রোহনের ঘটনা
(১)
এ আমার কিশোরবেলার কথা। আমি তখন সবে ক্লাস নাইনে পড়ছি। এইটের রেজাল্ট ভীষণ খারাপ হওয়ায় মা-বাবা দুজনেই খুব চটে আছে, আমার দিকে পোকামাকড়ের মতো নজরে দেখছে। আমারও মন- মেজাজ ভালো নেই।
তাই একদিন যখন আবার মায়ের বকা খেলাম, তখন মনে মনে ঠিক করলাম আমি এখানে আর থাকবো না। চলে যাবো অন্য কোথাও। কিন্তু যাবো বললেই তো যাওয়া যায় না, তার একটা প্রস্তুতি থাকে। তাই আমার জমানো কিছু টাকা আর জামাকাপড় নিয়ে এক নিশুতি রাতে বেরিয়ে পড়লাম।
একটা পুকুর আর কয়েকটা মাঠ পেরোলেই দিব্যি শর্টকাটে মেন রাস্তায় ওঠা যায়। কিন্তু ওই পুকুরের দিকে যাওয়া এই নিশুতি রাতে… । ভয়ে বুকটা একবার আমার কেঁপে উঠলো। এই পুকুর নিয়ে নানারকম উপকথা প্রচলিত।
রাত এগারোটার পর নাকি এই পুকুর পাড়ে একটা ছেলে বসে রোজ কাঁদে। অনেকে নাকি দেখেছে তাকে। তাকে যেই দেখে, সেই আর বাঁচে না, রক্ত বমি করতে করতে মারা যায়।
আমি ভাবলাম পুকুরপাড়টা খুব তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাবো কোনোদিকে না তাকিয়ে। কার্তিক মাসের শেষ। আকাশ পরিস্কার, বেশ একটা শিরশিরে ঠান্ডা রয়েছে বাতাসে। আমি ফুলহাতা জামাটা গায়ে ভালোভাবে আঁটালাম। কোথায় আমার গন্তব্য জানি না, তবু জানি এ ঘর থেকে আমাকে বেরোতে হবে।
ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম পুকুরপাড়ে। সেখানে কি কোনো সুগন্ধি ফুল ফুটে আছে, তা না হলে এমন স্বর্গীয় সুবাস আসে কোথা থেকে! মনে প্রানে আমার যেটুকু অভিমান, কষ্ট দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, তারা যেন সব শান্ত হয়ে গেছে।
সুগন্ধ আসছে পুকুরপাড়ের দক্ষিণ দিকটার এক ঝোঁপের থেকে । সেই ঝোঁপটা যেন অন্ধকারে চুপচাপ জমাট বেঁধে আছে। গন্ধটার মধ্যে যেন এক অদমনীয় হাতছানি আছে, যাকে উপেক্ষা করা বৃথা চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। আমি এগোতে লাগলাম পাড় ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্মুখীন হলাম ঝোঁপটার। যদিও ওটার অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই উপলব্ধি করতে পারছি না। এমনই গাঢ় অন্ধকার যে টরচের আলোও ম্লান হয়ে যায়। এবার ফুলের গন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসছে। নিশ্চয়ই ফুল এখানেই ফুটে আছে। সেইসময় হঠাৎই অন্ধকারের পর্দা থেকে উদয় একটা লোকের।
★★★★★★★★★
(২)
লোকটাকে আমি মোটেও চিনি না, তবে নাম জানি। বহু বছর আগে এই মহাপুরুষই কোথায় চলে গিয়েছিল, আজ নাকি ফিরে এসেছে। অন্তত আমাকে সেভাবেই কনভিন্স করালো। লোকটার হাতে একটা ঢ্যাঙা আদ্যিকালের হ্যারিকেন, তা থেকে হলুদ আলো বেরোচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে বিগলিত গলায় বললো-“আরে খোকা! তুমি লোকনাথদার ব্যাটা নও?”
লোকটা বিশাল লম্বা আর চেহারায় লিকলিকে। সে ঝোঁপের কাছে কম ঘাসযুক্ত জায়গায় বাবু হয়ে বসে আমাকে ডাকলো আর বললো কথাটা।
আমি থতমত খেয়ে বললাম-“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
“গ্ৰামে না থাকলেই কি খোঁজখবর নেব না? এমন আহাম্মক আমি নয়!”-লোকটা , বিচ্ছিরি ভাবে হাসতে হাসতে বললো।
আমার কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। এত রাতে হঠাৎই এমন লোকের ধূমকেতুর মতো আবির্ভাবও তো কম রহস্যময় নয়। লোকটা এখানে করছিল কী! না, ঘরে ফিরে যাই। বেকার মন খারাপ করে লাভ নেই। লোকটা যেন মনের কথা বুঝতে পেরে বললো-“যাচ্ছো কোথায়! আমার গল্প শুনে যাও।”
আমি বাধ্য ছেলের মতোই বসে পড়লাম লোকটার কাছেই। লোকটাও বলতে শুরু করলো-“লোকে কী বলে জানো, এখানে নাকি একটা অশরীরী থাকে। রোজ রাতে এই ঝোঁপের কাছে এসে কাঁদে।”
আমাকে আবার মুখ খুলতে হল, বললাম-“তাহলে এত রাত হয়ে গেল এখনও কাঁদছে না কেন? ”
লোকটা আমার কথার কোনও জবাব দিল না। আমি ঝোঁপের দিকে তাকালাম, আমার শরীর অজানা কারনেই ভয়ে অবশ হয়ে যাচ্ছে। লোকটা আবার শুরু করলো-“সেইদিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি আর আমার ভাইপো বৃষ্টিতেই এখানে চলে এলাম মাছ ধরতে।
আমার হাতে আছে মাছ ধরার উপকরণ রয়েছে। ভাইপো শুধু একটা হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে, তবে পুকুর উথালপাথাল, জল উপচে পড়ছে দুই পাড়ে।
আমি তো তখনই মাছ ধরতে লেগে গেলাম। ভাইপো আলো দেখায়, আর আমি ঝপাঝপ ধরি। বেশ ভালোই চলছিল, হঠাৎ ভাইপো বলে উঠলো-“কাকু, কেউ একজন খুব কাঁদছে। ”
আমি প্রথমে তার কথায় তেমন গুরুত্ব দিই নি। একটা থ্রিতে পড়া ছেলের কথায় গুরুত্ব দিয়েই বা লাভ কি! কিন্তু আবার পলাশের গলা শোনা গেল-“কাকু, আমার খুব ভয় লাগছে। খুব কাঁদছে ছেলেটা! ”
এবার আমি মাছ ধরা বন্ধ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম। ভুল কিছু বলেনি পলাশ। সত্যিই কেউ যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে, বুকটা আমার ধক করে উঠলো!
আমি তাড়াতাড়ি পলাশকে কানে আঙুল দিতে বললাম। এ কান্না কানে গেলেও ভয়াবহ বিপদ ঘনিয়ে আসে। তবে সে কান্না খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণ পরেই পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। আমিও যেন বুকে বাতাস পেলাম। পলাশকে বললাম-“নে আর কেউ কাঁদছে না। এবার আলো দেখা দেখি!”
পলাশ এতক্ষণ ভয়ে বেশ জড়োসড়ো হয়ে গেছিল। এবার দেখি মুখে কেমন একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে। অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। রাতও কম হয়নি, মাছ ধরতে ধরতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।
কিন্তু পলাশ দেখি আলো না দেখিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। এবার আমার গা রাগে রি-রি করে উঠলো, রেগে বললাম-“খাবার বেলায় তো গোগ্ৰাসে গিলবি, আর আমি বলছি আলো দেখাতে, তখন দেখাবি না!”
এমনিতে আমি বকলে ফ্যাঁস করে কাঁদতে শুরু করে পলাশ। সেইদিন তাও করলো না, ঠাঁই একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো! তাহলে ওর হলোটা কী? এমন চুপচাপ করে আছে কেন? রাগ কমাতে তার হাতটা আমি ধরতেই, ভয়ে গোটা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
শরীর এত ঠান্ডা! আবার আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম পলাশের দিকে। চোখ দুটোতে যেন বিষাক্ত লাল আলোর ঝলকানি। সেই শ্যেন দৃষ্টিতে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে আমার।
আমি চুপচাপ বসে পড়লাম। কোনোকিছু এখন আর আমার মাথায় আসছে না। আমার ওকে নিয়ে আসাটাই কি ভুল হলো? হায় ভগবান!
এমনই হা-হুতাশ করছি, এমন সময় পলাশ যেন কোন মন্ত্রবলে জেগে উঠলো। কেমন একটা খসখসে গলায় সে বলে ওঠে-“এই আমাকে মাছ দিবি না?”
গলার স্বর শুনে আমি ভয়ে সরে গেলাম। আমি ভয়ে মাছগুলো তাকে এগিয়ে দিলাম। সে কাঁচা মাছগুলোকে আমার কাছে থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে চপাং চপাং করে চেবাতে লাগলো।
কী যে রাক্ষুসে খিদে ভর করেছে পলাশের উপর! ছোট বড়ো সব মাছগুলোকেই সে গোগ্ৰাসে গিয়ে। তাহলে কি ওই ভুতটা…
ভাবনাটা জোরালো হওয়ার আগেই আমার ডান পা কেউ যেন শক্ত করে ধরেছে। আমি তাকিয়ে নীচে দেখি একটা কালো বীভৎস নোংরা হাত। আমি আর তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম মাটিতে। আর সেই সঙ্গে আমার সেই পা টেনে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললো সেই কালো হাতের মালিক।
টেনে চলছে তো টেনে চলছেই, কত যে আঁচড় পেলাম! তারপর সে থেমে গেল আর… ”-লোকটা এতটা বলে হঠাৎই থেমে গেল।
আমি বললাম-“ আমার না ভীষণ ভয় করছে, আমি এবার ঘর যাবো!"
“সব সময় ঘর যাবো করো কেন বলো তো। এখানে এসেছো তো ঘরের মায়া ত্যাগ করে! সবে রাত সাড়ে বারোটা বাজে। তাছাড়া আমাদের কী হলো সেটাও তো জানতে হবে নাকি?”- লোকটা যেন রেগে বললো।
তবে সত্যি বলতে কি আমার খিদেও পেয়েছে, কতক্ষণ যে কিছু খায়নি! হঠাৎ করেই হাতের কাছেই একটা খাবারের কথা ভেবে মন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। আমি লোকটাকে বলি-“কাকু, পুকুর থেকে মাছ এনে দাও না! বড্ড খিদে পেয়েছে!”
লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকায়, তারপর কি মনে করে ফিক করে হেসে ওঠে! তারপর বলে-“আচ্ছা, আচ্ছা। আমার কাজ তো শেষ, আমি এবার চলি।
★★★★★★★★★★★
রনির ঘটনা
রনির আজ সন্ধ্যা থেকেই মন খারাপ। আজ খেলাতে সন্তুদা তাকে এক ওভার মাত্র বল দিয়েছে। আরও এক ওভার পেলে তারা ম্যাচটা জিতে যেত।
আজ ওর পড়ায় মন নেই। তাই সে দাদুর কাছে গল্প শোনার জন্য বসলো। সে শুনতে চায় পুকুরপাড়ে ছেলে কাঁদার ব্যাপারটা। প্রথমে দাদু রাজী হচ্ছিল না, পরে বললো-“আচ্ছা, আচ্ছা। আসলে এ গল্প শোনালে সেও গল্প শুনতে চলে আসে। তারপর… ”
“তুমি শোনার কি না শোনাবে বলো?”-রনি অভিমানী সুরে বলে ওঠে।
“ঠিক আছে। অনেক বছর আগে আমাদের গ্ৰামে একটা ছেলে ছিল। বয়স কতই বা হবে নয় কি দশ! স্কুল ফাইনালে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় মা খুব বকলো, প্রায় ঘর থেকে বের করে দিলো। পলাশের তো খুব মন খারাপ। সে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো। তারপর হঠাৎই সে হেঁচকি তুলতে তুলতে দমবন্ধ হয়ে মারা গেল। তারপর থেকেই ওখানে রাত হলে ছেলে কাঁদে। আর কেউ যদি অভিমান বা মন খারাপ করে থাকে তাহলে যেন-তেন প্রকারেন তাকে টেনে নিয়ে যায় সেই পুকুরপাড়ে একটা লোক।”দাদুর কথা থামিয়ে দিয়ে রনি অবাক হয়ে বললো-“লোকটা আবার কে?”
“পলাশের কাকা। খুব ভালোবাসতো যে ওকে! শোক সামলাতে না পেরে সুইসাইড করে। কিন্তু লোকমুখে প্রচলিত আছে সে নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে। আসল ব্যাপারটা হলো, ওই কাকারই আত্মা টেনে নিয়ে আসে অভিমানী কিশোরকে। ”-দাদু বললো।
“ও আচ্ছা, যেভাবে রোহনদা ঘর ছেড়ে চলে গেছে! ”-রনি দাদুকে বলে।
“না, দাদু, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে!”-হঠাৎ অন্য একটা অদ্ভুত কন্ঠস্বরে দাদু আর রনি দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেল।
ওরা হতবাক বিস্ময়ে দেখলো রোহন বসে তাদের থেকে একটু দূরেই। দাদু মুখে কোনোমতে হাসি ফুটিয়ে বললো-“তুই আবার কখন এলি রে, দেখতে পাইনি তো! ”
রোহন দাদুর কথার কোনো জবাব দেয় না। সে বলে-“আসলে সেইদিন পলাশ ও তার কাকুও তো অমন ছেলে কাঁদা শুনতে পেয়েছিল। তাহলে ছেলে কাঁদার যে মিথটা রয়েছে সেটা তো আরো আগেকার তাই না?”
“না না। তা কেন হবে, এই ঘটনাটাই সত্যি। আসল কথা হলো পলাশের কাকা ভিকটিমকে শোনায় তার এক মনগড়া কাহিনী। আর কাহিনী শোনাতে শোনাতেই… ”-দাদু হঠাৎই থেমে যায়।
ওর গোটা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসছে। রোহন তো ঘর থেকে মনখারাপ করে বেরিয়ে গিয়েছিল আর তারপর কোনো খোঁজ নেই। আজ আবার হঠাৎ রাতে গল্প শুনতে এসেছে, তার মানে… ।
ভাবতে ভাবতে এতক্ষণ সামনের দিকে নজর দেয়নি। সামনের দিকে তাকাতেই সে রনি আর রোহন কাউকেই দেখতে পেলো না। এই রাতে আবার ওরা গেল কোথায়? আজ রনিরও তো মন খারাপ ছিল। তাহলে কি… ?
0 মন্তব্যসমূহ