ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

পাঠ প্রতিক্রিয়া: রক্তজল করা এক ঐতিহাসিক সময়- ঠগী -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

  • বই - ঠগী
  • লেখক – শ্রীপান্থ (নিখিল সরকার) 
  • প্রকাশনী – আনন্দ প্রকাশনী
  • পৃষ্ঠাসংখ্যা – ২২৬ 
  • প্রকাশকাল: জুন ১৩৬৭ 
  • প্রচ্ছদঃ শ্রী সুধীর মৈত্র 

“সাহেব খান,তামাকু লেও”।
“পান কা রুমাল লেও"।

দুটি অমোঘ রক্তহীম করা বাক্য। বাক্যের আক্ষরিক অর্থ যেখানে প্রাধান্য পায়না। কিন্তু যে ব্যক্তি এই বাক্য শুনতে পান, সেই মুহূর্ত তার জীবনের শেষ মুহূর্ত হয়। এ মৃত্যুদণ্ডাদেশ। মৃত্যুর পরোয়ানা বহন করে এই দুই বাক্য। 
ঠগী ( হিন্দি – ठग्गी, সংস্কৃত - sthaga) শব্দের উদ্ভব ঠক বা থাগ (অর্থ প্রতারক বা ধূর্ত) থেকে।ঠগী বলতে ভারতীয় উপমহাদেশের এক  বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদলকে বোঝায়, যারা ১৩ থেকে ১৯ শতকের সময়ে পথিকের গলায় হলুদ রেশমি রুমাল জড়িয়ে হত্যা করত এবং পথিক বা পথিকদের দলকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিত। 

সেই সময় ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে,ব্রিটিশদের বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হতে বেশিদিন আর বাকি নেই, নাদির শাহ, আহমদ শাহ্ আবদালীদের মত তস্করের আক্রমনে-লুণ্ঠনে ভারতবর্ষ বিধ্বস্ত। সেই সময় বাড়ি থেকে দূর গন্তব্যের উদ্দ্যশে রওনা হওয়া পথিকরা দলে দলে সম্পূর্ণ উবে যেতে লাগলেন। বাড়ি থেকে সুস্থ মানুষ বের হলেন দুরদেশে যাবার জন্য, কিন্তু তারপর আর তাঁর/তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। প্রায় তিনশ বছরের ইতিহাসে এই ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় আঠারোশ শতকের গোড়ায় ভারতবর্ষে কোম্পানির হয়ে চাকরি করতে এলেন সদ্য কুড়ি পেরুনো ইংরেজ যুবক উইলিয়াম হেনরী স্লীম্যান। ভারতে আসার কিছুদিন পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লাইব্রেরীতে ফরাসী পর্যটক এম থিভেনটের লেখা ভ্রমণকাহিনীতে প্রথম ঠগীদের কথা জানতে পারেন স্লীম্যান। তখন থেকেই শুরু হয় তার ঠগী খোঁজার সাধনা। কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা আর নিরন্তর প্রচেষ্টায় বছরের পর বছর ধরে একেকটা ঠগী দলকে করায়ত্ত করেন স্লীম্যান। তাদের মুখে শোনেন ঠগীদের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ। লিপিবদ্ধ করেন সমস্ত। সব খুনের ঘটনা, বিভৎসতা, পরিকল্পনা, বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার সব। উদ্ধার করেন হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার পথিকের অস্থি। প্রায় ৩০ বছর ধরে দিনের পর দিন লেগে থেকে হিন্দুস্তানকে ঠগীমুক্ত করেন স্লীম্যান।পরিচিত হয়ে যান “ঠগী স্লীম্যান” নামে।
স্থলে – জলে ডাকাত দলের অত্যাচারের সাথে সাথে সেই সময় ভারতে ধুতুরিয়া, ঠ্যাঙ্গারে, তুসমাবাজ ঠগ, মেকফানসা, ছেলেধরা প্রভৃতি ঘাতকদল ছিল। এই সমস্ত অত্যাচারী লুটেরাদের মধ্যে ভয়ংকরতম ছিল “ঠগী” সম্প্রদায়।এরা ছিল নৃশংস, বর্বরতম।তাদের হাত থেকে রেহাই পেত না বৃদ্ধ, যুবক, শিশু, নারী – কেউই। শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হতনা তারা, নিশ্চিহ্ন করে দিত সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। যেন হাওয়াও মিলিয়ে যেত জলজ্যান্ত মানুষগুলো। 
    
পথিকদের সাথে নিরীহ পথিকের বেশে এরা ১০-২০ জনের দল বানিয়ে মিশে যেত।পথশ্রান্ত ক্লান্ত পথিকদের খাবার ও বিশ্রামের সময় গল্প বলার ছলে তাঁদের মগ্ন করে ফেলা হত। অনেক সময় নিজেদের সুস্বাদু দামী খাবার ও পানীয় সরবরাহ করেও তারা পথিকদের বশ করত। নির্জন বন-জঙ্গল প্রান্তরে ঠগী সর্দার “ঝিরণী” দিত। “ঝিরণী” অর্থাৎ লুঠ ও হত্যা দেওয়ার হুকুম।তাদের নিজস্ব রামাসী (Ramasee) ভাষায় হুকুম আসত – “ সাহেব খান, তামাকু লাও।“ গল্পে ঠাট্টায় মগ্ন পথিকরা যখন তামাক সেবনের আশায় অপেক্ষারত তখনই নেমে উঠত এই ঝিরনি। সাথে সাথে চোখের পলকে পথিকদের গলায় রেশমি রুমালের ফাঁস পড়ে যেত। নিমেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন দলে দলে পথিক।মুহূর্তে তৈরি করা কবরে তাঁদের মৃতদেহ মাটি চাপা পড়ে উধাও হয়ে যেত চিরতরে। কেউ আর কোনো দিনও খুঁজে পেতেন না তাঁদের প্রিয়জনদের।
ঠগী শুধুমাত্র কোনো লুণ্ঠনকারীদের নাম নয়। ঠগী এক ধর্মের নাম। এক সু-সংঘটিত, সু-সমন্বিত সম্প্রদায়ের নাম। এক বিচিত্র বিশ্বাসের নাম। তাদের বিশ্বাস তারা সবাই মা ভবানীর সন্তান। এই দলে হিন্দু – মুসলিম সর্বধর্ম সর্বজাতির সমন্বয় ছিল। তাদের বিভিন্ন লোকাচার, বিভিন্ন কুসংস্কার, ধর্মাচারনের বিভিন্ন পদ্ধতি ছিল। লুঠ করার এক নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রতিবার তারা নির্দ্বিধায় অবিচারে নৃশংস হত্যা ও লুঠ করে যেত। বিশ্বাস করত সবই মা ভবানীর নির্দেশ। 
১৮৪৮ সালে হেনরি স্লীম্যান ভারতবর্ষকে ঠগী মুক্ত করার অসাধ্যসাধন করেন। তিনি প্রকৃতই ভারত-প্রেমিক ছিলেন। এই কাজ থেকে “ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়” কথার প্রচলন হয়ে যায়।  ইংরেজরা ভারতবর্ষের জন্য ভালো যা কিছু করেছে তার মধ্যে সে সময়ের সরকারী চাকুরে স্লীম্যানের এই ঠগী দমন অত্যন্ত গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস।তিনি ভালোবেসেছিলেন ভারতের কৃষকদের। সাধারণ মানুষদের। বইটি শেষ হতে না হতেই ভারতীয় উপমহাদেশকে ভালোবাসা এই ইংরেজের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসবে নির্দ্বিধায়। 
“ঠগী” কোনো উপন্যাস নয়। কোনো কল্পকাহিনী নয়। এ এক জলন্ত দলীল। এক ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষ্য। শ্রীপান্থ নিজের অপূর্ব সাবলীল লেখনীতে এই বইকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছেন।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই বই কালজয়ী রচনা হয়ে থেকে যাবে আজীবন।  

লেখক পরিচিতিঃ 

 

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সম্পাদক নিখিল সরকার বাংলা সাহিত্য জগতে সুপরিচিত ছিলেন "শ্রীপান্থ" ছদ্মনামে। ১৯৩২ সালের ১ লা মে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক উত্তীর্ণ করার পর সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। প্রথমে যুগান্তর ও পরে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হন| দীর্ঘকাল আনন্দবাজার পত্রিকার সোমবার প্রকাশিত জনপ্রিয় "কলকাতার কড়চা " বিভাগটির দায়িত্বে ছিলেন । সাংবাদিকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহাসিক ও গবেষণামূলক রচনাদি লিখেছেন। তাঁর চর্চার মূলবিষয় ছিল বাংলার সামাজিক ইতিহাস,কলকাতার সমাজ ও সংস্কৃতি। কলকাতার শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ ইংরেজিতেও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম ধাতব হরফে ছাপা বই ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড রচিত 'আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ'-এর দীর্ঘ ভূমিকার রচয়িতা ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণামূলক রচনাদি লিখেছেন | তাঁর চর্চার বিষয় সামাজিক ইতিহাস | বিশেষত কলকাতার সমাজ ও সংস্কৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করত | তিনি সতীদাহ,দেবদাসী,ঠগী,হারেম-ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনিই কলকাতার পটভূমিতে লিখেছেন একাধিক রচনা |১৯৭৮ সালে তাঁকে "আনন্দ পুরস্কার"-এ সম্মানিত করা হয় ।[১]

[১]  তথ্য সুত্রঃ উইকিপিডিয়া


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ