ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

উপকরণ -প্রীতম বিশ্বাস

 আদতে প্রাচীন মগধ অতি শুকনো দেশ ছিল। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ‍্যে ইরি ধানের সোনালী সমুদ্র আর বিস্তর বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে নীলচে-ধূসর আচলখানা মেলে ধরেছেন স্রোতস্বিনী গঙ্গা । পাটলিপুত্রের কাছে তার ডান হাতখানি এসে ধরেছেন সোন । সোনের ধারা বেয়ে বেনা ঘাসের নৌকাগুলো গঙ্গার সাথে একে একে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে তাম্রলিপ্ত বন্দরের অভিমুখে ।  তাম্রলিপ্ত থেকে এই ঘাস কলিঙ্গ , অস্মক এমনকি সিংহল দেশে পর্যন্ত রপ্তানী হয়। মাদুর সহ বিভিন্ন গৃহস্থালির নানান উপকরন নির্মাণে তার বিস্তর ব‍্যবহার । 


  চারিদিকের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নানারকম চৈতালি ফসলের রঙে রঞ্জিত। সোনের ধারে একটি ছোট্ট গ্রাম । গ্রামের প্রান্তে একটি শতাব্দী প্রাচীন পাকুড় গাছ তার ঝুড়িগুলো নদীর জলে ডুবিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে। বেলা প্রায় দিপ্রহর ।  উজান বেয়ে পাটলিপুত্রের দিক থেকে একখানা তালপাতার ছাউনি দেওয়া নৌকা এসে ভিরলো গাছটির কাছে ।

 নৌকার ছই থেকে  পায়ে কৃতদাসের বেঁড়ি পরা এক বছর বাইশের যুবককে নিয়ে বেরিয়ে এলেন গদাধর কবিরাজ। দাসের নাম   রিপুদ্দমন ।এই দৃশ্য এই গ্রামের ঘাটটিতে নতুন নয় । এই নিয়ে পরপর তিনি তিনটি কৃতদাস নিয়ে ফিরলেন । কিন্তু আগের দুইজনই পালিয়েছে । আর পালাবেইনা বা কেন , সারাদিন হাড়-প্রবাল-স্বর্ণ-তাম্র চূর্ণ করা ; বাঘ- নেকড়ে , বিষাক্ত সাপের ভয়কে দমিয়ে রেখে জঙ্গল থেকে গাছ গাছড়া জোগাড় করে আনা , আর এইসব নানা ফরমাসের প্ররিবর্তে দুপুরে একমুঠো ভাত আর রাতে এক মুঠো ভাজা আমন চাল , আর তার সাথে উপরি পাওনা সর্বক্ষণের সঙ্গী পায়ে আর গলায় বেড়ি।

  মগধরাজ ধননন্দের শাসনে কৃতদাস তো কোন ছাড় , বস্তুতপক্ষে জনসাধারণের জীবনই হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত সস্তা । নিজের সুবিশাল সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন‍্য প্রজাদের ওপর এত পরিমাণ করের বোঝা তিনি চাপিয়েছেন যে গরীব- মধ্যবিত্তরা ব‍্যঙ্গ করে বলতো , “কৃতদাসের জীবন ঢেড় ভালো , খাজনা তো দিতে হয়না বাপু ।“ একথা সর্বৈব মিথ্যা ঘোষণা তো করতে পারিনে তবে একথা বলতেই পারি কৃতদাসে আর জনসাধারণের মধ্যে ওই পরাধীনতার সামান্য তারতম্যটাই পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । এক পক্ষের পায়ের বেড়ি চোখে দেখা যায় আর কারো বেড়ি অদৃশ্য ।     

      আর্যবর্তের  বৃজি এবং দক্ষিণের অস্মক ছাড়া আর যে সব ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রী রাজ্য কিছুদিন আগেও মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল ,   তার মধ্যে অন্যতম হিমালয়ের পাদদেশের পিপ্ললিবন ।   মগধরাজ ধননন্দ এই পিপ্পলিবনের ক্ষুদ্র ক্ষত্রিয় গোষ্ঠিকে পরাজিত করেন । বহু নারী পুরুষ বন্দি হয় দাস-দাসীর জীবন বরণের নিয়তি নিয়ে । বহু নারীর স্থান হয় নগরের গণিকা গৃহে , বহু কর্মঠ পুরুষ কৃতদাস হিসেবে নগরের বাজারে বিক্রি হয় গরু – ছাগলের ন‍্যায় ।

   সেইদিন পাটলিপুত্রের বাজারে নিজের বিশেষ ঔষধী  ঘি বিক্রি করে বেশ ভালো রকম অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়েছিলেন গদাধর কবিরাজ , তাই উৎফুল্ল মনে দাসের হাঁটের দিকে যেতেই এই ছেলেটিকে পছন্দ হয় এবং তাকে দাস হিসেবে কিনে আনেন । গ্রামে প্রভুর ফরমাস পূরণের লক্ষ্যে জন্য দোকান-বাজার ঘুরে সে জানতে পারল তার আগের দাসদের পালিয়ে যাওয়ার কথা । কিন্তু তার কাছে এই দাসের জীবন ধননন্দের কারাগারের অত‍্যাচারের তুলনায় যেন স্বর্গ । 

        

  একসময় হঠাৎ করেই মনিবের অত‍্যাচারে ভাটা পরলো । বেড়ি খুলে গেল ,  আর মনিব আদেশ করলেন এখন থেকে তার কাজ হবে শুধুমাত্র বাগানের ঘৃতকুমারীর পরিচর্যা ও সময় মতো প্রভূর ঔসধ নির্মাণের কক্ষের দেড়গজ গভীর চৌবাচ্চার পোশ‍্য কাকড়াবিছে গুলিকে আরসোলা টিকটিকি ইত্যাদি ধরে ধরে খাওয়ানো । কবিরাজ মশাই নাকি এক বিশেষ ধরনের ঔষধি ঘি  নির্মাণ করবেন , যার জন্য ওই দুটি অপরিহার্য উপাদান । গৃহস্থালির বাকি কাজের জন্যে দৈনিক তিন আনা মজুরি ধার‍্য করে হরেরাম মুদির বোবা ছেলেটাকে নিযুক্ত করেছেন কবিরাজ মশাই । প্রভূর এইরূপ পরিবর্তনে খুসি হলেও মনের কোনে একটু সন্দেহ থেকেই যায় । ইতিমধ্যে প্রায় এক মোন ঘি এবং আধ মোন মোম আনিয়েছেন মনিব । বৈশাখী অমাবস্যা আসন্ন । কৃষ্না ত্রয়োদশীতে গোধূলি বেলায় মনিব তার ঝোলা নিয়ে ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন । যাওয়ার আগে বলে গেলেন , “আগামী অমাবস‍্যায় সূর্যগ্রহণ । আমার মহৌষধী তৈরির আদর্শ সময় । তার জন্য কিছু উপকরণ আনতে যাচ্ছি দেহরী নগরে ।  আমি ফিরে আসার আগে সমস্ত কিছু গুছিয়ে রাখবি , যেমনটি বলেছিলাম । কিছু যেন ভুল না হয় । “ এরপর ঘাটের দিকে রওনা দিলেন । দূর থেকে সে দেখলো তার মনিবের নৌকা উজানে যাত্রা করলো ।

   মনিবের আদেশ মতো ঘৃতকুমারীর পাতা , ঘী , মোম , কাঠ সব ঔষধি নির্মাণের কক্ষে সাজাতে থাকে সে । কাঁকড়া বিছেগুলো চিমটা দিয়ে চৌবাচ্চা থেকে ধরে ধরে বিশাল কাঁচের বয়ামে রাখে । বিশাল কড়াইখানা ঘরের মধ্যেই নির্মিত বিশাল উনুনে বসায় । সবকিছু শেষ করে সে মনিবের আদেশ মতো সামান্য ফলাহার সেরে সারারাত পাহারা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে । সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায়না , একপ্রহর – দুইপ্রহর করে রাত্রি তখন প্রায় শেষের দিকে । কি যেন ভেবে সে মনিবের ঘর থেকে লাল মখমলে মোড়া একখানা তালপাতার পুথি নিয়ে বারান্দার প্রদীপের আলোয় ধরে , আর পুথির লেখাগুলো সামান্য পড়েই গা গুলিয়ে ওঠে তার ; পায়ের তলার মাটি যেন এক লহমায় সরে যায় । কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটু ধাতস্থ হয়ে ভালো করে পুথিটি পড়ে আর বুঝতে পারে যে সে আসলে কবিরাজের মহৌষধী ঘী এর প্রধান উপকরণ । যার প্রস্তুতি প্রকৃয়ায় তাকে সহস্র জীবন্ত  কাকড়াবিছের সাথে ফেলা হবে ওই বিশাল কড়াইয়ে । আর যখন বিছের কামড়ে সে শেষ নিশ্বাস ত‍্যাগের জন্য ছটফট করবে তখন তাকে ফোটানো হবে বাকি উপকরণ সহযোগে , যার অধিকাংশ নামই তার অজানা । আস্তে আস্তে তার কাছে তার আগের দাসদের নিরুদ্দেশের রহস্য স্পষ্ট হলো। গত কয়েকদিনে তার ওপর মনিব এর ঐরূপ সদয় আচরণের কথা ভাবতেই তার নিজেকে  বলির পাঠা বলে মনে হয় । 

   সূর্য ভগবান তখন পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছেন । হঠাৎই বাড়ির বাইরে কতোগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল । সে তড়িঘড়ি পুথি যথাস্থানে রেখে এসে নিজের যায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলো ‌। ভোর হয়েছে ৷ মনিব ফিরে এসেছেন  , তবে একা আসেননি তার সাথে সাতজন পালোয়ান গোছের লোক । মনে মনে সে একটা কথাই বললো , “পাষন্ড” ।সে বুঝতে পারলো পালানোর চেষ্টা বৃথা । অর্থাৎ মনিবকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা যে সে তার পরিকল্পনা জানে , তাহলেই বিপদ । আর সে জানে মনিব পরদিন অর্থাৎ বৈশাখী অমাবস‍্যার সূর্যগ্রহণের আগে তার কোনো ক্ষতি করবেন না । 


        মনিব রিপুদ্দমনকে আদেশ দিলেন সে যেন তার মনিবকে বিরক্ত না করে , কারণ সে ক্লান্ত । আর সে যেন তার সঙ্গী এই পালোয়ানদের ভাত রেধে খেতে দেয় আর ঘরের কাজগুলো গুছিয়ে রাখে ।

    আগামীকাল অমাবস‍্যা , সূর্যগ্রহণ ; যা করার এইবেলাই করতে হবে । ক্ষ্যাত্রিয় সে । মরতে সে ভয় পায়না , কিন্তু এরকম মৃত্যুর কথা ভেবে তার মনেও ভয়ের উদয় হলো । তার সাথে জেগে উঠলো প্রতিশোধ আর দুষ্টের দমনের অঙ্গীকার । হাতির পায়ের তলায় পিষে মরতেও রাজি সে , কিন্তু এই পাষন্ডের হাতে কিছুতেই প্রাণ সমর্পণ করবেনা । সে মনে মনে ফন্দি এটে নিয়েছে । মনিব নিজের শয়নকক্ষে যেতেই সে ঔষধের কক্ষে গিয়ে সমস্ত আফিম নিয়ে এসে দুধের সাথে ভালো করে মিশিয়ে রাখলো এবং ভাতের পরে ওই দুধ খেতে দিলো পালোয়ানদের । বেশ তৃপ্তি করে খেলো সবাই । আফিম মেশানো দুধ গলায় ঢালার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমের দেশে যাত্রা করলো । এরপর সে মনিবের ঘরে ঢুকে অকৃতজ্ঞ পাষন্ড বুড়োটার হাত -পা-মুখ  বেঁধে ফেললো । এবং তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই কাকড়াবিছের চৌবাচ্চায় ফেললো এবং পুনরায় বিশাল কাঁচের বয়ায়টি খালি করে দিলো ওই চৌবাচ্চায় । বুড়ো কবিরাজ যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলো । নিজের প্রস্তুত করা মৃত্যুজালে বন্দী হয়ে ছটফট করতে থাকলো ।

   একছুটে ঘাটে এসে নৌকার দড়ি খুলে স্রোতের টানে নৌকা ভাসিয়ে চড়ে বসলো রিপুদ্দমন । গন্তব্য ঠিক করলো তাম্রলিপ্ত এবং তারপর বেনা ঘাসের  মাল্লার কাজ নিয়ে কলিঙ্গ কিংবা অস্মক , অথবা সিংহল ।

     

  ক্রমে কালের নিয়মে নগরগুলির যে শুধু আকার- আকৃতি শাসন ব‍্যবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে তাই নয় , কারো কারো নামের পরিবর্তন ও ঘটেছে । হারিয়ে যেতে বসেছে মগধের তৃতীয় দেওয়াল চম্পা নদী । কিন্তু  সকল পরিবর্তনের সাক্ষী ,বহন করেচলেছেন পরম স্নেহময়ী গঙ্গা । সাক্ষী হয়ে আছেন এইরকম নানান জানা-অজানা , বাস্তব অবাস্তবের ।   


                            -------------------------

           

   কৃতজ্ঞতা স্বীকার – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস 'গৌড় মল্লার' এবং মহাশ্বেতা দেবী রচিত ঐতিহাসিক গল্প ‘ রমথা’ থেকে অনুপ্রাণিত । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ