ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধে গ্রিনটির ভূমিকা- শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

 রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস কী?

এই রোগটি একটি অতিপরিচিত ক্রনিক ইনফ্ল্যামেটরি জয়েন্ট ডিজিজ এবং এই রোগটি বংশগতির মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয় আবার বিভিন্ন পরিবেশগত প্রভাবের ফলে এই রোগটির সৃষ্টি হতে পারে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে  টাইপ-থ্রি হাইপারসেনসিটিভিটি রিঅ্যাকশান এবং সিডি৪-টি-কোশের সক্রিয়করন ঘটে যার ফলে ইনফ্লেমোটরি সাইটোকাইনস, যেমন আইএল-৬,১ এবং টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টরের নিঃসরণ ঘটে। এই সক্রিয় সিডি৪-টি- সেল রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর  অ্যান্টিবডিকে সক্রিয় করে তোলে এবং এর সাথে অ্যান্টিসাইক্লিক সিট্রুলিনেটেড পেপটাইড অ্যান্টিবডিকে সক্রিয় করে তোলে যার ফলে ইমিউন কমপ্লেক্স তৈরী হয়। এইসময় অ্যাকিউট ফেজ প্রোটিন যেমন সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন প্রচুর মাত্রায় তৈরী হয় এবং এটি ইনফ্ল্যামেটরি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং এর পাশাপাশি এটি ইমিউন কমপ্লেক্সের উপর অবস্থিত অ্যান্টিবডির সাথে কমপ্লিমেন্টেসের স্থিতিকরনে সাহায্য করে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির ফলে আমাদের হাতে ও পায়ের জয়েন্টসমুহ ফুলে ওঠে অর্থাৎ ওইসব স্থানে প্রদাহ হয়।


রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের প্যাথোফিজিওলজি

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস মুলত ৪ রকমের ক্ষতিকর প্যাথলজিকাল অবস্থা নিয়ে গঠিত। এগুলো হল-

  • সাইনোভিয়াল প্রদাহ এবং সাইনোভিয়াল হাইপারপ্লাসিয়া
  • অটোঅ্যান্টিবডির উৎপাদন
  • তরুণাস্থির ক্ষতি
  • হাড় ধ্বংস

আমাদের কোশীয় এবং পরিবেশগত প্রভাবকেরর পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে আমাদের শরীরে একটি অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া ঘটে থাকে যার ফলে এই রোগটির বিস্তার লাভ হয়ে থাকে। অর্থাৎ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হল একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার। কিছু জিনগত ফ্যাক্টর এই রোগটির জন্য দায়ী হয়ে থাকে‌। এগুলো হল- কিছু এইচ এল এ জিন যেমন- ডিআরবি১*০১, ডিআরবি১*০৪, ডিআরবি১*১৩ এবং ডিআরবি১*১৫ এবং কিছু নন-এইচ জিন যেমন- পিটিপিএন২২, আইএল২৩আর, টিআরএএফ১, সিএলটিএ৪, আইআরেফ৫, এই রোগটির বংশগতীয় বিস্তারের জন্য দায়ী। 


আমাদের এই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  হল একটি অটোইমিউন ডিসঅর্ডার এবং এখানে আমাদের অনাক্রম্য তন্ত্রের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে রোগটির বিস্তারে। আমাদের অনাক্রম্য তন্ত্র এই রোগটির বিস্তারের সময় আমাদের অনাক্রম্যতন্ত্রে উপস্থিত টি কোশ সমুহকে সক্রিয় করে দেয় অর্থাৎ অনাক্রম্যতন্ত্র আমাদের কোশীয় বা আণবিক স্তরএর একটি উদ্দিপনার সৃষ্টি করে এবং যেটি উৎপন্ন হয় যখন আমাদের অনাক্রম্যতন্ত্রের স্থানীয় ডেনড্রাইটিক কোষ সমুহ কিছু বিশেষ প্রভাবকদের সাথে বিক্রিয়া করে এবং সেইসব বিশেষ প্রভাবক সমুহের এক্সপ্রেশন বৃদ্ধি করে। এইসব প্রভাবক গুলো হল- সাইটোকাইনস, এইচএলএ ক্লাস টু অণু, সহ-উদ্দীপক অণু।  এই সমস্ত প্রভাবক সমুহ আমাদের টি কোশ সমুহের বিস্তার এবং সক্রিয়করণে সাহায্য করে থাকে। এই সক্রিয় টি কোষ সমুহ আমাদের বি কোষ সমুহকে সক্রিয় করে তোলে এবং এর পাশাপাশি ম্যাক্রোফেজ সমুহ সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সক্রিয় ম্যাক্রোফেজ সমুহ কিছু ক্ষতিকর সাইটোকাইনস যেমন- টিএনএফ -α এবং ইন্টারলিউকিন -১, ৬, ১২,১৫,১8,২৩ কে সক্রিয় করে তোলে এর ফলে আমাদের জয়েন্ট সমুহের সাইনোভিয়াল ফ্লুইডকে নষ্ট হয়ে যায় এবং এই অবস্থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় সাইনোভাইটিস। এছাড়াও এই ম্যাক্রোফেজ সমুহ মেটালোপ্রোটিনেসেস নামক একটি ম্যাট্রিক্স অবক্ষয়কারী এনজাইমকে নিঃসরন করে এবং ফাগোসাইটোসিস এবং অ্যান্টিজেন উপস্থাপনার প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে দেয় এর ফলশ্রুতিতে আমাদের জয়েন্টর তরুণাস্থি সমুহ নষ্ট হয়ে যায় এবং ওইসব স্থানে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং স্থানটি ফুলে ওঠে। সাইটোকাইনস ছাড়াও আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন স্পিসিস [ROS এবং RNS] সমুহ অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের সৃষ্টি করে এবং এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের ফলে আমাদের জয়েন্ট সমুহে উপস্থিত তরুণাস্থি নষ্ট হয়ে যায়। এইভাবে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  এর বিস্তার আমাদের শরীরে হয়ে থাকে।


গ্রিনটি

চা হল একটি অতিজনপ্রিয় পানীয় এই গোটা বিশ্বে। প্রতিদিন সকালে এক কাপ চা না পেলে আমাদের দিন শুরু হয়না। চা পান করার পর আমাদের মনে ও প্রানে কাজকর্ম করার উদ্যম চলে আসে। তাই চা একটি অতিগুরুত্বপুর্ন একটি পানীয়। আমাদের বিশ্বের প্রায় বিভিন্ন স্থানে Camellia sinensis এই গাছের পাতা থেকে উৎপন্ন গ্রিনটি, ব্ল্যাক টি এবং উলন টি পান করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে অপর দুটির তুলনায় গ্রিনটি আমাদের শরীরকে বিভিন্ন রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করে আমাদের শরীরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। 

 

গ্রিনটি-এর উপাদান সমূহ

গ্রিনটি এর মধ্যে বিভিন্ন রকমের অ্যামিনো অ্যাসিড যেমন- গ্লুটামিক অ্যাসিড, ট্রিপটোফান, গ্লাইসিন, সেরিন, অ্যাসপার্টিক অ্যাসিড, টাইরোসিন, ভ্যালাইন, লিউসিন, থ্রোনাইন, আরজিনাইন, এবং লাইসিন, কার্বোহাইড্রেট যেমন- সেলুলোজ, পেকটিন, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, এবং সুক্রোজ, কিছু প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ যেমন- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লোহা, তামা, দস্তা, মলিবডেনাম, সেলেনিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস, কোবাল্ট, স্ট্রন্টিয়াম, নিকেল, পটাসিয়াম, ফ্লোরিন, এবং অ্যালুমিনিয়াম এবং কিছু পরিমাণ লিপিড যেমন- লিনোলিক এবং আলফা-লিনোলিক অ্যাসিড, স্টেরল স্টিগমাস্টেরল থাকে। এছাড়া গ্রিনটিতে কিছু ভিটামিন যেমন- ভিটামিন- বি, সি এবং ই থাকে। গ্রিনটি এর মধ্যে ক্লোরোফিল এবং ক্যারোটিনয়েড নামক রঙ্গক উপস্থিত থাকে। এছাড়াও গ্রিনটি তে কিছু উদ্বায়ী যৌগ যেমন- অ্যালডিহাইড, অ্যালকোহল, এস্টার, ল্যাকটোন, হাইড্রোকার্বন।

এছাড়াও গ্রিনটিতে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল উপস্থিত থাকে। এই পলিফেনলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ফ্ল্যাভানল, ফ্ল্যাভোনয়েড, এবং ফেনোলিক অ্যাসিড। গ্রিনটির মধ্যে উপস্থিত বেশিরভাগ পলিফেনল হল ফ্ল্যাভোনলস যেটি ক্যাটেচিনস নামে পরিচিত। এই ক্যাটেচিন ব্ল্যাক টি এবং উপন চায়ের থেকে গ্রিনটিতে বেশি পরিমাণে থাকে। গ্রিনটিতে প্রধানত ৪ রকমের ক্যাটেচিনস থাকে। সেগুলি হল- এপিকেচিন, এপিগ্যালোক্যাটেকিন, এপিক্যাটেকিন-৩- গ্যালেট, এবং ইজিসিজি।


রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  প্রতিরোধে  গ্রিনটি এর মধ্যে উপস্থিত এপিকভাটেকিন-৩- গ্যালেট (ইজিসিজি) -র ভূমিকা 


এপিকভাটেকিন-৩- গ্যালেট (ইজিসিজি)  হল epigallocatechin এবং gallic acid এর এস্টারিকৃত রূপ। এই এপিকভাটেকিন-৩- গ্যালেট হল গ্রিনটি এর প্রধান Bio active component। এই Epigallocatechin-৩-Gallate [EGCG] বিভিন্নভাবে আমাদের এই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  কে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এই পদ্ধতি গুলো হল-

গ্রিনটি এর মধ্যে উপস্থিত এই এপিক্যাটেকিন -৩- গ্যালেট বা EGCG আমাদের শরীরে ইন্টারলিউকিন -১β কর্তৃক সৃষ্ট প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে দেয়। এর ফলে আমাদের শরীরে বিশেষ করে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধী বা জয়েন্ট সমুহে বিভিন্ন Inflammatory mediators যেমন- cyclooxygenase ২ (COX-২), Interferon gamma (IFNγ), এবং tumor necrosis factor alpha (TNFα) এর ক্রিয়াকে অবদমিত করে।

EGCG আমাদের অর্থাৎ যারা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  এ আক্রান্ত তাদের রক্তের Serum এবং অস্থিসন্ধী বা জয়েন্ট সমুহের মধ্যে total immunoglobulins (IgG) and type II collagen-specific IgG এর মাত্রা কমিয়ে দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে EGCG IL-১β-induced inducible nitric oxide synthase (iNOS) এবং সিওএক্স-২ স্ফুটন এবং এদের ক্রিয়াকে অবদমিত করে আমাদের অর্থাৎ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের তরুণাস্থি সমুহকে রক্ষা করে। EGCG এই ক্রিয়ার ফলে নাইট্রিক অক্সাইড এবং প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনস ডি.ই এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় আমাদের তরুণাস্থিতে।

EGCG আমাদের শরীরে প্রদাহজনক উপাদান এবং আর্থ্রাইটিক উপাদান সমুহ যেমন- সাইটোকাইনস, কেমোকাইনস, এমএমপি, অ্যাগ্রিক্যানেস, আর ও এস, এনও, কক্স-২, এবং পিজিই২ এর প্রকাশকে অবদমিত করে এবং আমাদের শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধী বা জয়েন্ট সমুহকে এইসমস্ত components এর ক্ষতিকর প্রভাব যেমন- প্রদাহের হাত থেকে রক্ষা করে।

EGCG একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রূপে কাজ করে। এটি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  এ আক্রান্ত ব্যাক্তিদের জয়েন্ট এর স্থান থেকে  সুপারঅক্সাইড অ্যানিয়ন, হাইড্রক্সিল র‌্যাডিক্যাল এবং অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন স্পিসিসকে বহিষ্কার করে। এই ROS রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের প্যাথোজেনেসিসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে একজন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  এ আক্রান্ত ব্যাক্তির সায়নোভিয়াল ফ্লুইডে প্রায় ৯০% ROS এর উপস্থিত ছিল [Nanjo F et al এবং Kurien BT et al.]। 


যখন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  এ আক্রান্ত ব্যাক্তিদের জয়েন্ট সমুহে ROS এর মাত্রা বৃদ্ধি পায় তখন সেই ROS সমুহকে দূরীভূত করার জন্য ক্যাটালেস, সুপারঅক্সাইড ডিসম্যুটেজ এবং গ্লুটাথিয়ন পারক্সিডেসের ক্রিয়া বৃদ্ধি পায় এরা সবাই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইম এবং এদেরকে নিয়েই গড়ে ওঠে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা সিস্টেম।


এভাবে গ্রিনটি এর মধ্যে উপস্থিত এপিকভাটেকিন-৩- গ্যালেট (ইজিসিজি) রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসকে প্রতিরোধ করে থাকে। যারা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত তারা তাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় গ্রিনটিকে রাখতে পারেন। আপনারা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু শরীরচর্চা করার পর এককাপ গ্রিনটি পান করেন তাহলে আপনাদের শরীরটা তাজা হয়ে উঠবে এবং আপনারা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস  এর বিভিন্ন জটিলতা থেকে দূরে থাকতে পারবেন এবং আপনাদের জয়েন্ট সমুহ মুক্তমুলক এবং বিভিন্ন প্রদাহজনক সাইটোকাইনস এর ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং আপনাদের জয়েন্ট সমুহের স্বাভাবিক ক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে। এখন বাজারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গ্রিনটি পাওয়া যায়। আপনারা আপনাদের চিকিৎসক বা পথ্যবিশারদদের সাথে আলোচনা করে গ্রিনটি ব্যবহার করতে পারবেন। বাজারে লিপটন, পতঞ্জলী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের গ্রিনটি পাওয়া যায় আপনারা এগুলো ব্যবহার করতে পারবেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ