ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

ঘুমের দেশে -ভাস্কর পাল

পাপাই ছাদে  ঠাকুমার কাছে গল্প শুনছিল। তখনই ফোনটা এলো বাবার। রাত্রিবেলায় ছাদটাতে হাওয়া যেন ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে।

পাপাই-এর বয়স সবে দশ হবে। ঠাকুমার কাছে গল্প শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগে। ঠাকুমা তার ছোটোবেলাকার নানা রঙের গল্প বলে। শুনতে শুনতে ওই দশ বছরের নাতির ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে, ঠাকুমাও যেন স্মৃতির রেলে পাড়ি দেয় ছোটোবেলার  মায়াবী স্টেশনে।

বাবা ফোনে কথা বলছে খুব জোরে জোরে,তাই গল্প শোনায় ভাঁটা পড়লো।

সুদর্শন বলে কোনো আঙ্কেল হয়তো ফোন করেছে বাবাকে।ইনি ফোন করলে বাবা হাসে,খুব হাসে।ঘরে পাপাই আর কোনো সময় বাবাকে এমন হাসতে দেখেনি। বাবাকে সে ভীষন ভয় করে,যত আবদার তার ঠাকুমার কাছে।তবে সুদর্শন সম্পর্কে পাপাইয়ের এক অদম্য কৌতূহল রয়েছে। তবুও বাবা এ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করে না।

কিন্তু আজ ফোনে কথা বলা শেষ হওয়ার পর নিজে থেকেই বলল-“এই সুদর্শন হল আমার এক ওল্ড ফ্রেন্ড। অনেক দিন পর ওর সাথে দেখা হলো।কাজ না পাওয়ায় মাথায় মনে হয় একটু ডিফেক্ট হয়েছে। আমাকে ফোন করবে আর যতসব উদ্ভট গাঁজাখুরি বকবে।”

মা ছাদে বসে আছে,বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল-“মাথায় ছিট?কেন কী বলেছে?”

“সুদর্শন বললো সে নাকি পাপাইকে ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে চায়। ওখানে একবার গেলে আর নাকি ফিরে আসতে মন চায় না।তারপর”…-বাবার কথা শেষ না হতেই পাপাই ফস করে বলে বসলো-“বাবা আমি ওখানে যাবো।”

মা রীতিমতো তিতিবিরক্ত হয়ে বলল-“পাপাই কতবার বলেছি বড়দের কথা শেষ না হলে ছোটদের কথা বলতে নেই।”

পাপাই-এর মুখটা ছোট হয়ে গেল।মা বকলে খুব খারাপ লাগে।সে তাই ঠাকুমার কোলে চুপ করে বসে পড়লো।

ঠাকুমা বাবাকে আরও বলতে বললেন।

বাবা বললো-“মা, সুদর্শন একটা মস্ত ছিটওয়ালা। আমার সঙ্গে দেখা হলো বটতলার চায়ের দোকানে।ও বলছে ঘুমের দেশে নাকি শুধু ঘুম আর খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। এতসুন্দর জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ওখানে সমস্ত প্রানীই বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। কাজকর্ম, ছোটাছুটি, পড়াশোনা কিছুই নেই।হাতের কাছে খাবারের প্রাচুর্য থাকলে, অনায়াসে সব পেয়ে গেলে এতকিছু করার দরকারই বা কী!”

পাপাই ঠাকুমাকে বলে-“কত আরাম বলো ছেলেগুলোর ওখানে।স্কুলে যেতে হয়না, পড়তে বসতে হয় না। শুধু ঘুম, খাওয়া আর খেলা।”

বাবা বেশ খানিকক্ষণ হাসলো, তারপর বললো-“না রে, ওখানে একটিও মানুষ নেই।”

“মানুষ নেই! তবে কী আছে?”-মা অবাক হয়ে বললো।

“কী আছে সেটা আর বললো না।এমন বদ্ধ পাগল লোক আমি সাতজন্মে আর দেখিনি।সত্যি যদি থাকতো, অফিস-ঘর ফেলে ওখানেই বসত বানাতাম।”-বাবা হেসে বলল।

পাপাই ব্যাপারটায় বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। বাবা যখন অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকবে তখন যদি ওই সুদর্শন কাকুকে ফোন করা হয়!ওই ঘুমের দেশে আসলে কী থাকে সেটা জানা যাবে।তারপর তো যাওয়ার পরিকল্পনা। হুঁ,এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা।

     ‌ ★★★★★★★★★

অম্লান বাবু অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হচ্ছিলেন।এত গরম, মনে হচ্ছে সূর্য কারেন্টের তারে-টারে হয়তো আটকে গেছে।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাস্তাঘাটে বেড়াতে যাওয়ার ঢল নেমেছে।

পড়তে বসার আগে পাপাই একটু কার্টুন দেখে, তাই আজও দেখছিল। হঠাৎ পাশে বিছানায় রাখা বাবার ফোনটা বেজে উঠলো। পাপাই রিমোটটা সোফায় রেখে ফোনটা ধরতে গেল।

ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হালকা-ফুলকা গলা ভেসে এলো-“কে পাপাই নাকি?”

“হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?”-পাপাই দৃঢ় স্বরে বললো।

“আমি সুদর্শন আঙ্কেল বলছি। তোমার বাবা আমার কথা বলেননি খোকা?”-সুদর্শন কাকু বললো।

নামটা শুনেই পাপাই-এর চোখ-মুখ ঝলমল করে উঠল।সে ভীষন উৎসাহী হয়ে বললো-“আঙ্কেল, আমাকে ঘুমের দেশে নিয়ে যাবেন?”

আঙ্কেল হাসলো,তারপর বলে-“সে কি এমনি এমনি যাওয়া যায় খোকা! অনেক ঝক্কি।ভালো জায়গা তো, নানারকম টেনশন।”

“কীসের টেনশন?”-পাপাই প্রশ্ন করে।

“এমন একটা জায়গা, যেখানে বড়োদের প্রবেশ নিষেধ।সে ক্ষেত্রে তোমাকে একাই যেতে হবে।”-ফোনের ওপাশ থেকে আঙ্কেল বললো।

পাপাই বেশ হতাশ হল।সে আপশোষের সুরে বলল-“তাহলে আপনি কীভাবে ঘুমের দেশের কথা জানলেন?”

“আরে আমিই তো এই পরিচালন কমিটির হেড। তাছাড়া তুমি বন্ধুপুত্র, তোমাকে তো আগে খাতির করবোই।”-মৃদ্যু হেসে বলল সুদর্শন আঙ্কেল।

কিছুক্ষন পর পাপাই বললো-“কীভাবে যাওয়া যায় ঘুমের দেশে?”

“স্বপ্ন দেখলেই ওখানে যাওয়া যায়। তবে…”-আঙ্কেল পুরোটা বলতে চায় না।

“তবে কী আঙ্কেল?”-কৌতূহলী পাপাই বলে।

“একটা পাসওয়ার্ড লাগবে”-আঙ্কেল বললো।

“স্বপ্নে আবার পাসওয়ার্ড লাগে নাকি?”-পাপাই ভীষণ অবাক হয়ে বলে।

“হ্যাঁ,এখন সবেতেই পাসওয়ার্ড চাইছে।যে কেউ হ্যাক করে দিচ্ছে। আমার এক ভাইপো পাসওয়ার্ড ভুল বলে ফেলেছিল। সেইজন্য তাকে ভুলের মাশুল দিতে হয়েছিল।সে তো ঘুমের দেশে না গিয়ে হুম ডাকিনীদের দেশে চলে গিয়েছিল।সে কি কেলেংকারী!ওইজন্যই তো বলছি অনেক টেনশন।”-আঙ্কেল বললেন।

“তাহলে আমার পাসওয়ার্ড কী হবে?”-পাপাই যেন ভ্রমনের আশু আনন্দে কথাটা বলল।

আঙ্কেল ফোনের ওপাশ থেকে কিছু ভেবে নেয়।তারপর পাপাই কে ওর বয়স জিজ্ঞেস করে। পাপাই ঠিকমতো বলতে পারে না।

আঙ্কেল বললো-“ধরো তোমার বয়স যদি দশ বছর হয়, তাহলে তোমার পাসওয়ার্ড হবে-P.C 10। পাপাই চৌধুরীর জন্য-P.C আর বয়সের জন্য-10।বুঝলে খোকা?”

পাপাই আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে পেল বাবা এই ঘরের দিকেই আসছে।সে ঝড়ের গতিতে ফোনটা কেটে দিলো। বাবা তেমন কিছু বুঝতে পারলো না।

কিছুক্ষন পর মা পড়াতে বসালো। পাপাই-এর পড়াশোনায় তেমন মন বসছে না।তার কারনে  সহজ সরল বেমালুম ভুল করছে।মা, মাঝেই মাঝেই পিঠে চাপড় মারছে। মায়ের ওই একটাই মার দেওয়ার প্যাটার্ন,আর কোনো নতুনত্ব নেই।

আরো একবার চাপড়ে মা রাগত স্বরে বলল-“তোর কোথায় মন আছে বলতো?আসান অঙ্কগুলো ভুল করছিস।ওঘরে বাবাকে ডাকবো, একটা কড়া ডোজ দেবে সব পথে চলে আসবে।”

পাপাই মায়ের কথা শোনেনি এমন ভাব করে বললো-“মা আমার একদম ঠিক বয়সটা বলো তো।”

মা একটু অবাক হয়, তারপর পাপাই-এর দিকে তাকিয়ে বলল-“বয়স নিয়ে কী করবি?”

“দিদিভাই,দাদাভাইয়েরা অনেক সময় জিজ্ঞেস করে তো তাই আর কী..”-পাপাই ভয়ে ভয়ে বললো।

“তোর এবছর নয় পূর্ণ হলো”-মা বললো।

বয়স জেনে ফেলার পর পাপাই-এর আবার পড়াতে মন বসে।ছেলে তো ভালই,ওই ঘুমের দেশে যাওয়ার পরিকল্পনায় একটু মজে গিয়েছিল।তাই এখন কঠিন সরল ফটফট করে হয়ে যাচ্ছে। 

     ★★★★★★★★

কোথায় স্বপ্ন, স্বপ্নের তো কোনো দেখা নেই! সুদর্শন আঙ্কেলও আর ফোন করেনা,ইনফ্যাক্ট ফোন করতে পারেনা।ফোন করলে হয়তো জানতে পারতো কীভাবে সে স্বপ্ন দেখবে।

ব্যাপার হোলো কিছূদিন আগেই বাবা এয়ার কন্ডিশনার এনেছে।তো সেই শীততাপের আবেশে আজকাল এমন ঘুম হচ্ছে যে ঘুমের ওপর স্বপ্ন কোনো বেয়াদপি করতে পারছে না। তা কপালে যদি থাকে,সে ঘুমের দেশে যাবেই যাবে।আগের বছর সামার ভ্যাকেশনে ওরা দার্জিলিং গিয়েছিল।এবছর কোথাও যাচ্ছে না।

প্রায় এক সপ্তাহ পর,একরাতে পাপাই-এর চোখের পাতায় স্বপ্ন এসে ধরা দিল।

স্বপ্নে ঢুকতেই কেউ একজন ছেলেমানুষী গলায় বলল-“পাসওয়ার্ডটা বলো”

“P.C-9”-পাপাই উৎসাহের সঙ্গে বললো।

এরপর একটা মেশিনারী ভয়েসে শোনা গেল-your password is being checked…

যদিও পাপাই শুনতে পাচ্ছে, তবে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। চারিদিকে জমাট কালো অন্ধকার।

কিছুক্ষন পর পাসওয়ার্ডটা যে নির্ভুল সেটা ওরা কনফার্ম করলো।তারপর ওরা নাম জানতে চাইলো। পাপাই ওর নাম বললো।

এরপর সেই মেশিনারী কন্ঠ গলা ছেড়ে বললো-“ওকে খোকা। এবার তুমি আমাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও”

পাপাই খুব অবাকই হল।এটা তো কথা ছিল না,একদম আউট অফ সিলেবাস!

সেই মেশিনারী কন্ঠ প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছে-

    ১.ড্রিম-এর বাংলা অর্থ কী?

    ২.পরীরা ভালো না খারাপ?

    ৩.ঘুমাতে তোমার কেমন লাগে?

সব প্রশ্নের কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দিল পাপাই।প্রথম কোয়েশ্চেনের উত্তর তো জলের মতো আসান ছিল।তবে পরীরা ভালো না খারাপ,এই প্রশ্ন নিয়ে যথেষ্টই সন্দিহান ছিল সে। পাপাই তো পরী জীবনে কোনোদিন দেখেনি। তাছাড়া মা-বাবার গল্পের বই খুব একটা পড়তে দেয় না,তাই পরী সম্পর্কে পাপাই-এর মনমগজে কোনো ক্লিয়ার কনসেপ্ট তৈরী হয়নি। তবুও তার মন বলছে পরীরা ভালোই হবে।

ওদের ক্লাসে পরী নামে একটা মেয়ে আছে। সে তো ভালই, একদিন পাপাই পেন্সিল আনতে ভুলে যাওয়ায় তাকে বাড়তি পেন্সিল দিয়েছিল।

আর ঘুমাতে কার না ভালো লাগে!চটপট সে জবাব দেয় ভালোই লাগে।

   ‌‌  ★★★★★★★★

উত্তর দেওয়ার তৎক্ষণাৎ পরেই পাপাইয়ের মাথা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো দ্রুতগতিতে একপাক খেলো।

তারপর তৎক্ষণাৎ তার সামনে ভেসে উঠল রূপকথার মতো এক মায়াবী দৃশ্যপট।সে বুঝলো একটা গাছের দোলনায় বসে আছে সে।দোলনাটা বেশ সুন্দর, সুগন্ধি ফুল দিয়ে সাজানো। আশেপাশে আরও অনেক গাছ দেখা যাচ্ছে। গাছগুলোর কোনোটার রঙ নীল, আবার কোনোটার রঙ বেগুনী। চারিদিকে একটা চাঁদের মতো মায়াবী মৃদু আলো গোটা এলাকাটাকে স্বপ্নিল করে তুলেছে।ফাগুন বিকালের মতো একটা সুরভিত বাতায়নে মনটা মুগ্ধতায় ভরে যাচ্ছে।

কিছুক্ষন পর পাপাই দোলনাতে দেখতে পেল একটা পাত্রে কাঁচা সোনা রঙের আম আর গুবগুবে গোলাপী রঙের লিচু রাখা রয়েছে।আমগুলো থেকে মনমাতানো সুগন্ধ আসছে। কিন্তু পাপাই যেই একটা আম হাতে তুলে নিতে যাবে, হঠাৎ সেই সময় কোথা হতে একটা হলুদ কাঠবিড়ালি এসে পাপাই-এর কাছে এসে বসলো।

প্রথমটায় পাপাই থতমত খেয়ে গিয়েছিল,পরে নিজেকে সামলে নিয়ে সে দেখলো একটা উদ্ভট হলুদ কাঠবিড়ালি তার দিকে টুকটুক করে তাকাচ্ছে।

কাঠবিড়ালিটা একদম মানুষের গলায় পাপাই কে বললো-“আরে মানুষভাই , তোমাকে স্বাগত। দেখো আমার রঙও হলুদ, আবার পাকা আমটার রঙও হলুদ। তাহলে আমটা প্রথমে খাওয়ার অধিকার তো আমারই না!

খাদ্য ও খাদকের মধ্যে একটা সম্পর্ক মেনটেন করা উচিত।”

পাপাই ভাবলো এ আবার কোন হরিদাস রে,একটা বাচ্চা কাঠবিড়ালি তাকে উচিত-অনুচিত শেখাবে নাকি!

হঠাৎ নীচ থেকে একটা বাঁদর জাতীয় সবুজ রঙের প্রানী চাঁদের আলোর মতো হেঁসে বলল-“আরে এসে গেছো দেখছি,হিলি খুব জ্বালাচ্ছে না?”

পাপাই বুঝতে পারলো হিলি, ওই কাঠবিড়ালিটার নাম। জন্তুটা আবার   কাঠবিড়ালিটার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-“রঙ পালটিয়ে মামদোবাজি করা হচ্ছে।জানিস না,east and west guest is the best।”

ভয় পেয়ে কাঠবিড়ালি দোলনা থেকে নীচে নামলো।জমিতে পার্পেল রঙের বেজায় বড়ো বড়ো ঘাস।

জন্তুটার সবুজ মুখটা অনেকটা পান্ডার মুখের মতন। জন্তুটার দুটি হাতও রয়েছে,সেগুলোও একদম ঘাস-সবুজ রঙের।জন্তুটার লোমওয়ালা শরীরে স্কুল ড্রেসের মতো জামা-প্যান্ট। হলুদ রঙের কাঠবিড়ালীটা পার্পেল রঙের ঘাস জমিতে নামতেই রঙ তার গোলাপী হয়ে গেল।

চারপাশে রঙের রগড় দেখে পাপাই-এর তো ভালই লাগছে।কোথা হতে রামধনু রঙের ফুল পরছে তার মাথার উপর টুপটাপ করে।কী সুগন্ধ সেই ফুলের!যেন মনে হচ্ছে সাতটা সবচেয়ে সুগন্ধী ফুল এক হয়ে বিতরন করছে তাদের সুবাস।

সবুজ জন্তুটা পাপাই কে মিঠে গলায় বলল-“ভাই, তুমি কি এখন ঘুমাবে?না একটু বেড়ু-বেড়ু করে আসবে?

পাপাই আশেপাশে তাকিয়ে বলল-“এখন রাত না দিন গো দাভাই?”

কথাটা শুনে সবুজ জন্তুটা ঘাস জমিতে বেশ খানিকক্ষণ মনের সুখে ডিগবাজি খেল। তারপর সে এমনভাবে হাসলো যেন বিরাট কোহলিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তুমি কভার ড্রাইভ জানো?

অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে জন্তুটা বললো-“আকাশের দিকে তাকিয়েছো ভাই! আমাদের এখানে সবসময় জ্যোৎস্না থাকে।সূর্যের আলোর কোনো বালাই নেই।”

পাপাই বললো –“তোমাদের এখানে ভালো বেড়ানোর জায়গা আছে?”

“কি যে বলো তুমি! তোমাকে যখন গোটা এলাকা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো না তখন তুমি বুঝবে-east and west,this place is the best.”

“তাহলে,আমি বেড়াতে যাবো।”-আনন্দে বলে ওঠে পাপাই।

       ★★★★★★★★

পাকা আমগুলো তৃপ্তি নিয়ে খাওয়ার পর অনেকটাই এগিয়ে এসেছে পাপাইরা।এরপর এখানে থেকে আসমানী বন শুরু হয়েছে। এখানে সমস্ত কিছুর রঙই আসমানী,সেটা গাছপালা হোক বা পাখি হোক।

জঙ্গলে জন্তুটা ও কাঠবিড়ালিটা প্রবেশ করতে তাদের রঙও আসমানী হয়ে গেল। চাঁদের আলো কাকে বলে এখন তা বোঝা যাচ্ছে। চাঁদের নীলচে হলুদ আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। জঙ্গলে ঢুকতেই দুটি বিশাল দৈত্যাকার আসমানী গাছ তাদের ওয়েলকাম করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তাদের ছায়া পড়েছে ঘন আসমানী ঘাসের উপর।

পাখিগুলো সব তিড়িংবিড়িং করে পাপাই-এর আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।তাদের কন্ঠ থেকে একটা মিস্টি সিম্ফনি বেরিয়ে আসছে। পাপাই খুব আনন্দ পাচ্ছে,এমন মায়াবী স্বর্গীয় পরিবেশে হেঁটে বেড়াতে কার না আনন্দ হয়!

কথাবার্তা চলতে চলতে বোঝা গেল সবুজ জন্তুটির নাম গ্ৰিন বিষ্টি। পাপাই ভেবে পেলো না এমন নাম কেন হলো! 

বনের গভীরে ঢুকতেই পাপাই বারবার হাই তুলছিল।টের পেয়ে গ্ৰিন বিষয়টি বললো-“এই বনটা একটু সাবধানে পেরোলেই ব্যাস,যত পারো ঘুমাও না তখন।”

পাপাই অবাক হয়ে বলল-“সাবধানে কেন?”

গ্ৰিন বিষ্টি কিছু বললো না।সত্যিই জায়গাটা বেশ অন্যরকম আর নিস্তব্ধ। এখানে এত ব্যাপক পরিমাণে বড়ো বড়ো গাছ যে বনের মধ্যে চাঁদের আলো প্রবেশ করতে পারছে না।আবলুশ কাঠের মতো চারপাশে ঘন অন্ধকার হয়ে আছে।

এমনকি জন্তুটা আর পাপাইও একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে না।মনে হয় পাপাই অনেকটাই এগিয়ে গেছিল, হঠাৎ একটা গাছের সাথে জোর ধাক্কা খেয়ে পড়ে স্যাঁতসেঁতে আসমানী লতাপাতা গুচ্ছের ঝোপে। পাপাই কাঁদতে লাগলো।

গ্ৰিন বিষ্টি রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজে,তারপর বলে-“মানুষভাই কোথায় তুমি?”

কিন্তু সে কোন সাড়া পেল না,কান্নাও শুনতে পাচ্ছে না সে।ছেলেটার হোলো টা কী? চারিদিকে অসহ্য নীরবতা

“হিলি কোথায় আছিস রে? খোকার কী হোলো দেখ না!”-কাতর স্বরে  বলে ওঠে গ্ৰিন বিষ্টি। তাঁর কেমন কান্নাও আসছে।

হিলির কোনো পাত্তাই নেই।ও এই জঙ্গল এই সহজে মাড়ায় না,তারপর আজ আবার জঙ্গলের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ

গ্ৰিন বিষ্টিও এই গন্ধটা পেয়েছে। অন্ধকারেও সে পাপাই-এর উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো।

যতই এগোচ্ছে মনে হচ্ছে যেন কোনো অগ্নিকুন্ডের দিকে এগোচ্ছে সে।চারদিক হঠাৎ এমন তীব্র গরম হয়ে উঠেছে কীভাবে?

কিছুদূর গিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।তাঁর সামনে বিশাল একটা আগুনের গর্ত‌।গর্তের ভিতর যতদূর চোখ যায় শুধু আগুন আর আগুন।

এটা তো ঘুমের দেশ নয়,এটা ঘুমের দেশের আগের দেশ। এখানে খুব হাই ওঠে।হাই তুলতে তুলতে হয়তো পড়ে গেছে পাপাই গর্তের মধ্যে।

গ্ৰিন বিষ্টি পাপাই-এর কাতর অনুরোধ এবার শুনতে পাচ্ছে। সে তাকে বাঁচানোর তীব্র চেষ্টা করতে লাগলো।একটু অসাবধানী হলে সেও গর্তের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

সেই অগ্নিকুন্ডের মধ্যে পাপাই-এর হাতটা সে দেখতে পেলো। ছেলেটা আর চিৎকার করছে না।

তীব্র পচা আর বোঁটকা গন্ধে মনে হচ্ছে নাকের শিরা ফেটে যাবে। তবুও কয়েক মূহুর্তের মধ্যে ভালো লেগে যাওয়া বন্ধুটির প্রান বাঁচানোর শেষ চেষ্টা সে করলো। তাকে পারতেই হবে…

 ‌‌   ★★★★★★★★

পাপাই-এর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তার মায়ের ধাক্কায়। পাপাই আড়মোড়া ছেড়ে বিছানায় বসলো। জানলার দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো বৃষ্টি পড়ছে।আজ আর স্কুল যেতে হবে না।

চোখ-মুখ ধোওয়ার সময় আয়নাতে মুখ দেখতেই সে কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গেল।

তারপর কী একটা ভাবতেই সে বোকার মতো মুচকি হাসি হাসে। একটা হালকা সবুজ রঙের আভা পাপাই-এর গোটা গায়ে পরিলক্ষিত। স্বপ্নের সেই গ্ৰিন বিষ্টি তার মধ্যে রয়ে গেছে,মরতে বসা পাপাইকে বাঁচিয়েছিল যে সে!

---------------০--------------------


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ