকে ছিনিয়ে আনার স্বপ্ন দেখে তারা।
বিছানায় শুয়ে মাথার পেছনে দুহাত রেখে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে ষোলো-সতেরোর এক যুবক। গত বেশ কয়েক রাত ঘুম হচ্ছে না তার। মাথায় হাজারো চিন্তা, যার অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে বিভি।
আসলে ছেলেটির পরিবারে কেউ কখনও স্বদেশি করেনি। তার বাবা, দুই দাদা সবাই নিজ নিজে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। পড়াশোনায় সেও যথেষ্ট ভালো। সামনে রয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারে তো আর চুপ করে থাকা যাচ্ছে না। আজ সকালে চোখের সামনে একজন বৃদ্ধকে উপুর্যপরি বুটের লাথি খেতে দেখেছে সে। অপরাধ – দুর্বল শরীর নিয়ে চলতে চলতে ব্রিটিশ অফিসারের ঘোড়ার সামনে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাতে নাকি ওই অফিসারের যাত্রাপথে বাধাসৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা দিয়ে বেড়াল চলে গেলে যেমন আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। ব্রিটিশেরা অবশ্য কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে ভারতীয়দের খুব একটা তফাৎ করে না। বিভিন্ন ক্লাবের বাইরে চোখে পড়ে সাইনবোর্ড, “Dogs and Indians are not allowed.”
কথাটা মনে পড়তেই মাথাটা গরম হয়ে উঠল তার। আমাদেরই দেশে এসে আমাদেরকেই কিনা…
ঠক… ঠক…
খুব মৃদু একটা আওয়াজ হল জানালায়। ওই যে সে এসে গেছে। খাট থেকে নেমে জানালা খুলল যুবক। বাইরে অন্ধকারের মধ্যে চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি।
“কীরে প্রদ্যোৎ তৈরি তো?”
“হ্যাঁ একদম।”
“চল তাহলে। তাড়াতাড়ি কর।”
মাথাসমেত চাদর দিয়ে প্রদ্যোৎ জড়িয়ে নিল নিজেকে। তারপর চুপিসাড়ে খিড়কির দরজা খুলে বাইরে বেরোল। কুয়াশা ভেদ করে রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চলল দুই ছায়ামূর্তি।
মফস্বলের এদিকটায় খুব একটা আসেনা কেউ। বাজারহাট, দোকানপাট সব অন্যপ্রান্তে। জনবসতিও নেই তেমন। একটা মজে যাওয়া পুকুর। তাকে ঘিরে বড় বড় গাছ, আগাছা। আর তার পাশেই একটা পোড়োবাড়ি। বেশিরভাগটাই ভেঙ্গে পড়েছে। একটা দিক টিকে আছে কোনোক্রমে। সেখানেও খসে পড়েছে ইঁট। দেওয়াল ফাটিয়ে গাছ বেরিয়েছে। চারদিকে সাপখোপ, পোকামাকড়ের রাজত্ব। ঘন কালো অন্ধকার ঘিরে আছে আশপাশ। তার মধ্যে জ্বলে উঠল দেশলাই। হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত হল তিনটি মুখ।
দেশলাই কাঠি যার হাতে ধরা, প্রদ্যোৎ-এর উদ্দেশে সে বলে উঠল, “শুনেছি, তুমি নাকি রবি ঠাকুরের গান বড় ভালোবাসো?"
শুরুতেই এরকম একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে ভাবেনি প্রদ্যোৎ। ভেবেছিল, দেশ, স্বাধীনতা, বিপ্লব এসব নিয়ে প্রশ্ন আসবে। প্রথমটায় তাই হকচকিয়ে গেল সে। আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ… তা… বাসি।”
দেশলাই কাঠিধারী এবার পকেট থেকে একটা ছোট মোমবাতি বের করে ধরাল। আসলে ছেলেটাকে সে বাজিয়ে দেখতে চায়। মনে মনে কতগুলো প্রত্যাশিত প্রশ্নোত্তর সাজিয়ে নিয়েই আসে সবাই। তাই প্রথমেই সেই চেনা ছকে না গিয়ে আবহটাকে কিছুটা হাল্কা করে দিতে চাইল। কারণ তাহলে পরের প্রশ্নগুলোর উত্তরে ভান করতে পারবে না এ ছেলে। বলল, “রবি ঠাকুরের গান ভালোবাসো কিনা তার উত্তর এরকম কিন্তু কিন্তু করে দিতে হচ্ছে কেন?”
এবার প্রদ্যোৎ কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। বলল, “খুব… খু-উ-ব ভালোবাসি। আমার শিরায় শিরায় মিশে গেছে ওঁর সব সৃষ্টি।”
“বেশ… তাহলে এবার একটা গান শোনাও।”
“এখন?” অপ্রস্তুত শোনাল তার গলা।
“কেন? অসুবিধে আছে?”
একটু চুপ করে থেকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে জবাব দিল, “নাহ্! অসুবিধে কীসের? হোক তাহলে।”
রাতের নিজস্ব সুরে মিলতে শুরু করল তার গানের সুর –
"ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা…"
মোমবাতিধারী যুবক গান শুনে মোহিত হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ। আপনা থেকে ঘাড় নড়ছে তালে তালে। গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। একটু পরে চোখ খুলে বলল, “বাহ্! কী সুন্দর গান গাও তুমি। হাতের রোম খাড়া হয়ে গেল একেবারে।”
লজ্জায় নতমুখ করল প্রদ্যোৎ। ডানপায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বামপায়ের বুড়ো আঙুল খুঁটতে লাগল।
মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের গলার স্বর। এতক্ষণ খোশ মেজাজে গল্পের স্বর বদলে গেল গম্ভীরতায়, “প্রদ্যোৎ… ভালো করে সবকিছু ভেবে নিয়েছ তো? একবার ঢুকলে কিন্তু আর বেরোবার কোনো পথ নেই। একদিকে আছে তোমার এখনকার সুখ, শান্তির জীবন; সেখানে প্রভূত উন্নতি করার হাতছানি। আরেকদিকে অনিশ্চিত কঠিন ভবিষ্যৎ। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই কিন্তু মুখের কথা নয়। বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের মূল লক্ষ্য হল স্বাধীনতা। দলের সদস্যরা মারতে যেমন চাইবে, তেমন নিজেদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে মরার জন্য। এরপরেও বেছে নিতে চাও এই কণ্টকাকীর্ণ পথ?”
মুখ তুলল প্রদ্যোৎ। তার চোখে-মুখে প্রত্যয়।
“হ্যাঁ দীনেশদা”, দৃঢ়ভাবে জানাল সে।
নিজের নাম ছেলেটার মুখে শুনে থমকে গেল দীনেশ।
প্রদ্যোৎ-এর মুখে আলতো হাসি। বলল, “একেবারে কিচ্ছুটি না জেনে আমিও কিন্তু আসিনি এখানে।”
এবার সামলে নিয়েছে দীনেশ। ছেলেটাকে একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে, “বেশ। আবারও বলছি, কোনোকিছুই এতটুকুও অত সহজ হবে না। ধরা পড়লে ফাঁসি, দ্বীপান্তর, অকথ্য অত্যাচার; ভাগ্যে যা খুশি জুটতে পারে। হাসিমুখে সইতে পারবে?”
“নিশ্চয়ই।” প্রদ্যোৎ-এর গলার স্বরে একফোঁটাও দ্বিধা নেই।
“আর মার খেয়ে খেয়ে যখন লুটিয়ে পড়বে… মনে হবে এর চেয়ে কয়েকটা গোপন কথা যদি বলেই দিই, কী আর হবে এমন? অন্তত এই অমানুষিক অত্যাচারের হাত থেকে তো মুক্তি পাব। এরকম মানসিক অবস্থায় পারবে মন্ত্রগুপ্তি রক্ষা করতে?”
“ছোট হতে পারি, কিন্তু যতটা দুর্বল ভাবছেন, ততটা আমি নই। দেশমাতৃকার জন্য আমি সবকিছু সইতে পারব।”
দীনেশ দেখতে পেল ক্ষীণ মোমবাতির আলোতেও প্রদ্যোৎ-এর চোখে গনগনে আগুন।
বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সে অন্তর্ভুক্তির কথাটা কাউকে জানাতে না পারা পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছিল না প্রদ্যোৎ-এর। কাকে জানাবে… কাকে জানাবে… বাড়িতে বলাটা একটু চাপের। কে কীভাবে নেবে ঠিক ধারণা করা যাচ্ছে না। তাহলে?
ভাবতে ভাবতেই মাথায় চলে এল খুব প্রিয় একটা নাম। আরেহ্! বাড়ির কাছাকাছিই তো একজন রয়েছে যাকে এসব কথা খুলে বলা যায়, অপরূপা মাসি। ছোটবেলা থেকে সময় পেলেই প্রদ্যোৎ ছুটে যায় মাসির কাছে। কখনও নাড়ু, কখনও আচার, কখনও বা কামরাঙা এসব তো আছেই। কিন্তু আসলে সে ছুটে যায় ক্ষুদিরাম মামার গল্প শুনতে। মাসির ভাই। তার জন্মের আগেই যদিও ক্ষুদিরাম বসু শহীদ হয়েছিল, কিন্তু মাসির মুখে গল্পগুলো যখনই শোনে মনে হয় এসব বুঝি তার চোখের সামনেই ঘটছে।
প্রদ্যোৎ-এর মনে গভীরভাবে দাগ কেটে গেছে সেইসব ঘটনা। মাসি নানা সময়ে ওকে বলেছে সেসব গল্প-
“১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর থেকেই মেদিনীপুরে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। চারিদিকে শোভাযাত্রায় কাতারে কাতারে যোগ দিতে থাকে সমস্ত জাতির মানুষ। ওইসব শোভাযাত্রার একজন পান্ডা ছিল আমার ভাই।
পড়া ছাড়ার পর ভাই বেশ কিছুদিনের জন্য গৃহত্যাগী হয়। চিঠি লিখে জানায় সে সন্ন্যাস নিতে যাচ্ছে। অনেকদিন বাদে বাড়ি ফিরে এলে ’পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীরে, কোথায় ছিলি এতদিন?’ জবাবে সে বললে, ‘গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরেছি। জানিস দিদি, চাষীভাইদের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। বিনা পারিশ্রমিকে ওদের ঘরে মজুর খাটলাম কিছুদিন।’
একবার ওকে ম্যালেরিয়ায় ধরল। সবাই বলল, ভূতে ধরেছে। ওঝা ডাকা হল। পরে ভাইয়ের জ্ঞান হওয়ার পর কী বলল জানিস? বলল, ‘আমার ভূত ছাড়বে সেইদিন যেদিন ইংরেজ ভূত ভারতবর্ষের ঘাড় থেকে নেমে যাবে।’
বিলিতি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনের সময়েও ক্ষুদিরামই সম্মুখে ছিল। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও এক দোকানদার বিলিতি মাল শহরের বাইরে রপ্তানি করছিল। শুনেছিলাম, ভাই কেরোসিন ও দেশলাই নিয়ে শহরের বাইরে গিয়ে তার কাপড়ের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে আসে। এমনই একরোখা ছিল সে।
সেই সময় কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড লঘু অপরাধেও খুব কড়া কড়া সাজা শোনাত। ঠিক হল, তাকে মেরে ফেলা হবে। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ডের বদলি হয়ে গেল মজঃফরপুরে। ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী চলে গেল সেখানে। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়ল তারা। কিন্তু হায়! কিংসফোর্ড ছিল না সে গাড়িতে। ছিল ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী এবং কন্যা। তারা দুজনেই তৎক্ষণাৎ মারা যায়। ওদিকে ভাই আর প্রফুল্ল আলাদা আলাদা পালাল। পঁচিশ কিলোমিটার হেঁটে ওয়েনী স্টেশনে ধরা পড়ল ক্ষুদিরাম আর পুলিশ ধরার আগেই গুলি খেয়ে আত্মহত্যা করল প্রফুল্ল। ভাইয়ের বিচার হল। বাদীও ইংরেজ, বিচারকও ইংরেজ, সুতরাং রায় তো সবার জানাই ছিল। ১১ই আগস্ট যখন রাত্রি শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটছে, সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেশের জন্য আত্মবলিদান দিল আমার ভাই...”
হাঁ করে প্রদ্যোৎ গিলত এসব গল্প। রক্ত গরম হয়ে উঠত তার। মনে মনে ক্ষুদিরামকে নিজের আইডল হিসেবে কল্পনা করত। ভাবত, সেও যদি একবার সুযোগ পায়।
অপরূপা দেবীর বাড়িতে এসে হাঁক দিল প্রদ্যোৎ, “মাসি… মাসি…”
মাসি বাইরে বেরিয়ে আসামাত্রই দারুণ উত্তেজিত হয়ে সে শোনাতে লাগল দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাতের গল্প। যখন জানাল, সেও এখন বিপ্লবী দলে নাম লিখিয়েছে, অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল অপরূপা দেবীর দু’নয়ন। সেইসব মুক্তোয় সমস্ত শহীদের নাম লেখা।
ঊনিশশো একত্রিশ –
অচিরেই প্রদ্যোৎ দলের বাকিদের খুব প্রিয় হয়ে উঠল। তার স্বাভাবিক উচ্ছলতা, সবাইকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা, যেকোনো কাজে নিজে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সদিচ্ছা – এসবই তাকে খুব কম সময়ের মধ্যেই করে তুলল দলের একজন বিশেষ সদস্য। নিজের ডাকনামেই সে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠল– ‘কচি’।
পঁচিশে মার্চ। স্টেশনের পাশেই নির্জন মাঠ। ছেলেরা সব খেলাধূলা করে ফিরে গেছে। সন্ধের আঁধার নেমে এসেছে অশ্বত্থের ডালে ডালে। হালকা বাতাস উঠেছে। এলোমেলো উড়ছে শুকনো পাতা, ধূলোবালি। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস।
মাঠের এককোণে জড়ো হয়েছে উত্তেজিত পাঁচ যুবক। ফণী কুন্ডু, জ্যোতিজীবন ঘোষ, বিমল দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল দত্ত এবং ‘কচি’ ওরফে প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য।
বিমল শুরু করল, “কচি, প্ল্যান যাই হোক না কেন, মারব কিন্তু আমি। খুব বাড় বেড়েছে গোরারা। এবার পেডি সাহেবের বর্বরতার হিসেব মেটানোর সময় এসেছে।”
ম্যাজিস্ট্রেট পেডি একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর মানুষ। বিপ্লবীদের ওপর তার মাত্রাছাড়া অত্যাচার দলের সবাইকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।
জ্যোতিজীবন সায় দিল, “একদম ঠিক। বলে কিনা আমাদের এমন শিক্ষা দেবে যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে আমরা আর হাত তুলতে সাহস দেখাব না। আচ্ছা… দেখব… পিস্তলের সামনে ওই অত্যাচারী পেডি সাহেবের দৌড় কদ্দুর!”
হাওয়ার তীব্রতা বাড়ছে ক্রমশ। শোঁ শোঁ আওয়াজ দুলিয়ে দিচ্ছে চারিদিক। চোখেমুখে বালি এসে পড়ছে। ঠিক তখনই ঈশান কোণে যমদূতের মত কালো মেঘ চিরে দিল বিদ্যুতের ফলা। মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠল মাঠের আশপাশ। লোকজন সব নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। ভয়ঙ্কর এক প্রলয় ধেয়ে আসছে যেন। কেবল এই পাঁচ মূর্তি প্রতিক্রিয়াহীন। ঠিক যেন যন্ত্রমানব। মার খেতে খেতে দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায়, পাল্টা মার দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল প্রদ্যোৎ, “মেদিনীপুরে আর কোনো ইউরোপিয়ানকে লাঠি ঘোরাতে দেব না আমরা। প্ল্যানটা হল এরকম…”
সেই সন্ধের কয়েকদিন পরেই ৭ই এপ্রিল মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে স্কুলশিক্ষা প্রদর্শনীতে গর্জে উঠল দুটি বন্দুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ম্যাজিস্ট্রেট পেডি। মুহূর্তের মধ্যে বিমল আর জ্যোতিজীবন পগার পার। কেউ সাহস করল না ওদের পেছনে ধাওয়া করার। শুধু একটা বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, “বিমলদা…”
ভয়াতুর সরকার দু’মাসের জন্য ফ্রেঞ্চ নামের একজন ইন্টারিম ম্যাজিস্ট্রেটের পরেই তড়িঘড়ি নতুন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ করল, রবার্ট ডগলাস। কিন্তু তখন কি আর জানত যে ডগলাসের ভাগ্যেও খাঁড়া ঝুলছে…
বছরখানেক আগেই ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প। অধিকাংশ স্বাধীনতা সংগ্রামী যারা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, ধরা পড়ার পর তাদের সাধারণ জেলে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সরকার কিছু জায়গায় ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। প্রথমে ক্যাম্প তৈরি হল বক্সা ফোর্টে, তারপর হিজলিতে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। কঠোর হাতে নৃশংসভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এমন সময় ১৬ই সেপ্টেম্বর হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে নিরস্ত্র বন্দিদের উপর নির্বিচারে চলল গুলি। ২৯ রাউন্ড। আহত হল একশ জনেরও বেশি। তাদের মধ্যে পঁচিশ জন গুরুতর। শহীদ হলেন দুজন, সন্তোষ কুমার মিত্র এবং তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। পরেরদিন হিজলিতে এলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস এবং যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। মৃতদেহ দু`টি তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কোলকাতায়। শ্মশানে যাওয়ার পথে কলকাতায় একটি বড় মিছিলের আয়োজন হল।
প্রদ্যোৎ আরও ভালো করে ব্রিটিশ সরকারের নির্মমতার সাথে পরিচিত হল। ১৯২৫ সালে এই বর্বর সরকার নিয়ে এসেছিল ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’, যে অ্যাক্টের আওতায় নির্বিচারে আটক করা হল সেইসব ‘ভদ্রলোক’দের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি এই অ্যাক্টের মাধ্যমে ডিটেইনমেন্ট যে আদৌ আইনানুগ কিনা সেটা জানার অধিকারও খর্ব করা হয়েছিল। দু-দুবার অ্যারেস্ট হয়েও প্রমাণাভাবে ছাড়া পাওয়া সন্তোষ কুমার মিত্রকে খুব সহজেই এই অ্যাক্টের আওতায় এনে আটক করা হল। এমনকি তারকেশ্বর সেনগুপ্ত, যিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁকেও ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পের গুলিবর্ষণ গভীরভাবে আঘাত করল প্রদ্যোৎকে। ঘুমোলেই দুঃস্বপ্নেরা ভিড় করে আসে তার কাছে। উপুর্যপরি গুলির আওয়াজ, জেলের কর্কশ ঘন্টি, মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার… এসব শুনে ভয় পেয়ে জেগে ওঠে সে। দেখে, গা ঘামে ভিজে সপসপ করছে।
কোনো কারণ ছাড়াই এতগুলো নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালানো কাপুরুষতা নয়তো কী? সে বুঝল, অন্য কোনো জায়গার রাগ এখানে উগরে দেওয়া হয়েছে। সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন-তেন-প্রকারেণ সমস্ত প্রতিবাদী আওয়াজকে চুপ করিয়ে দিতে। কিন্তু এভাবে কি যুবশক্তিকে থামানো যায়? ডিটেনশন ক্যাম্পের এই ঘটনার পর ভেতরে ভেতরে আরও সতর্কভাবে তৈরি হতে লাগল তারা। ব্রিটিশ সরকারকে যে এর যোগ্য জবাব দিতেই হবে। ডগলাস সাহেব, তৈরি হও…
ত্রিশ এপ্রিল, ঊনিশশো বত্রিশ -
ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস নিজের সুরক্ষা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাই সশস্ত্র দেহরক্ষী ছাড়া এক পা-ও চলে না। এমনকি তার নিজের কাছেও থাকে লোডেড রিভলভার। মেদিনীপুর শহরেই অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে জরুরি সভা বসেছে। আর সেই সভাতেই তাকে খতম করার ভার পড়ল প্রদ্যোৎ আর প্রভাংশুর ওপর।
তৈরি হয়ে বেরোনোর আগে প্রদ্যোৎ দেখল, চেয়ারে বসে থাকা প্রভাংশুর একটু একটু পা কাঁপছে। প্রদ্যোৎ হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাঁটুর উপর হাত রাখল, “কীরে, ভয় লাগছে নাকি?”
গা ঝাড়া দিল প্রভাংশু, “না না। ভয় কীসের?”
“উঁহু! কাউকে মারতে গেলে ভয় পাওয়াটা তো স্বাভাবিক। তার উপর আবার সে যদি ডগলাসের মত কেউ হয় যে কিনা সবসময় নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে থাকে। শুধু ভয়টাকে মাথায় চড়তে না দিলেই হল। আর ভোজপুরি দারোয়ানদের মত যা একখানা পেল্লাই গোঁফ লাগিয়েছিস, তোকে তো আমিই চিনতে পারছি না, ওরা আর কী চিনবে? হে হে।”
এবার হেসে ফেলল প্রভাংশু। বলল, “চল, কাজটা তাহলে সেরেই আসি।”
বিকেল পৌনে ছটা। অফিসারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে জরুরি কাগজে সইসাবুদ করছে ডগলাস। চারিদিকে সেপাইদের সুরক্ষার বলয়। হঠাৎ বন্দুক উঁচিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল প্রদ্যোৎ আর প্রভাংশু। কেউ কিছু বোঝার আগেই আর্তনাদ করে উঠল তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। ঘরের নীরবতা খান খান করে দিল ডগলাসের গগনবিদারী চিৎকার।
“পকড়ো… পকড়ো…” শোনা গেল সিপাহীদের গলা আর হুটোপাটি। প্রদ্যোৎ আর প্রভাংশু দুজনেই একসঙ্গে দৌড়াচ্ছে। ডগলাসের দেহরক্ষীরাও ধাওয়া করেছে তাদের। একের পর এক গুলি ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। বন্দুকে নতুন গুলি ভরে পেছনদিকে পাল্টা ছুঁড়ল প্রভাংশু। বিপক্ষ খানিকটা পিছিয়ে গেল। সেই সুযোগে এগিয়ে গেল তারা কিছুটা।
কিন্তু একসময় দুজনে আলাদা হয়ে গেল দুটো ভিন্ন রাস্তায়। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রভাংশু উধাও হয়ে গেল। তার নাগাল পেল না সেপাইরা।
কিন্তু অন্যদিকে ভাগ্য সহায় হল না প্রদ্যোৎ-এর। তার বন্দুক গেল বিগড়ে। নতুন গুলি ভরে বারবার চেষ্টার পরেও একটিও গুলি বেরোল না রিভলভার থেকে। শেষমেশ উপায়ান্তর না দেখে একটা ভাঙা পোড়োবাড়িতে ঢুকে পড়ল সে। সেপাইরা ঘিরে ফেলল সে বাড়ি। ধরা পড়ে গেল প্রদ্যোৎ।
শুরু হল এলোপাথাড়ি মার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার দেহ। তবু এক মুহূর্তের জন্যও ভয়ের লেশমাত্র ফুটে উঠল না তার চোখেমুখে। পকেটে পাওয়া গেল দুটি কাগজ।
একটিতে লাল কালিতে বাংলায় লেখা: ‘হিজলী হত্যার ক্ষীণ প্রতিবাদে— ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক— বন্দেমাতরম।’
অন্যটিতে ইংরেজিতে লেখা: ‘A fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt on the patriotic sons of Bengal— Bengal revolutionaries.’
জেলে শুরু হল প্রদ্যোৎ-এর উপর পাশবিক অত্যাচার। লাঠি দিয়ে আঘাত করা হল, নখে ফোটানো হল পিন, চেন দ্বারা প্রহারে রক্তাক্ত হল পিঠ, শুইয়ে রাখা হল বরফের চাঁইয়ের উপর, নাকে-মুখে দেওয়া হল লঙ্কার ধোঁয়া। কিন্তু তবু টলানো গেল না প্রদ্যোৎকে। শত ঝঞ্ঝাতেও মহীরুহের মত সে অবিচল। ‘কে ছিল তার সঙ্গে?’ এ প্রশ্নের উত্তর বের করা গেল না কিছুতেই।
বারোই জানুয়ারি, ঊনিশশো তেত্রিশ -
শীতের ভোর। ঠান্ডার কামড় বেশ ভালোরকমই মালুম হচ্ছে। ডগলাসকে খুন করার অপরাধে প্রদ্যোৎ-এর ফাঁসি হবে আজ। সাতসকালেই স্নানের শব্দ আসছে তার সেলের ভেতর থেকে। সঙ্গে ভেসে আসছে গান –
"তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফলবে না।"
এই ছোট্ট ‘কচি’কে মৃত্যুর সম্মুখেও এভাবে স্থাণু হয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল আশেপাশের বন্দিরা। ফাঁসির মঞ্চে যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সবাই মিলে তার নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল।
ডগলাসের পরে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছে বার্জ। প্রদ্যোৎ মঞ্চে দাঁড়ালে ’পরে বার্জ তাকে শুধোল, “Are you ready?”
বার্জের দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হাসল প্রদ্যোৎ। বলল, “We are determined, Mr. Burge, not to allow any European to remain at Midnapore. Yours is the next turn. Get yourself ready.”
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এরকম সরাসরি ভয় দেখাবে কেউ, একথা স্বপ্নেও ভাবেনি বার্জ। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ শুকিয়ে গেল। গলায় দড়ি পরানোর
ঠিক আগেই গর্জে উঠল প্রদ্যোৎ,
“বন্দেমাতরম্।”
0 মন্তব্যসমূহ