ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

দিনশেষের আর্দ্রতা — সুদর্শন লোধ



|| ১ ||


"কী চাই ?"

"আমি যা চাই তা আমি পাবোনা, তুমি দিতেও পারবে না"


আগন্তুকটিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মেপে নিলেন অরুণ—রোগা মতো একটা লোক; বয়স তিরিশও হতে পারে, পঞ্চাশও হতে পারে! একটা ঢলঢলে কালো প্যান্টের ওপর তালিমারা সবুজ পাঞ্জাবী, মুখে হালকা গোঁফ-দাড়ি। বহু বছর আগে বইমেলায় দেখা এক দুঃস্থ তরুণ কবিকে তাঁর মনে পড়ে গেল। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে আবার শান্তস্বরে বললেন, "তাহলে আমি কী করতে পারি ?"

কোনও উত্তর পাওয়া গেল না!

অরুণ দরজার সামনে থেকে সরে এসে প্রায় রাস্তায় এসে কথা বলছিলেন। এবার ঐ লোকটি তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আশ্চর্য! হতভম্ব হয়ে তাকানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা এধরনের পরিস্থিতিতে।

অরুণ তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখেন, লোকটা বারান্দায় রাখা একটা টুলের ওপর বসে ইতিমধ্যে তিন বছর আগের হলদেটে নিউজপেপারটা ওলটাতে শুরু করেছে। এমন একটা ভাব যেন এই ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক!

অরুণের মধ্যেও আজকাল কেমন একটা ঘোর কাজ করে; যা চলছে, চলুক—এমন একটা অবস্থা। শরীরটাও ভালো যাচ্ছেনা কʼদিন ধরে। তিনিও একটা টুল টেনে এনে মুখোমুখি বসলেন। তারপর বললেন, "বললেন না তো ঠিক....আপনার নামটাই বা কী?"

পেপারটাকে শাড়ির মতো ভাঁজ করে লোকটি হেসে বললো, "আমার নাম নেই, নামহীন বলতে পারো—নিজের ইচ্ছা মতো একটা নাম বসিয়ে নিতে পারো...যা খুশি। তবে আপনি করে ডেকো না।"

- "ও আচ্ছা, কেন এসেছো ?"

এই নামের বিষয়টা খুব একটা হতচকিত করতে পারেনি অরুণকে। তিনি আবার বললেন, "তা নিশ্চয়ই কোনো কাজেই এসেছো, সেটা বলো।"

তিনি এতক্ষণ লক্ষ্য করেননি, নামহীন মানুষটির চোখ কেমন যেন মাছের মতো শীতল, ভাবলেশহীন!

কয়েক মুহূর্ত কোনো শব্দের আদান-প্রদান হলো না; স্থলপদ্ম গাছের ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের ঠাণ্ডা রোদ এসে এই দুই প্রাণীর ওপর কেমন যেন এক অলৌকিক বিষণ্ণতা এঁকে দিয়েছে।

"আমাকে একটু থাকতে হবে "

অরুণ প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। শেষবার এরকম বিরক্ত হয়েছিলেন বছর খানেক আগে, যখন জানতে পেরেছিলেন তাঁর টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে। কিছুটা সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বললেন, "মানে ? তুমি কে, তোমাকে চিনিও না—আর তাছাড়া আমার মনে হয় তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন।"

"আমাকে বেশিক্ষণ থাকতে হবে না, একটু থেকেই চলে যাবো—আর আসবো না"

"কতক্ষণ ?"


|| ২ ||


অরুণ চৌধুরী একা মানুষ। আজকাল যেন একটু বেশিই একা। এখন কোনো কাজ করেন না। একসময় টিউশনি করেছেন, গ্যারেজে কাজ করেছেন। যা কিছু জমিয়েছিলেন, তা দিয়ে রোজকার ডাল-ভাত জুটে যেত। তবে এখন তিনি একটা পাগলাটে ধরনের মানুষ হয়ে গেছেন। হাতে কানাকড়িও নেই। সব মদে গেছে। এখন সেটা কেনার টাকাও নেই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বাকী পাঁচজন যেমন নেশায় টান পড়লে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়, তিনি তা হয়ে যাননি। যেন তিনি শখের বশে মদ খেয়ে গেছেন। তাছাড়া, এক নাগাড়ে বেশ কয়েকদিন মুখে দানাপানি না দেবার ইতিহাসও আছে !

             নামহীন লোকটি একদম মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইল। এই প্রকার আজব আবদারের সম্মুখীন অরুণকে কখনও হতে হয়নি। কিন্তু কী মনে করে, তিনি রাজি হলেন। একজন অচেনা মানুষকে থাকতে দেওয়া—বিষয়টি সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারবে না; হয়তো অরুণ এতদিনে অসভ্যে পরিণত হয়েছেন।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যাবেলার আবছা আলো আলিঙ্গন করে ফেলে চারিদিক। নামহীন লোকটি বারান্দাতেই বসে থাকে। বাইরের গেটটা ভেজিয়ে এসে অরুণ খাটে চোখ বুজে শুয়েছিলেন। অনেকক্ষণ সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, সব চুপচাপ—নিশ্চয়ই ব্যাটা পালিয়েছে। পাশে রাখা একটা ছেঁড়া লাইন টানা পৃষ্ঠা নিয়ে তিনি কিছু একটা লিখতে বসলেন।


"এগুলো কী? কবিতা?"

মারাত্মক চমকে উঠলেন অরুণ। পেনটা হাত থেকে পড়ে গেল।

"তুমি? কোথায় ছিলে? এভাবে কেউ ভয় দেখায়—উফ্!"

"ভয় কেন দেখাবো; আমি তো পাশেই বসে আছি অনেকক্ষণ। লিখছিলে তো, তাই খেয়াল হয়নি বোধ হয়। "

একটু থেমে সে আবার অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, "সুতপাকে মনে আছে?"


অরুণ নামহীন মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, পলকহীন দৃষ্টি। সুতপা, ১৯৮৯, বিকেলবেলার ঘ্রাণ—এক পশলা বৃষ্টি; বহুদিনের পুড়ে যাওয়া ক্ষতে আবার অগ্নিসংযোগ। এতকাল পরেও এসব ভেবে অরুণ মুখের ভেতর তেতো স্বাদ অনুভব করলেন। কিন্তু, কিন্তু এই অচেনা লোকটি কে ?

"তুমি...তুমি, ওকে চেনো?"

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে বলে, "আরেকটু ভালোভাবে থাকা যেত, জানো ?"

"আমার ভালো লাগছে না"—অরুণের কণ্ঠে যন্ত্রণার স্পর্শ।



|| ৩ ||



ছাদে এসে অরুণ দেখলেন আকাশের প্রত্যেকটি নক্ষত্র যেন খুব পরিচিত কয়েকটি ছিদ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। মহাকাশ যেন এক বৃহৎ ঝাঁঝরি! সেই ছিদ্রসমূহ দিয়ে অতি প্রাচীন কোনো তরল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে—তাঁকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, বারবার।

সুতপা! কবেকার কথা। এতদিনে বিদেশে সুখে সংসার করছে হয়তো, ওর ছেলেও বড় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। না, অরুণ কখনোই ওর যোগ্য ছিল না। যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে।

কোন কম বয়সের প্রেম-বিরহ, এইসব বিষয় নিয়ে ভেবে এই বুড়ো বয়সে তাঁর দুঃখ পাওয়ার কথা নয় কিন্তু তাও আজ কষ্ট হচ্ছে। জীবনের সেই সময়টা অরুণ পেরিয়েছেন খুব কষ্টে। পরবর্তীকালে সেভাবে কোনো স্থায়ী চাকরি জোগাড় করতে পারেননি; চোখের সামনে বয়স্ক মা-টা বিনা চিকিৎসায় একটু একটু করে শেষ হয়ে গেছেন। নিকৃষ্ট মাতাল হয়ে জীবনটা কেটে গেল শুধু।

                অরুণ আনমনা হয়ে অনেকগুলো পুরোনো লেখা পৃষ্ঠা তিনি ছিঁড়তে লাগলেন। আগুন দিতেই যাবে এমন সময় দেখেন, নামহীন লোকটিকে জ্যোৎস্নার আলোয় দেখতে খুব ভালো লাগছে; ঠিক যেন অরুণের মতোই দেখতে—তেইশ বছরের অরুণ। সেই অরুণ, যে অরুণ চাইলে নিজেকে বাঁচাতে পারতেন। না, নেশা তো করেননি আজকে—তাও এসব উদ্ভট দৃশ্য, উদ্ভট ভাবনা কেন ?

সেই অচেনা লোকটি আপনমনে গাইতে থাকে,

                    " কথা নয় আজি রাতে

                      আমারে গাহিতে দাও

                       এ মধুর জোছনাতে...."


অরুণের শরীরটা কেমন গুলাচ্ছে। গলগল করে অনেকটা রক্তবমি করে ফেললেন তিনি। কাশতে কাশতে দেখলেন নামহীন মানুষটি খুব হাসছেন—হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেছে। অরুণ আর দাঁড়াতে পারলেন না, পড়ে গেলেন—আবার বমি করলেন। এবার যেন বমি না, কোনো উজ্জ্বল ও নিষ্ঠুর উষ্ণ জ্যোৎস্না উগলে দিচ্ছেন ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলির ওপর। পৃষ্ঠাগুলিও আজ এইরকম মুহূর্তের জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছিল।

কী ছিল এই পৃষ্ঠায়? তাঁর জীবনের কথা? তাঁর অনুতাপ? তাঁর কৈফিয়ৎ? এখন মনে পড়ছে না। অরুণের শেষ সময়টা স্তব্ধ আকাশের দিকে তাকিয়েই কেটে গেল; সজল চোখে একগুচ্ছ বিস্ময়।

নামহীন লোকটি অরুণের পাশে একইভাবে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আর গাইতে থাকে, "কথা নয়, কথা নয়..."

দুই অরুণ শুয়ে থাকলেন পাশাপাশি। একজন ঘুমন্ত, আরেকজন জেগে; তবে সেও চলে যাবে। অতলস্পর্শী হৃদয়ে নৈঃশব্দের অবিরাম জন্ম-মৃত্যু, যতটা অকৃত্রিম বলে মনে হয়; ঠিক ততটাই অকৃত্রিম—ততটাই মনোরম এই দৃশ্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ